শুটিং দিদা

অনেক সকালে ঘুম থেকে উঠলে জানলা থেকে শহরটাকে অন্যরকম দেখায়। মনে হয় যেন গোটা তিনেক পাহাড় দিয়ে ঘেরা আছে শহরটা। আসলে ব্যাপারটা তেমন নয়। শহরের মাঝখানে পাহাড়টা আসবে কোথা থেকে শুনি? এটা কি দার্জিলিং না কার্শিয়াং? এগুলো তো সব জঞ্জালের পাহাড়। গোটা শহরের নোংরা এনে পাহাড় করেছে মানুষ। গালভরা একটা নামও দিয়েছে ধাপা। মনে মনে হাসেন সরলা। ধাপা শব্দটার মানে কী? ধাপ্পা? নটু বাবু হলে হয়তো তাই বলতেন।

দেখছিস না পাহাড়ের মাথায় কেমন ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ।

ও নটু বাবু ওতো জঞ্জাল।

হোক না জঞ্জাল। পাহাড়ের মতো চেহারা নিয়ে আমাদের ধাপ্পা দিচ্ছে তো। ধর রে…বাঁশিটা বেহাগে… ধর দেখি একটু।

বেজে উঠতো বাঁশি, হারমোনিয়াম, তবলা। গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে যেতেন সরলা মঞ্চের মাঝে। স্পট লাইটের আলো এসে পড়তো তাঁর গায়ে। দূরে উইংসের আড়ালে বানীবাবু খাতা হাতে নিয়ে প্রমটার। সরলাদেবী সেই মোহময় পরিবেশে দর্শকদের দিকে তাকিয়ে গান ধরলেন।

ব্যস এইটুকুই। এরপরে ভাবতে গেলে মনটা কেমন করে উঠবে। শুধু বসে বসে ভাবতে ইচ্ছে করবে সেই কবেকার সব পুরনো কথা। তখন সকালটা নষ্ট হবে। অনেক কাজ পড়ে আছে যে! দুখানা শাড়ি গতকাল রাতে ভেজানো আছে। একটা বিছানার চাদর। মশারিটাও নোংরা হয়েছে খুব। সেগুলো টাইম কলে জল এলে কাচতে হবে। ঘর পরিষ্কার করে নাইতে হবে। তারপর স্টোভে দুটো চাল-ডাল ফুটিয়ে নিলেই হলো। এমন অনেক দিন হয়েছে শুধু দুবেলা মুড়ি খেয়ে থেকেছেন সরলা। বুড়ো বয়সে একার জন্য আর রান্না বান্না করতে ভালো লাগে না। তাও নটু বাবু থাকলে বাজার করতো। কচি পুঁইশাক, কুমড়ো, নতুন আলু, রুই মাছের মাথা ঠিক নিয়ে আসতো। বলতো নেরে সরলা আজ একটু ছ্যাঁচড়া কর দেখি। কিম্বা বেলা শেষের বাজারে গিয়ে তেলের পোঁটা টোঁটা যা থাকতো নিয়ে এসে বলতো রাঁধতো দেখি একটু লঙ্কা বাটা দিয়ে মাছের তেলের চচ্চড়ি।

নেয়ে এসে গায়ে আতর মাখতেন সরলা। নিজামউদ্দিন আতরওয়ালা বাড়ি বয়ে দিয়ে যেত। সেসব দিন অন্যরকম ছিল। রামধনু রঙে রঙীন। থিয়েটারের ব্যাক ড্রপের মতো জমকালো। এখন শুনলে বিশ্বাসই করবে না কেউ। এমন কত রাত হয়েছে নটু বাবু বাড়ি ফিরে যায়নি। পাতার পর পাতা নতুন নাটক পড়ে শুনিয়েছে সরলাকে। রিহার্সাল করেছে। খুব সাধ ছিল তার সরলার কোলে একটা ছেলে হোক। সে বয়ে নিয়ে বেড়াবে এই থিয়েটারকে। নেশাকে। পাগলামিকে। কিন্তু তার বংশ পরিচয়? নটীর ছেলে বলে মানবে তো সমাজ তখন? ও নটুবাবু তোমার বউ মানবে? বাড়ি? বংশ? বাবুদের ভদ্রলোকের থিয়েটার? তুমি নিজে তাকে স্বীকৃতি দেবে তো নটুবাবু? সরলার প্রশ্নের কোনো উত্তর না দিয়েই শেষ ভোরে হুইস্কির বোতল খালি করে নটুবাবু বাড়ি ফিরে গিয়েছিল। বেলা পর্যন্ত তার ঘুম দরকার। নাহলে নাটক খেলবে না মাথায়। নামবে না চট করে স্টেজে। থিয়েটার হলে ঘন হয়ে জমাট বাঁধবে না দর্শক।      

নতুন নাটক নামার দিন দক্ষিণেশ্বরে গিয়ে পুজো দেওয়ার চল ছিল। ঠাকুরের কাছে গিয়ে মানত করতো সরলা, উতরে দিয়ো ঠাকুর। তোমাকে গরম জিলিপি ভোগ দেবো। তা উতরে যেত সেইসব নাটক তরতরিয়ে। তিল ধারণের জায়গা থাকতো না হলে। থেকে থেকে হাততালি পড়তো। লোকজন চিৎকার করে উঠতো এনকোর এনকোর বলে। আবার করতে হতো একই দৃশ্যের অভিনয়। গান। ভালো লাগতো সরলার। থিয়েটারে লোকশিক্ষে হয়। নটুবাবু বিশ্বাস করতো। মনে করিয়ে দিতো ঠাকুরের কথা ক্ষণে ক্ষণে। শুনলে সবাই দুহাত জড়ো করে মাথায় ছোঁয়াত। পয়লা বোশেখে, রথের দিনে নিয়ম করে দলের ঘরে পুজো হতো। ছোট্ট দল কিন্তু তাতে কী? বড় দলের মতো আদব কায়দা বজায় থাকতো সব সময়। বজায় রাখতেন নটুবাবু। কল্পতরু উৎসবে একবার কাশীপুরে যেতেন সরলা। মনে মনে চাইতেন ঠাকুর যেন জ্যান্ত হয়ে এসে সামনে দাঁড়ান। মাথায় হাত দিয়ে আশীর্বাদ করে বলেন, তোর চৈতন্য হোক।

তা সে আর কোথায় হলো? মায়া কি ছাড়তে পারলেন? না এই শরীরটাকে? অশক্ত দুই পায়ের ওপর এখনও কেমন যেন দাঁড়িয়ে আছে সে রক্ত মাংসের একটা পিন্ড হয়ে। সবটা এখনও তাহলে শেষ হয়নি? আরও কিছু বাঁকি আছে তাহলে? সেটা আসলে কী? হিসেবটা এখনও কষে উঠতে পারেন না সরলা। নড়বড়ে শরীরে কাপড় ভেজানো বালতি নিয়ে কলতলার দিকে এগোতে গেলে থমকে যান। সদর দরজার কাছে ইঁট বের করা দেওয়ালে সকালের সূর্যের আলো এমনভাবে এসে পড়েছে মনে হচ্ছে কেউ যেন থিয়েটারের লাইট ফেলেছে। এক পা দুপা করে সেই আলোটায় এসে দাঁড়ান সরলা। চোখ বন্ধ করেন। থার্ড বেলের আওয়াজ ভেসে আসে কোথা থেকে।

সেবার নামলো নটি বিনোদিনী। সে যে কতকালের স্বপ্ন সরলার। নট সম্রাট বিনোদবাবু ঠাকুরের রোলে ভাসিয়ে দিয়ে গিয়েছিলেন সকলকে। বড় টাকার এ্যাডভান্স দিয়ে নিয়ে আসা হয়েছিল তাঁকে। অনেক টাকার খেসারত দিতে হয়েছিল তারজন্য দলকে। সরলা নিজে দিয়েছিলেন শ্যাঁকরা পাড়ার দত্ত বাড়ির গিন্নির কাছ থেকে পুরষ্কার পাওয়া  দু-ভরি সোনার হার। কিন্তু জমেছিল বটে সে থিয়েটার। শুধু বিনোদিনীকে দেখতে হল ছাড়িয়ে, রাস্তা ছাড়িয়ে ভিড় উপচে পড়েছিল পাঁচ মাথার মোড় পর্যন্ত। নটু বাবু মজা করে বলতেন, তুই দেখছি ম্যাটনি আইডলকেও ছাড়িয়ে গেলি রে সরলা। সারা রাত মহড়া দেবার পর ভোরে মায়ের ঘাটে ডুব দিলে শরীর মন জুড়িয়ে যেত। তখন তো কোমড় পর্যন্ত চুলের ঢেউ। অঙ্গে কাঁচা সোনা রঙ। চারপাশের মানুষ মুখিয়ে আছে ছিঁড়ে খাবার জন্য। বিনোদিনীকে তো খেয়েছিল। খায়নি কি? মানুষে খেলো। থিয়েটারে খেলো। আর সরলাকে?

কলতলায় আজ বেদম ভিড়। রাতে নাকি জল আসেনি। তাই বাচ্চা কাচ্চা, ডেও ঢাকনা, মেয়ে মরদ সবাই সবাইকে কেমন যেন ন্যাংটো করে দিয়েছে জলের সামনে। এখানে সরলা আসতে চায়নি। গঙ্গার ঘাটে যে চাতালে থাকতেন সেখানে এতোসব কিছু ঝামেলা ছিল না। হাঁ করা খোলা আকাশ ছিল। আর সঙ্গে ছিলেন মা গঙ্গা। বর্ষায়, শীতে একটু কষ্ট হতো বটে কিন্তু তা আর কি করা যাবে? এই শহরে যাদের মাথার ওপর ছাদ নেই। স্থায়ী ঠিকানা নেই। আপন বলে কেউ নেই। আত্মজ তো দূরের কথা! তাদের সবার দলে নাম লিখিয়ে ছিলেন সরলা। এক সময়ে মঞ্চের পাদপ্রদীপে দাঁড়িয়ে থাকা অভিনেত্রী ভেবেছিলেন অন্তর্জলির আয়োজন বুঝি সম্পূর্ণ হলো। রোজ ঘাটে পুরনো কাশীদাসী মহাভারত খানা মেলে ধরে পাঠ করতেন। সেও তো কবেকার অভ্যেস। নটুবাবু শিখিয়ে দিয়েছিলেন হাত ধরে। ওরে মহাভারত খানা না পড়লে আর অভিনয়ের শিখলিটা কী? এক-একটা শব্দের ওপর আঙুল সরে সরে যেত। পয়ার ছন্দে দুলে দুলে পড়তেন সরলা-

পদ্মবনে যে কন্যা হয়েছে উতপতি।

তাহা দিয়া পূজা কর দেব জগৎপতি।।

পূর্বে নাম ছিল তাঁর লক্ষ্মী হরিপ্রিয়া।

মুনি শাপে ভ্রষ্ট হইয়া জন্মিল আসিয়া।।

তাহার কারণে সিন্ধু হইল মথন।

নিবারণ হবে লক্ষ্মী পেলে নারায়ণ।।

সরলার নারায়ণ লাভ হয়নি কোনো কালে। যাকে চেয়ে ছিলেন ধরে রাখতে পারেননি নিজের কাছে কোনো দিন। এদিকে দিনে দিনে পেশাদারী থিয়েটার হলগুলো কেমন যেন মুখ কালো করে বন্ধ হয়ে যেতে লাগলো। পঞ্চপান্ডব প্রথম শোয়ের পর আর করা গেল না। নারী শরীর দেখানো হয়েছে বলে অপবাদ দিলো লোকজন। ভাঙলো থিয়েটার। সরকার বললো অপসংস্কৃতি। নটু বাবু কেমন যেন দুমড়ে মুচড়ে গেলেন। অতো বড় বাড়ির ছেলেকে অসম্মান করা হল। কুৎসা রটানো হল তার নামে। শরীরে মারণ রোগ বাসা বাঁধলো। তাও কি ছাড়তে পেরেছিলেন থিয়েটার? মোটেই না। শেষ ইচ্ছে ছিল তাঁর নিমাই সন্ন্যাস করার। লিখেও ফেলেছিলেন তর তর করে। কেন্দ্রে ছিলেন বিষ্ণুপ্রিয়া। তিনি না থাকলে কি নিমাই সন্ন্যাসে যেতে পারতেন? যাকে সবাই বলেছিল দুহাতে আঁকড়ে রাখতে, সেই যুগ পদ্মকে ছেড়ে দিয়েছিলেন এই মহিয়সী নারী। হাহাকার ওঠেনি মনে? চাপা কান্না? সেগুলো সব মনি মুক্তোর মতো ছড়িয়ে দিতে হবে স্টেজে সরলা। তবেই প্রান পাবে তোর বিষ্ণুপ্রিয়া। নটু বাবু কাছে ডেকে বলেছিলেন। একটু পান সেজে দিবি তোর ওই গোলাপ জল দিয়ে? তাতে একটু ভেজা সুপুরি দিস। আর সুরভি জরদা।

ছোট ছোট খিলি করে পান সাজতেন সরলা। রূপোর ডিবের মধ্যে ভরে রাখতেন নটু বাবু খাবে বলে। পান মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে আরাম কেদারায় বসে থাকতো নটু বাবু। কাশ্মিরী রঙিন শালটা লুটোতো মেঝেতে। আজও কেমন যেন ঝাপসা ঝাপসা দেখতে পান সরলা। তাই তো সারা জীবন ওই একটা লোকের সাথেই কথা বলে যান আড়ালে, আবডালে, মনে মনে। তিনি খুব ভীষণ ভাবেই চেয়েছিলেন এই নাটকটা অন্তত দেখে যাক নটু বাবু। যাকে সমাজ ইচ্ছে করে গাল পাড়লো। সম্মানহানি করালো। সেই সমাজ একবার এসে বসুক নিমাই সন্ন্যাসীর সামনে। থিয়েটার কাকে বলে বুঝুক তারা। কিন্তু সে আর হয়ে উঠলো না। হঠাৎ একদিন বাড়ি থেকে রিহার্সালে আসতে গিয়ে রিক্সা থেকে পড়ে গেল নটুবাবু। সেই যে পড়লো আর উঠলো না। অতো বড় চেহারার মানুষটা কেমন যেন বিছানার সাথে মিশে গেল।

রিহার্সাল বন্ধ হল। থিয়েটারও। টাকা পয়সার সেকি টানাটানি। বাড়ি ভাড়া বাঁকি। মুদির দোকান। কেষ্ট চাটুজ্জে অফিস পাড়ায় থিয়েটার করতো। প্রায়ই আসতো দলে। এর আগে বেশ কবার সরলাকে বলেছে সেখানে গিয়ে এ্যাক্টো করতে। রূপ আছে, জৌলুস আছে, নাম আছে। ওরা ভালো টাকা দেবে তোকে। লেখাপড়া জানা বাবুদের গায়ে গায়ে থাকবি ক্ষতি কী? সরলা পাত্তা দেয়নি। সে মঞ্চে দাঁড়ালে তখন গোটা হলে হাততালি পড়ে। সংলাপ পছন্দ হলে এনকোর এনকোর বলে চিৎকার করে দর্শক। কেউ কেউ শোয়ের শেষে পায়ের কাছে নামিয়ে রেখে যায় ফুলের তোড়া। উড়ো চিঠি দেয় ভালোবাসার। যাদের সাহস থাকে রাজ রানী করে রাখবে বলে সামনে এসে। তাদের সবার সামনে দরজা বন্ধ করে শুধু থিয়েটারকে ভালোবাসে সরলা। যে থিয়েটারে তার দেবতা শুধু নটু বাবু। সেই সরলা যাবে কিনা ভাড়া খাটতে অফিস পাড়ায়?

যেতে হয়েছিল তাকে তারও অনেক পরে। শরীর, মন ভেঙে গেছে যখন সবটা। রঙ মেখে এ্যামেচার বাবুদের সঙ্গে শখের থিয়েটার করেছিল সে। ভেবেছিল এইসব তার মনের কথা নটু বাবুকে জানাবে। কিন্তু ঢুকতে দেয়নি সরলাকে তার বাড়ির লোক। সিংহ দরজা থেকে ফিরে আসতে হয়েছিল। মরলে খবর পেয়ে ছুটে গিয়েছিলেন শ্মশানে। দূর থেকে জ্বলন্ত চিতার আগুনটুকু ছাড়া আর কিছুই দেখতে পাননি।

এককালে অফিস পাড়ার নাটক গেল। যৌবন গেল। রূপও। রক্ত মাংসের শরীরটাকে নেড়ে চেড়ে দেখার লোকেরও অভাব হলো। বাড়ি ভাঙা পড়লে গঙ্গার ধারে কাশীদাসী মহাভারতখানা বুকে জড়িয়ে দাঁড়িয়েছিলেন একদিন রাতে সরলা। মনে হয়েছিল এরচেয়ে উলঙ্গ দৌপ্রদীকে আর কে কবে করেছিল? এতো বড় থিয়েটারের স্টেজ কোথাও পেয়েছ নটু বাবু? এই গঙ্গার চাতাল। ঘাট। ওই পুরনো বটের তলা। এতোবড় ইলেকট্রিক চুল্লির শ্মশান। যদি সেই রাতে সরলা মরে যেত কার কি যায় আসতো? কিন্তু মরেও মরেনি সরলা। শেষ একবার তার এ্যাক্টো করার ইচ্ছে হয়েছিল। মা গঙ্গায় ডুব দিয়ে কাশীদাসী মহাভারত খানা মেলে ধরেছিলেন সামনে। সকালে যারা স্নান করতে এসেছিল তারা দেখলো কবেকার এক প্রাচীন বুড়ি ছেঁড়া খোঁড়া এক বই খুলে সুরে সুরে কি যেন পড়ছে। তা মহাভারত না রামায়ণ অতো বোঝার অবস্থায় কেউ ছিল না। কারোর তাড়া ছিল কাজে যাবার। কেউ বা পূণ্য অর্জন করতে এসেছিল নদীতে ডুব দিয়ে।

বেলা গড়ালে, গলা শুকিয়ে আসার পর সরলা দেখেছিলেন তার সামনে জমা হয়েছে কিছু খুচরো পয়সা। মা গঙ্গার দান বলে কপালে ঠেকিয়ে আঁচলে বেঁধেছিলেন। সেই পয়সায় মাটির মালসা কেনা হয়েছিল। চাল। শ্মশানের দশকর্মার দোকান থেকে কাঠ। একটু ঘি। গঙ্গার ধারে দুটো ইঁট জোগাড় করে হবিষ্যি বসিয়ে ছিলেন সরলা। আধসেদ্ধ সেই ভাতকে বড় বড় গোল গোল পিন্ড করেছিলেন। আর মনে মনে মা গঙ্গাকে বলেছিলেন নিজের পূর্ব জন্মের শ্রাদ্ধ করলাম মা। আমাকে নতুন জন্ম দাও। চিক চিক করে উঠেছিল চোখ। গপ গপ করে কত দিনের ক্ষিদেতে খেয়েছিলেন সেই পিন্ড। সত্যিই সেদিন থেকে নতুন জন্ম শুরু হয়েছিল তাঁর। পরিচিতিও।

কত মানুষ যে কাশীদাসী মহাভারত শুনতে আসতো। ভোরের আলোয় ঘিরে ধরতো সরলাকে। একটা বড় মঞ্চে একই আসনে কখনও তিনি দ্বৈপায়ন ব্যাস, কখনও অর্জুন, কখনও ভীম, কখনও দ্রৌপদী আবার কখনও বা সত্যবাদী রাজা যুধিষ্ঠির। একই অঙ্গে কত চরিত্রের সমাহার! তুমি যদি দেখতে নটু বাবু তোমার ম্যাটনি আইডল সরলাকে, মনে মনে খুশি হতে পারতে তো? বিড়বিড় করেন সরলা। তাও এতো সুখ বেশিদিন সহ্য হলো না। ওই যে ললাটের লিখন। ছোট্ট বেলায় আঁতুর ঘরে বিধাতা পুরুষ লিখে দিয়েছিল। গঙ্গার ঘাটে লোকজন হঠাৎ কমে গেল। পৃথিবী শুদ্ধু নাকি মড়ক লেগেছে। সবাই নাকি একই রোগে মরছে। সরকার বলেছে কেউ নাকি বাড়ি থেকে বেরোবে না। কাজ করবে না। তাহলে খাবে কী? কত শত লাশ যে প্লাস্টিকে মুড়ে শ্মশানে এলো। দাউ দাউ করে জ্বললো চুল্লী। কই তবু এতো কিছুর পরেও ডাক এলো না তো সরলার। যমের অরুচি হয়ে থাকলেন বুঝি!

এরই মধ্যে একটা ঘটনা ঘটলো। ওই যে ফুলেশ্বরী, গঙ্গার ঘাটে ঝাঁট দেয়। যাকে ডেকে চা খাওয়ান সরলা। সুখ দুঃখের গল্প শোনেন। তার যে বর ডুমুরেশ্ব্‌র, মড়ার গাড়ি চালায়, সে একদিন এসে কোনো কথা না শুনে সরলাকে নিয়ে গিয়ে তুললো ধাপার পাশের বস্তিতে। তাদের পাড়ায়। এখানে থাক মা। বাইরে মড়ক। সেই থেকে সরলা রয়ে গেছেন সেখানে। কিন্তু কারোর বোঝা হয়ে থাকার মেয়ে নন সরলা। ছোট থেকে কাজ করে খেয়েছেন যে। যতবার চলে যেতে চেয়েছেন গঙ্গার ধারে ততবার পথ আটকে ধরেছে ফুলেশ্বরী, ডুমুরেশ্বর, তাদের বাচ্চা বুঁদি, শহরের নোংরা ঘাঁটা বেশ কিছু মানুষ। এখন এরাই যে তাঁর পরিবার। তাদেরই কোন এক জামাই শ্যুটিং পার্টিতে গাড়ি চালায়। দলে দলে লোক নিয়ে যায় বস্তি থেকে। তারা সবাই নাকি এ্যাক্টিং করে। বিনিময়ে খেতে পায় আর দুশোটি টাকা। একদিন সেই ভিড় গাড়িতে উঠে পড়লেন সরলা। কাজের আশায়। পেটের টানে। সেই কবেকার অভিনয়কে ভালোবেসে।

বড় বড় আর্টিস্টদের পেছনে, কখনও ভিড়ের মধ্যে, কখনও বা মিছিলে প্রায়ই দেখা যেতে থাকলো স্টুডিও পাড়ায় একটা বুড়িকে। পাটের শনের মতো তার চুল। মায়া ভরা মুখ। ছিপছিপে গড়ন। রোদে পুড়ে গায়ের রঙ তামাটে। এই বুড়িকে কোনো কিছুতেই বিরক্ত হতে দেখা যায় না। ভিড় বাড়াতে যারা আসে তাদের মধ্যে যে বায়নাক্কা গুলো থাকে বুড়ির মধ্যে একদম নেই। যেটা বলা হয় সেটা যে কি সুন্দর করে করে দেন। আর সবচেয়ে যেটা আশ্চর্যের ইনি গড় গড় করে মুখস্থ ডায়লগ বলতে পারেন। প্রচন্ড ক্যামেরা ফ্রেন্ডলি। আস্তে আস্তে চেনা পরিচিতি বাড়তে থাকে স্টুডিও পাড়ায়। কাজ বাড়তে থাকে। অভিনয় করতে থাকেন সেই কবেকার মঞ্চের পাদ প্রদীপের আলোয় দাঁড়ানো সরলাদেবী। যদিও পূর্ব স্মৃতির কথা তিনি কাউকে বলেন না কোন দিনই। কারণ নিজের শ্রাদ্ধ নিজেই করেছেন যে।

কি বলবো তোমাকে নটুবাবু তুমি শুনলে হাসবে। একটা দৃশ্য এরা যে কতবার করে কত দিক থেকে ক্যামেরায় তোলে। আর প্রত্যেকবার ঠিক আগে যেমনটা করেছিলে তেমনটা করতে হয়। ফিরে তাকানো, হাসা, কথা বলা সব এক। আমাদের সেই এনকোরের মতো। আমার বেশ ভালো লাগে জানো। কত মানুষ, কত আলো, কত গল্প। আর সবচেয়ে যেটা ভালো লাগে কি জানো নটু বাবু? যখন শ্যুটিং এর সব আলোগুলো জ্বলে ওঠে একের পর এক। ডিরেক্টার বাবু চিৎকার করে বলেন এ্যাকশান। আমরা হুড়মুড় করে গিয়ে ক্যামেরার সামনে দাঁড়াই। ঠিক তখনই আমি একটা মঞ্চকে স্পষ্ট দেখতে পাই। দর্শকদের কালো কালো মাথা। আর দূরে একদম দূরে পেছনের সারিতে তুমি বসে আছো। দেখছো আমার অভিনয়। ওরা আমাকে কি বলে ডাকে জানো নটু বাবু? না না তোমার সরলা নয়। সে তো কবেই হেজে মরে গেছে। আমি এখন স্টুডিও পাড়ার শ্যুটিং দিদা।


ঋণ-পৃথিবীর সেইসব ভুলে যাওয়া নামহীন অভিনেতা অভিনেত্রীদের মনে রেখে।


রবিবারোয়ারি, এই সময় পত্রিকা। ১৯ এপ্রিল, ২০২৫ প্রকাশিত। 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি