‘গোরা নকশাল’ পাঠ অভিজ্ঞতা


গোরা নকশাল বই হিসেবে প্রকাশিত হবার পর থেকে অনেক পাঠক তাঁদের অভিজ্ঞতার কথা জানিয়েছেন ব্যক্তিগত ভাবে। তাঁদের সেই অভিজ্ঞতার কথা এখানে রাখা থাকলো। কখনও কখনও ব্যক্তির স্মৃতি সমষ্টির স্মৃতিকেও প্রতিফলিত করে।


গোরা নকশাল' কেন এতদিন পড়িনি, এ আপশোস যাবার নয়। তবে এই যে পড়ে ফেললাম, আরও দেরি করে ফেলিনি, সেটা আপাতত স্বস্তির। যদিও 'গোরা নকশাল' স্বস্তিদায়ক লেখা নয়। যদি বলি, এ-উপন্যাস ব্যর্থ স্বপ্নের, তবে ভুল হবে নিশ্চিত। এবং, যদি এ-ও বলি যে, এ-উপন্যাস আগামীর ও স্বপ্নের, তাহলেও ভুল হওয়ার সম্ভাবনা থেকে যায়। বস্তুত আমার কাছে এ-উপন্যাস পুনরুদ্ধারের। কাকে? নিজেকে, সময়কে, স্মৃতিকে ও ইতিহাসকে। দেশকে-ও। দেশের আত্মা ছোঁয়ার সঙ্গে গোরার একটা নিবিড় যোগ আছে। সেই গোরার পাশে নকশাল এসে বসতেই ইতিহাসের সঙ্গে একটা সময়পর্বের সেতুবন্ধ হয়ে যায়। এরপর যখন লেখক নিশ্চিত করে দেন পায়রাদের টাইটেল নকশাল, তখন সময় তার নির্ধারিত সীমা অতিক্রম করতে চায়। আর সেখানেই লুকনো থাকে লেখকের যাবতীয় ম্যাজিক-রুমাল। সেই রুমাল বুলিয়ে বুলিয়ে তিনি সেরে নেন সমস্ত অন্তর্বর্তী বুনন তথা জরুরি অন্তর্ঘাত। আসলে এ-উপন্যাস নিজে একটি অন্তর্ঘাত-ই, যা সুচ হয়ে সমস্ত নিশ্চিন্তির মধ্যে ঢুকে পড়ে ফালাফালা করে দেয় সুখী গৃহকোণ। বিষাদ-আচ্ছন্নতা-অপরাধবোধের ভিতর দাঁড়িয়ে তখন সম্ভবত একটিই আর্তি জেগে থাকে - কেন ভুলে ছিলাম! আর, ছিলাম যদি তো ভুলিয়েই রাখো, নয়তো বলো করণীয় কী! গোরা বা লেখক এর সরাসরি জবাব দেন না। কিন্তু আমরা উপলব্ধি করি, যে, স্মৃতির ভিতর যে শূন্যতা, তা আসলে প্রকারান্তরে উদ্বাস্তু হওয়াই। একরকমের এসকেপ। অতএব, যন্ত্রণার হলেও স্মৃতির মিছিলে আমাদের হাঁটতেই হবে, নতুবা আমাদের পরিত্রাণ নেই। স্মৃতির কাছে, ইতিহাসের কাছে আমাদের ঋণ ও অপরাধ, দুই-ই স্বীকার করার আছে। তবেই এগোনো সম্ভব। 'গোরা নকশাল'-এ আমাদের অনেকের হয়ে সেই কাজটি করেন লেখক, আর আমাদের এগিয়ে দেন সামনের দিকে। সময়ের প্রতি তীব্রভাবে দায়বদ্ধ একজন লেখক হয়ে, শুধু বসন্তদাগকে চিহ্নিত করেই তিনি ক্ষান্ত হননি, তার উপর আঙুলও বুলিয়ে দিয়েছেন। এইখানে 'গোরা নকশাল' তার উত্তীর্ণ হওয়ার রসদ পেয়ে যায় বলে আমার বিশ্বাস। কারণ, গোরার পাঠকরাও উপলব্ধি করে, 'গাছেরা ঘুমোলে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে?', এ-উত্তরের খোঁজ আর কারও একার নয়, বস্তুত প্রত্যেকেরই। বইটি প্লিজ পড়ুন সকলে, অনুরোধ। 
সরোজ দরবার। 


শেষ করলাম । ধন্যবাদ গুরুচণ্ডালি এবং কল্লোলবাবু । প্রকৃত নকশাল যে আত্ম-হনন নয় আত্ম-খনন এটা আবার বোঝানোর জন্য । আত্মখননেই প্রকৃত মেরুদণ্ডর খোঁজ পাওয়া যায় এবং তার সংস্পর্শে আসা যায় । নেতৃবৃন্দ দের মেরুদন্ডের ওপরে ব্যক্তিগত চাহিদার এত আস্তরণ ছিলো যে ওনারা হয়তো আর আত্ম খননের পথে যান নি দুর্গন্ধ র ভয়ে । তাই শেষ দিকে শুধু আত্ম হননে জোর দিয়েছিলেন ।গোরা নকশাল আসলে সেই প্রকৃত নকশাল মতাদর্শ যা ভোরের টাটকা ফুলের মতো যেটার আত্মখনন না হলে সুবাস ছড়ায় না ।সুবাসিত ধন্যবাদ আপনাকে । 
ভাষ্কর ভট্টাচার্য


বইমেলা ২০১৯গোরা নকশাল (কল্লোল লাহিড়ী)গুরুচণ্ডালী প্রকাশনা নাম শুনে মনে হয়েছিলো নকশাল আন্দোলন বা তার পরিপ্রেক্ষিতে লেখা। আসলে এখানে কিন্তু নকশাল আন্দোলন বা বলা যাক সেই নকশাল আন্দোলনের একজন - যার নাম গোরা নকশাল - আছেন প্রচ্ছন্নে। তার দীর্ঘ ছায়া এই গল্পের টাইমলাইনে। আর একটি সংলাপ "যে উড়তে পারে, সেই নকশাল"। গল্প - সেই অর্থে খুব সামান্য। আশীর দশকে মফঃস্বলের একটি কারখানা বন্ধ হয়ে যাওয়া এবং সেই আন্দোলন নিয়ে। গল্পটি বলা হয়েছে একটি বালকের চোখ দিয়ে। তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকে "গোরা নকশাল" - তার ছায়াময় উপস্থিতি একাধারে ওই আন্দোলনে এবং ওই বালকের মনে। অনবদ্য লেখার স্টাইল। সিনেমার ছাত্র বলেই কল্লোলবাবু ন্যারেটিভে অবলীলায় মিশিয়েছেন ভিজুয়াল এলিমেন্ট, ব্যবহার করেছেন জাম্পকাট, ব্যাখ্যার বদলে এনেছেন অনুভব। ঠিক নন-ন্যারেটিভ না হলেও দুটো টাইমলাইন নিয়ে চমৎকার খেলা। সঙ্গে মৃদু উচ্চারণে অন্য রেফারেন্সে চলে যাওয়া। এটা নিয়ে খুব ভালো সিনেমা করা যেতে পারতো। কিন্তু যাবে না। কারণ এটা যিনি করতে পারতেন, তিনি ১৯৭৬এ এই পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। তারপর স্পর্ধা গেছে, বিনয় এসেছে।বাসুদা আর সব্যকে ধন্যবাদ এই বইটার খবর দেবার জন্যে। 
অতনু দে
 
বইয়ের ভূমিকা তে প্রকাশকের পক্ষ থেকে জানানো হয়েছে, এই উপন্যাসিকা 'পাঠ খুব সুখকর অভিজ্ঞতা নয়'! অতএব, সাধু সাবধান!! দুটো সমান্তরাল সময় এবং সমান্তরাল খাতে বয়ে চলা জীবন, সমাজ, রাজনীতি এবং অভিন্ন মনন কে তুলে আনতে টানা ন্যারেটিভ এবং দুটো সময়ের লিঙ্ক করার জন্য কোনো নির্দিষ্ট স্থান এর ব্যবহার, চমকপ্রদ। প্রতিটা আখ্যান এর বা phase বলা ভালো, সূচনা হচ্ছে এক বা দু-চার পঙতি কবিতা দিয়ে, যেগুলো নিঃসন্দেহে পাঠক কে প্রস্তুত করে দেবে আখ্যান টিকে আত্মস্থ করতে। গোরা নকশাল, একজন মাঝবয়সী উদ্বাস্তু মানুষ, যার এক পা খোড়া হয়ে গিয়েছিল, হাতের মাংস খুবলে গিয়েছিল সরকারী অতিথিশালায় থাকাকালীন - যে ফিরে আসছে বারবার, যেমন সন্ধ্যামণি গাছের গাঢ় সবুজ পাতার আড়ালে রক্তিম ফুল আসে, তেমনই অমোঘ তার প্রত্যাবর্তন। এই মানুষটা সজীব হয়ে ওঠে টুকনুর স্মৃতির পটে, যখন সে ঠিক করে চিত্রনাট্য লিখবে তার ছোটবেলার পছন্দের মানুষটির উপর। সেই স্মৃতি মধুর নয় মোটেই, বরং তেতো, অবশ্যই পাঠকের কাছে কারণ এই তেতো স্বাদ না চাখলে গোরা নকশালের কাছে ঘেঁষতে পারা যাবে না। রোম্যান্টিজম এর মোড়কটা খসে পড়ার পরে সেইসব 'গরীবের নেতা যাদের দূর থেকে দেখা যায়', বা তাদের সরকার ও তাদের পুলিশ, পাঠকের ভাবার বিষয় নতুন প্রবাহ লাভ করবে। চরিত্রনির্মাণে মুন্সিয়ানা প্রথম আখ্যান থেকেই দেখা যায়, যেখানে টুকনুর কাকা হাঁদার পোষা পায়রার নাম 'নকশাল'-টুকনু বিশ্বাস করে যে পায়রাদের টাইটেল হয় নকশাল, যারা নির্দ্বিধায় যেখানে সেখানে উড়ে বেড়াতে পারে! এই বিশ্বাস পরে উপলব্ধিতে পৌছয়। কারখানা ও শ্রমিক রাজনীতির বিভিন্ন চরিত্রের সাথে, চুনু হজমিওয়ালা, ঠুলি, সুশান্ত (চরিত্র..) রা যখন আসে, প্রতিক্ষেত্রেই নতুন করে পাঠকের সামনে উন্মোচিত হয় গোরা নকশাল, এক এক আঙ্গিকে। লেখক সামনে এনেছেন, গোরা নকশালের দিনবদলের স্বপ্ন যা সে আমৃত্যু লালন করেছে, দৌড়েছে সবার দুমুঠো ভাত-মাথা গোঁজার স্থান-শিক্ষার জন্য, এবং সেই বিপ্লবের বীজমন্ত্র বপন করে চলেছে পিছনে ফেলে আসা মাটিতে, আগামী সম্ভাবনাময় দিনের জন্য। ফলত এই উপন্যাস কখনই রম্য নয়, যখন তেতো অস্বস্তি গলার কাছে দলা বেঁধে আসে, যখন গোরাদের সামান্য দাবীর বদলে গরীবের সরকার কমরেড প্রিয়াংশুর খুলি উড়িয়ে দেয়, খুবলে নেয় প্রেসিডেন্সীর বছর উনিশের সুশান্তর চোখ, খুবলে যায় গোরার হাতের মাংস। পাঠক এর কাছে দুটো আঙ্গিকে উপন্যাসিকাটা রাখা যেতে পারে, পৃথকভাবে বা সমান্তরালী। প্রথমত, নকশাল আমলে বন্দুক হাতে উত্তর কলকাতার গলি দিয়ে ছুটে চলার রোম্যান্টিজম কে দূরে রেখে বাস্তবের কাছাকাছি সেই সৈনিকদের মানসিকতা এবং বজ্রনির্ঘোষ এর ধ্বনী স্তব্ধ হয়ে যাওয়ার পরে নতুন করে স্বপ্ন দেখার স্পর্ধা - পাঠক কে অবগত করে সেই মূল্যবোধ বা নিঃস্বার্থ আত্মত্যাগের, যার জন্য কোলহারা শত শত মা। দ্বিতীয়ত, রাজনীতি নিয়ে সচেতন পাঠক পড়বেন এই উপন্যাস, প্রথম থেকে শেষ শব্দ, প্রতিটা অত্যন্ত গুরুত্ব সহকারে। ক্ষমতার কালো রঙে যে কোনো রঙ মিশলে অন্তিমে যে অমানিশা আসে- তা উপলব্ধি করা যাবে। তবে, একজন বিপ্লবীর প্রত্যয় ও আজীবন তার স্বপ্ন কে ধাওয়া করে যাওয়ার প্রয়াস এবং তার পারিপার্শ্বিক এর উপর প্রভাব, পাঠক প্রায় দেখতে পারবেন, লেখকের শৈলীর সুচারু ব্যবহার ও সময়কাল কে উপন্যাসিকার চরিত্র রূপে নির্মাণ করার ফলে।কলম চলতে থাকুক। শুভেচ্ছা রইল। 
ঋক ঘোষ 


যে জন্য এখানে আসা, সেটা তো বলাই হয়ে উঠল না। আপনাদের কল্লোল লাহিড়ী-র গোরা নকশাল লেখাটি অসম্ভব ভাল লেগেছে আমার। বইটা পড়বার সময় মনে হচ্ছিল যেন ঘটনাগুলো আমার চোখের সামনে ঘটছে, সব যেন দেখতে পাচ্ছি। মুড়ির বাটি থেকে দেওয়ালের রংচটা খসে পড়া চামড়া পর্যন্ত... সব দেখতে পাচ্ছি। যেন আমিও সেই জায়গাতেই থাকি, আমিও তাঁদেরই একজন। খুব একটা সাজিয়ে-গুছিয়ে আমি বলতে পারি না। পারলে হয়তো আরও কিছু লিখতে পারতাম এই "গোরা নকশাল" নিয়ে। 
পাঠক (নামহীন)। 


আমি বইটি পড়েছি সম্প্রতি। নিটোল গদ্য, প্রত্যেকটি শব্দের প্রয়োজন ছিল কোনো বাহুল্য নেই শব্দের/বাক্যের, ঝরঝরে লেখা। খুব ছুঁয়ে গেছে লেখাটি। ওনার লেখা আর কোনো বই আছে? 
সুমন পাচাল

গোরা নকশাল পড়ে ছবিটি এঁকেছেন দেবালয় ভট্টাচার্য

চেনা আলোয় ছড়িয়ে পড়া কথাগুলো জড়ো করার গভীর মনোযোগ আর গল্পের মুখগুলো চিনে নেবার একবুক তাগিদ নিয়ে পাঠক শুরু করেন গোরা নকশাল।পূর্ব বাংলা থেকে আগত এক পরিবার, বলা ভালো উদ্বাস্তু তকমা এঁটে যাওয়া এক পরিবার, যাদের ঠাঁই পশ্চিম বাংলার বালি এলাকায়। সেই তাদের নিয়েই শীতের একটা সকালের বর্ণনার মাধ্যমে গল্পের উড়ান। উত্তম পুরুষে লেখা এই আখ্যানের কথক ছোট্ট টুকুনের দেখা পাবেন পাঠক প্রথম অধ্যায়েই। সে পরিবারের কনিষ্ঠ জন। ভীষণ ঘুম কাতুরে, নানান ফন্দিতে পড়াশোনায় ফাঁকি দেয়া, ঠাম্মার খাবারে ভাগ বসানো, আর ঠাম্মা, মণির মুখে শোনা মজাদার খাবারের জন্য ছোঁক ছোঁক করাই যার প্রধানতম কাজ। ও হ্যাঁ, আরো একটা কাজ সে বিশেষভাবেই করে যায়, মনে মনে নকশাল নামের ছোটকা হাঁদা'র পোষা পায়রাটিকে কিভাবে জব্দ করা যায় সে ভাবনায় ডুবে থাকে। এহেন ছোট্ট টুকুনের পরবর্তী জীবনের মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্যই যেন তার জেল ফেরত জেঠতুতো কাকা গোরা নকশালের আর্বিভাব ঘটে। যাঁর পুঁতে দেয়া বীজমন্ত্রের অনুরণন পাঠক শুনতে পান বড় হয়ে ওঠা কল্লোল লাহিড়ীর বয়ানে। 'গোরা নকশাল'এর গল্পটা একটা কোলাজ। সময়ের একাল- সেকালের ফোঁড় দিতে দিতে এগিয়েছে।টুকুনের পরিবার আর্থিক ভাবে প্রায় নিঃস্ব হলেও, আত্মিকভাবে যথেষ্ট সমৃদ্ধ। পরিবারটি পাঠপ্রিয়। বিষাক্ত রাজনীতির ছোবল তাদের পূর্ব বাংলার ভেটেমাটি ছাড়া করলেও রুচিশীল সংস্কারগুলো কেড়ে নিতে পারেনি। তাই সঙ্গত কারণেই 'গোরো কিনা কালো কি'র মত সস্তা চটুল গান এ পরিবারে ব্রাত্য। ঠুলির মত খিস্তিবাজ ছেলের বন্ধুত্ব গ্রহণ করা বারণ। কানের পাশে চুল গুঁজে রাখা শেখায় রুচিবোধ। যেখানে পরিবারের কর্তা স্কুল শিক্ষক বাবা স্কুলের বই ফেরত দেবার আগে ভালো ভালো কিছু বই আরো একবারটি করে পড়ে নিতে চান। ঘুমে ঢুলতে থাকা ছোট্ট টুকুনের বুকে সেঁধিয়ে যায় বাবার পাঠরত কিছু খুচরো লাইন ''আমলকি বন কাঁপে যেন তার বুক করে দুরু দুরু/পেয়েছে খবর পাতা ঝরার সময় হয়েছে শুরু।'' লাইব্রেরি থেকে আনা বইগুলো পড়ে নেবার ব্যাকুলতায় চোখের ছানি যত দ্রুত সম্ভব কাটানোর তাগিদ দেখি বয়স্ক ঠাম্মার মধ্যে। যে ভরপুর জীবন আমাদের দেখা হয়নি কোনোদিন, কেবলি গল্প হয়ে ঘুরে ফিরে কাছে আসে, সেজীবনের প্রতি একটা বিস্ময়মাখা আগ্রহ জেগে থাকে যেন। ঠাম্মার মুখে শোনাপরিবারের টইটম্বুর দিনের গল্পেরা তাই কথকের টুকুন মনে লেপ্টে থাকে।আস্তে আস্তে গোরা নকশাল টুকুনের অবচেতনে তার বুকের ভেতর বুনে যেতে থাকেন ভবিষ্যতের ইস্তেহার। যা টুকুন কল্লোল লাহিড়ী হয়ে বুঝে নেবেন একদিন। এই বুনে যাওয়া আর বুঝে নেয়ার রথযাত্রায় লেখকের সাথে সাথে পাঠক একবার অতীত আবার বর্তমানের ভ্রমণের সঙ্গী হয়ে ওঠেন স্বাচ্ছন্দ্যে। 'এ ভ্রমণ আর কিছু নয়, কেবল তোমার কাছে যাওয়া'র আকুলতায় সে রথের চাকা বার বার যেখানে গিয়ে থামে 'সে বড় সুখের সময় নয়, সে বড় আনন্দের সময় নয়'। তারপরও টুকুন এক মায়াবী লাবন্য খুঁজে পায় পুলিশের নিষ্ঠুর অত্যাচারে পঙ্গু , আশ্চর্য সুন্দর হাসতে জানা একজনের মুখে, বুকে। যিনি একটি আন্দোলন, রাষ্ট্র কর্তৃক ধামাচাপা দিতে চাওয়া এক রক্তক্ষয়ী ইতিহাসের সাক্ষী। 'গোরা নকশাল' আমাদের সেই আন্দোলনের কাছে নিয়ে যায়, পাঁজর খুলে দেখাতে চায় ক্ষতের বীভৎসতা।যে আন্দোলন স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবালন হয়ে ওঠার উৎসাহ দিয়েছিল হাজার তরুণ যুবাকে।স্বপ্ন দেখতে আর দেখাতে তাড়না যুগিয়েছিল দিন বদলের। ইতিহাসের সেই সময়কে কল্লোল এক অবাক মোহময় ঘোর নিয়ে পাঠকের কাছে বয়ান করে যান। সে বয়ানে পাশাপাশি ঢুকে যায় কথকের উত্তর কলকাতার প্রায় মফস্বল শহরের বাড়ির কাছাকাছি চটকলের ধর্মঘটী শ্রমিকদের কথা। সুশান্ত নামের এক তুখোড় ছাত্র যে কিনা প্রেসিডেন্সিতে ভর্তি হয়েছিল, ভবিষত্যে সংখ্যাতত্ত্ব নিয়ে যার পড়ার ইচ্ছে, তাদের বাড়িতে তার আগমন এবং পরে পুলিশের তাকে তুলে নিয়ে যাওয়া। কংগ্রেস পার্টির হয়ে অসৎ হরিমিত্রের ভোটে নামা। হাঁদার দোকান চটকল বন্ধের সাথে সাথে বন্ধ হয়ে যাবার আশঙ্কা কিংবা সুশান্তের খু্ন হয়ে যাওয়া, গঙ্গায় তার ভেসে যাওয়া লাশ টেনে আনার জন্য ঠুলি নামের অনাথ ছেলের ভরা কোটালকে উপেক্ষা করে ঝাপিয়ে পড়া। কিংবা ক্ষমতার পালাবদলে গরীবের বন্ধু সরকারের মুখপাত্রের ভাষণ শোনায় মন না দিয়ে শিবু দোকানির কিছুটা আত্মকেন্দ্রিক ভাবনায় ডুবে যাওয়া। বন্ধু সরকার ক্ষমতায় এলেও যে গরীবের ভাগ্যের খুব একটা হেরফের হয়না, হাঁদার 'গরীবের সরকার, গরীবের উপর লাঠি চালায় কী করে? জাতীয় অবোধ প্রশ্নগুলো পাঠকের মনে ইতিহাসের সেই সময়কে জানার একটা আগ্রহ তৈরি করে এগোতে থাকে। অনুসন্ধিৎসু পাঠক, লেখকের সেসব বয়ানে নিজেকে সঁপে দিতে বাধ্য হন। গভীর মনোযোগ কেড়ে নেয় লেখকের বয়ানের মুন্সিয়ানা। যাদের ঘরে ফেরার কথা ছিল; যারা স্বপ্ন দেখেছিলেন দেশহারা মানুষেরা দেশ পাবে, অন্নহীনের থালায় ভাত উঠবে, কেন তাদের ঘরে ফেরাটা নিশ্চিত করা গেলো না। কিংবা কেন তাদের 'রোজ চেটে খেতে হলো লজ্জা ও ঘৃণা', বাস্তবে সত্যিই তাদের কোনো দেশ আছে কিনা প্রশ্নের গোলক ধাঁধায় পড়ে 'আমি একা, ভারতের মত স্বাধীন। দুই চোখে দেখিনি তো দেশ কোনোদিন!' এমন এক উদ্বাস্তু আক্ষেপে ডুবে যেতে হলো। ফুল শুঁকিয়ে রাষ্ট্রীয় ছেলেধরারা হাজার হাজার তাজা প্রাণ যেসব তরুণ-যুবাকে ধরে নিয়ে গেলো কিংবা লোপাট করে দিলো, তার সঠিক হিসাবই বা কত? ইত্যাদির সবটাই হয়ত এই আখ্যানে ওঠে আসেনা। সে দায় লেখকের উপর চাপানোটাও অন্যায়, কারণ এই গল্পের স্পটলাইটটা কল্লোল ফেলেছেন একজনেরই উপর। গোরা নকশালকে কেন্দ্রে রেখেই তিনি নানান 'রেফারেন্স, কাউন্টার রেফারেন্স অন্তর্ঘাতের বয়ান' দিয়ে গেছেন। এদত সংক্রান্ত বিষয়ে ঋদ্ধ পাঠকমাত্রই সেসব বুঝে নেবেন চটজলদি। সেরকম পড়াশোনার অভাবজনিত কারণে আমার পক্ষে তার সবটা বুঝে নেয়া খানিক মুশকিল হলেও উপন্যাসের টোন ধরে এগোতে খুব বেগ পেতে হয়নি। অভিমন্যুর মত চক্রব্যুহ থেকে বের হবার মন্ত্র না জেনেই সেখানে প্রবেশের ঝুঁকি মানুষ ঠিক কখন নিতে পারে তার বিস্তারিত সুলুকসন্ধানে কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল আমাকে আগ্রহী করেছে। ছোট্ট টুকুনের বিশ্বাস যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল। গোরা নকশাল স্বপ্ন নিয়ে তাকে সেই উড়ানের বিদ্যােটাই শিখিয়ে দিয়ে গেছেন। এই উড়ানের সীমারেখায় কোনো রাষ্ট্রীয়শক্তিই যেন লক্ষণরেখা টেনে দেবার দীনতা না দেখায়। রাজনীতির নামে, স্বাধীনতার নামে কারো পিঠে 'কাটা তারের দাগ' এর ছাপটা কলংক বয়ে বেড়ানোর মত মর্মঘাতী বেদনা না ছড়ায়। এটাই আন্তরিক চাওয়া।প্রথম পাতা থেকে গুনলে(গল্প শুরুর আগে) এই বইয়ের পৃষ্ঠা সংখ্যা দাঁড়ায় ৬৪।পাতার সংখ্যা বিচারে এটা ছোটোখাটো উপন্যাস, বলাইবাহুল্য। কিন্তু ছোটো বলেই এটি একনিঃশ্বাসে পড়ে ফেলার মত বই নয় বলেই মনে হয়েছে আমার। এর গভীরতা ব্যাপক, সেটা পাঠকমাত্রই স্বীকার করবেন। প্রতিটা অধ্যায়ের শুরুতে উদ্ধৃত পংক্তিগুলো খানিকটা সূত্রধরের মত ভেতরের গল্পকে পাঠকের সামনে হাজির করেছে। এটা খুব পছন্দ হয়েছে আমার। জীবনকে আতশকাঁচের নীচে ফেলে দেখবার আর দেখাবার ক্ষমতা, এবং গল্পের ভাষা, কল্লোল লাহিড়ীর সবচে' বড় অস্ত্র। সে অস্ত্রের নানামুখী ঘায়ে পাঠক কখনও কাঁদবেন, নকশালদের উপর পুলিশি অত্যাচারের নির্মম বর্ণনায় শিউরে উঠতে উঠতে হয়ত ভাববেন(তাঁকে যাঁরা ব্যক্তিগতভাবে চেনেন), 'ওরকম একজন নরম সরম মানুষের পক্ষে এভাবে বর্ণনা করা কিভাবে সম্ভব!' আবার নিজের শৈশবের নানান ফন্দি ফিকিরের বয়ানে পাঠক ফিক করে হেসেও উঠবেন। গোরা নকশাল কল্লোল লাহিড়ীর প্রথম ছাপার অক্ষরের উপন্যাস। নকশাল নামের যে পায়রাটিকে তিনি পাশের বাড়ির হুলোর পেটে চালানের নানান চিন্তায় ডুবে ছিলেন শৈশবের অনেকটা সময়। একদিন সত্যি সত্যিই পায়রাটাকে হুলোটা ঘাড় মুটকে নিয়ে গেলে তার মৃত্যুর জন্য তিনি নিজেকেই দায়ী করেন। মণির মামদোর চেয়েও ভয়ংকর ভাবে আজীবন কাঁধে(নাকি বুকে?)চেপে বসা গোরা নকশালের টিবি রোগে আক্রান্ত হয়ে মৃত্যুতেও তিনি নিজের অক্ষমতাকে দায়ী করে ভেঙে পড়েন গভীর এক বেদনায়। হাসপাতালের বিছানা ছেড়ে গোরাও নিশ্চিত বাড়ি ফিরতে চেয়েছিলেন! কিন্তু পারেননি। তাঁদের সবার না ফেরার বেদনা ভুলতেই এই অসাধারণ লেখাটা গোরা নকশালসহ আরো যেসব স্বপ্নবাজ মানুষের বাড়ি ফেরা হয়নি, তাঁদের প্রতি লেখকের ব্যক্তিগত ট্রিবিউট। এরচে সুন্দর, আন্তরিক শ্রদ্ধাঞ্জলি আর কী হতে পারে! এবইটির ভূমিকা যিনি লিখেছেন তাঁর পরিচয় জানার পর মনে কেমন একটা শিহরণ জাগে। তিনি বাস্তবের নকশাল আন্দোলনে জড়িত মানুষ, কল্লোল দাশগুপ্ত! এটিকে আমি কল্লোলের সৌভাগ্যই বলবো। সায়ন কর ভৌমিকের করা গোরা নকশালের প্রচ্ছদটাও উপযুক্ত বটে। রক্তাক্ত প্রান্তর, নানান জট জঞ্জাল পেছনে ফেলে শুভ্র-সুন্দর-কল্যাণকে বুকে নিয়ে সাদা এক পায়রার উড়ান! চমৎকার!! বাংলা চটি সিরিজের বই হিসেবে একটি গুরু চণ্ডা৯ প্রকাশনা থেকে বইটা প্রকাশিত। এর মূল্য:৬০টাকা(ভারতীয়)। লেখক হিসেবে কল্লোল লাহিড়ীর সৌভাগ্যের মুকুটে সাফল্যের নতুন নতুন পালক জুড়ে বসুক। সাহিত্যের জগতে এই বইটা নিজের ন্যায্য আসন পাক, সেই শুভকামনা। 
নাহারা তৃণা। গল্পপাঠ।

এই সময় পত্রিকার বইয়ের খবরের পাতায় গোরা নকশাল।

তোমার দেওয়া এই এক মুঠো বইটি অবশেষে পড়ার ফুরসৎ হলো।এই একটি মুঠোয় ধরা বইটি যেন মুঠোর বাইরের অজস্র অতীত স্মৃতির টুকরো টুকরো মেঘে ভাসিয়ে দিল।তোমার উপস্থাপনার সাবলীলতা টুকনুর ছোটবেলা বা 'গোরা নকশালে'র সময়টা যেন সিনেমার ফ্ল‍্যাশবেক।হারিয়ে যাচ্ছিলাম সেই কারখানার সাইরেন বাজা দিনে যে খানে দিনে -রাতে পাড়ার রাস্তা কাঁপানো 'ইনক্লাব জিন্দাবাদ ' স্লোগান আর পরন্ত বিকেলে গঙ্গার ধারে মানুষের আনাগোনা।আমার শৈশবের সেই দিনগুলো ও কেটেছে শহরতলির অলিতে গলিতে।তাই হয়তো চরিত্রের পরিবেশের সঙ্গে একাত্ম হয়ে পরেছিলাম।যদিও 'গোরা নকশালে'র মতো চরিত্র যারা আদর্শের জন্যে নিজের জীবন ও উৎসর্গ করতে পারেন এমন মানুষের সান্নিধ্যের আশায় দিন ফুরিয়ে যায়,চোখ খুঁজে বেড়ায় সেই আশ্রয়।তবুও আশা হয়তো বা কোনো খানে কোনো একদিন ঠিক খুঁজে পাওয়া যাবে সেই চরিত্র দের আর সেদিন আমাদের প্রজন্ম থেকে পরবর্তী প্রজন্ম স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেলবে।তোমার লেখায় কিছু বিদেশী লেখার ছোঁয়া ও পেলাম।আর সবশেষে মনে হলো 'রাতের সব তারাই আছে দিনের আলোয়'।তুমি এভাবেই আরো সহজ সরল টুকনুকে উপহার দাও যার চোখ আর মন জুড়ে শুধু জিঞ্জাসা, দাও ওর দাদার মতোন দুটি হাত যা প্রয়োজন অপ্রয়োজনে টুকনুদের হাতে রাখবে তার ভরসার হাত (যা আজকালকার টুকনুদের বড়োই অভাব),দাও ঠাম্মার সান্নিধ্যে বেড়ে ওঠা টুকুন,দাও উনিশ বছরের আদর্শবান সুশান্ত কে যে পারবে শুধু আদর্শের জন্যে জীবন দিতে আর এমনি কাল্পনিক সব গল্প যা এখনকার প্রজন্মের কাছে শুধুই কল্পনা আর আমাদের ছুঁয়ে দেখা অতীত। 
শাস্বতী মুৎসুদ্দী 


'গোরা নকশাল' পড়ার সুযোগ হলো (সৌভাগ্য লিখলে বোধহয় ঠিক হতো)। আমার মতো মধ্যমেধার পাঠকের তথাকথিত 'রিভিউ' লেখার স্পর্ধা নেই। তাই অগোছালোভাবেই লিখছি। মজার ব্যাপার এখানেই, প্রায় তিনঘন্টার ট্রেনযাত্রায় লেখক একজন আদ্যোপান্ত অলসকে দিয়ে বইটা নিরবিচ্ছিন্নভাবে পড়িয়ে নিয়েছেন। এটা আলাদাভাবে কৃতিত্ব দাবী করে। বাবা-কাকাদের মুখে শোনা গল্পের সরণী মিশে গ্যাছে গোরা নকশালের চরিত্রে। একটা অস্থির সময়, শ্রেণীসংগ্রাম, বিপ্লবী চেতনা, অভাব, উদ্বাস্তু সমস্যা ইত্যাদি বিভিন্ন চরিত্রের মধ্যে ফুটিয়ে তুলেছেন। 'গোরা নকশাল' পড়ার সময় গল্প বলার মধ্যে এক ভিন্ন নিজেস্বতা খুঁজে পেলাম। রয়েছে বন্দী জীবন, লাশ ভেসে বেড়ানোর গল্প, পুলিশের অত্যাচার আর জীবন বাজি রাখা বদলে ফেলার সংগ্রাম, বন্ধ কলকারখানা, শ্রমিকের মুষ্টিবদ্ধ মিছিল, লাল নিশান, সংগ্রামী বীজমন্ত্র পরবর্তী প্রজন্মের বুকে পুঁতে দেওয়া। কিছু পরিচিত কবিতার কয়েকটি লাইনের নিখুঁত ব্যবহার মুগ্ধ করেছে। বলার মতো আরো অনেক ব্যাপার রয়েছে। সম্ভব হলে 'গোরা নকশাল' কিনে পড়ুন।পুনশ্চঃ অনেক ভালোবাসা সেই প্রিয় দিদিকে, যিনি প্রথম আলাপেই এবারের বইমেলায় আমায় 'গোরা নকশাল' উপহার দিয়েছিলেন। 
শেখ সাহেবুল হক 


গোগ্রাসে গিলে ফেললাম গোরা নকশাল। পুরো গল্পটা যেন একটা চিত্রনাট্য।
প্রথমদিকে টুকনুর সঙ্গে নিজের কিছুটা মিল পাচ্ছিলাম। কাকার এক বন্ধু ছিল তাঁর একটা পা ছিল টিউব লাইটের মতো। তিনিও বাম আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত ছিলেন। তবে নকশাল ছিলেন না। তিনি আমাদের বাড়িতে আসতেন। কাকার সঙ্গে অনেকবার তাঁর পার্টি অফিসেও গেছি। চলতি বছরের শুরুর দিনে তিনি প্রয়াত হয়েছেন।তবে টুকনুর ছোটবেলার সঙ্গে আমার বাবার অনেক মিল। আমাদের বাড়ির পাশের সুসজ্জিত শহিদ বেদিতে যে চার জনের নাম খোদাই করা আছে তাঁরা সকলেই বাবার খুব কাছের ছিলেন। তাঁদের জীবনটা আবার গল্পের প্রিয়াংশু বা সুশান্তের মতো।
সৌমেন শিল 


উৎসর্গপত্র পাঠের আগ্রহকে তীব্রতর করল, যেখানে লিখছ -- "সেইসব গোরাদের, যারা বাড়ি ফিরতে চেয়েছিল। কিন্তু আমরা তাদের ফিরে আসার কোনও নিশ্চয়তা দিতে পারিনি।" এক অনিশ্চিত সময় ভেসে উঠল চোখে, ঠিক যেমনটা শুনেছিলাম, পড়েছিলাম কিংবা জেনেছিলাম বিভিন্ন সূত্রে। এরপর আর তর সয় না। ভারী সুন্দর এক উদ্ধৃতি দিয়ে শুরু করেছ লিখতে --
"কিছুটা থাক আলগোছেতে...কিছুটা থাক কাছে...কিছু কথা ছড়িয়ে পড়ুক...চেনা আলোর মাঝে...।"জানলাম যখন কথাগুলো তোমারই লেখা, চমৎকৃত হলাম। ভালোবাসা।নকশাল আমল আমি দেখিনি, কিছু শুনেছি, জেনেছি "আলগোছে"-ই। তাই এ উপন্যাস স্মৃতিমেদুর করে না আমায়। কিন্তু টুকনু-র দেখা "সময়" আমাকে ভাবায়, ভাবতে বাধ্য করে। এ উপন্যাসের নামে "নকশাল" ঠিকই, কিন্তু এতো বিপ্লব-আন্দোলনের চিরাচরিত ছবি আঁকা নয়! বরং দেশভাগ, ওপার বাংলা থেকে এপার বাংলায় উদ্বাস্তু হয়ে চলে আসা মানুষগুলোর জীবন, নকশাল গোরা কাকা, ছোট্ট টুকনুর এরই মাঝে সবকিছুকে আঁকড়ে বেড়ে ওঠা যেন ঘোর লাগায়। যখন লেখো, "ঠাম্মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে তুলে নিয়েছিল এক খাবলা দেশের মাটি। ঠাকুরের বাক্সতে এখোনো তাকে যত্ন করে পুজো করে ঠাম্মা। রোজ সকালে প্রণাম করে। বাতাসা দেয়" কিংবা "অনেক তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলতে হবে উদ্বাস্তু তকমা!" ---মনটা কেমন ভারী হয়ে আসে। আদর্শের জন্য বলিপ্রদত্ত সুশান্ত, প্রেগনেন্ট অমিয়ার জন্য প্রিয়াংশুর বাঁচার আকুতি, কিংবা পুলিশের লাঠিতে খোঁড়া হয়ে যাওয়া গোরা --- এ শুধু কাহিনী নয়, হতে পারে না। এর মধ্যে বাঁচতে হয়, নাহলে এমন লেখা বেরোয় না।
এ উপন্যাসে তুমি পাঠককে একটা "সময়ের মধ্যে বসিয়ে দিয়েছ...সময়ের নকশিকাঁথা গায়ে দিয়ে"(তোমার কথাই ধার করতে হল)। যে সময়ে সব মানুষই "সুখী গৃহকোণ" খুঁজে নিত না, হাসিমুখের ছদ্মবেশে স্বার্থের পুজো করত না। কারও কারও যাপন ছিল আদর্শে। কেউ কেউ বাঁচত দিন বদলের স্বপ্নচোখে। আরে দেখো দু'চোখ ভরে কল্লোলদা। আরো লেখো। অপেক্ষায় রইলাম। সুদীপ্ত বাগচী। 



‘ভাগ্যিস সে সময়ে জন্ম নিই নি’…। ঊর্ধ্বশ্বাসে ‘গোরা নকশাল’ পড়বার সময় ঠিক তাই মনে হয়েছিল। পড়তে পড়তে প্রতিটি চরিত্র, প্রতিটি সিন ভেসে উঠছিল চোখের সামনে। কখনো টুকনুর মধ্যে পড়াশোনার প্রতি অনীহাতে নিজেকে খুঁজে পেয়েছি, কখনো সেসময়ের পরিস্থিতির সম্মুখীন না হওয়ায় নিজের সৌভাগ্য মনে করেছি। তবে সত্যি বলতে পড়ার পর এক মন খারাপের দীর্ঘ নিঃশ্বাস ফেলেছি। তবুও বলব, গল্পটা পড়ে খুব ভালো লাগলো স্যার।‘ যারা ভালো উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে’। 
শবনম মুস্তাফি।

কল্লোলের 'গোরা নকশাল ' অগ্নিবীনায় উঠে পড়তে শুরু করেছিলাম, শেষ হল ঠিক আসানসোল ঢোকার মুখে, আমার স্ত্রী ওর ভাই এর লেখা বইটি অনেক কষ্টে মেয়েকে দিয়ে দেজ থেকে সংগ্রহ করেছিল, কারণ কলকাতা বইমেলায় এর সবকটি সংস্করণ ই শেষ হয়ে গেছিল, দেজ এও ছিল শেষ কপিটি ।এবার আসি লেখাটির কথায় , যত পাতা উল্টেছি মনটা ভারাক্রান্ত হয়েছে, কখন জানি চোখের কোনায় জল জমেছে, ছোট্ট বাচ্চা ছেলে টুকনুর চোখ দিয়ে দেখা ঘটনা পড়ে মনে হয়েছে গোরা নকশাল তার বিপ্লবের বীজ আজ থেকে বহু দিন আগে বপন করেছেন , আর কল্লোল তার লেখায় বর্তমান এই সময়ে আমাদের পাঠক দের আয়নার সামনে দাড় করিয়েছেন, যখন দেশের সম্পদের ৮০%কিছু পরিবারের করায়ত্ত, জনগনের কষ্টার্জিত পয়সা লুঠ করে বহাল তবিয়তে দেশ ছাড়া যায়, তখন আমরা ব্যস্ত মুঠোফোনে ঠাকুরের ছবি পোস্ট করতে । যখন আজকের গোরা নকশাল ছত্রিশগড়ের চিকিৎসক শৈবাল জানা রাষ্ট্রের পুলিশের হাতে বন্দি, তার দোষ তিনি সহায়সম্বলহীন মানুষ গুলির নিখরচায় চিকিৎসা দিতেন ।তাদের অধিকার বুঝে নেবার পাঠ দিতেন।এই সময় এই উপন্যাস লজ্জায় ফেললো, কারণ আমি ও তো এর বাইরে নই, ট্রেনে বাসে আজ যে মনের কথা আদানপ্রদান উঠে গেছে এক জাদু মন্ত্রে । সেই সময় কল্লোলের অসাধারণ লেখনী জানান দিল ১৩৮ নম্বর বেডে গোরা নকশাল শেষ হয়ে যায়নি। 
সঞ্জয় মুখার্জি। 
 


একটি সাদা পায়রা। উড়তে চাইছে। পাখা দুটি শূন্যে মেলেছে। মেলেছে ঠিকই কিন্তু পা কোথায় ? পায়রার পা খুঁজতে কী বোর্ডের সাথে আমার চশমার সংঘর্ষ হয়ে যায়।
আমি দেখি পায়রার পায়ের নীচে কালো জল । নাকি অসংখ্য কালো আইনের মৃত্যুজাল! কিম্বা নির্যাতনে ঢলে পড়া সেই তাদের শুকিয়ে যাওয়া রক্তকণা ! খরখরে। ক্রমশ উর্বর। বীজ বপনের প্রায়লগ্ন। এরকমই ত শুনেছিলাম সেই শিশুকালে। এক কিশোর নকশালের লাশ পুকুরের পাড়ে পেয়েছিলো যারা তারা তার পাদুটো খুঁজে পায়নিকো। তবু বলেছিলো, ভুলবো না
সায়ন কর ভৌমিকের এই প্রচ্ছদ আমাকে অনেকগুলো মাস সেই তাদের নিয়ে অনেক সত্যি গল্পে ভাসিয়ে নিয়ে যাচ্ছিল। সেই ! সেই তারা। যারা লাল লাল বই পড়ত । লুকিয়ে রাখত । আমার মা যেমন কোরাআন শরীফের লাল গেলাফের আচ্ছাদনে লুকিয়ে রেখেছিল কতগুল লাল বই! আমি বার বার প্রচ্ছদে পা খুঁজি । নকশালের পা। আমার মামাতো ভাই দুলাল সিকদারের ফর্সা ফেটে যাওয়া রক্তাক্ত পা। বংশধারা মেনে তার বাবা ছিল চেয়ারম্যান। মামা ছিল পাকিস্তান সেনাবাহিনীর কিছু তারা খচিত সেনা কর্মকর্তা। ভবিষ্যৎ বাঁধা ছিল সোনারূপার পুঞ্জিতে। পড়াশুনা শেষে তবু দুলাল নকশালই হলো। হা কপাল! কিম্বা ছিঃ । কেউ কেউ তবু বলে, লাল সেলাম। কমরেড। ফায়ার নাকি রিট্রিট ! অনেক পরে যখন ভেঙ্গেচুরে হারিয়ে যেতে বসেছিল নকশালরা, কমরেড দুলাল ফিরে এসেছিল। রিট্রিট। সে এক অন্য গল্প। আমি বড় হতে হতে ভেবেছি, ভাগ্যিস, এই ভুল পর্বের শেষ হলো। বেশ হলো। ওদের ভুলে আমরা ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছি। তবু মায়া লেগে থাকত ভুল কি শুদ্ধের জটিল হিসেবখাতায়। “গোরা নকশাল” সেই মায়াকে জাগিয়ে তুলেছে। বইটির প্রচ্ছদ কেবল দেখে গেছি । প্রচ্ছদ দেখে যে গল্পগুলো নিজেই বানিয়েছি তা বানাতে গিয়ে বুকের ভেতর খিঁচ ধরেছে বার বার। পায়রার পা দুটো যে দেখতে পাচ্ছি না ভালো করে। তবে কি উড়তে পারেনি পাখিটি ? কি সে আটকালো ? কে আটকে দিলো এই উড়াল ? নড়াইলের কোনো এক গ্রামের ইশকুলে রক্ষিবাহিনীর হাতে ধরা পড়ে বন্দি হয়েছিল কিছু নকশাল। নির্যতনের এক পর্যায়ে একজন কিশোর নকশাল রক্তাক্তমুখে রক্ষিবাহিনীর কম্যান্ডোকে বলেছিল, জয় হবেই। কোনো এক ভোরে সেই কিশোরের লাশ পাওয়া গেছিল এক পুকুরে। পাদুটো জলজ শ্যাওলা কাদা জলে ডোবা। কেউ কেউ বলে, পা ছিলনা। পা গেলো কোথায় ? ভাসতে ভাসতে সেই কথা আমাদের বাসায়ও পৌঁছে গেছিল। আমাদের বাসা তখন নকশালের বাসা নামে ব্রাত্য। আত্মীয়রা থুঃ ফেলে। ভয়ে , ঘৃণায়। খেলার মাঠে আমাকে কেউ “নকশালের বোন নাস্তিইইইইক” বললে আমি ধুমে মারামারি করি। গালি দিই। মার খাই। আবার মারি। কোথাও কি আমিও টুকনু ছিলাম ? বাংলাদেশে গুরুচণ্ডা৯র পাঠানো “গোরা নকশাল” বইটি সাথে সাথেই শেষ। ওরা সান্ত্বনা দেয়, অর্ডার গেছে ডজনখানেকের। আমার সাথে দুটি লিটল পত্রিকার দুজন সম্পাদক ছিল। ওরা জানে আমার বই খুঁজে পড়ার ইতিহাস। জটজলদি ওরাও দুটি “গোরা নকশাল” ধরে রাখার অর্ডার দিয়ে রাখল। ঘরে এসে হাঁটি , ঘুরি ফিরি , আমেরিকা থেকে ভাই সম্পাদনা শেখায়, ভয়ে ভয়ে শিখি। কিন্তু মন তো ভোলে না। গোরা নকশাল আমার চাইইই চাই। টুং করে বুকের ভেতর ভেসে ওঠে টুকনু। আরে আমিও তো টুকনুর বোন। ঠুলির সাথে পয়সা কুড়াতো ভাই। দিদি না হয় পিডিএফই কুড়াবে ! পড়তে পড়তে আমি কতবার কাঁদলাম। কাঁদলাম কারণ ইদানীং আমি নিজেকে বদলে নেবো ভেবে স্মৃতির গলিগুলো মুছে দিতে চাইছিলাম। চাইছিলাম সহজ সরল জীবনে কিছু গেরো ফেলে নিজেকে জটিলকুটিল করে তুলতে। পারলাম না।গোরা নকশাল পড়তে পড়তে মনে পড়ে গেলো, রাত দুপুরে পুলিশের উৎপাতের সেই ঘটনাগুলো। আমাকে চকোলেট টফি দিয়ে দাদা কোথায় জানানোর সেই নকল আদুরে চ্যাটচেটে প্রশ্নগুলো। কোরআন শরীফের লাল সাটিনের গেলাফ খুলে কতগুলো লাল বই বের করে পুলিশকাকুদের মুখব্যাদান, ছি ছি আপনারা দেখি একেবারেই নাস্তিক! পবিত্র কোরাআনের সাথে কেউ এই বই রাখে! তওবা তওবা ! আমি আজোও জানিনা ওজনদার একটি পিস্তল মা কেমন করে কখন, পুলিশের সার্চ করে রাখা আমার পুতুলের বাক্সে লুকিয়ে ফেলেছিল। কল্লোল লাহিড়ীর গোরা নকশাল পড়তে পড়তে মনে হলো, এক অন্তর্ভেদি সময়ের অন্ধ গলিতে দাঁড়িয়ে অঙ্কুরোদগমের উষ্ণ শব্দধ্বনি শুনতে পেলাম। আচ্ছে আছে। রক্তবীজের ঝাড় নিঃশেষ হয়নিকো। সময়ের কাঁটা ঠিকঠিক মিলে গেলেই লেখকের গোরা নকশাল আমার দুলালদা হয়ে, মেধাবী সুশান্ত নড়াইলের নাম না জানা কিশোর হয়ে ভেসে আসবেই।গেলো বিকেলে "বাংলাদেশের নকশাল আন্দোলনের নারী" বইটি পড়ছিলাম। শিউরে উঠছিলাম সাতাশ নম্বর বেঙ্গলের ঠান্ডা পাঠকক্ষে। যারা কবরে গিয়েছে,আগুনে পুড়েছে, যারা নিজেকে সজ্ঞানে হারিয়ে লুকিয়ে আছে সময়ের আড়াল আবডালে, দেশে বিদেশের সেই সব নকশালদের লাল সেলাম। ভুল কি শুদ্ধ আজও জানিনা। শুধু জানি, মানুষকে ভালোবেসে ওরা লড়েছিলো। দিতে চেয়েছিল এক অভিন্ন সাম্যভূমি।কল্লোল লাহিড়ীর বইটি উড়ুক। ভাসুক।আমার বাপি লিখেছিলেন, -- সুকান্ত সে দামাল ছেলে পথ হারিয়ে ফেরে, মরল ছেলে কাদের তরে কে বলো তা জানে!” আমার মা প্রতিবাদ করেছিলেন, পথ কেনো হারাবে ? আর কাদের জন্যে ছেলেরা মরল একদিন ঠিকই পৃথিবী জানবে। তুমি হতাশ কবিতা লিখো না তো ! লেখক এক দিয়া জ্বালিয়ে দিলো। পথ দীর্ঘ। সময় অনন্ত। আর পৃথিবী বৃত্তাকার। কিছুই হারায় না। তাই গোরা নকশালরা ফিরে ফিরে আসে। আসবেই। তাদের আনার জন্যে রয়েছেন, কল্লোল লাহিড়ী , প্রকাশক গুরুচন্ডা৯ আর কিছু মায়াময় মানুষ। ধন্যবাদ সবাইকে। 
রুকসানা কাজল। 

গোরা নকশালের সঙ্গে আমার প্রথম পরিচয় বেশ কয়েক বছর আগে, কল্লোলের ব্লগের কোনোও একটা কিস্তিতে। দুয়েকটা কিস্তি পড়েছিলাম। তারপরে যা হয়... ধারাবাহিক সবসময়ে মনে রেখে রেখে পড়াও যায়না; আর যে গল্পে কোনো টান টান উত্তেজনা নেই, রহস্য নেই, রোমাঞ্চ নেই, বরং পড়লে কেন জানি না সাদা কালো কিছু দেখা, কিছু না দেখা ছবির দুখী মন্তাজ চোখের সামনে ঘোরে, সেই গল্পকে খুঁজে পেতে ফিরে পড়তে যাওয়া আর হয়ে ওঠেনি। তারপরে একদিন জানলাম সেই ছোট উপন্যাস লেখা শেষ ও হয়ে গেছে। কল্লোল বলল, ব্লগে পড়ে নিতে পারিস। কিন্তু তখনও পড়া হল না। অবশেষ ২০১৭ এর নভেম্বরে ( বেশিদিন না, মাত্র মাস চারেক আগে) একদিন জানলাম গোরা নকশাল বই হয়ে এসে গেছে। তারপরে একদিন সেই ছোট্ট লাল মলাটের বইটাতে একখানা সই দিয়ে সেই বইয়ের এক কপি আমাকে উপহার দিল কল্লোল। সেই বইয়ের পেছনের বিষয় পরিচিতিতে লেখা ...' এক রম্য দুপুরের রোদে পিঠ ঠেকিয়ে এক নিঃশ্বাসে এই ছোট উপন্যাসটি পড়ে ফেলা সম্ভব নয়।ভাগ্যিস নয় ! " এই বাক্য পড়ার পরে সারা শীত কেটে গেল, কত দুপুরের রোদ এল-গেলো, কিন্তু আমি সাহস করে হঠাৎ যখন ইচ্ছে হল, তখনই বইটা পড়ে ফেলতে পারিনি। তার জন্য আমার দৈনন্দিন ব্যস্ততা যতটা দায়ী, ততটাই জরুরী ছিল নিজেকে এই পাঠের জন্য প্রস্তুত করাঘিঞ্জি চটকল শহর বালীর একটা ছোট্ট আধো অন্ধকার বাড়ির বাসিন্দা বছর সাত-আটেকের ছেলে টুকনু। আদর্শবাদী স্কুল শিক্ষক বাবা, নুন আনতে পান্তার ফুরানোয় ব্যতিব্যস্ত মা, টোটকা বিধান দেওয়া বিধবা পিসি, দেশের জন্য কাতর ঠাকুমা, ক্লাসে ফার্স্ট হওয়া দাদা, ঈষৎ প্রতিবন্ধী কাকা আর কাকার পোষা পায়রা নকশাল- এদেরকে নিয়েই জিটিরোড আর গঙ্গানদীর উজানভাঁটার মধ্যে , কয়লার ধোঁয়া আর শীতের লেপ কম্বলে জড়িয়ে মড়িয়ে, চায়ে বিস্কুট ডুবিয়ে খেয়ে, দিব্যি দিন কাটাচ্ছিল টুকনু। তার পড়াশোনার নিয়মানুবর্তীতার মাপকাঠি তার টিনের বাক্সে নকশালের সবুজ হাগু। তার বন্ধু শ্মশানে পয়সা কুড়িয়ে বেড়ানো ঠুলি। এমন আপাত রোমাঞ্চকর থোড়-বড়ি-খাড়া জীবনে একদিন আবির্ভূত হল গোরা নকশাল। সে জেল থেকে ছাড়া পেয়ে ফিরে এসেছে; তার পায়ে মেরে হাড় গুঁড়িয়ে দিয়েছে পুলিশ, তাই সে সোজা হাঁটতে পারে না। সে সম্পর্কে টুকনুর কাকা হয়। তার ঘরে অনেক বই, অনেক রাত অবধি তার গঙ্গার ধারের ঘরের জানালায় আলো জ্বলে; সে সকালে পাখিদের আটার গুলি মেখে খাওয়ায়। গোরা নকশালকে সবাই আলাদা যত্ন করে, ভালোবাসে; গোরা টুকনুকে ভালোবাসে। আর টুকনু? না, এই ছোট উপন্যাসটি গোরা নকশালের সঙ্গে টুকনুর সম্পর্ক গড়ে ওঠার বা টানাপোড়েনের কাহিনি বয়ান করে না। এই কাহিনি টুকনুর পরিবারের চরিত্রদের জীবনের চড়াই-উৎরাইয়ের মেলোড্রামাও নয়। আর না, এই উপন্যাস কোনোওমতেই নকশাল আন্দোলন কিংবা সেই আন্দোলনের সঙ্গে জড়িত কোনোও একজন চরিত্রকে নিয়ে বীরগাথা নয়। 'গোরা নকশাল' একটা সময়ের কাহিনি। ভাষার আলগা কিন্তু দৃঢ় বুননে, ছোট ছোট দৃশ্যকল্পের মাধ্যমে কল্লোল আমাদের সামনে সেই সময়কে সফল ভাবে তুলে আনতে সক্ষম হয়েছেন। সত্তর দশকের শেষ থেকে আশির দশকের শুরু দিকের মধ্যবিত্ত মফস্বলী দিনযাপন, বিবিধ ঘটনা পরম্পরায় শ্রমিক রাজনীতি এবং পশ্চিমবঙ্গের রাজনৈতিক পট পরিবর্তন - খুবই সাবলীল ভাবে উঠে এসেছে কল্লোলের লেখায়। সত্তরের দশকের মাঝামাঝি আমাদের জন্ম। স্বাভাবিকভাবেই নকশালবাড়ি আন্দোলন সম্পর্কে আমার অন্তত, যাবতীয় জ্ঞানগম্যি বইপত্র পড়ে বা সিনেমা থিয়েটার দেখে। গোরা উদবাস্তু, রোটি-কপড়া-মকানের নিশ্চয়তা নেই, তবুও সে নকশাল কেন - এ মর্মে দুই কর্তব্যরত পুলিশ তাকে মারতে মারতে মন্তব্য করেছিল। হয়ত সেই রোটি-কপড়া-মকান নিশ্চিত করার তাগিদেই আমার উদবাস্তু পূর্বপুরুষেরা এবং পূর্বনারীরা নিজেদের যেকোনো রকমের সক্রিয় রাজনীতি থেকেই দূরে রেখেছিলেন। শহর কলকাতা থেকে বহুদূরের এক শিল্প-শহরে মোটামুটি নির্বিবাদে বড় হয়ে ওঠার সময়ে 'ইনকিলাব জিন্দাবাদ', লাল পতাকায় সাদা কাস্তে-হাতুড়ি-তারা, আর মে দিবস অমর হোক শুনতে অভ্যস্ত থাকলেও, 'নকশাল' শব্দটার সঙ্গে প্রথম পরিচিত হয়েছিলাম বাবা-মায়ের চোখ এড়িয়ে দেশে প্রকাশিত ধারাবাহিক 'পূর্ব-পশ্চিম' পড়তে গিয়ে। মোটামুটি সেই একই সময়ে, আমারই সমবয়সী টুকনু ,এক অন্য জগতের অংশ ছিল। আমার এবং আমার মত আরোও অনেকেরই অদেখা, অজানা সেই দেশ-কালের একটা টুকরোকে প্রায় চার দশক পরে ফিরিয়ে দিতে পেরেছেন কল্লোল। সময় নিয়ে, যত্ন করে এমন এক আখ্যান আমাদের উপহার দেওয়ার জন্য কল্লোলকে ধন্যবাদ। এখানে এ কথাও স্বীকার করতে বাধা নেই, যে লেখক কল্লোল না হলে 'গোরা নকশাল' - এমন নামের কোনো বই আমি নিজে থেকে কিনতাম কি না কে জানে। বইটা শেষ করার পর, আবারও একবার, আমাদের সার্বিক অতীতের জন্য মন খারাপ হয়েছে। আমাদের ঝাঁ চকচকে , চরম দ্রুতগতির জীবন রোজ শেখায় অতীতের ঠিক ভুল নিয়ে স্বপ্নবিলাসের সময় নেই, শুধুই সবাইকে পেছনে ফেলে একলা এগিয়ে যেতে হবে। তবুও এই লাল মলাটের ৬৪ পাতার ছোট বইটা হয়ত কয়েক মূহুর্তের জন্য থমকে দাঁড় করিয়ে দিতে পারে, কিংবা গতি কমিয়ে অন্য আরোও অনেকের সঙ্গে হাঁটার কথা ভাবাতে পারে। কল্লোলের কলম স্বাভাবিকভাবেই তার পড়াশোনার জগৎ এবং পেশাকে প্রতিফলিত করে। তাই আমার কাছে এই বইটা পড়াটা অনেকটা ছোটবেলায় রবিবারের দুপুরে দিল্লি দূরদর্শন থেকে দেখানো রাষ্ট্রীয় পুরষ্কারপ্রাপ্ত বিবিধ ছবি দেখার অনুভূতিকে ফিরিয়ে আনে। কল্লোলের 'গোরা নকশাল'কে আমি এক সিনেম্যাটিক সৃজন বলতেই পারি। আমার পড়তে পড়তে মনে হয়েছে এই কাহিনির ওপর নির্ভর করে খুব ভালো একটা ছোট ছবি বানানো সম্ভব।বইটা প্রকাশিত হয়েছে গুরুচন্ডা৯-এর বাংলা চটি সিরিজে। আর বইটিকে প্রকাশ করার আংশিক আর্থিক দায়িত্ব নিয়েছে প্রসূন দে। এই শেষের ব্যাপারটি খুবই ভালো। নতুন লেখকদের উৎসাহিত করবে এই ধরনের আরও উদ্যোগ।
প্রচ্ছদ করেছেন সায়ন কর ভৌমিক। রক্ত লাল রঙা প্রেক্ষাপটে ডানা মেলেছে সাদা এক পায়রা। সেই পায়রার টাইটেল নকশাল। দুনিয়ার সব সাদা পায়রাদের পদবীই কি 'নকশাল' হয়? এই প্রশ্নের উত্তর সম্ভবত কেবলমাত্র হাওয়ায় ভাসে । 
মহাশ্বেতা রায়। 

আজকে কয়েকদিন হলো এক অদ্ভুত যোগাযোগে তিনটি বই এক সাথে হাতে এসে পড়েছে-cheর diary, সোমনাথ হোরের tebhaga sketches আর আমার বন্ধুর লেখা বই গোরা নকশাল। প্রথম দুটি বইয়ের মতোই পড়তে পড়তে নামিয়ে রাখা শক্ত কল্লোলের গোরা নকশাল। পশ্চিম ভারতের (আমি থাকি) শুকনো মাটিতে কখন যে দু এক ফোঁটা জল চোখের কোন গড়িয়ে পড়েছে ও কখন গলার কাছে চাপা একটি কি জানি -হতাশা, রাগ, দুঃখ, জমা হয়েছে খেয়াল করি নি। বইটা মনে করিয়ে দিচ্ছে জয়া মিত্রের লেখা হন্যমান পরে হওয়া মনের অবস্থা। দু দিন ঘুমোতে পারি নি, না খেতে। ঠিক এমনি এক দুপুরে, দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধের পটভূমিকায় ছোট্টো মেয়ের গল্প নিয়ে এনিমেশন ছবি grave of the fire flies মনের মধ্যে প্লাবন এনেছিল। যেমন বার বার হয় ঋত্বিকের সুবর্ণরেখা দেখে। তবে কি সব স্বপ্ন এই ভাবে একদিন ভেঙে যায়। কি জানি। মনে হয় যতদিন কল্লোলের টুকনু বা ঠুলিরা পতাকা তুলে নেবে স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে, ততদিন স্বপ্ননেরা বেঁচে থাকবে পৃথিবীর কোনায় কোনায়।দ্বিতীয় সাহসী উপাখ্যানের অপেক্ষায় থাকলাম বন্ধু কল্লোল। 
সুধন্যা দাশগুপ্ত


একজন লেখক যখন তাঁর ভাবনার কেন্দ্রে সচেতন কর্তব্যবোধ ও সামাজিক দায়বদ্ধতাকে ভিত্তি হিসাবে স্থাপন করেন তখন সহৃদয় পাঠকের উপরেও তা পাঠ করার দায় থেকে যায়।লেখকও কিন্তু তাঁর নিজস্ব দায়বদ্ধতা-র সঙ্গে পাঠকের মননকে যুক্ত করে নেন পাঠকেরই অগোচরে আর তখনই সেই ভাবনামূলক সৃষ্টিটি হয়ে ওঠে হৃদয়গ্রাহী।কল্লোল লাহিড়ীর "গোরা নকশাল" এরকমই একটি সৃষ্টি। গোরা নকশাল ওপার থেকে জনস্রোতে ভেসে আসা"পিঠে কাঁটা তারের দাগ" আঁকা এক উদ্বাস্তু যার চোখে স্বপ্ন ছিল দিন বদলের—"গোরা নকশাল হোঁচট খেয়ে পড়ে যেত বারবার।কিছুতেই পেরোতে পারত না অন্ধকার সেই মাঠটা যে মাঠটার উল্টো দিকেই আস্তে আস্তে ভোরের আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে ।ওখান থেকেই দিনের আগুনরঙা সূর্য উঠবে।"
রাজনৈতিক আবর্তে পাঠককে ঘুরপাক খাওয়ানো নয় ,সমাজ-রাজনীতি-অর্থনীতির অবিচ্ছেদ্য মেলবন্ধনে জীবন্ত দলিল রচনা করাই কল্লোল লাহিড়ীর উদ্দেশ্য এবং তিনি নিঃসন্দেহে সেই উদ্দেশ্য পালনে সক্ষম হয়েছেন।বইটির সহজ সরল অনাবিল ভাষায় ও খন্ডবাক্যের ঝর্ণা ধারায় পাঠককে বারংবার স্নাত হতে হয়।জারিত হতে হয় জীবনরসে যে জীবন টানাপোড়েনের নিখুঁত বুনোটে গাঁথা।ফলে সময়ের অন্ধকার ডালপালা সরিয়ে চুপি চুপি উঠে আসে মানুষের কাহিনী—জীবনের কাহিনী—গোরা নকশালের কাহিনী।কে এই গোরা নকশাল?সে কি রাজনীতির তকমা আঁটা বিশেষ কোন মানুষ? না কি সারা বিশ্বের সব বুভুক্ষদের উদ্বাস্তুদের প্রতিনিধি?না কি টুকনুর কাকা হাঁদার পোষা পায়রা? চলুন না পাতা উল্টে দেখি—"হাঁদার একটা পোষা পায়রা আছে ।তার নাম নকশাল।হাঁদা বাঁশ দিয়ে হই হই করে সেই পায়রাটকে ওড়ায়।হাঁদার খুব দুঃখ আমাদের বাড়ির ছাদ নেই।মানে ছাদে যাবার অনুমতি দেয়নি বাড়িওয়ালা।কিন্তু নকশাল ছাদে যায়।নকশাল রেলিংয়ে বসে।নকশাল মনের সুখে রোদ পোহায়।....... দাদা আমার দিকে তাকিয়ে বলে— নকশাল হল তারা যারা মনে করতো একদিন সব কিছু পালটে দেবে।
আমি ঠোঁট ওল্টাই—এই ঘেঁচু।কিচ্ছু জানিস না তুই।আসলে ওটা পায়রাদের টাইটেল।যারা ভালো উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে।দেখিস না হাঁদার নকশালকে?"এক অদ্ভুত মায়াবী প্রতীকী ব্যঞ্জনায় পাঠকের অনুভূতিতে ও চোখের জলে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে গোরা নকশাল।লেখক কেমন করে যেন জাদুবলে আমাদের দিয়ে পড়িয়ে নেন বইটি।
 
শম্পা চক্রবর্তী।

এই বইমেলায় গুরুর স্টল থেকে সংগ্রহ করা গেল কল্লোল লাহিড়ীর লেখা “গোরা নকশাল”। ৬৪ পৃষ্ঠার চটি বই , কিন্তু নখদাঁত বের করা ,তীক্ষ্ণ কাঁটায় ভরা লেখাটি পড়ার আগে কেউ যদি আশা করেন যে “গোরা নকশাল” এক প্রাক্তন নকশালের জেলজীবনের অত্যাচার সহ্য করার বা বিপ্লবী প্রেমের রোগা ও রোমান্টিক গল্প , বা মাও-এর সেই অমোঘ উক্তিকে কলা দেখিয়ে কোনো শ্বেতাঙ্গ মাওবাদীকে নিয়ে কোনও পুলিৎজার প্রার্থী সাংবাদিকের লেখা ভোজসভা বা সূচিশিল্প টাইপের সুশীল প্রবন্ধ রচনা তাহলে তিনি বেশ হতাশই হবেন। অথচ আখ্যানভাগে সে সুযোগ ছিল। আর লেখক যেহেতু ফিল্মশিক্ষিত তাই সে সুযোগকে দিব্যি কাজে লাগিয়ে নিজের বাল্য অভিজ্ঞতা আর স্ক্রিপ্ট রাইটিং স্কিল মিশিয়ে এক ঝকঝকে বাজারখাদ্য কোলাজসমৃদ্ধ রঙ্গীণ প্রোডাক্ট সৃষ্টি করতে পারতেন। লেখককে আর গুরুচন্ডালি প্রকাশনা কে অনেক ধন্যবাদ যে , সেরকম আতা গাছে তোতা টাইপ বই এটা নয়। এ বইয়ে বারুদ আছে। এই বই পড়তে পড়তে নিজেকে পুকুরে ছোঁড়া একখানা ঢিল ভেবে তলিয়ে যাওয়াই পাঠকের পক্ষে ভাল আর সেই পুকুরে তলিয়ে যেতে যেতে ব্যাঙাচির ঝাঁক, ঘোলা জলে জন্মানো রাজ্যের শ্যাওলা আর গেঁড়িগুগলিতে ডুবতে ডুবতে পাঠকের গায়ে ধাক্কা দেবে পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হওয়া ভাল ছাত্র তরুণ সুশান্ত’র জলে ডোবা, খোবলানো লাশ। তারপর এই লাশ একপাশে সরিয়ে রেখে চিলছাদে বসে ঘুড়ি, এরোপ্লেন, ঝড়বৃষ্টি, ঝুলঝাড়ু, মানুষ, পায়রা দেখতে অভ্যস্ত হয়ে যাওয়া। তারপর যেমন নবারুণের হারবার্টে পড়েছে পাঠক ‘অথচ শত শত বছর ধরে চাঁদের আলোয় বা শীতের ভোরে কুয়াশায় তার প্রেম নিয়ে খোড়োরবি ঐ মরণজলে ভেসে থাকবে। তাকে ঘিরে মৎস্যকন্যারা ওলটপালট করবে যারা কাঁদলেও তাদের চোখের জল কেউ দেখতে পাবে না।’ আখ্যানটি শুরু হচ্ছে প্রোটাগনিস্ট টুকনুর ছেলেবেলা থেকে।এক উদ্বাস্তু পরিবারের চেনা ছবি দিয়ে যা মোড়া । মফস্বলের বাসাবাড়ি, রিলিফ ক্যাম্প, ডুমুর গাছ, পাতকুয়ো , তার মাঝখানে সে একদিন লেপকাথা জড়িয়ে দুম করে খাট থেকে পড়ে মাথা ফাটায়। যখন জ্ঞান ফেরে সে দেখে শাদা রঙের পাঞ্জাবী , যা তাঁর রক্তেই লাল হয়ে গেছে , পরা একটা ফর্সা লোক কোঁকড়ানো দাড়ির ফাঁক দিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে হাসছে। টুকনুর বাবা বলেন “গোরা চা খেয়ে যাস।“ সেই গোরা নকশাল। ছোট্ট টুকনুর এই জেল খাটা কাকাটিই শেষে তার কানে দিয়ে দিলেন ফুস মন্তর , যার ফল এই বই  গোরা নকশাল। টুকনুর ছোটকা হাঁদা'র পোষা পায়রাটির নাম আবার নকশাল । ওই পায়রাটাকে কিভাবে জব্দ করা যায় সে ভাবনায় টুকনু কাহিল । সে দাদাকে জিগেস করে নকশাল মানে কি সেই পায়রা ? দাদা টুকনুর দিকে তাকিয়ে বলে “ নকশাল হল তারা , যারা মনে করত একদিন সবকিছু পালটে দেবে।এইখানে চটাপট তালি পড়া উচিৎ ছিল চিত্রনাট্যে । কল্লোল সেটা পড়তে দেন নি , বরং নৈর্ব্যাক্তিক দক্ষতায় কাহিনী এগিয়ে নিয়ে গেছেন । এর পর ছোটকা হাঁদা ওকে বলেছিল “ যারা উড়তে পারে তারা নকশাল” । যারা উড়তে পারে, তারা নকু না, খিল্লিখোরাক না , তারা নকশাল। এটাই এক বীজমন্ত্রের মত টুকনুর মাথায় সেই পুঁতে দিলেন গোরা নকশাল। শান্তির অহিংস পারাবতের নাম নকশাল- হা হা হা , এইএন্টি-থিসিসটি পাঠকের গালে কল্লোলের এক মোক্ষম বিরাশি সিক্কার থাপ্পড়। অতঃপর আমরা এক রক্তাক্ত জীবনগল্পের পিছনে দৌড়তে বাধ্য হই। এ এমনই এক গল্প যা থেকে নিজেকে বিযুক্ত রাখা যায় না। ক্রমশ যেন আমরাই দগ্ধ হতে হতে রক্তাক্ত হয়ে থাকি। পুলিশের মারে মাংস খোবলানো হাত ,জখম পায়ে খুঁড়িয়ে হাঁটা গোরা নকশাল এমনই এক জীবন বদলে যাওয়ার ইতিহাস, ক্ষোভের, ক্ষুব্ধতার ইতিহাস রচনা করতে থাকেন আমাদের চোখের সামনে। অনাগত শিশু আনন্দীর পিতা তরুন প্রিয়াংশুর চোখ খুবলে নিয়েছে পুলিশ , আর তারপর গুলিতে তার খুলি ছিটকে গেছে , চটকলের ধর্মঘট, কারখানার নেতা বুড়ো বিহারী খুন হয় আর গোরা নামের মানুষটি শেষতক আমাদেরকে রক্তাক্ত করতে করতে শেষে হাসপাতালে টিবি রুগী হয়ে মরে যেতে বাধ্য হয়। মানুষ আর মানুষ থাকে না; সে নিজেকে এমন এক স্যাঁতলা ধরা জোছনায় নিজেকে মেলে ধরে যাতে সেই জোছনায় আমরা পুড়ে যাই, ছাই হতে হতে যেন আবারও নিজেকে খানিক দেখার বাসনা হয়। হতাশার ভিতর দাঁড়াতে দাঁড়াতে আমরা রক্তাক্ত হই। অন্ধ ভিক্ষুকের মত একটা দশককে , সেই সত্তরের দশককে, আমরা মুক্তির দশক মনে করি।আমরা ভারতের বুকে শুনি বসন্তের নির্ঘোষ, উঠতে দেখি সকাল আটটা-নটার সূর্য্যকে। আমরা হয়ত গোরা নকশালের জন্য অপেক্ষাও করি। অথচ কী এক ঘুর্ণিচক্রে কেবল ঘুরতে থাকি। আমরা একসময় পার করছি বটে! এ তো আখ্যান নয় যেন নিজেকে এক রক্তময় এপিটাফের মাঝখানে দাঁড় করিয়ে দেয়ার আয়োজন। গোরা নকশাল কে পাঠক বারবার তুলনা করবেন নবারুণের "যুদ্ধ পরিস্থিতি" উপন্যাসের নায়ক রণজয়ের সংগে।দুজনেই বস্তুত বিপ্লবী আকাঙ্ক্ষার এক এক এমবডিমেন্ট । রণজয়ের চেতনায় ভিড় করে ছিল আছে চিরকাল থাকবে রুশ বিপ্লব চিন বিপ্লব মার্কিন আগ্রাসন ও নাপাম বোমার মুখে ভিয়েতনামের প্রতিবাদী প্রতিরোধ ফ্যাসিবাদবিরোধী লড়াই বা নকশালবাড়ির বিপ্লবী কর্মকাণ্ড ও চারু মজুমদার। ভিড় করে আছে অসংখ্য সহযোদ্ধা কমরেড যারা স্বপ্ন দেখেছে, লড়াই করেছে, অত্যাচারিত হয়েছে, শহিদ হয়েছে বারাসাতে, বেলেঘাটায়, বরানগরে, কাশীপুরে, সন্তোষপুরে, মেদিনীপুরে, মুর্শিদাবাদে পুলিশ লক আপে ময়দানে দিনের আলোয় বা রাতের অন্ধকারে। "যুদ্ধ পরিস্থিতি" উপন্যাসে পাঠক দেখেছিলেন একটানা কোনো কাহিনি নেই। আছে রণজয় ও তার কাছাকাছি থাকা কিছু মানুষের জীবনের টুকরো টুকরো কিছু কথা। রণজয়-এর মধ্য দিয়ে একটি যুদ্ধ পরিস্থিতিকেই আসলে নবারুণ সামনে এনেছেন। নকশালবাড়ি আন্দোলন এই যুদ্ধ পরিস্থিতির কেন্দ্রে কিন্তু তাকে ঘিরে আছে আরো আরো যুদ্ধ পরিস্থিতি যার কোনোটা রাশিয়ার পেট্রোগ্রাডে কোনোটা চিনের লং মার্চে কোনোটা ভিয়েতনামে মার্কিন আগ্রাসনের বিরুদ্ধে আবার কোনোটা স্পেনে ফ্রাঙ্কোর ফ্যাসিবাদী হামলার বিরুদ্ধে বা কোনোটা নাৎসি আগ্রাসনের বিরুদ্ধে চলমান।আর গোরা নকশাল টুকনুর চুল এলমেলো করে দিতে দিতে বলে কয়েকটা লাইন, “ বিজয়ের পথে এগিয়ে চল! স্বদেশ অথবা মৃত্যু! সবটুকু বিপ্লবী উষ্ণতা দিয়ে আলিঙ্গন করছি তোমাকে!” সে চে গুয়েভারার ছবি দেখিয়ে বলে “ এই লোকটাকে চিনে রাখ টুকনু। এই লোকটা একদিন সব পালটে দেবে বলেছিল। সবাইকে পালটে দেবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল।“ আর তাঁর পর গোরা নকশাল চুপ হয়ে যায় ।কাশির দমকে যখন রক্ত উঠছে , রোগশয্যায় শুয়ে গোরা টুকনু কে বলছে “ এই বইটা পড়েছিস ?” বইটার নাম গ্যাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজের “চিলিতে গোপনে”। পাঠকের তখন মনে পড়তে বাধ্য নবারুনের উপন্যাস “যুদ্ধ পরিস্থিতি” র নায়ক রণজয় ও তাঁর তরুণ প্রটেজে কৌশিকের কথা, যে রণজয় কৌশিককে একটার পর একটা বই পড়তে দিত। ঘন্টার পর ঘন্টা ওকে যুদ্ধের গল্প শোনাত - স্তালিনগ্রাদ , লং মার্চ , ভিয়েতনাম কিউবার মুক্তিযুদ্ধের গল্প । মনে পড়বে কৌশিকের কেন বহুদিন পর মনে হয়েছিল রণজয়দার সই করা একটা বই নিয়ে গিয়ে বলবে যে বইটা চিনতে পারছে কিনা। যেমন, ভিলহেলম লিবনেখত এর ‘অন দা পলিটিকাল পোজিশন অফ সোশ্যাল ডেমোক্র্যাসি’ বা কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়ের অনুবাদে ক্লারা সেৎকিন-আমার স্মৃতিতে লেনিন অথবা রিডার্স গাইড টু দা মার্কসিস্ট ক্লাসিকস -মরিস কনফোর্থের -লরেন্স অ্যান্ড উইশার্ট লিমিটেড, ১৯৫৩ বা গিওর্গি দিমিত্রভের ইউনাইটেড ফ্রন্ট অব দা ওয়ার্কিং ক্লাস এগেন্সট ফ্যাসিজম।আহা সেই লিস্টটিও যেন ঝলসে উঠবে পাঠকের স্মৃতিতে। মনে পড়বে যুদ্ধ পরিস্থিতির মোকাবিলার এক বিরাট পাঠ-প্রস্তুতির তালিকা হাজির করেছিলেন নবারুণ। ছেলে কোবা পড়বে এ সব বই প্রস্তুত হবে আগামী এক যুদ্ধ পরিস্থিতির জন্য এমনই ভাবে রণজয়- কোবা বড় হয়ে দুনিয়া কাঁপানো দশদিন পড়বে। ধীরে বহে ডন, সাগরে মিলায়ে ডন পড়বে। পড়বে ডাইসন কার্তার এর সোভিয়েত বিজ্ঞান, লিও কিয়াচেলি নতুন দিনের আল্ ডিয়ানা লেভিন এর সোভিয়েত রাশিয়ার শিক্ষাব্যবস্থা, দিলীপকুমার মুখোপাধ্যায় সম্পাদিত ছোটদের সোভিয়েত, তিন খণ্ডে অমল দাশগুপ্ত, রবীন্দ্র মজুমদার ও অনিল কুমার সিংহের অনুবাদে পারীর পত্ লু সুন, লাও চাও, তিৎ লিঙ ও অন্যান্য পাঁচজনের লেখা এগারোটি গল্প, নীহার দাশগুপ্তের অনুবাদে গোর্কির নবজাতক। আর পাঠক ভেবে পাবে না সর্বকালের সকল রণজয় বা গোরা নকশালরাই পরবর্তী প্রজন্মের উত্তরসুরির হাতে কেন তুলে যেতে চেয়েছে আর কিছু নয়, শুধু কয়েকটা বই? এই ক্ষুদ্র বইটির এক সম্পদ হচ্ছে এর ভাষা। ভাষার সৃজনকর্ম কখন প্রিয় হয়, তা তো একটু গভীরভাবে ভেবে দেখার বিষয়। এই যে প্রিয়তা এর কি বস্তুগত কোনো রূপ আছে? এর কি অবয়ব থাকতে নেই! এটি কি নিরাকার ঈশ্বরের মতো কোনো বিষয়? নাকি তার বায়বীয়তা একটা অবস্থানকেই কেবল রিপ্রেজেন্ট করে? না কোনো প্রিয়তাই অদৃশ্য কোনো বিষয় হয় না। এর আকার প্রকার, দৈর্ঘ-প্রস্থ, মান-ইজ্জত, সহনীয়তা, অসহনীয়তা- সবই আছে। সে রকমই এক নির্ভার জ্যান্ত ভাষা কল্লোল ব্যাবহার করেছেন সচেতন ভাবে। কখনো টুকনুর মুখে , কখনো বা তৃতীয় পুরুষ গোরা নকশালের মুখে। টুকনু ছোট থেকে বড়ো হয়েছে , কৈশোর পেরিয়ে পরিণত হয়েছে আর ওর ভাবনার ভাষা পালটেছে তরতর করে । ঠাকুমা , দাদা, মণি, ঠুলি, হরি মিত্র ,মিছিলের মানুষেরা,পাঁচুর মা, তাঁদের উল্লাস, যন্ত্রণা, ক্ষুব্ধতা, শঠতা তাঁদের মুখ থেকে কেড়ে নিয়ে বসানো হয়েছে লেখায় । যখন গোরা বলে “ মনে রাখিস টুকনু , যারা প্রতিবাদের কথা বলে , যারা প্রাপ্য চাহিদার কথা বলে, যারা বলে ফিরিয়ে দাও আমাদের অধিকার, আমাদের স্বাধীনতা , আমাদের দুবেলা দু মুঠো অন্নের অধিকার, তাদের প্রতিবার , প্রতি জনসমুদ্রে এইভাবেই ভাসিয়ে দেওয়া হয় ।“- তখনও কথাগুলো থিয়েটারি রেটোরিক হয়ে ওঠে না, কারন এক অদ্ভুত খাঁটি বিশ্বাসের সঙ্গে কল্লোল কথাগুলো বলতে পারেন। তাই আমার মনে হয় পঞ্চাশ বছর পরেও , যদি নকশাল আন্দোলনের ব্যর্থ বিপ্লব ও চুরমার হওয়া স্বপ্ন নিয়ে কোনো অথেন্টিক সাহিত্যিক কুলুজী তৈরি করার কথা ওঠে , তাহলে সেই সময় এই কৃশকায় বইটিরও খোঁজ পড়বেই পড়বে। 
পার্থপ্রতিম সেনগুপ্ত



বইমেলা থেকে কেনা বইগুলির মধ্যে প্রথম পড়লাম কল্লোল লাহিড়ীর "গোরা নকশাল"। পড়ে প্রথম যেটা করলাম সেটা আমি খুব কম করেছি ফেসবুকে। কল্লোল বাবুকে বন্ধুতার আমন্ত্রণ পাঠালাম।আর কী আশ্চর্য তিনি সেটি গ্রহণও করে নিলেন। কেমন একটা ঘোর লাগলো লেখাটি পড়ে। নক্সাল আন্দোলন যারা একেবারে কাছ থেকে দেখেছেন, আমি তার মধ্যে একজন। সেই উত্তাল সত্তরে আমি সবে কুড়ি। গোরা নক্সালকে আমরা যার চোখ দিয়ে দেখলাম, গল্প শুনলাম সেই টুকনু র সংগে আমার বয়েসের তফাৎ অনেক। সে গোরা নকশালকে দেখেছে আশীর দশকে। আমি এইরকম অনেক গোরা নক্সালদের সামনে থেকে দেখেছি। একেবারে শুরু থেকে দেখেছি তাদের। শেষও হয়ে যেতে দেখেছি। কেউ সেই সময়েই। কেউ অনেক পরে।এত সুন্দর গদ্য লেখেন কল্লোল!! কী আছে এই ছোট উপন্যাসে? আছে এমন অনেক কিছু যা ইতিপুর্বে আমরা পড়ি নি। টুকনু দেখছে একটা লোক জেল থেকে ফিরছে। সম্ভবত সাতাত্তর সালে। লোকটাকে সবাই শ্রদ্ধার চোখে দেখে। ইচ্ছাকৃত ভাবে কেমন নিরাসক্ত ভাবে লেখা অথচ গভীর, দৃঢ়।লোকটি তার বাবার জ্যেঠতুতো ভাই। টুকনু আগে দেখেনি তাকে।আমরা টুকনুর চোখ দিয়েই দেখতে শুরু করলাম তাঁকে। এমন একটা সময়কে ধরেছেন কল্লোল যা একেবারে কাছ থেকে দেখেছি আমরা। যেমন ধরুন এই গোরা নক্সাল যে মানুষটি। এমন মানুষ আমিও দেখেছি তবে সেই সত্তরের দশকের প্রথমে। সাতাত্তরে তাদের অনেককে দেখেছি জেল থেকে বেরোতে। জেলের অত্যাচারের চিহ্ন দেখেছি তাদের শরীরে। শুনেছি অত্যাচারের কথা। শিউরে উঠেছি।কল্লোল কিছু অসম্ভব শক্তিশালী গদ্য লিখেছেন এই বইটিতে। যেমন, টুকনুরা রিফিউজি। কল্লোল লিখছেন -" লম্বা চাটাইয়ে সাঁতসাঁতে পলেস্তারা খসা ঘরে শুয়ে থাকতো ওপার বাংলা থেকে অনিচ্ছায় আসা উদ্বাস্তু মানুষগুলো। সকালের রোদ আমাদের বালীর বাসায় ঢুকত না একটুও। কিন্তু মায়ের উনুনের ধোঁয়া সারা ঘর ছেয়ে ছোট ছোট ঘুলঘুলি দিয়ে বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করত পাশের বাড়ির ডুমুর গাছের পাশে শেফালিদের পাতকুয়ো পেরিয়ে অনেক দূরে আমার -না- দেখা কোন এক মাঠের দিকে।"আমি উদ্বাস্তু নই তবু কোথায় যেন টুকনুর মা আমার মা হয়ে যান। আসলে আমরা সবাই মনে হয় উদ্বাস্তু। আমরাও তো স্থায়ী ঠিকানা পেয়েছি অনেক পরে। তার আগে তো এ বাড়ি থেকে ও বাড়ি, ও বাড়ি থেকে সে বাড়ি....উদ্বাস্তু র মতই ঘুরে বেরিয়েছি। বাস্তু তো পেয়েছি অনেক পরে। গঙ্গার জলে বান আসা দেখতে যায় টুকনু। দেখে এক লাশ ভেসে আসছে।সেই লাশ ছিল প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়া চশমা চোখ সুশান্তর। একাত্তরে আমি প্রথম জলে ভেসে ওঠা একটি ছেলের লাশ দেখেছিলাম আমাদের পাড়ার ঝিলে। ভেসে উঠেছিল। সাদা হয়ে যাওয়া সেই লাশের মুখটা হাঁ করা ছিল। মুখের চারপাশে মাছি ভনভন করছিল। কিছু পিঁপড়েও বেরিয়ে আসছিল মুখ থেকে। আমি পালিয়ে গিয়েছিলাম পাড়া থেকে। তবু রাত্রে একুশ বছরের আমি ঘুমোতে পারতাম না। বারবার সেই মুখটি চোখের সামনে চলে আসতো।কল্লোল প্রতিটি পরিচ্ছেদ শুরু করেছেন এক একটি কবিতার লাইন বা গদ্যের লাইন দিয়ে। পাঁচ পরিচ্ছেদ শুরু করেছেন বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায় এর জেলখানার চিঠি দিয়ে। খুবই ক্ষীণতনু ছিলেন এই কবি কিন্তু তাঁর কবিতা ছিল প্রবল শক্তিশালী। কল্লোল উদ্ধৃতি দিয়েছেন।
-"একজন কিশোর ছিল, একেবারে একা
আরও একজন ক্রমে বন্ধু হল তার।
দুয়ে মিলে একদিন গেল কারাগারে;
গিয়ে দেখে তারাই তো কয়েক হাজার!
(জেলখানার কবিতা)
অদ্ভুত ভাবে এবারেও কল্লোল আমায় স্মৃতির ভেলায় ভাসালেন।মনে করালেন মোহনকে। মোহন সোম। আমরা ডাকতাম ভাইসোম বলে। সত্তর সালেই সেই অসম্ভব মেধাবী ছেলেটিকে বাগমারি বেরিয়াল গ্রাউন্ডের কাছে গুলি করে মারে পুলিশ।পরে বলে এনকাউন্টারে মারা গিয়েছে মোহম। মনে পড়ে আশিষকে, অরুপরতনকে। এরা গোরা নকশালের মত বেঁচে গিয়েছিল সেই সময়। পরে মারা যায়।অনেকেই এখন বলেন যে হঠকারী আন্দোলন ছিল নক্সাল আন্দোলন। হবে হয়তো। তবে সেই সময় এই সব বামপন্থীরা ছিলেন অন্যরকম।যা করতেন বিশ্বাস থেকে করতেন। ধান্দাবাজ ছিলেন না। আর লিখবোনা কিছু। মনটা খারাপ হয়ে গেল বইটি পড়ে। কল্লোলকে ধন্যবাদ এই মনখারাপের জন্যে। ওর জন্যেই, আজ এতদিন পর মনে পড়লো ভাইকে,আশিষকে, অরূপকে।আর ধন্যবাদ গুরুচন্ডা৯ প্রকাশনাকে। এমন একটি বই মাত্র ষাট টাকায়( আমায় আটচল্লিশ টাকায় দিয়েছে বইচই) আমাদের দেওয়ার জন্যে।
শেষ করি একটি গানের কথা দিয়ে।"-আকাশ বোঝে আনন্দ তার,বোঝে নিশার নীরব তারা।"ঠিক হলো না উদ্ধৃতি টি?তাই না? কী করি? এটাই যে মনে এলো....।
 
বিমোচন ভট্টাচার্য


বইমেলা প্রতিবারই যাই। এবারেও গিয়েছিলাম। প্রতিবারের মতই এবারও বাজেট এবং সম্ভাব্য বই ঠিক করে রেখেছিলাম। তবে এবারে বাজেট অল্প থাকার দরুন বেশি বই আমার লিস্টে রাখতে পারিনি। কিছুদিন আগে ফেসবুকের সূত্রে পরিচিত বন্ধু সেখ সাহেবুল হক আমাকে একটা গ্রুপের কথা বলে। আমি বিভিন্ন রাজনৈতিক, সামাজিক, ধর্মীয় গ্রুপে জয়েন করে দেখেছি সেখানে হয় ছাগলামো নয় নোংরামো হয়। আমি বন্ধুর মত তর্কা-তর্কি করতে ভালোবাসি। সঙ্গে ছোটো বেলা থেকেই প্রতিষ্ঠান বিরোধিতার একটা ভাবনা মনে দানা বাঁধতো। প্রসঙ্গত উল্লেখ্য আমার ছেলেবেলার প্রিয় কবি সুকান্ত। তিনি আমাকে খুব টানতেন। আমি সাহেবুলের পরামর্শে গুরুচন্ডালী জয়েন করলাম। ইতিপূর্বে গুরুর কোনো বই পড়ার সৌভাগ্য হয় নি। এবারে গুরুর একটা বই আগে থেকেই মনে মনে ঠিক করে রেখেছিলাম।গোরা নকশাল গুরুর স্টল স্থান পরিবর্তন করার পরদিন আমি গিয়েছিলাম। গিয়ে দু একটা বই ঘেঁটে আমার কাঙ্খিত বই কিনে স্টল ছেড়েছিলাম। এবার আসি “গোরা নকশাল” বিষয়ে কারন আমার এই পোষ্ট সে বিষয়েই। গল্প শুরু হচ্ছে টুকনু নামের একটি বাচ্চা ছেলের নজরে দেখা বর্ননা দিয়ে। যেটা সাধারণ দৃষ্টিতে দেখলে হাস্যরসের বিষয় হতে পারত। কিন্তু লেখক কল্লোল লাহিড়ী সেই বর্ণনার মধ্যে বিরাট সম্ভাবনার বিজ বুনেছেন। আমি আরবি সাহিত্যে ইতিপূর্বে এই ধরনের বর্ণনা পড়েছি। ডঃ ত্বহা হুসাইন তাঁর হাস্যরসাত্মক আত্মজীবনি (আল আইয়াম) “দিনগুলি” –তে এই পদ্ধতিতে শিশুর চোখে দেখা বর্ননা দিয়েছেন। সেই দৃষ্টিতে দেখলে এটা বিশ্বমানের একটা রচনা। আর কি অদ্ভুত ব্যাপার ডঃ ত্বহা হুসাইনও প্রতিষ্ঠান বিরোধি ছিলেন এবং তিনিও প্রচলিত ধারনাকে প্রশ্নের মুখে দাঁড় করাতেন। কল্লোল লাহিড়ীও প্রশ্নটা তুলেছেন, লাল পতাকার শাসনে কেন শ্রমিকেরা বঞ্চিত হবে? সাতের দশকে এক দল প্রত্যয়ী কিশোরের একটা মতবাদকে আঁকড়ে সব কিছু বদলে দেবার যে প্রচেষ্টা ছিল তার ঐতিহাসিক পুনর্নির্মান করেছেন লেখক। নকশালের ধারনা বদলেছেন কিংবা মিলিয়েছেন, যার চেতনা ডানা মেলে বহু দূর উড়তে পারে সেই নকশাল। এটা বোঝাবার জন্য যে ধরনের ঘটনার কোলাজ লেখক ব্যবহার করেছেন তা এক কথায় অনবদ্য। অর্ধেক পড়ে আমার মনে হচ্ছিল, আমি কেন চোখের সামনে সব ঘটনা দেখতে পাচ্ছি না? এই সমস্যা কাটাবার জন্য আমি “নক্সাল” নামে মিঠুন চক্রবর্ত্তী অভিনিত সিনেমা ইউটিউব থেকে দেখে নিলাম। যদিও সেই সিনেমায় বাজার ধরার উদ্দেশ্যে কিছু আপোশ ছিল। এবার শুরু হল আমার আসল যাত্রা। আমার চাকরি জীবনে আমি উত্তর পাড়ায় দুবার ভোট করেছি। সেখানকার শ্রমিকদের অবস্থা আমি নিজের চোখে দেখেছি। একেবারে চোখের সামনে বাস্তব উপলব্ধি পাচ্ছিলাম লেখায়। গোরা নকশাল যেন টুকনুকে আঁকড়ে বাঁচতে চায়ছিল।টুকনুর দাদা নকশালের যে অর্থ বলেছিল তা বড়ই বাস্তব। তাই বার বার সে কথা এসেছে। টুকনু দ্বন্ধে পড়েছে তা নিয়ে। টুকনুর দাদা শিক্ষার প্রতি আগ্রহি ছিল টুকনু সম্পুর্ন তার বিপরিত। তাকে গোরা নকশাল নিজের হাতে তার আদর্শে গড়তে চেয়েছিল। কি হয়েছিল তা বড়ই আবছা। অবশ্য এটা আমার ভ্রমও হতে পারে।
শ্রমিক আন্দলনকে আবার পুনঃসংগঠিত করার ক্ষেত্রে যখন প্রথম গোরাকে অনাসক্ত দেখা গেল আমার একটু রাগই হয়েছিল। তবে পরে সে ভূল ভেঙেছিল। আবার নতুন আঙ্গিকে নতুন রাজনৈতিক আবর্তে শ্রমিক আন্দলন দানাবেঁধেছিল। কিন্তু শাষকের কালো হাত সর্বদাই সর্বহারার অধিকারের আন্দলন রক্ত দেখিয়ে দমন করেছে। এই পর্বে আমার এই গল্পের সবথেকে প্রিয় চরিত্র ঠুলিকে পেলাম। ঠুলি চরিত্রটি শরৎচন্দ্রের শ্রিকান্ত উপন্যাসের ইন্দ্রনাথকে মনে করায়। তবে এই ঠুলি জানে সে কোন শ্রেনির প্রতিনিধিত্ব করছে। সে লাল পতাকা নিয়ে ইনক্লাব স্লোগান দিতে জানে। এই পর্বে সুশান্ত নামে যে চরিত্রটি এসেছে সে অনবদ্য। সে নকশাল আন্দোলনের সত্তরের দশকের যে কোনো চরিত্রেরই প্রতিচ্ছবি। তবে এই পর্বে সে ঠুলির কাছে ম্লান হয়ে গেছে।
চে গুয়েভারা এই গল্পের চরিত্র হয়ে উঠেছে। সঙ্গে বিভিন্ন রাজনৈতিক চাপান উতোরও গল্পের অঙ্গ হয়ে উঠেছে।সবথেকে বাস্তব হল পিসি মণি চরিত্রটি। যে পরিবার নকশাল চিন্তাধারাকে বহন করে সেই পরিবারেই তাবিজ-কবজের প্রচলন। এ যেন আমাদের দেশের বহুত্ববাদী চিন্তাধারার ক্ষুদ্র সংস্করণ।সিনেমা নির্মানের সঙ্গে এই গল্পের আত্মিক যোগ। বার বার ফ্লাস ব্যাকে ফিরে যাওয়া। গল্পের সংলাপ হয়ে বার বার একবার এগিয়ে যাওয়া আবার ফিরে দেখা। তবে এটা বই না হয়ে সিনেমা হলে যেমন কিছুটা সুবিধা হত তেমনই বেশ কিছু অসুবিধাও ছিল। শিশু মননের যে বর্ণনা এতে আছে তা হয়ত সিনেমাতে দেখানো সম্ভবও ছিলনা।এবারে আসি ক্লাইম্যাক্সে-গল্পের প্রতিটা চরিত্র এখানে আকর্ষনীয়। সকলেই পাঠকের হৃদয়ে জিবন্ত হয়ে ওঠে।একটা বাস্তব প্রশ্নের সামনে পাঠককে দাঁড় করিয়ে দেয় “গোরা নকশাল”।ওরা আমাদের কোনো অধিকার দেয়নি। নামেই বাঁচিয়ে রেখেছে। আসলে রাষ্ট্র ক্ষমতা মানুষকে অধিকার বুঝিয়ে দেয়নি। সব প্রতিশ্রুতিই থেকে গেছে। কোনো নকশালও সব বদলে দিতে পারেনি। রাস্ট্র তাদের কোমর ভেঙে দিয়েছে।টুকনু বড় হয়ে বুঝেছে, সেও আসলে নিষ্ঠুরই ছিল। সে তো বুঝেছিল, কিন্তু আমরা? আমরা সকলেই হয়ত কোথাও না কোথাও নিষ্ঠুরই।কাঁচা হাতে লেখায় ভুল-ত্রুটি থাকতে পারে। ক্ষমা করবেন। 
আবু তোরব মোল্লা। 


গোরা নকশাল...গুরু তে প্রথম বার পোস্ট হওয়ার সময় থেকেই নাম টা কেমন টানছিল। এবারের বইমেলায় তাই এটাই ছিল আমার প্রথম রসদ। কাল সন্ধ্যাবেলায় পড়তে শুরু করেছিলাম- উৎসর্গ, কৃতজ্ঞতা, ভুমিকা কোনো টাই ছাড়া গেল না। অনেকদিন পর এরকম অনায়াস ঝরঝরে বাংলা পড়ার আরাম পাচ্ছিলাম। টুকনুর ছোটবেলার নির্ভেজাল দিনগুলো মনে হলো আমার চোখের সামনে দেখছি। কিছুটা পড়ার পর ভাবলাম রেখে দিই, বাকিটা কাল হবে। কিন্তু পারলাম না তো! ততক্ষণে যে গোরা নকশালের সাথে প্রথম পরিচয় হয়ে গেছে, ঘুম আসার নামগন্ধ নেই। অতঃপর রাতদুপুরে আলো জ্বেলে আবার পড়া শুরু, এবার এক নিঃশ্বাসে শেষ। সত্যি কি আর শেষ হয়, নাকি হওয়া সম্ভব? চোখ বুজলেই তো প্রিয়াংশু, সুশান্ত, গোরা রা ভেসে উঠছে এখনো, বুকের ভেতর ধাক্কা মারছে সমানে। সারারাত প্রায় জেগে কাটলো, এখনো ঘোরের মধ্যেই আছি।
 রাজর্ষি সরকার


গোরা নকশাল ঠিক অতীতের গল্প নয়। ভুল হলো। গোরা নকশাল শুধুই অতীতের গল্প নয়। অতীত ও ভবিষ্যৎ জুড়ে, হলেও হতে পারে বা কোন একদিন হবে এমন ঘটনাসমূহ লেখক ধরার চেষ্টা করেছেন, পড়তে পড়তে এরকম লাগে। গোরা নকশাল একেবারেই শুধু নকশাল আন্দোলনের টালমাটাল কিছু ঘটনাবলী, কিছু মানুষের জীবনের গল্প নয়। সেগুলো এবং তার বাইরেও যা পড়ে থাকে, কুয়াশাচ্ছন্ন সেই সময়, টুকনুর চোখ ক্যামেরার মত বন্দী করে। দৃষ্টি ঝাপসা অথচ না এগোলেই নয় এমন পরিস্থিতিতে কখনো পড়েছেন? অন্ধকারে এমন হয়, দূর্যোগেও এমন হয়। রাজনীতির সেই সময় যার সাথে ক্লিশে "উত্তাল" শব্দটি জুড়তে জুড়তে প্রায় থীমপার্কের প্রহসনে পরিণত হয়েছে, তা নিয়ে লেখালেখি আছে বিস্তর। গোরা নকশাল সেই অন্য লেখাগুলোর মত নয়। তার প্রধান দুটি কারণ হলো, ১) এই লেখায় লেখক প্রচ্ছন্ন, তাঁর আমিত্ব একবারের জন্যেও প্রতিপাদ্যের ওপর ছায়া ফেলেনি। ২) নকশাল আন্দোলনের কথা বলতে গিয়ে, সেই আন্দোলন আসলে কাদের ভালোর জন্য, সেকথা ভুলে না যাওয়া। সেই মানুষগুলো তাঁদের নিজস্ব রূপেই আছেন, ক্ষুদ্রস্বার্থ নিয়ে, অনর্থক পরোপকার ভালোবাসা মায়া নিয়ে। এই উপাখ্যান খুবই দরকারি প্রচেষ্টা সেটা মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য। 
মিঠুন ভৌমিক


এইমাত্র গোরা নকশাল পড়ে শেষ করলাম...বেশ খানিকক্ষণ একটা আচ্ছন্নভাব রইলো...একটা ঘোর...যেন কোথাও একটা কিছু ছেড়ে গেছে...ছেড়ে যাচ্ছে...হারিয়ে যাচ্ছে আর সেই হারিয়ে ফেলার বেদনায় ভারাক্রান্ত হয়ে উঠছে মনটা...তার একটা কারণ অবশ্যই লেখাটার প্রসাদগুণ...দ্বিতীয় কারণ অই সময়টা যেটার ভগ্নাবশেষ বয়ে নিয়ে আসে গোরা নকশাল...আমাদের শৈশবের শুরুর দিনগুলোয় সেই আগুন স্তিমিত কিন্তু কোথাও কোথাও ধোঁয়া রয়ে গিয়েছে তখনো যা ক্রমশঃ কৈশোরে পা দিতে দিতে কিছু হলদেটে খবরের কাগজের কাটিং কিছু বিবর্ণ হয়ে আসা দেয়ালের ঝাপসা লেখা আর কিছু অগ্রজ আত্মীয়-স্বজন পাড়া-প্রতিবেশীদের মুখের কথায় ক্রমশঃ বিলীয়মান...তবু কোথাও একটা টান থেকেই যায়...কোথাও কিছু মায়া জড়িয়ে রয়ে যায় যা এই উপন্যাসটা আবার একবার মনে করায়...মনে করায় কেউ কেউ স্বপ্ন দেখেছিলো - কেউ কেউ এখনও স্বপ্ন দেখে...মনে করায় গরীবের সরকারও গরীবের উপর লাঠি চালায়...ভেঙে দেয় আন্দোলন-প্রতিবাদ-প্রতিরোধ...মনে করায় রাইটার্সের উপর লাল পতাকা ওড়ার কালেও প্রতিবাদী সহকর্মীর গুলি খাওয়া লাশের উপর লাল শালু জড়িয়ে দিতে হয়...তবু কেউ কেউ মনে রাখে "যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল"!! 
সব্যসাচী কর


সেইসব গোরাদের গল্প, যারা বাড়ি ফিরতেই চেয়েছিল। লিটল ম্যাগাজিন মেলায় 'গুরুচণ্ডা৯' র বেঞ্চে হঠাৎ চোখে পড়েছিল বইটা। প্রথম দর্শনেই ঘরে তুললাম। ৫৫ পাতার বই একনাগাড়ে হৈ হৈ করেই পড়ে ফেললাম। মানে পড়ে ফেলতেই হলো এমনই লেখার অমোঘ আকর্ষণ তৈরির ক্ষমতা লেখক কল্লোল লাহিড়ী দেখিয়েছেন। বাঙালি নস্টালজিয়ায় বাঁচে। আর কিছু বাঙালি বাঁচে নক্সালজিয়ায়। সেইরকম এক মিঠে শীতসকালের রোদ আর লেপমুড়ি দিয়ে শুরু হয় গল্প। শহরতলির ছোট্টো মফস্বলের এক ছোট্টো পরিবার ফেলে আসা ওপার বাংলার স্মৃতিবেদনা একটু একটু ভুলবার সময়ে বেড়ে ওঠা এক ছোট্টো ছেলের চোখে দেখা দুনিয়া নিয়েই নিজের নিয়মে এঁকেবেঁকে চলে 'গোরা নকশাল' এর কাহিনী। ছোটোবেলার এক পায়রার নাম ছিল 'নকশাল'! 'নকশাল' ছিল পায়রাদের পদবী, যারা নকশাল তারা উড়ে বেড়ায়। হঠাৎ সেই ছেলের জীবনে আসে গোরা, তারও পদবী নাকী নকশাল, সেও উড়তে পারে? অন্তত উড়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখে আর দেখাতে পারে। ছোটোবেলার নিয়মছাড়া জীবনে বড়োদের অনিয়মগুলো পরতে পরতে বুনে গেছে অনন্য চিন্তাজাল, কাহিনীর বুনোট হয়েছে ঘন। ফেলে আসা মফস্বল ছেলেবেলার এই গল্প একসময়ে পরিণতির দিকে ধেয়ে যায়। গোরা নকশালের জীবনকে মাপতে চাওয়া ছোট্টো ছেলেটার চোখদিয়ে আমরা দেখতে পাই সেই সময়ের বালি-উত্তরপাড়া, চটকল, জিটিরোড, কলোনির ছাদে লেপের রোদপোহানো, শ্মশানঘাটে বাচ্ছা ছেলের সাঁতার আরোও এরকম কতো কতো মিঠে কোলাজ!  ভূমিকায় 'গোরা নকশাল' নকশালপটভূমির সাহিত্যকীর্তির উজ্জ্বল তালিকায় অন্তর্ভুক্তি পাঠকের উপর দায় ঠেলেছেন, আমি জানিনা ওই তালিকায় রাখার নিয়মাবলী, তবে আমি এটুকু বলতেই পারি, আমার স্মৃতির তালিকায় 'গোরা নকশাল' বহুদিন উজ্জ্বল থাকবে, আর ফিকে হতে শুরু করলেই আবার ঝালিয়ে নেবোই নেবো। 
অনির্বাণ রায়


একমাস হয়ে গেল গোরা নকশাল পড়েছি। এই একমাসে আরো অনেক কিছু হয়ে গেছে। আমার একটা ওয়েব ছবির শুটিং আর এডিট শেষ করেছি (ডাবিং আর কালার বাকি আছে)। আরেকটা ওয়েব ছবির শুটিং প্রায় শেষ। সাংবাদিকতার পাশাপাশি কিছু লেখালিখির কাজ চলছে। মাঝে মাঝে টুক করে বেরিয়ে পড়া তো আছেই। সাথে চাকরি পাওয়া আর চাকরি ছাড়ার বদ অভ্যাসটা আবার শুরু হয়েছে। এরমাঝে মামনি (আমার বড়মাসি) অসুস্থ হয়েছেন, আমার পরিবারের কেউ অসুস্থ হলে আমি একটু ব্যাকফুটে চলে যাই। আরও অনেককিছুই হয়েছে। যাইহোক যে কথা লিখতে বসেছি সেখানে আসি, এই একমাসে কম করে ৫ জন কে গোরা নকশাল পড়িয়েছি। আর একটা জিনিস করিনি... গোরা নকশাল নিয়ে একটা রিভিউ লিখব ঠিক করেও লিখতে পারিনি। বইটা কিনে বাড়ি আসার পথে বাসে-ট্রেনেই সিংহভাগ পড়া হয়ে গেছিল। বাড়ি ফিরে বাকিটা শেষ করেছিলাম। তখন রাত প্রায় ২ টো। ততক্ষণে আমার জ্বর এসে গেছে। বিকালেই বৃষ্টিতে ভিজেছি, ব্যাস...। আর তারপর জ্বরের ঘোরে যা তা ভুলভাল লিখেগেছিলাম...।শুরুতেই একটা কথা বলে রাখছি, আমি কিন্তু গোরা নকশালের রিভিউ লিখছি না। কারন এ বিষয় লেখার মত মূলধন আমার নেই। কুড়িয়ে-বাড়িয়ে যা পেয়েছি তাতে আমি কনফিউজ এবং আমার তা স্বীকার করতে কোন সংকোচ নেই। যেমন গোরা নকশাল বইয়ের প্রকাশের দিন তুমুল মতানৈক্য দেখলাম দু’জন মানুষের মধ্যে... নকশাল একটা সময়; না আন্দোলন? বিহার-উত্তরপ্রদেশ-ঝাড়খন্ড-ওড়িষ্যার মাওবাদিদেরও নকশাল বলে শুনেছি। সবই শোনা অথবা বইবন্দী পড়াশোনা। কোনটা সোনা আর কোনটা চোনা তা মাপার মত নিক্তি আমার কাছে নেই। তাই যে বিষয় আমার অভিজ্ঞতা নেই, তা নিয়ে লেখার ক্ষমতাও আমার নেই। যেকোনো বই পড়ার পর, বা ছবি দেখার পর অথবা গান শোনার পর একটা আফটার এফেক্ট আমার মধ্যে কাজ করে। কম বা বেশি যাই হোকনা কেন, করে। সময়ের সাথে তা আস্তে আস্তে মৃদু হয়। এবারও তাই হল। তার সাথে আমার একটা অদ্ভুত অভিজ্ঞতা হ’ল। আমার নিজের সাথে না বলা কথাগুলো হঠাৎ করে নিজে বলতে শুরু করেছি। মানে আমার এই প্রলাপটা আমার ভেতরে ছিল ঠিকই, তার টের পেতাম। কিন্তু সে কথা বলতো না। ঠিক আমার ছোটো থেকে বড় হয়ে ওঠার সময়টার মত। যখন আমি কারো সাথে কমিউনিকেট করতে বিব্রত বোধ করতাম। আমার স্পিচিং প্রবলেমের জন্য। অথচ কাউকে বুঝতে দিতাম না। ঠিক সেই রকম। আমি কোনোদিন কোন গোরা নকশাল দেখিনি, তাই তার প্রতি কোনও প্রেম আমার নেই। আমি কি ঠিক বললাম ? হয়তো না। হয়তো কেন, নিশ্চয়ই না...। কারন গোরা নকশালদের চিনিয়ে দেবার মত আমি কাউকে পাইনি। বা পেলেও এই গোরা নকশালদের কেউ চিনিয়ে দেয়নি। অথবা চিনিয়ে দিলেও, তাদের চিনলে যে কি হবে তা কেউ বলে দেয় নি। কিম্বা বলে দিলেও তা বুঝতে পারিনি। আর আজ বুঝলেই বা কি করব তাও বুঝতে পারি না...।কারো প্রতি প্রেম না থাকলে কি চোখ দিয়ে জল পরতে পারে... গায়ে উদবাস্তুর গন্ধ মেখে যারা কোনও এক রাতের অন্ধকারে নিজের ঘর, উঠোন আর পরিচয় ছেড়ে আরেক পরিচয়ের খোঁজে বেরিয়ে পড়েছিল। কোলের শিশুটাকে আঁকড়ে শিয়ালদার কোনও এক এঁদো গলির স্যাঁতস্যাঁতে ঘরের মেঝেতে একসাথে গাদাগাদি করে শুয়ে আধো ঘুমের মধ্যে মাঠ-পুকুরধার-সবুজ ঘাসের স্বপ্ন দেখেছিল, আর সকাল হলেই ঝেড়ে ফেলতে চাইত উদবাস্তুর তকমা। তাদের সেই শিশুটার তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার খুব তাগিদ ছিল। থাকবেইতো, বাঁচতে হবে যে। ...অথবা এদেশে থেকেও স্বাধীনতার স্বপ্নভঙ্গ হয়েছিল যাদের। এক চূড়ান্ত অচলায়তন সময়, যখন বাড়ির বাইরে বেড় হলে ফেরার কোনও নিশ্চিয়তা থাকত না। ঠিক সেই সময় যারা একটু শান্তির আশায় ঘর বেঁধেছিল, তাদেরই কোনো এক নববিবাহিত বধূ জানলার ধারে পরদার আড়ালে দাঁড়িয়ে দূরের অন্ধকার নেমে আসা রাস্তাটার দিকে তাকিয়ে থাকত প্রত্যেকটা সন্ধ্যার আগে। অফিস থেকে উনি ফিরে আসবেন বলে। কিছুটা বারুদের গন্ধ, ধোঁয়ার কুণ্ডলী, গুলির শব্দ আর অন্ধকার গলির পাশে পড়ে থাকা লাশের পাস কাটিয়ে উনি মানিকতলার ভাড়া বাড়িটার একতলার ঘরে ফিরতেন। তারপর জানালা বন্ধ হ’ত। এরপরতো স্বপ্ন দেখার সময়। ওদিকে বাড়ি ফেরার পরও রাস্তায় কারা ছুটছিল...। বাইরের অশান্ত সময় শান্ত ঘরটার একতলার জানলার বাইরে থেকে যেত। তাদের কোলের শিশুটারও তাড়াতাড়ি বড় হওয়ার খুব তাগিদ ছিল। থাকবেইতো, বাঁচতে হবে যে। সেই বেড়ে ওঠার তাগিদের মধ্যে নিশ্চয়ই তাদের সাথে এমনই কোনও গোরা নকশালের দেখা হয়েছিল...। বড় হওয়ার সাথে সাথে তাড়াও দিন বদলের স্বপ্ন দেখেছিল। কিন্তু তারা তাদের বিভীষিকাময় অতীতটার কথা জানত। তাই দিন বদলের স্বপ্ন কোনো এক রাতে অন্ধকার গলির বাঁকে লুকিয়ে রেখে পরদিন ভোরে তারা বাড়ি ফিরেছিল, কিছুটা রোদ্দুর গায়ে মেখে। তাদের ঘরের ভেতরে চাতক পাখির মত বসে থাকা প্রানী গুলো দিনান্তে শুধু একটু নিশ্চিন্তের ঘুম চেয়েছিল। তাই তাদের বাড়ি ফিরতে হয়েছিল, কিছুটা রোদ্দুর গায়ে মেখে। অথবা সেই সব হারানো উদবাস্তু শিশুটা বড় হয়ে একটা সংসার চেয়েছিল। তাই তাদের বাড়ি ফিরতে হয়েছিল, কিছুটা রোদ্দুর গায়ে মেখে। আর সময় পেলেই সেই অন্ধকার গলির বাঁকে লুকিয়ে রাখা দিন বদলের স্বপ্নটাকে দেখে আসতো সেই তাড়তাড়ি বড় হওয়ার তাগিদে বড় হয়ে যাওয়া শিশুগুলো। কিন্তু ততদিনে অন্ধকার গলিতে বাতির আলো জ্বলেছে।স্বপ্নরা আর আলোর মধ্যে ধরা দেয়না...এভাবেই বেড়ে ওঠা সেই দুই শিশু যখন একসাথে একটা সংসার তৈরী করল। আর সেই প্রায় স্বচ্ছল সংসারে নয়ের দশকের মাঝামাঝি সময় যখন এক দ্বিতীয় সন্তানের জন্ম হল, তখন সবাই মিলে দুহাত দিয়ে আগলে বিগত সময়ের শেষ ধোঁয়াটুকুর গন্ধটার আঁচও পেতে দেয়নি সেই খুদেকে। তাই জন্মের প্রথম দিন থেকেই তার গায়ে খুব নরম রোদ্দুর লেগেছে। তাই যখনি কোনও এক গোরা নকশালের ফিসফিসানি তার কানের পাস দিয়ে ঠাণ্ডা হাওয়ার মত বয়ে গেছে, তখনি গোরা নকশালেরা হয়ে গেছে; হয় কোন এক অমুক অথবা এক তমুক। ভয় হয়, এই খুদেটা আবার যদি দিন বদলের স্বপ্ন দেখে...! অনেক হয়েছে দিন বদল। আসলে কিছু বদলায় না, মানুষ বদলাতে দেয় না। শুধু সময়ের প্রলেপে নিজেদের বদলানোর দাবি করে যায়...। তাই আর মামার বাড়ির ওপরের ঘরের মিটিং দেখা হয়ে ওঠে না। আমার শোনা একটা দূর্ঘটনার কথায় ভিখারী পাসোয়ানকে নিয়ে রচনা লেখা হয়ে ওঠে না। বার বার খুদেটার দিকে ঘুরে তাকায় মা, তাকিয়ে থাকে অনিতা দিদিমণি। আমি জানি অনিতা দিদিমণি সেদিনকার আমার লেখা রচনার কাগজটা তুমি আস্তে করে মায়ের হাতে গুঁজে দিয়েছিলে, মা সেটা দলা পাকিয়ে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছিল রাস্তার ধারে। আমি দেখেছিলাম। আমি আরও দেখেছিলাম মামার বাড়িতে আমার কোন কোন বই গুলোতে হাত দেওয়া বারন। ওগুলো বড়দের বই। আমি জানতাম ওগুলো বড়মামার বই। আমি এটাও জানতাম তোমরা সবাই কোনও না কোনও গোরা নকশালকে দেখেছ। মা, অনিতা দিদিমণি, বড়মামা, ছোটমামা, বাবা, অংক স্যার, প্রদীপ কাকু, টুকনু দা সবাই...। শুধু আমাদের থেকে তাদের আড়াল করে গেছো। আমি দিন বদলের স্বপ্ন দেখি না জানো। দেখি বললে খুব মিথ্যে কথা বলা হবে। জানিনা আমার পাশাপাশি হেঁটে চলে বেড়ানো কারাকারা দিন বদলের স্বপ্ন দেখে। আর দেখার পর কি করে তাও জানিনা। আসলে আমি এমন কোনও দিন দেখিনি যেটা বদলের প্রয়োজন আছে। আমি এটাও জানি না যে আমি যেটা দেখছি সেটা আদৌ দিন কিনা। হয়তো দিন, হয়তো না। কিন্তু এতেই চোখ সয়ে গেছে। কারন আমি স্পষ্ট দেখতে পাই। আমারই বয়সি রাকাইনের কেউ আজ দিন বদলের স্বপ্ন দেখে, কোনও এক কাশ্মীরি দিন বদলের স্বপ্ন দেখে, কোনও এক দলিত দিন বদলের স্বপ্ন দেখে, কোনও এক প্যালেস্তাইনি দিন বদলের স্বপ্ন দেখে, কোনো এক মেক্সিকান দিন বদলের স্বপ্ন দেখে। কোনও এক ইজরাইলী দিন বদলের স্বপ্ন দেখে।উদবাস্তু, নকশাল শব্দগুলো শুনতে আমার হেব্বি ভালো লাগে। মাইরি বলছি, ইস... হেব্বি লাগে। শুধু কনফিউজ থাকি নকশাল সময় হলেই বা কি আর আন্দোলন হলেই বা কি...। ঠিক যেমন কনফিউজ ছিলাম ঝাড়খণ্ডে একটা ডকুমেন্টারীর শ্যুটিং করতে গিয়ে... “ ওপাড়ের জঙ্গল পেড়িয়ে নকশালরা আসে, আমার বেটার মাথায় বন্দুক ধইরে বলে – আজ তুর ঘরে থাকবু। তারপর সদরে গিয়ে গুলি চালিয়ে আবার ওপাড়ের জঙ্গল পেড়িয়ে চলে যায়। তারপর পুলিশ আসে, আমায় মাইরধর করে। আর ভাইটারে উঠায় নিয়া কুথায় যে চলি গেল, চাইর মাস খোঁজ নাইরে দাদা। বল ইবার... দশটা টাকা পেইলে মুড়ি কিনব না গুলি কিনব...” কোনো এক বসন্তের বিকেলে আমরা যখন ফাইটার গেমের ডিভিডি নিয়ে কাড়াকাড়ি করছিলাম, ঠিক তখন কোনো এক হাসপাতালে টিবি রোগে ভুগে মারা গেছিল গোরা নকশাল। আমাদের ভারচুয়াল ফাইটিং গেমে জেতার উল্লাস বা হারার হাহুতাশ কি মারা যাওয়ার আগে শুনতে পেয়েছিল তোমার গোরা নকশাল? জীবনের শেষ বিকেলের পড়ন্ত রোদ্দুরটুকু কি দিন বদলের আশ্বাস দিতে পেরেছিলো গোরা নকশালকে ? টিবি রোগে যে মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে সেটা মন দিয়ে প্রথম কোথায় দেখেছিলাম জানো টুকনু দা... কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে, ফিল্মস্টাডি পড়তে গিয়ে। আমাদের সেই ক্লাসটা নিয়েছিলেন কল্লোল লাহিড়ী।তোমরা তো গোরা নকশালদের বাঁচার গল্পটা না জানলেও, মরার গল্পটা জানো। আমিতো তার কোনও খবরই পাই নি। আমাদের তো তা পেতে দেওয়া হয় না। আজ থেকে বহু বছর পর আমার জীবনের শেষ বিকালের ঠিক আগে যদি কোনও টুকনু দিন বদলের স্বপ্ন নিয়ে এসে দাঁড়ায়, যদি গোরা নকশালের গল্প শুনতে চায়…। আমি কি উত্তর দেব বলতে পার…। 
স্বর্ণাভ আর চৌধুরী


 
চে গুয়েভারা ছিলেন একজন আর্জেন্টিনীয় মার্কসবাদী, বিপ্লবী, চিকিত্সক, লেখক, বুদ্ধিজীবী, গেরিলা নেতা, কূটনীতিবিদ, সামরিক তত্ত্ববিদ এবং কিউবার বিপ্লবের প্রধান ব্যক্তিত্ব,আরও কত কত কঠিন শব্দ। তবে এই লোকটা যে কিছু পালটে দেওয়ার জন্যই জন্মেছিলেনন,তা তো আমরা সবাই জানি। কোনোরূপ রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট ছাড়া একটা বাচ্ছাকে কী করে এই ভালো মানুষটার গল্প শোনাবেন?কী করে বলবেন ওই বড় বড় চুলওয়ালা লোকটা কে? গোরা নকশাললেখক- কল্লোল লাহিড়ী বইটা যদিও সম্পূর্ণ এটাকে ঘিরেই তা নয়।তবে এই জায়গাটুকু আমার খুব ভাল লাগলো।তাই সব্বার সাথে শেয়ার করলাম। 
নীলাঞ্জন ঘোষাল


আমার ঠাম্মার কাছে শোনা আমাদের বাড়িতে নাকি নকশাল রা থাকতো। বোমা বাঁধা হত বাড়ির পিছনের দিকে। বন্দুক, গুলি, বারুদ এসব নাকি রাখা হত একতলার সিঁড়ির নীচে। নিজে কখনো দেখিনি। সবটাই শোনা। ঠাম্মা নাকি চিঠি পৌঁছে দিত কমরেডদের। স্বাধিনতার আগে জন্ম তাদের। কত কিছুর যে সাক্ষী ঠাম্মা তা সবটা জানিও না। গল্পকথাতেই যেটুকু শোনা। তবে গল্পটার যে জলছবি এতদিন চোখে ভাসত তা অনেক টা স্পষ্টতা পাচ্ছে আমার কাছে। একটু একটু করে বুঝতে পারছি, 'লাল সেলাম' কথাটার মানে। বুঝতে পারছি নকশাল কাদের বলে। নকশাল তারা, যারা উড়তে পারে। আর বুঝছি, 'ভালোবাসার আর এক নাম প্রতিবাদ।' 
সুদীপ ধাড়া


কিছু কিছু মুহূর্ত এমন আসে, যখন একলা হতে ইচ্ছা হয় নিজের সাথে। যেমনটা হয় হঠাৎ কোনও গান, সিনেমা বা বই পড়ার পর; হঠাৎ কারুর সাথে দেখা হয়ে যাবার পরের মুহূর্তে কিংবা কখনও শুধুই বা নদীর উপর একটা সূর্যাস্ত দেখার অছিলায়। ... ঠিক যেমনটা হলো সদ্য স্বয়ং লেখকের হাত থেকে উপহার পাবার পরে একটা লম্বা ট্রেন জার্নিতে “গোরা নকশাল” বইটা শেষ করবার পর (লেখক : কল্লোল লাহিড়ী; প্রকাশক : Guruchandali গুরুচন্ডালী না, “গোরা নকশাল” কোনও রোম্যান্টিক স্বপ্নালু বিপ্লবের গল্প আমাদের শোনায় না। বরং মনের ভিতর যেন গেঁথে দিয়ে যায় এক যন্ত্রনা থেকে অন্য যন্ত্রনায় ভ্রমনের এক যাত্রাপথ। এবং বইয়ের নামটাই ভাসিয়ে নিয়ে যায় সবার আগে। একদিকে “গোরা” আর অন্যদিকে “নকশাল”, এই দুই শব্দের ব্যাপকতা বা মোহময়তা যে কতখানি, তা হয়তো সচেতন বাঙালীদের কাছে বলার অপেক্ষা রাখেনা। আর সেখানেই মনে হয়, সবকিছু বদলে দেবার স্বপ্ন আমাদের এই “গোরা নকশাল” ছাড়া কেই বা দেখাতে পারতো !! তাই হয়তো খুব সহজে মিলিয়ে ফেলা যায় এই নকশাল গোরার সাথে রবি ঠাকুরের গোরাকেও, যখন সে বলে, “পৃথিবীতে যারা মুখ ফুটে নালিশ করতে পারে না, চুপ করে থাকে, তারাই উলটে আসামি হয়।” … এভাবেই “গোরা নকশাল” আমাদের আয়না ভাঙা কাঁচের টুকরোর মধ্যে দিয়ে যেন জীবনকে দেখিয়ে যায় এক ঝলক। আমাদের মনে করিয়ে দিয়ে যায় অবিরাম ঝরে পড়া রক্তের সাথে জোয়ারের জলে ভেসে ওঠা লাশ, মেহনতি মানুষের মিছিল আর ঘামের গন্ধ আর কারুর মনে করিয়ে দেওয়া অস্ফুটে যে, স্বপ্নকে খুন হতে দেখলে তার খুনিকে মনে রাখতে হয়।… অথচ কি ভীষণ আদরে বলে চলা এই সব !! ভীষণ রাগের মধ্যে হলেও, বারুদ গন্ধের মধ্যে হলেও, এ যেন আসলেই একটা কুঁড়ির ফুটে ওঠা। দেওয়ালে ঝুলে থাকা চে’ কেও যেখানে জোর করে চিনিয়ে দেওয়ার কোনও প্রচেষ্টা নেই, কোনও দীক্ষামন্ত্র নেই কোনও বিপ্লবের; বরং ভালোবাসা আছে। শিশু বা কিশোরদের হাতে রাইফেল তুলে দেওয়া নেই, বদলে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরা আছে। … নকশাল গোরা শুধু কথা বলতে চায়নি, বরং তীব্র বিশ্বাসে আঁকড়ে ধরে এগিয়ে যেতে চেয়েছে। প্রচন্ড রকম অসময়ে দাঁড়িয়েও বিশ্বাস করতে চেয়েছে, গাছেরা ঘুমালেও, ফুলেরা ঘুমায়না নিশ্চিতভাবেই। একটা গোটা প্রজন্ম যেটা চেয়েছিল !! বাইরে থেকে না দেখে সমস্যার ভিতরে ঢুকে সেটাকে অনুধাবন করা। ঠিক যেমন চেয়েছিল রবি ঠাকুরের গোরাও, “নিন্দা করতে গেলে বাইরে থেকে করা যায়, কিন্তু বিচার করতে গেলে ভিতরে প্রবেশ করতে হয়।”“গোরা নকশাল” পড়তে পড়তে এই নানান কথা মনে ভীড় করে আসছিল শুধু। বিপ্লব ছেড়েও ভীড় করে আসছিল নেহাত কিছু শৈশবকালীন স্মৃতি। বইয়ের সিলভার কালারের সুটকেস, পেঁয়াজকলি ভাজা, জন্মদিনের মধ্যবিত্ত পায়েস, রোদে দেওয়া লেপ-কাঁথা-কম্বল, বাড়ির সামনের উঠোন কিংবা ঘুলঘুলিতে চড়াই পাখির বাসা –– এই সব কিছুতো আমারও ছিল; শুধু গোরা নকশালকে পেয়েই কেমন যেন আলাদা হয়ে গেল টুকনুটা !! ভিন্ন হয়ে গেল আমাদের থেকে, অযথা কিছু মনখারাপ উপহার দিয়ে।আর তার সাথেই কিছু নিজস্ব, ব্যক্তিগত বিশ্বাসের খুঁটি শক্ত করে দিয়ে গেল এই বই। একটা সময়ের পর বিশ্বাস জন্মাতে শুরু করেছিল যে, আজকের দিনে বাঙালীর এই চূড়ান্ত মধ্যমেধার জয়জয়কারের পিছনে মূল কারনটা হলো একটা নির্দিষ্ট সময়ে একটা আন্দোলন প্রতিহত করার নামে অসম্ভব সমস্ত প্রতিভাবান বাঙালী ছাত্র-ছাত্রীদের একটা গোষ্ঠী বা একটা গোটা সম্প্রদায়কে নির্বিচারে সরকারি মদতে স্রেফ নিকেশ করে যাওয়া। বাঙালীর মেরুদন্ডে সেই গুলির ক্ষত সহজে বোধহয় সারবারও নয়। “গোরা নকশাল”-এও এই তেতো সত্যিটা উঠে এল ভয়ানক ভাবেই।সুতরাং আক্ষরিক অর্থেই, “গোরা নকশাল”-এর বিবরণী সহজ ধারাপাত নয়। বড়দিন বা বছর শেষের পিকনিকের আমেজ মিটে গেলে, কখনও হাতে তুলে নিয়ে দেখা যেতে পারে “গোরা নকশাল” বইটি। ঠিক সেই প্রয়োজনে, যেই প্রয়োজনে কখনও কখনও একটা কঠিন বাস্তবের আয়নার সামনে দাঁড়ানো দরকার হয়ে পড়ে খুব। ভীষণ। ভীষণই !! 
শুভদীপ চক্রবর্তী

সাদা পায়রাটিকে যখন লাল প্রচ্ছদের মলাটের উপর উড়ে যেতে দেখলাম তখন মনে হল মলাটের ওপারে এক নতুন ভোরের আহ্বান আছে। নতুন স্বপ্ন দেখার কথা বলা আছে। আমরা যারা ৭০ দশকের কথা শুধুমাত্র বইয়ের পাতা থেকে জেনেছি এবং সেই সময়টাকে নিজের করে নিতে চেয়েছি তাদের কাছে এই উড়ে যাওয়া সাদা পায়রাটি মলাটের ওপারের পাতাগুলোয় কলমে লিখে গেছে ‘নকশাল মানে যারা উড়তে পারে’। কল্লোল লাহিড়ীর প্রথম উপন্যাস ‘গোরা নকশাল’ আমাদের দিন ও রাতের সেই সন্ধিক্ষণে নিয়ে গিয়ে ফেলে যেখানে ভোরের কুয়াশা ভেতর থেকে সাদা পাঞ্জাবী পাজামা পরে খোঁড়াতে খোঁড়াতে একটি মানুষ এগিয়ে আসে, বাস্তুহারা সেজন ভেবেছিল একদিন সবকিছু বদলে ফেলা যাবে। গুরুচন্ডালঌ থেকে প্রকাশিত ‘গোরা নকশাল’ ইমেজের মত আমাদের চোখের সামনে সেইসব দৃশ্য তুলে ধরে যা সত্তর পরবর্তী সময়ে শহরের অনতিদূরের মফঃস্বল চাক্ষুষ করছে। যেখানে জুটমিলের সাইরেনে ঘুম ভাঙা মফঃস্বলবাসী দেখে সদ্য জেল থেকে ছাড়া পাওয়া গোরার সাদা পাঞ্জাবী ভেসে যাচ্ছে ছোট টুকনুর রক্তে। আর গোরা ফিরে যাচ্ছে জেলে তার চোখের সামনে যখন তার বন্ধু প্রিয়াংশুর খুলি উড়িয়ে দেওয়া হয় সেই দৃশ্যে, যেখানে মেঝে ভেসে যাচ্ছে রক্ত গঙ্গায় আর দূরের সেল থেকে প্রিয়াংশুর সদ্যজাত কন্যা প্রথমবার কেঁদে উঠছে। আর এর অনেক পরে যখন টুকনুর মাথার ব্যাথা কমে গেছে যখন গোরা নকশাল টুকনুর বন্ধু হয়ে গেছে যখন টুকনু জেনে গেছে আসলে তার কাকা হাঁদার পায়রা নকশাল আর গোরা হল সেই প্রজাতির যারা উড়তে পারে, ঠিক তখন বয়ে যাওয়া গঙ্গায় তার বন্ধু ঠুলি টেনে নিয়ে আসে গলার নলি কাটা সুশান্তর লাশ, যে বলেছিল ‘ছোটদের মারতে নেই’। যে চশমা ছাড়া কিছুই দেখতে পেতনা, যে প্রেসিডেন্সীর মেধাবী ছাত্র হয়ে সুনাম কুড়োতে পারত কিন্তু শ্রমিকের হক আদায় করতে গিয়ে পুলিশের লাঠি এসে পরেছিল তার পিঠে। সেই সুশান্তের লাশ সেদিন টুকনুর চোখের জল আটকাতে পারেনি। উদ্বাস্তু হয়ে এদেশে আসা কিছু মানুষ, যাদের চোখে ওপার বাংলার স্মৃতি এখনও স্পষ্ট যারা আজও মনে করে সুদিন আসবে সেরম কিছু মানুষের সামনে হঠাৎই হাজির হয় জেল ফেরত গোরা। যে একদিন উড়বে বলে নকশাল হয়েছিল। ছোট টুকনুর চোখ দিয়ে এই নকশালের উড়ে বেড়ানোর ইতিবৃত্তই আসলে গোরা নকশালের পাতায় লিখিত। আর তার মাঝে এসে পরা এমন কিছু চরিত্র যারা আজ আমাদের চারপাশ থেকে উধাও। যাদের জবানী কেউ কোনদিন নেয়নি সেইরকম কিছু চরিত্র এবং একটি নদী, যে এই সব চরিত্রদের ঘটনার সাথে সমান্তরাল ভাবে বয়ে চলেছে আর সাক্ষী থাকছে এক বিরাট সময়ের। এদের নিয়েই গোরা নকশালের পথ চলা শেষের দিকে। আসলে শেষ নয় স্বপ্নের দিকে, যে স্বপ্ন একদিন বলেছিল সুদিন আসবে, যেদিন সবাই দুবেলা দুমুঠো পাবে। সেই স্বপ্নের দিকে। যে স্বপ্ন একদিন মুখ দিয়ে রক্ত উঠতে উঠতে টিবি হাসপাতালের সরকারী বিনামুল্যের বেডে মুক্তি পাবে। উড়ে যাবে। কারন ওই যে শুরুতেই বলেছিলাম ‘নকশাল মানে যারা উড়তে পারে’।
এই উপন্যাসের প্রধান প্রাপ্তি এই উপন্যাস যে ভাষায় লেখা তার সাথে দৃশ্য ভাষার অনেক মিল। ঘটনাগুলো যেন ইমেজের মত আমাদের চোখের সামনে চলে আসে। উপন্যাসের ভূমিকাতেও এই একই কথা বলা আছে। যদিও বলা হয়েছে চরিত্রদের সাথে বাস্তবের কোন চরিত্রের মিল নেই তবুও পড়তে পড়তে বারবার মনে হবে এই দৃশ্যের সাথে পরিচয় না থাকলে কিভাবে সম্ভব এই অখ্যান রচনা? এক সময়কে ধরতে গিয়ে তার আগেপরের সময়কেও ধরিয়ে দেওয়া, চরিত্রের মূল্যবোধ নয় চরিত্রের দর্শনকে প্রাধান্য দেওয়া এবং সর্বোপরি আজকের এই দুঃসময়ে দাড়িয়ে যেখানে ধীরে ধীরে আমরা বলার ভাষা হারাচ্ছি, ইনটলারেন্ট হয়ে পরছি, ধর্মের নামে মানুষে মানুষে বিভেদ সৃষ্টি করছি, রাষ্ট্র যন্ত্রের বিকলাঙ্গতাকে এড়িয়ে চলছি ঠিক সেই সময় এমন এক সময়কে আমাদের সামনে দাঁড় করানো যেখানে রাষ্ট্র যন্ত্রের বিকলাঙ্গতার বিরুদ্ধে আঙুল তুলে যুদ্ধ ঘোষণা করা হয়েছিল এই দাবীতে যে সবাই যেন দুবেলা দুমুঠো খেতে পায়, আর তার পরিণতিতে রাষ্ট্র তাদের দুচোখ উপরে নিয়েছিল, বিকলাঙ্গ করে দিয়েছিল, খুলি উড়িয়ে দিয়ে গঙ্গার জলে ভাসিয়ে দিয়েছিল, ঠিক সেই সময়কে তুলে আনার জন্য এই সময়ে দাড়িয়ে এই উপন্যাস অবশ্য পাঠ্য আমাদের, আমরা যারা দিনবদলের স্বপ্ন দেখি, আমরা যারা সুদিন আসবে বলে এখনও ভাবি।
প্রসঙ্গত গত ৯ই ডিসেম্বর বইটি প্রথমবার প্রকাশিত হওয়ার সময় এক আবছায়া ধুসর সময়ের ইতিহাস শুনতে শুনতে বারবার যেন মনে হচ্ছিল যেদিন হাজার সাদা পায়রা আকাশে উড়ে যাবে সেদিন আমরা ভাবতে পারব ‘নকশাল মানে যারা উড়তে পারত’। লেখকের আরও লেখা প্রকাশ হওয়ার অপেক্ষাতে রইলাম। বইটি কলেজস্ট্রীটের ধ্যানবিন্দু, দেজ এবং দে বুক স্টোর ছাড়াও অনলাইনে কলেজস্ট্রীট.কম থেকে সংগ্রহ করতে পারেন।
 
আদিত্য ঢালি 

'নকশাল মানে যারা উড়তে পারে'। গোরা নকশাল কি শুধুই সাদা উড়ন্ত এক পাখীর রূপকের আড়ালে সম্ভাব্যতার খোঁজ, আততি। নাকি সুস্থভাবে হাঁটতে পারার ক্ষমতা জেলে রেখে আসা দাড়িওয়ালা প্রসন্ন এক প্রতিস্পর্ধীর এক আবছায়া বিবরণ? সদ্য পড়ে উঠলাম এই বই। লেখক যে ছায়াছবির শিল্পচর্চার সাথে সংযুক্ত তা বয়ানের ঝোঁকে বেশ বুঝতে পারা যায়। ঝকঝকে নির্মাণ আর লেখকের মতে যা শুধুই 'কাল্পনিক' বিবরণ তা উত্তাল সত্তরের আর এক ভাষ্য। এবং শুধু তাও নয়। এ ভাষ্য স্বপ্নের বহমানতার। স্বপ্নবীজক অনন্ত জপের অসীম চংক্রমণের। পথ যাই হোক।গঙ্গাপারের মফস্বল জনপদ বালীর এক উদবাস্তু পরিবারে টুকনু তার দাদা, ঠাকুমা আর বাবা-মায়ের জগতে উপস্থিত হয় তাদের এক নিকটাত্মীয় গোরা। গোরার পরিচয় বইএর নামেই তবু না বললে নয় যে টুকনুদের পায়রার নামও নকশাল। জেলযাপনের গর্বিত স্মারক চিহ্ন বয়ে চলা গোরার প্রসন্নতায় আলোকিত হয়ে ওঠে বয়ে চলা এক স্বপ্নের নদীপথ।
সে নদীতে কখনো গঙ্গা বেয়ে ভেসে আসে পরিচিত সদ্যউনিশ এক ছেলের ফুলে ওঠা লাশ। সে নদী কখনও হয়ে ওঠে স্থানীয় জুটমিলের দারোয়ান হরকিষনের গ্রামের ছোটো নদী কমলা। হরকিষনের মন খারাপ বহুদিন সে নদী না দেখে। হয়ত সে নদীরও মন খারাপ। এ বই গতকাল প্রকাশ হয়েছে যে বাড়িতে তারও নাম কমলা। উঁকি দিয়ে যায় স্বপ্নভঙ্গের অস্থির কিছু স্মৃতি। অধিকার চিনে বুঝে নেওয়ার অদম্য ইচ্ছার মুখে ক্ষমতাতন্ত্রের প্রদর্শন ছিঁড়েখুঁড়ে নিতে চায় যাবতীয় স্বপ্নের চারাগাছগুল্মদের। গোরা চোখ বোজেন একদিন বুক ভরা টিবিকীটাণু নিয়ে। প্রাচীন রিলেরেসের ক্লান্ত বিধ্বস্ত দৌড়বাজ প্রাচীন পবিত্র স্বপ্নদেরকে অবশ্য এগিয়ে দিয়েছেন। চোখ উপড়ে দিয়ে খুলিতে গুলি খাওয়া গোরার সহপথিক সেই জেলখানায় খুন হওয়া আলোর পথের আর এক অভিযাত্রী এবং গোরার কতশত বান্ধবদের নিজের, নিজেদের পারানির কড়ি এবং আলোর ঠিকানার খোঁজ আজ নতুন মানুষদের হাতে। টুকনুদের চোখে এবং কলমে সে স্বপ্ন বয়ে চলে তুরতুর করে। এ ভাষ্য তাই শুধু ভাঙাস্বপ্নের উপাখ্যান নয়। এ ভাষ্য ব্যাটনবদলের, নতুন চোখে দ্যাখার এবং অবশ্যই আগামী টুকনুদের করোটিতে সেঁধিয়ে ফণা তোলা ফোঁসফোঁসানির। কল্পনা এবং বাস্তবের সীমারেখা এখানে য্যানো সেই চশমাটা। যা ছাড়া সুশান্ত দেখতে পেতোনা ভালো। সেই সুশান্ত যার ফুলে ওঠা লাশ গঙ্গা থেকে তুলে আনে টুকনুর বন্ধু। পুলিশ তাকে ভ্যানে তোলার সময়ে যা পড়ে থাকে মাটিতে।প্রচ্ছদ খুব সুন্দর। লেখকের আরও লেখা আসুক। যেকোনো মাধ্যমেই পড়তে চাইবো।
 
অভিষেক সরকার

 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি