গোরা নকশাল
এক
'কিছুটা থাক
আলগোছেতে...কিছুটা থাক কাছে...কিছু কথা ছড়িয়ে পড়ুক...চেনা আলোর মাঝে...।''
খুব সকালে ঘুম ভাঙতে চাইতো না আমার। লেপের পরে লেপ,
চাদরের পরে চাদর এর গা থেকে ওর কাছ থেকে, ছেড়ে যাওয়া বিছানা থেকে টেনে টেনে গায়ে
চলে আসতো আমার। লম্বা চাটাইয়ে স্যাঁতসেঁতে পলেস্তারা খসা ঘরে শুয়ে থাকতো ওপার
বাংলা থেকে অনিচ্ছায় আসা উদ্বাস্তু মানুষ গুলো। আমিও তাদের মধ্যে কুন্ডুলী পাকিয়ে
লেপ, চাদর আর কাঁথার পাহাড়ের মধ্যে সেঁধিয়ে থাকতাম। সকালের রোদ আমাদের বালীর বাসায়
ঢুকতো না একটুও। কিন্তু মায়ের উনুনের ধোঁওয়া সারা ঘর ছেয়ে ছোটো ছোটো ঘুলঘুলি দিয়ে
বেরিয়ে যাওয়ার চেষ্টা করতো পাশের বাড়ির ডুমুর গাছের পাশ দিয়ে, শেফালীদের পাতকোয়া
পেরিয়ে অনেক দূরে আমার না দেখা কোনও এক মাঠের দিকে। পাশে বসা দাদার কম্বল জড়িয়ে
সকাল সকাল জোরে জোরে পড়া মুখস্থতে আমার ঘুম ভেঙে যেত। আমারা পিসিকে মণি ডাকতাম।
সেই যে কবে ছোট্টবেলায় বিধবা হয়ে আমাদের বাড়ি চলে এসছিলো আজো কেউ মনে করতে পারে
না। এমনকি ঠাম্মাও না। মণি ডিসেম্বরের
সেই শীতের সকালে গঙ্গায় স্নান করতে যাওয়ার উদ্যোগ নিতো। বাবার পরের সবচেয়ে রুগ্ন
ভাইকে আমরা ডাকতাম ‘হাঁদা’ বলে। হ্যাঁ তখন সেই আশির দশকের গোড়ায় হাঁদা-ভোঁদা খুব
পপুলার আমাদের মফস্বলের শহরে। কমলা রঙের চটি বই গুলো হাঁদাই কিনে দিতো আমাকে আর
দাদাকে। মাসের প্রথমের ‘শুকতারা’ নিয়ে কাড়াকাড়ি পড়তো। হাঁদা ঘুম থেকে উঠতো সবার
আগে। সকালের আহ্নিক সেরে বাবার কিছুদিন
আগে করে দেওয়া ছোট্ট চায়ের দোকানটা খুলতে ব্যাস্ত হয়ে পড়তো হাঁদা। আমার কানে এসে
পৌঁছোতো বাবারই গত রাতে পড়া সহজ পাঠের কবিতার একটা লাইন। “আমলকি বন কাঁপে যেন তার
বুক করে দুরু দুরু/ পেয়েছে খবর পাতা খসানোর সময় হয়েছে শুরু।” বই গুলো স্কুলে জমা
দেওয়ার আগে বাবার মনে হতো যেগুলো ভালো, যেগুলো সুন্দর, সেগুলো আরও একবার যদি পড়া
যায়। আমি ঢুলতাম, বাবা গড়্গড়িয়ে পড়ে চলতো। কখোনো সখনো দাদা ধুয়ো ধরতো এসে।
হ্যারিকেনের তেল যতক্ষণ না শেষ হয়, সারাদিনের ক্লান্ত মাখা মানুষ গুলো বাবার পাঠ
চুপটি করে শুনতো।ঠাকুমা তার মাঝেই একবার জেনে নিতে চেষ্টা করতো কবে রিলিফ ক্যাম্প
খুলবে? কবে তার ছানি অপারেশান হবে। দাদা লাইব্রেরী থেকে যে বই গুলো নিয়ে এসেছে
সেগুলো যে একটাও পড়া হচ্ছে না তার। সেই রাতের ঢুলুনির মধ্যেই আমি তক্কে তক্কে থাকি
আজ একাদশী, আজ ঠাকুমা নলেন গুড় মেখে খই খাবে। দুধ পাওয়া যায়নি। দুধকাকু বলে দিয়েছে
হরিণঘাটার দুধের দাম বেড়েছে। আসতে আরো পাঁচ-ছয় দিন লাগবে। ঠাম্মা হ্যারিকেনের সেই
নরম আলোয়, ওপার বাংলা থেকে আনা পদ্মকাটা কাঁসার বাটিতে একটু একটু করে জল ঢালে আর
মিইয়ে যেতে থাকে খই গুলো। গলার কাছে কোঁচা দেওয়া চাদরে ঢাকা আপাদমস্তক আমি অপেক্ষা
করি, অপেক্ষা করি কখন ঠাম্মা আমার হাতে তুলে দেবে একদলা জল মাখা খই। আমি সেই খই
মাখা খেতে খেতে গল্প শুনবো আওটা দুধের। পাখা দিয়ে বাতাস করা লোহার কড়াইয়ের ঘন
সরের। বাগানের ডয়রা কলার। ঠাম্মা আস্তে আস্তে খেতে খেতে আমার তো অনেকটা খাওয়া হয়ে
যায়। দুধহীন একাদশীতে বাটির শেষ জল মাখা খইটুকু যাতে বাড়ির সবচেয়ে বয়জ্যেষ্ঠ মানুষটার
পেটে যায় তা নিশ্চিত করতে মা আমাকে প্রায় জোর করে সেখান থেকে নিয়ে যায়। আমি রাগ
করে শুয়ে পড়ি। খাই না। রোজ রোজ ফুলকপি খেতে আমার ভালো লাগে না। বাবা কি একটু
পেঁয়াজ কলিও আনতে পারে না? আমার প্রশ্নের উত্তর দেওয়ার কোনো লোক থাকে না। কোথাও
যেন মায়ের ওপর গভীর অভিমান, রাগ আমার দুচোখ জড়িয়ে ঘুম নামায়। আমি স্বপ্নে দেখি
ঠাম্মার কোলাপোতার গোয়াল ঘরটাকে। দুধে ভর্তি লোহার সেই বড় কড়াইটাকে। তার ওপরে আসতে
আসতে জমতে থাকা সরের প্রলেপটাকে। ঠাম্মা বলেছে, বাবাকে একদিন বলবে সর জমিয়ে রাবড়ি
করতে। ঘুমের মধ্যে এইসব পাক খেতে খেতে সকাল নামে। লেপ টেনে নিতে থাকি… দাদার পড়ার
শব্দ শুনতে পাই…আমার চারপাশে জমতে থাকে উনুনের ধোঁওয়া।
লেপটাকে একটু ফাঁক করে বেলা বোঝার চেষ্টা আমার বৃথা
যায়।কারণ ঠান্ডা লেগে চোখ পিচুটিতে ভর্তি। বন্ধ হয়ে গেছে চোখ দুটো নিজে থেকে। আমার
ভয় লাগে। আর যদি না খোলে চোখ দুটো? আমার ভয় লাগে অন্ধকারে। আমি হাতড়াই। তাড়াতাড়ি
সরিয়ে ফেলি আমার গায়ের চাদর, লেপ, কাঁথা…স্তুপাকৃতি জড়তা। আমি প্রানপণে দাদাকে
খোঁজার চেষ্টা করি। দাদা বসে নেই কাছে। পড়ার আওয়াজ শুনতে পাওয়া যাচ্ছে না। আমি
মাকে ডাকি। মা শুনতে পায় না। বাইরে গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের ধারে কারা যেন পিকনিক
করতে যাবে বলে টেম্পোতে জোরে জোরে গান চালাচ্ছে।আমি ভয় পাই। ভীষণ ভয়। মণির কাছ
থেকে শোন, মণির দেশের আমার না দেখা সেই আশশ্যাওড়া গাছের কথা মনে পড়ে। সেই দুষ্টু
মামদোটার কথা মনে পড়ে। যে লেপের তলায় হিসি করা ছেলেদের ঘাড়ে চাপতো আর কুট কুট করে
চিমটি কাটতো। অনেক দিন হলো আমি আর হিসি করিনা বিছানায়। সত্যি মামদো। একটুও ভিজে
নেই শতরঞ্চি, তোষক কিছুই। ডাক্তার কাকিমা আমাকে অনেক গুলো কৃমির ট্যাবলেট দিয়েছে।
সব খেয়েছি। আমি আর রাস্তা দিয়ে হাঁটতে হাঁটতে হজমি ওয়ালার কাছ থেকে ‘পচা কুলের’
আচার খাই না। বিশ্বাস করো। মনে মনে যত বিড়বিড় করি ততই শরীরের গভীর গহণ কোনে ভয়টা
আমার সেঁধিয়ে যেতে থাকে। মাকে ডাকি, মণিকে ডাকি, হাঁদাকে ডাকি, দাদাকে ডাকি, কেউ
সাড়া দেয় না। চোখ বন্ধ করা চারপাশের অন্ধকার নিয়ে আমি এগোতে থাকি। আর বিপত্তিটা
সেখানেই হয়। লেপ, চাদর, বালিশ কাঁথা জড়িয়ে আমি সটান আছাড় খাই মেঝেতে। সেই প্রথম
আমার মাথা ফাটে।
কানের পাশ দিয়ে চটচটে কি একটা জিনিস গড়িয়ে যাচ্ছে
বুঝতে পারি না। মায়ের কান্নার শব্দ শুনতে পাই। ডাক্তার কাকিমা ঝুঁকে পড়ে ছুঁচ
ফোটায় আমার কপালে। আমি চিতকার জুড়ি। কিন্তু হাত পা ছুঁড়তে পারি না বড় একটা। কেউ
যেন আমাকে চেপে ধরে আছে। কোনোরকমে চোখটা খোলার চেষ্টা করি। দেখি একজন আমাকে কোলের
মধ্যে আঁকড়ে ধরে বসে আছে। তার শাদা রঙের পাঞ্জাবি
লাল হয়েছে আমার রক্তে। সকালের এক চিলতে রোদ্দুর এসে পড়েছে লোকটার মুখে।
একগাল ভর্তি দাড়ি… কোঁকড়ানো কালচে দাড়ি নিয়ে লোকটা আমার দিকে তাকিয়ে হাসছে কি? ওমা
তাইতো হাসছেই তো। আমার আরও কান্না পায়। আমার কষ্টে লোকটা কষ্ট পায় না, হাসে! তাহলে
কি এই সেই মণির জ্যান্ত মামদো? কোল থেকে নামতে চাই। ছটফট করতে থাকি। লোকটা আরো
জোরে জাপটে ধরে আমাকে। কিছুক্ষণ পর খাটের ওপর শুইয়ে দেয়।
বাবাকে বলতে শুনি “গোরা চা খেয়ে যাস।” লোকটা বসে না। খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যায়
দরজার দিকে। এমন ভাবে খোড়াচ্ছে যেন মনে হয় হাঁটতে কষ্ট হচ্ছে লোকটার। আমার সেটা
দেখে এক অদ্ভুত নৃশংস আনন্দ হয়। চিতকার করে বলি “ঠিক হয়েছে...আমাকে চেপে ধরেছো
তো...তাই ভগবান তোমার পাটা মুচকে দিয়েছে।” ঠিক তখনি অপ্রত্যাশিত ভাবে বাবা চিতকার
করে ওঠে “টুকনু”। দাদা অঙ্ক করতে করতে মুখ তুলে চায়। মা রান্না ঘর থেকে ছুটে আসে।
লোকটা দাঁড়ায় না। একবার পেছন ফিরে তাকিয়ে হাসে। আস্তে আস্তে বেরিয়ে যায়। মা এসে
আমার ওই ব্যান্ডেজ বাঁধা গালেই একটা থাপ্পড় কষিয়ে দেয়। মাকে কেউ বাধা দেয় না। মণি
আহা উহু করে এগিয়ে আসে না। ঠাম্মা অনেক বারের মতো এবার চিতকার করে বলে না... “
নিজেদের রাগ গুলা ওদের ওপর চাগাও ক্যান”। ফিসফিসিয়ে বাবাকে বলতে শুনি, আর কোনোদিন
বোলো না টুকনু। ওর পা দুটো পুলিশ মেরে মেরে ভেঙে দিয়েছে। চিতকার করে বলি “বেশ
করেছে...। পুলিশ তো দুষ্টু লোকদের মারে।” মা আবার তেড়ে এসেছিলো। কিন্তু মারতে
পারেনি তার কারণ সেই একগাল দাড়ি ওয়ালা লোকটা হাতে শালপাতার ঠোঙা নিয়ে আমার ঘরের
দরজার সামনে দাঁড়িয়ে ছিলো এসে আবার। আমাদের বাড়ির সেই আসূ্য্যস্পর্শা দেওয়ালের
ফাঁক দিয়ে এক চিলতে রোদ এসে পড়েছিলো সেই লোকটার মুখে। তার শাদা পাঞ্জাবিতে
লেগেছিলো আমারই রক্তের দাগ। লোকটা অমিলন হাসিতে ভরিয়ে দিচ্ছিলো আমার সারা সকালটা।
খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে আসতে গিয়ে বলেছিলো, “টুকনু শুনলাম জিলিপি খেতে ভালোবাসে।”
এক ঠোঙা জিলিপি ধরে সেই শক্ত দুটো হাত। আরো অনেক পরে জানতে পারবো, যে হাত গুলো
থেকে খুবলে নেওয়া হয়েছিলো মাংস। ঠাম্মা অস্ফুট স্বরে শুধু বলে... “সেই ওরা তোকে
ছাড়লো...কিন্তু মাটাকে যদি একবার শেষ দেখা দেখতিস...। গোরা গোরা করে...”। বাবা
এবার ধমকায় ঠাম্মাকে। বাবার বকুনিতে চুপ করে ঠাম্মা। মা নিয়ে আসে গরম রুটি, নলেন
গুড়, আর লিকার চা। দুধ আসা বন্ধ। কারণ এই মাসে বাবার স্কুলের মাইনে হয়নি। শিক্ষকরা
কিসব যেন আন্দোলন করছে। আন্দোলনের কথা শুনলে লোকটার চোখ চিক-চিক করে ওঠে। আমি সেই
শীতের কুয়াশা ঘেরা সকালেও খুব যেন দেখতে পাই গভীর গহন চোখ দুটো। “কিছু বলবি না
গোরা তুই?” বাবার কথার জবাবে লোকটা শুধু বলে, “অনেক কাজ পড়ে আছে রবিদা। জেলের জামা
কাপড় গুলো কাচতে হবে। নদীর ধারে চিলে কোঠার ঘরটা একটু ঝাড়তে হবে। বই গুলোও
অনেকদিন...”। রোদ সরতে থাকে। লোকটাও খোঁড়াতে খোঁড়াতে এগিয়ে যায় সদর দরজার দিকে। ঘর
থেকে বেরিয়ে যায় সবাই লোকটার পিছু পিছু।
দাদার দিকে তাকাই। “কেরে দাদা?” দাদা অঙ্কর খাতা থেকে মাথা
তুলে বলে, “চিনিস না?” আমি ঘাড় নাড়াই, “না”। দাদা বলে “গোরা নকশাল”। কথাটা আমার
কানে বাজতে থাকে। হাঁদার একটা পোষা পায়রা আছে তার নাম নকশাল। হাঁদা বাঁশ দিয়ে হই
হই করে সেই পায়রাটাকে ওড়ায়। হাঁদার খুব দুঃখ আমাদের বাড়ির ছাদ নেই। মানে ছাদে যাওয়ার
অনুমতি দেয় নি বাড়িওয়ালা। কিন্তু নকশাল ছাদে যায়। নকশাল রেলিং এ বসে। নকশাল মনের
সুখে রোদ পোহায়। সেই রকম নকশাল? দাদা ঘাড় নাড়ে। “না”। দাদা গম্ভীর। ওর ঠোঁটের ওপর
একটা কালচে রঙের রেখা উঠছে। সেটা যত গাঢ় হচ্ছে দাদা তত গম্ভীর হয়ে যাচ্ছে। ইদানিং
আবার মাঝে মাঝে আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়াচ্ছে আর রেখাটাকে দেখছে। একবার নয় অনেকবার,
বারবার। মা বলেছে দাদা বড় হয়ে যাচ্ছে। সেই বড় হতে থাকা দাদা আমার দিকে তাকিয়ে বলে,
“নকশাল হলো তারা...যারা মনে করতো একদিন সব কিছু পালটে দেবে।” আমি জিভ উল্টোই, “এই
ঘেঁচু...। কিচ্ছু জানিস না তুই। আসলে ওটা পায়রার টাইটেল। যারা ভালো উড়তে পারে
তাদের নকশাল বলে। দেখিস না হাঁদার নকশালকে?” দাদা বেশি কথা বাড়ায় না। ক্লাসে ফাস্ট
হয়। কেউ ওর কথা এমন তুচ্ছ তাচ্ছিল্য করে না। আরো গম্ভীর হয়ে যায় সে। পাপ্পু খেলতে
আসে। আমার খেলা হয় না। কারণ বেঁহুশ জ্বর আমাকে ঘিরে ধরেছে। মাথা ফাটার সাময়িক
ধাক্কাটা আমি আস্তে আস্তে টের পেতে থাকি। চারপাশে আঁধার নামতে থাকে। আমার আর কোনো
জ্ঞান থাকে না। সেই অন্ধকারের মধ্যে দেখতে পাই শাদা পাঞ্জাবি পরা গোরা নকশাল আমাকে
চেপে ধরে আছে। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী আমার রক্তের রাঙা। আর দাদা বলে চলেছে “নকশাল
হলো তারা...যারা মনে করতো একদিন সব কিছু পালটে দেবে”। জ্বরের
ঘোরে আমার চোখের সামনে কোথা থেকে যেন মামদো উধাও হয়। গোরা নকশাল উজার হয়ে
থাকে।ঠাম্মা বাবাকে ফিসফিস করে কিসব যেন বলতে থাকে। অনেক রাত…, পুলিশের জিপ…। আমি
ঘুমিয়ে পড়তে থাকি। আমার মাথায় তখন মায়ের হাত। আমার মাথায় তখন জল পট্টি। সোনার কাঠি
আর রূপোর কাঠি ছুঁইয়ে কেউ যেন আমাকে ঘুম পাড়িয়ে রাখছে অনেক দিনের জন্যে।হাঁদার সেই
ধপধপে সাদা পায়রা নকশাল আমার দিকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখছে। আমি দাদাকে বলছি নকশাল আসলে
পায়রাদের টাইটেল। তারপর কিছু মনে নেই। ছোটদের সব কিছু মনে রাখা উচিত নয়। আসলে
ওগুলো সব স্বপ্ন…কিম্বা…গল্প…আসলে যা শুনছো…দেখছো সবটাই ম্যাজিক…। ম্যাজিক দেখাতে
দেখাতে একটা ফেরিওয়ালা আমাকে আর দাদাকে বলেছিলো। আজ সকালে আমার সামনে এমন একটা
ম্যাজিক হয়েছে। আমি সারা জীবনের জন্যে গোরা নকশালকে পেয়ে গেছি!
দুই
“যাদের
সামনের পথটা অজানা...আর পেছনের পথটা বিস্মৃত...তারাই গোলকধাঁধার পথে অন্তরীণ...”
হাতে ধরা
আমার মুঠো ফোন বিপ বিপ করে বেজে ওঠে। শীতের রাত চিরে ছুটছে সেদিনের শেষ ডানকুনি
লোকাল...আমি ছুটছি বাড়ি...সারাদিন আমাকে ক্লান্ত করে রেখেছে কয়েকটা
মিটিং...সারাদিন ক্লান্ত আমি না করা কাজের চাপে। মুঠোফোন বেজে যায়। ওপার থেকে ভেসে
আসে খুব কাছের এক বন্ধুর গলা...
“হাতে কিছু
কাজ আছে?”
মানে?
“না...কোনো
কিছু করছিস কি এখন?”
বাড়ি
যাচ্ছি...।
“উফ...তুই
বড্ড এঁড়া টাইপের ছেলে মাইরি...জানতে চাইছি এখন ব্যাস্ততা কেমন?”
কেনো বলতো?
“শোন...ওই যে
তোর একটা ছোট লেখা বেরিয়েছিলো না...।”
ফিল্মের
রিভিউ?
“উফ
না...না...।
মেগা
সিরিয়াল?
“সেটাও আজকাল
ছাপাচ্ছিস নাকি? পাবলিক মাইরি তুই...”
কোনটা
বলতো...ঠিক বুঝতে পারছি না...আমার ব্লগে?
“সেটা আমার
মনে থাকলে তো হয়েই যেত...। ওই যে যাত্রা নিয়ে লেখার সময়...কে একজন মারা গেলেন
না...”।
শান্তি
গোপাল?
“রাইট...হ্যাঁ
হ্যাঁ...। ওই লেখাটা।”
তোর চাই?
“না। শোন আগে
কথাটা...ওই লেখাটাতে... খুব ছোট করে লিখেছিলিস...ওই যে তোর কাকা না কে...নকশাল
নকশাল...!”
গোরা নকশাল?
“হ্যাঁ...হ্যাঁ...একদম
ঠিক...শোন ওই লোকটাকে নিয়ে ছবি করতে চাই...”
ফিল্ম?
“একদম...।”
হঠাৎ? আর
কোনো সাবজেক্ট পাচ্ছিস না বুঝি?
“তোকে এতো
কিছুর জবাব দিতে পারবো না ফোনে...আর তেমন কিছু তোকে করতেও হবে না। শুধু নিজের মতো
করে লিখে যেতে হবে।”
লিখে যেতে
হবে মানে?
“আরে একটা
পার্সোনাল জার্নি...সহজে কিছু বোঝানো যায় না তোকে”।
গোরা নকশালকে
নিয়ে?
“রাইট...বেঁচে
আছে না লোকটা এখোনো?”
হ্যাঁ...মানে...না...মানে...
“কী মানে
মানে করছিস?”
আসলে সবটা
সত্যি নয়...।
মানে?
মানে ওটা
একটা গল্প...কিছু মানুষের...। যাদের কাছে স্বাধীনতা মানে ছিলো দেশ ভাগ... যারা
ভেবেছিলো আবার একদিন তারা ফিরে যেতে পারবে নিজের দেশে...নিজের গ্রামে...। কিন্তু
হয়নি...। খাদ্য, বস্ত্র, বাসস্থানের নায্য দাবীতে যারা একসময় পথে নেমে ছিল...যাদের
কাছে বেঁচে থাকাটা পুরোটাই স্বপ্ন আর স্মৃতি...
“থাক...থাক...পলিটিকাল
এজেন্ডা দাঁড় করিয়ে দিচ্ছিস তো..এর মধ্যে গোরা নকশাল কোথায়...?”
আছে...।
“স্বপ্নে না
স্মৃতিতে?”
সিনেমায়...।
“লিখবি?
সত্যি তুই লিখবি আমার জন্য?”
হ্যাঁ...।
ফোন কেটে
যায়। বালী বিজ্রের ওপর দিয়ে ছুটে চলেছে ট্রেন। গঙ্গার ঠান্ডা হাওয়া এসে লাগছে আমার
চোখে মুখে। আমি ফিরে যাচ্ছি আমাদের লোড শেডিং এর দিন গুলোয়...ফিরে যাচ্ছি সেই
বয়েসটায় যেখানে বড় হওয়ার বড্ড তাড়া ছিলো। মা থার্মোমিটারটা আমার মুখ থেকে নিয়ে
নিচ্ছে...। একটু হাসছে...। জ্বর আর নেই...। তিনদিনের পরে আমার তপ্ত গা ঠান্ডা হয়।
সারা রাত জাগা মায়ের মুখটা অনেকদিন পরে খুব দেখতে ইচ্ছে করে। ট্রেন থেকে নেমে আমি
বাড়ি যাই। আর ওদিকে পুলিশের গাড়ি থেকে ঠেলে নামিয়ে দেওয়া হয় গোরা নকশালকে। এক
মাঘের শীতের রাতে, জমকালো আঁধারে। খোঁড়াতে খোঁড়াতে গোরা নকশাল
এসে বসে খেয়া ঘাটে। যেখানে মাঝিরা শুকনো পাতা জড়ো করে আগুন জ্বা্লিয়েছে। গা
ঘেঁষাঘেঁষি করে বসে আছে সবাই। বুড়ো শিব প্রামানিক সেই আগুন আলোর ধোঁওয়ার মধ্যে
গোরা নকশালকে ঠিক চিনে নেয়। গোরা না? হ্যাঁ তাই তো...। কবে এলো এই মানুষটা? কবে
ছাড়া পেলো? সেই যে একবার পুলিশের তাড়া খেয়ে লোকটাকে নদী পার করে দিয়েছিলো শিব...।
তারপর আর দেখেনি কোনোদিন। শুনেছিলো জেলে আছে। পচছে। এর মধ্যে কত কি তো ঘটে গেলো। কত কচি কচি ছেলের লাশ গঙ্গা দিয়ে ভাসতে
দেখলো শিব। কংগ্রেস গেলো...যুক্ত ফ্রন্ট এলো...আবার কংগ্রেস...। এখন আবার লাল
পার্টি এসেছে। শিব একবার লরি করে ময়দানে গিয়েছিল। বিশাল জমায়েত দূর থেকে অনেক উঁচু
মাঁচার ওপর এক লোককে দেখেছিল শিব। বেঁটে খাটো চশমা পরা লোকটা নাকি এবারের
মুখ্যমন্ত্রী। গরীবের বন্ধু...। “হাঁ গা...লোকটার নাম কী?” রুটি ভেলিগুড় দেওয়া
অল্প বয়স্ক ছেলেটা তাকিয়ে ছিল এক মুহূর্ত তার অনেক পাওয়ারের চশমার ফাঁক দিয়ে। “উনি
কমরেড জ্যোতি বসু।” শিব অনেক দূর থেকে গরীবের বন্ধুকে দেখেছিল। সব কথা বুঝতে
পারেনি সেদিন...। শিব সব কথা বুঝতে পারে না। আবার আগের মতো গঙ্গায় মাছ এলেই হয়...।
ইলিশের মরশুমে তেমন তো মাছ উঠলো না...। বউটা অসুস্থ, ছেলেটার জুটমিলে কিসব গন্ডগোল
শুরু হয়েছে। খুব টাকার দরকার শিবের।
গোরা নকশাল
নদীর রাস্তার দিকে তাকায়। একদল মানুষ গোল হয়ে বসে আগুন পোহায়। সেই কবে থেকে যেন
মানুষ এমন করেই আগুনের ধারে বসে আছে। সেই কবে মানুষ জোটবদ্ধ হলো। তাদের নিজেদের
কথা নিজেরাই গুছিয়ে বললো। ভাবতে গেলে মাথা টনটন করে গোরা নকশালের। কতদিন পরে সে
জেলের বাইরে পা রাখলো। গল্প শুনতে ভালো লাগে তার। মানুষ গুলোর মাঝে এসে বসে।
আগুনের সামনে। খোলা আকাশের দিকে তাকায়। অনেক দিন পর সে রাত দেখছে...অনেক দিন পর সে
ঠান্ডা বাতাসে। অনেকদিন পর সে মানুষের ঘামের গন্ধ শুঁকছে। অনেকদিন পর সে বুঝতে
পেরেছে...আসলে সব কিছু পাল্টে দেওয়া যায় না। সব কিছু পালটে দিতে দেয় না মানুষ।
হাঁটু মুড়ে
বসতে পারে না গোরা। শিব এগিয়ে এসে ভাঙা একটা টুল এগিয়ে দেয়। শিব বলে “চিনতে পারছেন
কত্তা?” গোরার চোখ চিক চিক করে ওঠে। শিব নৌকা বাইছে...আর পেছনে পুলিশের লঞ্চ...।
গোরা কি ঝাঁপ দিয়েছিলো জলে? নাকি শিব পার করে দিয়েছিলো তাকে? গোরা মনে করার চেষ্টা
করে। পারে না। অনেক কিছু মনে নেই তার। অনেক কিছু ভুলে গেছে। মাথায় ওরা লোহার বাঁট
দিয়ে মারতো...। মাথাটা নীচের দিকে করে পাটা ঝুলিয়ে দিতো...। চোখের সামনে জ্বেলে
দিতো একটা বাল্ব...। চোখের সামনে সেই উজ্জ্বল ধাঁধার নির্যাতিত আলোতে গোরা নকশাল
দেখতে পেতো খুলনার প্রাথমিক স্কুলটাকে....। গোরা নকশাল দেখতে পেতো একুশে ফেব্রুয়ারীর অলৌকিক
ভোর...। গোরা নকশাল দেখতো স্বাধীন বাংলাদেশ। গোরা নকশাল শুনতে পেতো “তোর পিঠে
কাঁটা তারের দাগ”। এক উদ্বাস্তু নকশাল হয়েছে বলে পুলিশ গুলো হাসাহাসি করতো। গোরা
নকশাল অজ্ঞান হয়ে যেত। পাশের পুলিশ অফিসারের কাঁচা কাঁচা খিস্তি তার আর কানে এসে
পৌঁছোতো না...। গোরা নকশাল অন্ধকারের মধ্যে শুধু টপকাতে থাকতো একের পর এক মাঠ...।
পালটে দিতে হবে সব কিছু। ওই সব হারানো মানুষগুলোর সব কিছু ফেরত দিতে হবে দেশ...কাল...স্বাধীনতা...অধিকার...। বাঁচার
অধিকার। ঝোলার মধ্যে থেকে বেরিয়ে আসতো পিস্তল...। আর গোরা নকশাল হোঁচট খেয়ে পড়ে
যেত...বারবার...। কিছুতেই পেরোতে পারতো না অন্ধকার সেই মাঠটা। যে মাঠটার উলটো
দিকেই আস্তে আস্তে ভোরের আকাশটা পরিষ্কার হচ্ছে। ওখান থেকেই দিনের প্রথম আগুন রঙা
সূর্য উঠবে।
শিব
প্রামানিক এসে দেখে গোরা নকশাল ঘুমিয়ে পড়েছে টুলে বসেই। একটা মানুষ কেমন ছিলো আর
কি হয়েছে। তাগড়া মানুষটার সমস্ত শরীর যেন চিবিয়ে খেয়ে নিয়েছে কেউ এই এতগুলো বছরে।
শিব নৌকো থেকে নিয়ে আসে একটা ছেঁড়া কাঁথা। গোরা নকশালের গায়ে চাপিয়ে দেয়। ঘুমোক।
জেলে কি ঘুম হয়? তাও তো ওর লাশটা অনেকের মতো গঙ্গা দিয়ে ভেসে যায়নি। অনেকের মতো
বৈঠা দিয়ে ঠেলে ফেলে দিতে হয়নি জলে, কুকুরে খাওয়া সেই সমত্ত ছেলেটার লাশটার মতো।
“ঘুমোও কত্তা...ঘুমোও। কাল সকালে তোমায় দিয়ে আসবোনি তোমার বাবার বাড়ি।” সকালে উঠে
শিব দেখেছিলো গোরা নকশাল আর সেখানে নেই। প্রথম সূর্যের আলোয় পড়েছিল ভাঙা টুলটা।
গতরাতের ছেঁড়া কাঁথা আর অল্প অল্প ধোঁওয়া ওঠা আগুনের শেষ আঁচটুকু। গোরা নকশাল সেই
অলৌকিক ভোরে আসতে আসতে এগিয়ে গিয়ে সদর দরজা খুলেছিল রবি মাষ্টারের বাড়ির। নিজের
বাড়ি বলে ভুল করে ঢুকে পড়েছিলো সে।
ভুল করে ঢুকে
পড়েছিলো? নাকি গোরা নকশাল খুঁজতে গিয়েছিলো তার ছোটোবেলাকে...তার মাকে...ওপার
বাংলার মানুষগুলোর গায়ের গন্ধকে। যা অনেককাল আগেই জেলের ছোট্ট খুপরিতে সে হারিয়ে
ফেলেছিলো। গোরা নকশাল দেখেছিলো একটা ছোট্ট ছেলেকে। গোরা নকশাল দেখেছিলো রক্তে ধুয়ে
যাচ্ছে ধরণী। কেউ যেন কবে একটা বলেছিলো “তোমরা আমাকে রক্ত দাও আমি তোমাদের
স্বাধীনতা দেবো”। কোথাও যেন শুনেছিলো “সশস্ত্র বিপ্লবই আমাদের একমাত্র পথ”। গোরা
নকশাল ছুট্টে গিয়েছিলো ছোট্ট ছেলেটার কাছে। আঁকড়ে ধরেছিলো ছটফট করতে থাকা
ছেলেটাকে। ডাক্তার কিস্কু তার মাথায় সেলাই করেছিল। গোরা নকশালের শাদা পাঞ্জাবী
ভিজে গিয়েছিলো তাজা রক্তে। অনেক দিন পর রক্তের ঝাঁঝটা গোরা নকশালের নাকে এসে
লেগেছিলো। একটা ছোট্ট তাজা প্রানকে আঁকড়ে ধরে রেখেছিলো গোরা নকশাল। আর সেই প্রানের
যাবতীয় স্পন্দন যেন নিজের ভাঙা শরীরটার মধ্যে সঞ্চারিত করে নিচ্ছিলো সে। আর ঠিক
তখনি...হ্যাঁ তখনি... জঙ্গলের মধ্যে একটা লাল পতাকা উড়তে দেখেছিলো গোরা নকশাল।
সকাল হয়ে আসছিলো। কারা যেন গেয়ে উঠছিলো “একদিন সূর্যের ভোর...”। কারা যেন শিস
দিচ্ছিলো। আর খেপা কুকুরের মতো ঝাঁক ঝাঁক গুলি এসে লাগছিলো সতীর্থদের গায়ে। গোরা নকশাল
চোখ বন্ধ করে। কোলের মধ্যে ছটফট করছে বাচ্চাটা। ওখানে প্রান আছে, ওখানে ক্ষিদে
আছে, ওখানে আছে অধিকার বুঝে নেওয়ার বীজ মন্ত্র।
গোরা নকশাল
কি তাহলে আরো একবার বাঁচতে চাইছে? সেটা বোঝা যাচ্ছে না। শুধু সেই মুহূর্তে দেখতে
পাওয়া যাচ্ছে উঁচু পাঁচিলের গা ঘেঁষে এক ফালি রোদ এসে পড়েছে গোরা নকশালের মুখে। কালো
কোঁকড়ানো দাড়ি ভর্তি ফরসা মুখটা অমলিন হাসিতে টুকনুর দিকে তাকিয়ে আছে। টুকনু রেগে
যাচ্ছে...। টুকনু ভয় পাচ্ছে।..টুকনু চিনতে পারছে না গোরা নকশালকে...। চিনবে কী করে? তার বাবার জ্যেঠতুতো ভাইকে তো এই
প্রথম দেখলো সে। তখনও টুকনু জানে না একদিন সে গোরা নকশালকে নিয়ে ইয়াবড় একটা গল্প
ফাঁদার চেষ্টা করবে!
তিন
“বিজয়ের পথে এগিয়ে চলো! স্বদেশ অথবা
মৃত্যু !... সবটুকু বিপ্লবী উষ্ণতা দিয়ে আলিঙ্গন করছি তোমাকে!”
জ্বর, পেট
ব্যাথা, শর্দি, সারা গায়ে গুটি গুটি এলার্জি এই সব হলে সাধারণত আমার আনন্দ হয়। আর
একবার হলে দিন কয়েকের জন্যে আমার পড়াশুনো সব শিকেয় ওঠে। মা সরস্বতীর রাজ হাঁস সব
বই পত্তর নিয়ে চৌপাট দেয় আমার এ্যালুমিনিয়ামের স্কুল বাক্সে। ধুলো জমে। মাকড়সা এসে
বাসা বাঁধে। হাঁদার সাদা পায়রা নকশাল এসে মাঝে মাঝে তার ওপর একটু পাখনা মেলে ঘুরে
বেড়িয়ে আমার দিকে ঘাড় কাত করে তাকায়। ভাবটা যেন... “টুকনু তুই হাড়ে বজ্জাত।” একটু
সবুজ রঙের হাগুও করে দিয়ে যায়। তখনি বাড়ির সবার টনক নড়ে। তখনি খোঁজ পড়ে আমি অনেক
দিন পড়ি না। দাদা কত পড়ে। সদ্য ওঠা গোঁফ নিয়ে, জ্যাবড়া করে মাথায় নারকোল তেল আর
গায়ে পিঠে সরষের তেল মেখে রোদ না আসা উঠোনের এক কোনায় শীতের দুপুরে অঙ্ক করে।
আমাকে বাবা বকে না। বলে “ওকে ছেড়ে দাও...বাপী তো আছে...ওই সামলে নেবে ভাইকে।
...দেখ টুকনু নকশালও তোর এই না পড়া সহ্য করতে পারছে না। দিয়েছে অপ কম্মটি করে। ”
আমিও তক্কে তক্কে থাকি। আসুক পাশের বাড়ির হুলোটা একদিন। এমন মাংস ভোজ হবে না...তোর
সব রেলা বেড়িয়ে যাবে। ঘাড় কেতলে পড়ে থাকবি...কিম্বা গোরা নকশালের মতো পা মুচকে
যাবে। দাদা আবার অঙ্ক খাতা থেকে মাথা তোলে। গম্ভীর হয়ে তাকায়। আজ আমার জ্বরের তিন
দিন। মাথার ঘাটা শুকিয়েছে। দাদা কেনো কারোরই দেখি পছন্দ নয় গোরা নকশালকে নিয়ে আল
টপকা এমন সব কথা বলা...। তিন দিন গোরা নকশাল আমাদের বাড়ির দিকে আসেনি। তিনদিন আমিও
যে বিছানা থেকে খুব একটা উঠতে পেরেছি তেমনটাও নয়। দাদা আবার অঙ্কে মন দিলে আমি আমার
গলার কাছে গিঁট বাঁধা চাদরটা ঠিক করে নিই...। “গোরো কিনা কালো কি...” গুনগুন করে
আসে গানটা গলার কাছেই। কালই পিকনিক পার্টি চালাচ্ছিলো মাইকে।
জিটি রোডের
পাশে হনুমান জুটমিলের কোয়ার্টারের দেওয়ালে পোষ্টার এঁটে দিয়েছে হরেন কাকা নতুন
সিনেমার। হরেন কাকা পোষ্টার সাঁটে। দুপুরে সবাই যখন ঘুমিয়ে পড়ে, হরেন কাকা ছোট্ট
মই, একটা বালতি ভর্তি আঠা আর পোষ্টার নিয়ে বের হয়। আমি পিছু নিলেই ঘাবড়ে যায় ছোটো
খাটো মানুষটা। কাইমাই করে ওঠে। ওর ধারণা মাষ্টার বাবু ওকে বকবে। আমাকে বাধ্য হয়ে
চলে আসতে হয়। তবে আসার আগে শর্ত হিসেবে হরেন কাকা বলে দেয় পোষ্টারে নাকি লেখা আছে
ডিস্কো ডান্সার। মিঠুনের বই। হেবি হিট। শ্রীকৃষ্ণতে এসেছে। হরেন কাকার কান ঢাকা
চুল। হরেন কাকার সাদা রঙের চটি। হরেন কাকা বিড়ি খায়। আর হাঁদার দোকানে চা। দাদা
ডাকে। পেছন ফিরে তাকাই। “বাবা হিন্দি গান করতে বারণ করেছে না?” আমি মুখ ভ্যাঙাই। ওকে দেখিয়ে দেখিয়ে হরেন কাকার মতো
কানের ওপর চুল গুলোকে আনতে চাই। দাদা চিতকার করে ওঠে... “ওই দেখো মা ভাই হিন্দি
গান গাইছে...কানের ওপর চুল টানছে”। রান্না ঘর থেকে ভেসে আসে মায়ের গলা... “ওকে
এবার ঠিক নেড়া করে দেবো দেখ...।” আমি পালাই। বাড়িতে একমাত্র মাকে ভয় পাই। আর কাউকে
না। আমার পালানোর চোটে নকশালের দানার থালা উলটে যায়। নকশাল গলা ফুলিয়ে পাঁচিলের
ওপরে ঘাড় কাত করে আমাকে দেখে। আমি ঠিক জানি যারা উড়তে পারে তাদের নাম হয় নকশাল।
দাদা ভুল, কোনো মানুষ কি কিছু পালটে দিতে পারে? থমকে দাঁড়াই। স্কুলে একটা লোক
ম্যাজিক দেখাতে এসেছিলো। সে সবুজ রঙের সব ফুল গুলোকে লাল করে দিলো। তাহলে কি গোরা
নকশাল ম্যাজিশিয়ান? কিছুতেই ওই লোকটার কথা ভুলতে পারছি না কেনো? এতো মণির মামদোর
চেয়েও খুব খারাপ।
গোরা নকশালকে
ভুলে এগোতে গেলে বাবার সাথে দেখা হয়ে যায়। বাবার ব্যাগ থেকে পেঁয়াজ কলি উঁকি মারতে
দেখে আমার খুব আনন্দ হয়। বুঝতে পারি আজ খুব সুন্দর করে ভাত খাবো। বাবা রান্না ঘরের
সামনে ব্যাগ নামালে মা চিতকার করে ওঠে। “আচ্ছা আবার এই এতো পেঁয়াজ কলি আনলে?” বাবা
কথা ঘোরাতে চায়। “ওই জোর করে দিয়ে দিলো...বললো শেষবেলার বাজারে এসেছেন মাষ্টার
মশাই...এই কটা নিয়ে যান।” মা আরো রেগে যায়। “তার সঙ্গে তেলটাও দিয়ে দিলে পারতো।”
আমার সুন্দর মাটা দিন দিন কেমন যেন খিট খিটে হয়ে যাচ্ছে। বাবা ইশারায় আমাকে ওখান
থেকে চলে যেতে বলে। আমি রান্না ঘরের সামনে থেকে পালাই। জল খাবার কি হচ্ছে সেটা
জানার আর সাহস থাকে না আমার।
এখন তো শরীর
খারাপ তাই নানা টাল বাহানা, ফন্দি ফিকির এঁটে আমাকে পড়তে বসতে হয় না। পরীক্ষা শেষ,
বড় দিনের ছুটি তাই বাবার সাথে সক্কাল বেলা উঠে স্কুলে যেতে হয় না। শুধু চিন্তা
থাকে একবার স্কুলটা খুললে রেজাল্টটা যখন বেরোবে তখনকার কথা চিন্তা করে। শীতের
সকালটা কেমন যেন ভয় নিয়ে আসে আমার ওই হাফপ্যান্টের জীবনে। চুপটি করে
ঠাম্মার পুজোর পাশে গিয়ে বসি। হে ঠাকুর...আমাকে পাশ করিয়ে দিও বাবা...। চোখ বন্ধ
করি। আর ঠিক তখনি মণির কাছে জল পোড়া নিতে আসে পাশের পাড়ার দত্ত বাড়ির বৌ। লাল পাড়
শাদা শাড়ি। গলায় মোটা একটা সোনার চেন। পাড়ার মধ্যে ওদের বাড়িতেই একমাত্র ফোন আছে।
আমি কোনোদিন ফোন ধরিনি। দাদা বলেছে ফোনের মধ্যে থেকে নাকি পি পি আওয়াজ বেরোয়। দাদা
কে দত্ত গিন্নি মাঝে মাঝে নেমনতন্ন করে খাওয়ায়। ওর পৈতে হয়ে গেছে কিনা...। আমায়
করে না। আজ ষষ্ঠী...কাল একাদশী...পরশু অমুক লেগেই থাকে। দাদা এসে জোরে জোরে গড় গড়
করে বলে কি কি খাইয়েছে। হাঁদা, মণি, ঠাম্মা রেগে যায়। আমার তখন লুচি খেতে ইচ্ছে
করে। শিমাইয়ের পায়েশ খেতে ইচ্ছে করে। লাড্ডু খেতে ইচ্ছে করে। ইচ্ছে করে দু পা
ছড়িয়ে খুব করে কাঁদতে। হাঁদা আমাকে দোকানে নিয়ে যায়। বেঞ্চিতে বসিয়ে লম্বু দেয়।
আমি চায়ে ডুবিয়ে ডুবিয়ে খাই। আর জুটমিলের হরকিষাণ দারোয়ান তখন বসে একটু জিরোয়।
দেশের ছট পুজোর গল্প করে। তার গ্রামের পাশ দিয়েও নাকি গঙ্গার মতো এতো বড় না হলেও
একটা ছোট্ট নদী বয়ে গেছে। কমলা। সে দেশে যেতে পারেনি এই বছর, তার মন ভালো নেই।
মণি ফুঁ দিয়ে
জলের ওপর কিসব মন্ত্র পড়ে। হাত দিয়ে আঁকি বুঁকি কাটে জলের ওপর। অনেক দূর দূর থেকে
লোকজন আসে মণির কাছে। ভিড়টা একটু বেশি হয় শনি আর মঙ্গলবারে। কারো ঘাড় মচকে গেছে,
কারোর পিঠে ব্যাথা, কারো অনেক দিনের বাচ্চা হচ্ছে না। মণি সবার কথা শোনে, তারপর
কাগজের পুড়িয়াতে মুড়িয়ে মুড়িয়ে কিসব দেয়। দাদা বলে মণি অনেক তন্ত্র মন্ত্র জানে।
রাতের বেলায় ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে কথা বলে। বিড়বিড় করে। আমিও শুনেছি। কিন্তু ভয় পাইনি
কোনোদিন। কেনো ভয় পাবো? মণি, ঠাম্মা, বড়মা সেই যে কবে আঁধার রাত পেরিয়ে, কাঁটা তার
পেরিয়ে একা একা ইচ্ছামতী পার করে চলে এসেছিলো...। ঠাম্মা লক্ষ্মীর ঝাঁপিতে তুলে
নিয়েছিলো এক খাবলা দেশের মাটি। ঠাকুরের বাক্সতে এখোনো তাকে যত্ন করে পুজো করে
ঠাম্মা। রোজ সকালে প্রনাম করে। বাতাসা দেয়। তুলসী গাছ নেই...তুলসী তলা নেই...পুজো
করতে করতে আমার দিকে তাকিয়ে ছানি পাকা চোখ গোল গোল করে বলে “একটা বড় তুলসী মঞ্চ
ছিলো বুঝলি টুকনু...। বড় বড় পাতা। তোর দাদু সেখানে অষ্টম প্রহরের শামিয়ানা
টাঙাতো।” অষ্টম প্রহর কী আমি জানি না। আমার তিক্ষ্ণ নজর বাতাসার থালার দিকে। ডেঁও
পিঁপড়েদের আগে সেগুলো আমার পেটে। মণি ডাকে। কপালে হাত দিয়ে জ্বর দেখে। মাথায় ফুঁ
দিতে গেলে আমি সরিয়ে নিই। পাছে জ্বর সত্যি সত্যি সেরে যায়! মণি দাদাকে
পাঁচ টাকা দেয়। দত্ত গিন্নি প্রনামী দিয়েছে। আজ দুধ আসবে বাড়িতে। পায়েস হবে।
হাঁদার জন্মদিন। আমি গিয়ে জানলার ধারে বসি। মাথার ঘাটা শুকিয়ে এসেছে। কত লোক কত
কাজে যায় আমাদের বাড়ির সামনে দিয়ে। কত বড় বড় ট্রাক, বাস ছুটে যায় জিটি রোডের ওপর
দিয়ে। বাড়ির কোনের দিকের ছোট্ট ঘরটার জানলা দিয়ে সবটা দেখা যায়। আমি অনেকটা সময়
কাটাই এই ঘরে। মণি, ঠাম্মা, হাঁদা থাকে এই ঘরটায়। লম্বা একটা চাটাই পাতা হয়। শীতের
সময় কড়িকাঠ থেকে ঝোলা বাঁশের ওপরে রাখা লেপ, কম্বল পাড়া হয়। বড় পাঁচিলের ওপর থেকে
যেটুকু রোদ আসে সেটুকুতেই ওদের সেঁকা হয়। তারপর ঘরে ঘরে নাম করে সবার যা যা জিনিস
চলে যায়। ঘর বলতে তো ওই মোটে সাড়ে তিনটে। সামনে একটা উঠোন। আর উঠোনের পাশে রান্না
ঘর। উঠোনের আর একদিকে পায়খানা। সকালে ওদিকটা আবার মেথর এলে যাওয়া যায় না। খাটা
পায়খানা থেকে গন্ধ আসে খুব। হরি মেথর বড় বড় দুটো টিনের ডাব্বা একটা ছোট্ট গাড়িতে
ঠেলতে ঠেলতে নিয়ে আসে। সঙ্গে থাকে বড় একটা হাতা। বড় বড় হাতা দিয়ে রাস্তার ওপরে
দাঁড়িয়ে হরি মেথর গু ঢালে বড় টিনের ডাব্বাতে। হাঁদা ঠিক উলটো দিকের দোকানে উনুনে
আঁচ ধরায়। সাতটার সাইরেন পড়ে। জুটমিল ছুটি হয়। বিহার থেকে আসা সব মানুষ গুলো জড়ো হয়
হাঁদার দোকানের সামনে। শীতের সকালে ওদের মুখে চোখে লেগে থাকে সারা রাত জেগে কাজ
করার একটা স্নিগ্ধ অনুভূতি। ওদের মাঝখানে ওই শীতের
সকালে চায়ের ভাঁড়ে যাকে চুমুক দিতে দেখি, তাকে তিন দিন দেখিনি। একটু একটু করে
চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দেয় গোরা নকশাল। আর বুড়ো বিহারীটা যে আমাদের বাড়ির পাশে ডাক্তার
কিসিকুর ডিস্পেন্সারিটা রোজ খুলে দেয়, ঝাঁট দেয়, সে হাতপা নেড়ে কিসব বলতে থাকে। ওর
পাশে জড়ো হয় আরো গুচ্ছের লোক। সকাল বেলায় হাঁদার দোকানটা বেশ জম জমাট ভিড় হয়ে যায়।
দাদা আমাকে ঠেলে জানলার পাশে এসে দাঁড়ায়। আমি বলি “দেখ কত বিক্রি হবে চা, মুড়ি,
বিস্কুট। কাল সারা রাত জেগে যে ঠোঙা গুলো আমরা করলাম সব শেষ হয়ে যাবে আজকের সকালের
মধ্যেই।” দাদা চুপ করে থাকে। সে জানে এইভাবে চললে আর বেশিদিন ব্যবসা করতে পারবে না
হাঁদা। জুটমিলের মালিক বদল হচ্ছে। জুটমিলের অনেক লোককে বসিয়ে দেবে।হপ্তার টাকাও
ঠিক মতো দিচ্ছে না। ওরা সবাই গোরা নকশালকে ঘিরে ধরে। গোরা নকশালকে বলে চলে। গোরা
নকশাল সব শোনে, চুপ করে। কোনো কথা বলে না। আড় চোখে আমার জানলার দিকে তাকাতেই গোরা
নকশাল আমাকে দেখতে পায়। তার সেই কোঁচকানো দাড়িতে তরঙ্গ ওঠে। গোরা নকশাল হেসে ওঠে।
আমি দাদার মতো গম্ভীর হতে চেষ্টা করি। পারি না।
সেই প্রথমবার হাঁদার জন্মদিনে পায়েস হয়। গোরা নকশাল নেমনতন্ন খেতে আসে।
বারান্দায় চাটাই পেতে সবাই আমরা বরাবরের মতো খেতে বসি। ঠাকুমা তালপাতার পাখা নিয়ে
মাছি তাড়ায়। আমি দেখি গোরা নকশাল খাচ্ছে আস্তে আস্তে। পাঞ্জাবির হাতার ফাঁক দিয়ে
যে অংশটা বেরিয়ে পড়ছে সেখানকার মাংসটা খোবলানো। আমার দিকে তাকাতেই হাতা ঠিক করে
নেয় সে। “ওরা নাকি ধর্মঘট করছে গোরা? জুটমিল নাকি বন্ধ রাখবে। কোনো শ্রমিক কাজ
করবে না?” বাবা জানতে চায়। গোরা নকশাল কিছু বলে না। আঙুল গুলো চাটে। একটা ঢেকুর
তুলে বলে কতদিন পর পায়েস খেলাম রাঙা মা। গোরা নকশাল ঠাম্মার এতো সুন্দর একটা নাম
দিয়েছে জানতাম না তো। মা আরো একটু পায়েস ঢেলে দেয় বাটিতে। গোরা নকশাল চেটে চেটে
খায়। বাইরে তখন শেষবারের মতন হনুমান জুটমিলের সাইরেন বেজে ওঠে। কাল থেকে হরতাল।
কাল থেকে কাজ বন্ধ। কাল থেকে “দুনিয়ার মজদুর এক হও”। গোরা নকশাল ওঠার আগে বাবার
দিকে তাকিয়ে বলে “জানো রবিদা…আমার ঘরে দুটো চড়াই বাসা বেঁধেছে। কাল আসিস টুকনু…।
চড়াইয়ের ডিম দেখাবো।”
সকালে ঘুম ভাঙে দাদার ঝাঁকুনিতে। এই ভাই ওঠ ওঠ…পুলিশ এসেছে। আমি ধড়মড় করে
উঠে বসি। বাবার সাথে কিসব কথা বলছে পুলিশ। আর তখন হাঁদার দোকানের সামনে পড়ে আছে
বুড়ো বিহারীর রক্ত জমাট দেহ। ভোর বেলায় গঙ্গার স্নান করতে যাওয়ার সময় কেউ তার
মাথাটা থেঁতলে দিয়েছে পাথর দিয়ে। সেই ভিঁড়ের মধ্যে কোথাও গোরা নকশালকে দেখতে পেলাম
না। শুধু দেখলাম বুড়ো বিহারীর বউ আছাড়ি পিছাড়ি দিয়ে কাঁদছে। আর হনুমান জুটমিলের
সামনে বসে গেছে সার বেঁধে লোকজন। ওরা তাদের লিডারের লাশ তুলতেও দেবে না। কাজও হবে
না। ওরা চিতকার করতে থাকে “মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও গুড়িয়ে দাও…। হরতাল চলছে
চলবে…। ইনক্লাব জিন্দাবাদ…।” আমাদের শান্ত জনপদটা আর শান্ত রইলো না। কেমন যেন সব
পালটে যেতে থাকলো। বিকেলের দিকে পুলিশ এলো। তারা লাশ তুলে নিয়ে গেলো। কিন্তু
শ্রমিকরা কেউ নড়লো না কারখানার দরজা থেকে। কেউ একটা
গুনগুন করে গাইতে থাকলো “হাম ভুখ সে মরনে বালো…ইয়া মত সে ডরনে বালো…আজাদিকা ঝান্ডা
উঠাও…”
বিশাল জমায়েতটার পাশ কাটিয়ে আমি দাদার সাথে সেই প্রথম গেলাম গোরা নকশালের
ঘরে। ওপরের ছাদের ধারে একটা ছোট্ট ঘর। ঘরটার চারিদিকে জানলা। জানলার ওপাশেই গঙ্গা।
ঘরটার দেওয়ালে আমাদের বাড়ির মতোই পলেস্তারা খসা। আর আমাদের ঘরের মতো যেটা নয় সেটা
হল ঘরের সব দেওয়াল জোড়া বইয়ের তাক। সেখানে সারি সারি বই। বইয়ের ফাঁকে চড়াইপাখির
বাসা। গোরা নকশাল আমাকে চড়াই পাখির বাসা দেখায়। তার ডিম ফুটে বের হওয়া ছানা দেখায়।
আমি গঙ্গার ধারের জানলা ধরে দোল খাই। এমন যদি আমাদের বাড়িটা হতো দাদা? দাদা ইশারায়
চুপ করতে বলে। গোরা নকশাল শুনতে পায়। গোরা নকশাল হাসে। “এটা তোকেই আমি দিয়ে যাবো
টুকনু…এই ঘরটা তোর”। একগাল হেসে বলি “সত্যি? কবে দেবে?” গোরা নকশালের চোয়াল শক্ত
হয়ে যায়। আমার এলোমেলো চুল গুলোকে আরো এলোমেলো করে দিতে দিতে বলে কয়েকটা লাইন…
“বিজয়ের পথে এগিয়ে চলো! স্বদেশ অথবা মৃত্যু!... সবটুকু
বিপ্লবী উষ্ণতা দিয়ে আলিঙ্গন করছি তোমাকে!” আমি
কিছু বুঝতে পারিনা ছাই মাথা মুন্ডু। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে জানতে চাই... “ ওই যে
দেওয়ালের গায়ে এঁকেছো কোঁকড়ানো চুল...তোমার মতোই হাসছে...দাড়ি রেখেছে লোকটা কে?”
গোরা নকশাল হা হা হা করে হেসে ওঠে। লোকটা হাসলে সারাটা ঘর যেন কাঁপতে থাকে। হাসির
দমক যেন থামতে চায় না। লোকটা কী পাগল? লোকটা কী মণির বলা সেই মামদো ভূতটার মতো? আমি
আসতে আসতে সরে আসি দাদার কাছে। দাদার মুখের দিকে তাকিয়ে দেখি সেও খানিকটা বিস্মিত
গোরা নকশালের অট্টহাসিতে। ঘর ফাটানো হাসির দমক আস্তে আস্তে থেমে গেলো। লোকটার
শরীরের কাঁপুনিটাও। দেওয়ালের দিকে তাকিয়ে গোরা নকশাল বিড় বিড় করে বললো। “এই
লোকটাকে চিনে রাখ টুকনু...এই লোকটা একদিন সব পালটে দেবে বলেছিল...সবাইকে পালটে
দেবার স্বপ্ন দেখিয়েছিল...।” গোরা নকশাল হঠাৎ করে চুপ হয়ে যায়। ঘরটায় চড়াই পাখির
কিচির মিচির ছাড়া কিছু শোনা যায় না। আমি দাদার দিকে তাকাতেই দাদা ইশারা করে বেরিয়ে
যাওয়ার জন্য। ঘর থেকে বেরিয়ে সিঁড়ি দিয়ে নামতে নামতে জিজ্ঞেস করি, “ লোকটা কে রে
দাদা?...ওই যে ছবির...”। দাদা ফিসফিস করে বলে “ইতিহাস বইতে ছবি আছে লোকটার...
এর্নেস্তো চে গুয়েভারা...সবাই ডাকে চে বলে।”
মাঘের শীতের
বিকেল সবে শেষ হচ্ছে। ধূসর দেওয়ালে এক ধূসর মানুষের মুখের ছবি দেখে যখন রাস্তায়
নেমেছি আমার চোখের সামনেই ঘটনাটা ঘটে গেলো। বিহারীর মৃত্যুর প্রতিবাদে বসে থাকা
জুটমিলের শ্রমিকদের লক্ষ্য করে কারা যেন বোমা ছুঁড়তে থাকলো। ধোঁওয়ায় ধোঁওয়া হয়ে
গেল চারিদিক। অনেক রাতে সবার সাথে খেতে বসে বাবাকে সেই প্রথম বলতে শুনলাম,
“টুকনু...কাল থেকে একা একা মাঠে খেলতে যেও না। দাদা কিম্বা মণি তোমাকে দিয়ে আসবে
কেমন?” হাঁদা ফিসফিস করে বললো “গরীবের সরকার...গরীবের ওপর লাঠি চালায় কী করে?”
ঠাম্মা দেওয়ালে ঠেসান দিয়ে দীর্ঘ নিশ্বাস ছাড়লো। কারণ ঠাকুমা বুঝতে পেরেছে এই
বারের শীতেও হয়তো রিলিফ ক্যাম্প খুলবে না। এই বারের শীতেও তার চোখের ছানি অপারেশান
হবে না। ঠাকুমা হয়তো একদিন অন্ধই হয়ে যাবে। লম্ফটা নিভে যায়। তলানির তেলটুকুও শেষ।
সেই ঘন কৃষ্ণকায় অন্ধকারে বসে থাকে দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া কয়েকটা মানুষ। এক ফালি চাঁদের
আলো এসে পড়ে তাদের এঁটো কাটা থালা বাটির ওপর।
চার
“গাছেরা
ঘুমিয়ে পড়লে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে?”
খেলার মাঠে
হরেক রকমের আচার নিয়ে আসে চুনু হজমিওয়ালা। তার নানারকম কাচের বয়ামের মধ্যে থাকে টক
জলে চোবানো লাল কুল। মাটির ডেলার মতো লাল হজমি। তেঁতুলের আচার। বিলাতী আমড়া।
কারেন্ট নুন। এগুলো প্রত্যেকটাই আমার কাছে খুব লোভনীয়। প্রত্যেকটি আমার বায়নার
জিনিষ। এদের কোনো না কোনটা আমার রোজ বিকেলের সঙ্গী না হলেই মনটা খারাপ হয়ে যায়।
ঠিক আজ যেমন হয়েছে। ঠাম্মার কাছে পয়সা চাইতে যাওয়ার সময়ের একটু গন্ডগোল হওয়াতেই
বিপত্তিটা ঘটেছে। ঠিক এমনটা হতো না, যদি না ঘুমটা আমার ঠিক চারটের সময়েই ভাঙতো।
“আজ তিরিশ মিনিট লেট”। ঘুম থেকে উঠতেই দেওয়াল ঘড়ির দিকে তাকিয়ে দাদা বলে দিয়েছিল।
দাদা সময়ের কাঁটা ধরে চলে। সময়ে পড়তে বসে। সময়ে খায়। সময়ে স্কুলে যায়। সময়ে ঘুমোয়।
এবং সময়ে ঘুম থেকে ওঠে। ওকে সময়ের মধ্যে বসিয়ে দিয়ছে বাবা। চিনিয়ে দিয়েছে সময়ের
কাজ সময়ে শেষ করার রাস্তা। দাদা খুশি মনে সময়ের নক্সীকাঁথা গায়ে দিয়ে বাবার
নির্দেশ পালন করে। কারণ দাদা জানে তাকে অনেক তাড়াতাড়ি বড় হতে হবে। অনেক তাড়াতাড়ি
সংসারের হাল ধরতে হবে। অনেক তাড়াতাড়ি ঝেড়ে ফেলতে হবে উদ্বাস্তু তকমা!
ঠাম্মার ঘরের
দিকে যেতে গিয়েই এক্কেবারে মায়ের সামনে পড়ে যাই। “রোজ রোজ পয়সা দিয়ে ওর বারোটা আর
নাই বা বাজালেন!” মা ঝাঁঝিয়ে ওঠে ঠাকুমাকে। শীতের পড়ন্ত বিকেলের অন্ধকার ঘরের কোন
থেকে... ছানি না কাটা চোখের কোঠর থেকে ভেসে আসে তীব্র মমতা। “থাক না বৌমা...মোটে
তো দশ আনা!” মা হার স্বীকার করে না। “ওই দশ আনাই দশ দিনে একটা টাকা! আমার এক ব্যাগ
কয়লার সাশ্রয়!...হাঁ করে দাঁড়িয়ে দেখছো কী? হয় বেরোও...না হলে হ্যারিকেন জেলে
দিচ্ছি পড়তে বোসো।” অন্ধকারের কোণ থেকে ভাঙা গলায় একটি বারের জন্য যেন ঠাম্মা শেষ
খড়কুটো ধরতে চায়... “আজ ওর দাদু বেঁচে থাকলে...কলাপোতার বাজারে...ভোলা ময়রার
দোকানের চিট সন্দেশ এনে দিতো...”। ঝাঁঝিয়ে ওঠে মার গলা আরো। “রাখেন আপনার ওপারের
কথা...শুনে শুনে কান পচে গেলো! যা যাবার তো গেছে। আমার ছেলে গুলো উচ্ছন্নে না
গেলেই হলো!” কে যেন হাত ধরে আমাকে টানে।
সবে সন্ধ্যে
নামবে নামবে করছে। দেখি দাদা গলায় জড়িয়েছে একটা মোটা মাফলার। গায়ে দিয়েছে ফুল
সোয়েটার। একটুতেই ওর ঠান্ডা লাগে। নাকের নীচে ঠোঁটের ওপরে কালো রেখার জমাট
গম্ভীরভাব থেকে দাদা বলে “চল মাঠে যাবি চল।” ঘরের গুমোট ভাবটা নিমেষে হাওয়া হয়ে
যায়। পল্টুর লাট্টুর মতো আমি পাক খেতে খেতে দাদার আগে ছুটি। “হ্যাঁরে দাদা তুই
কোনোদিন চিট সন্দেশ খেয়েছিস?” দাদা গম্ভীর হয়ে মাথা নাড়ায়। না। খায়নি ও। “ঠাম্মা
বলেছে...কলাপোতার ভোলা ময়রার দোকানে চিট সন্দেশ পাওয়া যায়।” আর কথা এগোয় না আমার।
একটা লম্বা মিছিল আমাদের সামনে দিয়ে চলে যায়। “মালিকের কালো হাত ভেঙে দাও গুঁড়িয়ে
দাও। ইনক্লাব...জিন্দাবাদ...ধর্মঘট চলছে চলবে...মালিক তুমি দালাল হতে পারো
না...পারো না...ভাতের বদলে রক্ত চাইতে পারো না...পারো না...”। গমগম করতে থাকে
রাস্তাটা। মানুষজন সব থমকে যায়। যে লোকগুলো সারা রাতের শ্রমের স্নিগ্ধ
ক্লান্তিটুকু নিয়ে হাঁদার দোকানে চা খেত সেই মানুষগুলোই কেমন যেন পালটে গেছে।
মায়ের মতন খিটখিটে হয়ে গেছে। বুড়ো দারোয়ানটা আমাকে দেখলে এখন আর হাসে না। তার
গ্রামের গল্প করে না। পাশ দিয়ে বয়ে চলা ছোট্ট কমলা নদীর গান শোনায় না। সারাক্ষণ
ওরা জড়ো হয়ে বসে থাকে। নিজেদের মধ্যে কি শলা-পরামর্শ করে। বুড়ো বিহারীর খুনীকে না
পাওয়া পর্যন্ত ওদের যেন শান্তি নেই। কারখানার গেট না খোলা পর্যন্ত ওদের উনুনে ভাত
রান্না হবে না। সবাই ছাতু খেয়ে থাকবে। আমি একদিন ছাতু খেয়ে দেখেছি। ভালো লাগেনি
তেমন। গোল গোল দলা পাকিয়ে ওরা একটু একটু ছাতু খায়। মন ভালো ভালো থাকলে গুণগুণ করে
গান গায়। এখন ওসবের পাট উঠে গেছে। সারাক্ষণ কারখানার সামনে একটা ভাঙা তক্তপোষে ওরা
বসে থাকে। আর আশায় থাকে কবে মালিক এসে ওদের সাথে কথা বলবে। কবে ওরা ওদের ন্যায্য
টাকা পাবে। কবে ওদের লিডারের খুনী ধরা পড়বে। কিন্তু তেমন কিছুই হয় না। দিন এগোতে
থাকে।
চটকলের
ধর্মঘট আজ কুড়ি দিনে পড়লো। এগুলো আমার জানার কথা নয়। ছোটদের সব কিছু জানতে দিতে
নেই বলে বাড়ির বড়দের যে ফতোয়া জারী হয় তাতে তারা বুঝতে পারে না পরোক্ষভাবে এতে
ছোটদের লাভ হয় বেশী। তারা লুকিয়ে হোক...ঘুমিয়ে থাকার ভান করেই হোক...কিম্বা অন্য
কোনো উপায়ে শুনে নেয় সব কিছু। বুঝুক আর নাই বুঝুক নিষিদ্ধ যাবতীয় জিনিসের প্রতি
তাদের তীব্র টান। যে টানের জন্য টুকনু অনেক ছোট থেকে জেনে যায় অনেক কিছু। তাকে তো
জানতেই হবে। ছোট থেকেই সে ঠিক করে ফেলেছে একদিন এই সব নিষিদ্ধ জিনিস নিয়েই সে
লিখবে “নিষিদ্ধ এক ইস্তেহার...”। যেখানে থাকবে শুধু তার লুকিয়ে লুকিয়ে গল্প শোনার
কথা। আর না বলা দুষ্টুমির অঙ্ক গুলো। যদিও অঙ্কে সে প্রচন্ড কাঁচা। উলটো একে
চন্দ্র লিখতে তাকে হিমসিম খেতে হয়। নামতা মুখোস্থ হতে চায় না। সেই সুযোগটার সদ
ব্যবহার করতে চায় দাদা। “ভাই মিছিলে কটা লোক গোন তো। এই সামনে সারির টা গুনলেই
হবে।” অতি চালাকের গলায় দড়ি দিয়ে আমিও গুনতে থাকি। তিরিশের পর খেই হারিয়ে যায়।
দাদা আমার দিকে তাকিয়ে হাসে। আমাকে অবাক করে দিয়ে আমার ফাস্ট হওয়া দাদা বলে ওঠে
“পঁয়ষট্টি জন”।
বড় মিছিলটা
সরে যেতেই মিছিলের প্রান্তে যে মানুষটাকে দেখতে পেলাম তাকে সেখানে তখনি দেখতে পাবো
বলে আশা করিনি। আমার ছোট ছোট পা...আর ছোট্ট একটা মন ছুট্টে গেলো লোকটার কাছে। সেও
হাত বাড়িয়ে ধরলো আমাকে! “জানো গোরা নকশাল...ঠাম্মা বলেছে কলাপোতার ভোলা ময়রার
দোকানে চিট সন্দেশ ছিল...”। লোকটার কালো দাড়ির মধ্যে একটা হাসির তরঙ্গ ওঠে। পাশে
দাঁড়িয়ে থাকা একটা ছেলে। দাদার থেকে একটু বড়। একে তো আগে কোনোদিন দেখিনি! চশমার
ভেতর থেকে বড় বড় গোল গোল চোখ করে বলে “ আপনাকে নাম ধরে ডাকছে কমরেড!” ওরা দুজনেই
হেসে ওঠে! আমার রাগ হয় গোরা নকশালের ওপর। চলে যেতে গেলে আমার হাত ধরে টানে ছেলেটা।
“এই বুঝি আপনার টুকনু...? চে’র ছবিকে যে বলেছিল আপনার ভাই?” গোরা নকশাল হাসে। আমার
রাগ আরো বেড়ে যায়। ইশ...আমার কথা গুলো আবার এই একদম কোনোদিন না দেখা একটা ছেলেকে
বলে দিয়েছে? আমি আর দাঁড়াতে চাই না। ছেলেটাও আমাকে ছাড়ে না। “এই যে কমরেড
টুকনু...তুমি কী জানো আজ থেকে আমি তোমাদের বাড়িতে থাকবো?” ধাক্কাটা খেতাম না।
কিন্তু সত্যি যখন দেখলাম ছেলেটা আমাদের সাথে বসেই রুটি আর পেঁয়াজকলি ভাজা খাচ্ছে।
খেজুরের গুড় হ্যাংলার মতো চেটে চেটে খাচ্ছে তখন রাগটা বেমক্কা গিয়ে পড়লো গোরা
নকশালের ওপর। আমার পেঁয়াজকলি। আমার খেজুড়ের গুড়ে আমি কাউকে ভাগ বসাতে দেবো না। সে
তুমি যতোই সাম্যবাদের কথা বলো না কেনো। কেউ আমার দিকে তাকায় না। বলে না... “আহা
টুকনুর পাতে একটুও পেঁয়াজকলি নেই...ওকে একটু দাও...”। সবাই ছেলেটার সাথে কথা বলে।
“শুনেছি এবার উচ্চমাধ্যমিকে স্টার নিয়ে পাশ করেছো?” মা বেশি করে পেঁয়াজ কলি তুলে
দেয় ছেলেটার থালায়। আমার কান্না পায়। কিন্তু কে তাকায় আমার দিকে। বাবা বলে “পাশ কী
বলছো? সোনার টুকরো ছেলে সুশান্ত! প্রেসিডেন্সি কলেজে ভর্তি হয়েছে। সংখ্যাতত্ত্ব
নিয়ে পড়তে চায় ভবিষ্যতে।” ছেলেটা লজ্জা পায়। মাথা নীচু করে থাকে। কিন্তু খাওয়াতে
লজ্জা নেই। একবার তো না বল। একবার তো পেঁয়াজকলির থালাটা আমার দিকে আসুক। ছিঃ
ছিঃ...এই নাকি হীরের টুকরো ছেলে। যা দিয়ে যাচ্ছে খেয়ে যাচ্ছে। ওরে না তো একবার বল।
সব শেষ হয়ে গেল। “গোরার কে হও তুমি?” ঠাকুমার প্রশ্নের জবাবে এই প্রথম মাথা তুলে
তাকায় সুশান্ত। “বন্ধু বলতে পারেন...! আমাদের কমরেড গোরা...।”
“অতবড় লোকটা
তোমার বন্ধু কী গো?” ঠাকুমা তল পায় না। ছেলেটা বলার আগেই বাবা বলে ওঠে “ওর বাবাকেও
জেলে থাকতে হয়েছিল গোরার সাথে অনেকদিন মা...আর জেলেই ওর বাবা মারা যান।” হঠাৎই
নিঃস্তব্ধতা নেমে আসে। ঠাম্মা অস্ফুট স্বরে বলে ওঠে। “আহা রে...”। রাগের চোটেই
হোক। দুঃখেই হোক। জেনেই হোক বা না নেজেই আমার হাত থেকে গ্লাস পড়ে যায়। ভিজে যায়
পাশে বসা হাঁদার রুটি। জল গড়িয়ে আসন ভিজিয়ে দেয় ছেলেটার। মা মারতে উঠলে ছেলেটাই
ঠেকায়। “ছোটদের মারবেন না। ওদের মারতে নেই।” মা থমকে যায়। এতো এক্কেবারে গোরা
নকশালের মতো কথা বলে। আজ অবশ্য দেখেছি জুটমিলের সামনে বড় জমায়েতে কিসব বোঝাচ্ছিল
ছেলেটা শ্রমিকদের। ওরা মন্ত্রমুগ্ধের মতো শুনছিল ছিপছিপে চশমা পড়া বছর ঊনিশের
ছেলেটার কথা।
লেপের তলায় শুয়ে মন খারাপ করা রাগ নিয়ে জানতে চাই... “দাদা...ছেলেটা
কতদিন থাকবে রে?” দাদা আমার দিকে পাশ ফিরে শোয়। গায়ের ওপর লেপটা ঠিক করে দেয়। আমার
চোখের ওপর পড়ে থাকা লম্বা চুলটা সরিয়ে দিয়ে বলে “চলে যাবে কালকে।” “গোরা নকশালের
কাছে এসেছে আমাদের বাড়ি খাচ্ছে কেন?...থাকছে কেনো?” দাদা আমার প্রশ্নের কোনো উত্তর
দেয় না। বিড়বিড় করে বলে “প্রেসিডেন্সি কলেজ কোথায় জানিস ভাই?” আমি মাথা নাড়াই
“না”। “অনেক বড় কলেজ। অনেক বড় বারান্দা। সেই ব্রিটিশ আমলের। যারা খুব খুব ভালো
পড়াশোনায়...তারা ওখানে পড়তে যায়।”
“তোকে কে
বলেছে?”
“গোরা নকশাল।
...আরও বলেছে...আমি যদি সত্যি সত্যি খুব ভালো রেজাল্ট করতে পারি মাধ্যমিকে...উচ্চ
মাধ্যমিকে...তাহলে আমি নাকি প্রেসিডেন্সি কলেজে পড়তে পারবো।”
দাদা পাশ
ফিরে শোয়। আমি জানি এখন ও কলকাতার বড় কলেজের স্বপ্ন দেখবে। প্রেসিডেন্সি কলেজের
লম্বা বারান্দার ওপর দিয়ে হাঁটছে। ক্লাস করছে। কাল ভোরে উঠে আবার অঙ্ক কষতে বসবে।
নকশালকে দানা খাওয়াবে। স্নান করাবে। দাদা নকশালকে ভালোবাসে। কিন্তু দাদা জানে না
আসলে নকশাল হল পায়রাদের টাইটেল। “যারা উড়তে পারে তারাই নকশাল”। হাঁদা আমাকে
বলেছিল। সেইবার নকশাল প্রথম এসেছিল আমাদের বাসায়। হাঁদা হাতে করে দানা খাওয়াতো আর
বলতো... “সময়ের সাক্ষী থাকবি তুই নকশাল...যেখানে পারবি উড়ে বেড়াবি...আমি তোর ডানার
পালক কেটে দেবো না কোনোদিন”। হাঁদা কোনোদিন পালক কাটেনি নকশালের। নকশাল এখানে
ওখানে উড়ে বেড়ায়। ক্ষিদে পেলে নেমে আসে উঠোনে। ঘুরে ঘুরে দানা খায়। বাড়ির সবাই
ভালোবাসে নকশালকে। শুধু আমি ছাড়া। তক্কে তক্কে থাকি...কোনদিন এসে হুলোটা ওর ঘাড়
মটকাবে। ঠিক হবে।
বাইরে এই এতো
রাতে কারা যেন কথা বলছে। বাবা না? এখনো ঘুমোতে যায়নি বাবা? উত্তরের হাওয়ার মতোই
আমার কানে কথা গুলো ভেসে আসতে থাকে।
“গোরা এগুলো
কি ঠিক হচ্ছে? সুশান্ত ওই টুকুনি ছেলে... ফুলের মতো ওরা... বোঝেটাই বা কী? এখন
ওদের পড়ার সময়...নিজের মতো সুশান্তর জীবনটাও তুই কি চাস জেলের পেছনে কাটুক? কিম্বা
গুম হয়ে যাক? ...”
গোরা নকশাল
উত্তর দেয় না। তার চোখ তখন রবিদার বাড়ির পাশে ফোটা সন্ধ্যামণি গাছটার দিকে। গাঢ়
সবুজ রঙের পাতার পাশে থোকা থোকা লাল ফুটিয়ে রেখেছে গাছটা। হঠাৎ গোরা নকশাল বলে
ওঠে...
“গাছেরা
ঘুমিয়ে পড়লে কি ফুলেরাও ঘুমিয়ে পড়ে রবিদা?”
বাবা কোনো
জবাব দিয়েছিল কিনা টুকনু জানে না। কারণ টুকনু তখন ঘুমের মধ্যে চলে গিয়েছে ঠাকুমার
খুলনার কলাপোতার গ্রামে। ভোলা ময়রার দোকানটা খুঁজছে টুকনু। ওখানে নাকি ভালো চিট
সন্দেশ পাওয়া যায়।
পাঁচ
একজন কিশোর
ছিল, একেবারে একা
আরও একজন
ক্রমে বন্ধু হল তার।
দুয়ে মিলে
একদিন গেল কারাগারে;
গিয়ে দেখে
তারাই তো কয়েক হাজার!
(জেলখানার
কবিতা/বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়)
জানলা গুলো
ছিল একদম ঘরের মাথার কাছে। মানে যেখানটায় কড়িকাঠ। ওখান দিয়ে দিনের প্রথম আলো এসে
পড়ে। এক ফালি আলো মেঝেতে লুটোচ্ছে। দিনের প্রথম সূর্যের আলো। একটা লোক দুমড়ে মুচড়ে
পড়ে আছে মেঝেতে। আধো আলো আধো অন্ধকারে ভালো করে দেখা যায় না তাকে। লোকটার ঠোঁটের
পাশ দিয়ে মানে কষ বেয়ে পড়ছে রক্ত। মাঝে মাঝে কেঁপে উঠছে শরীরটা। আবার স্থির হয়ে
যাচ্ছে। ঘরের কোনে জলের কল থেকে টিপ টিপ জল পড়ার শব্দ ভেসে আসছে। মাথা তোলে লোকটা।
তার কি জল পিপাসা পেয়েছে? কিন্তু সে তো জলের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে না। সে এগোচ্ছে
সম্পূর্ণ বিপরীত দিকে। যেখানটায় সূর্যের প্রথম আলো এসে পড়েছে সেখানে। ভাঙাচোড়া,
দোমড়ানো মোচড়ানো শরীরটাকে নিয়ে এগিয়ে যেতে থাকে লোকটা সেই এক ফালি টুকরো আলোর
দিকে। ঘেঁষটে ঘেঁষটে এগিয়ে যাচ্ছে রক্তে ধোওয়া শরীরটা। মনে হচ্ছে একটা সরীসৃপ যেন
এগিয়ে চলছে এক টুকরো আলোর দিকে। ডানহাতটা আলোর প্রসারিত টুকরোর ওপরে রাখে লোকটা।
আর ঠিক তখনি সারা ঘরটা যেন কেঁপে ওঠে নবজাতকের কান্নার আওয়াজে।
“কাকে নিয়ে
লিখছিস টুকনু?” বড়মা আমার দিকে চেয়ে থাকে অপলক দৃষ্টিতে। আমি রহস্য সৃষ্টি করি।
বলো তো কাকে নিয়ে লিখছি? “তোর সিরিয়ালের কিছু?” আমি হাসি। না। “তাহলে?” গোরা
নকশালকে নিয়ে! বড়মা আস্তে আস্তে উঠে চলে যায় পাশের ঘরে। আমি পিছু নিই। সঙ্গ ছাড়ি
না। বড়মার এখন মনে থাকে না কিছু। খুব তাড়াতাড়ি ভুলে যায়। আবার যখন বলতে শুরু করে
গড়গড়িয়ে বলে চলে। এতোটুকু ক্লান্তির ছাপ পড়ে না বিরাশি বছরের চোখে মুখে। ভালো
লাগলো না তোমার? বড়মা দাঁড়ায়। ফিরে তাকায় আমার দিকে। “মনে আছে গোরাকে তোর এখোনো?”
আমি মাথা নাড়ি। হ্যাঁ। “কেউ তো আর মনেই রাখে না তাকে। একটা লোক যে ছিল...ভুলে গেছে
সবাই।” আমি ভুলিনি বড়মা! জানলা দিয়ে আসা মাঘের শেষবেলাকার রোদ এসে পড়ছে বড়মার
গায়ে। শাদা চাদর আর শাড়িতে উজ্জ্বল হয়ে উঠেছে জায়গাটা। আমার ফাস্ট হওয়া দাদার
ঝকঝকে ফ্ল্যাটের মেঝে থেকে বিচ্ছুরিত আলোয় বড়মা আমাকে অবাক করে দিয়ে বলে “বীরেন
চট্টোপাধ্যায়ের কবিতাটা তোর মনে আছে টুকনু?” কোনটা বড়মা? “ওই যে...ওই যে...বল
না...। বল না...।” বড়মা হাতড়াচ্ছে...বড়মা মনে করছে...কিছু স্মৃতি পরতের টানে ফিরে
আসছে আর কিছু লোপাট হয়ে যাচ্ছে চিরটাকালের মতো। শীতাভ রোদের বিরাশি বছরের এক
প্রাচীন মানুষ আমার কাছে জানতে চাইছে একটা কবিতা... আর আমি ছুটছি...আমি ছুটছি
ফ্ল্যাশব্যাকে। আমি খুঁজে পাওয়ার চেষ্টা করছি আমার বাসাটাকে। ওই তো...ওই তো...বাবা
বসে আছে...ওই তো হাঁদা দোকান বন্ধ করে ক্লান্ত শরীর নিয়ে ফিরে এলো...। দাদার হাতে
ওটা কী? ওই চটি বইটা কোথা থেকে পেলো? গোরা নকশাল দিয়েছে। লেখা আছে ‘প্রথম হওয়ার
উপহার...’। ইশ...খালি তো একটা চটি বই তার ওপর আবার প্রথম হবার উপহার। দেখবি আমাকে
এই এত্তোবড় একটা আরব্য রজনীর বই দেবে গোরা নকশাল। সামনেই আমার জন্মদিন কিনা। টেনে
নিতে যাই দাদার কাছ থেকে বইটা। ছিঁড়ে যায় ওপরের মলাট। আমার গম্ভীর দাদা কিছু বলে
না। পাশ থেকে একটা থাপ্পড় এসে আমার গালে পড়ে। মায়ের দিকে তাকাতে ইচ্ছে করে না
আমার। রাগ হয়। কেউ এসে বলে না “বাচ্চাদের মারবেন না। বাচ্চাদের গায়ে হাত দিতে
নেই।” বলার লোকটা চলে গেছে। শোনা যাচ্ছে সুশান্তকে পুলিশ মিথ্যে মামলা দিয়ে জেলে
পুড়েছে। চটকল কবে খুলবে ঠিক নেই। দাদা বলেছে আর কোনোদিন সুশান্ত প্রেসিডেন্সিতে
পড়তে পারবে না। দাদা দুঃখ পেয়েছে। আর গোরা নকশাল চুপ করে গেছে বেশ কিছুদিন।
“কী রে
পেলি?”
খুব সহজে কী
পাওয়া যায় অতীতকে বড়মা? ভ্যাগিস দাদা গোছানো। আমার মতো বাউন্ডুলে উড়নচন্ডী না।
সেই ছেঁড়া
মলাটের পাতলা বইটা আমার হাতে। কোন কবিতাটার কথা বলছিলে তুমি? বড়মা আমাকে অবাক করে
দিয়ে বলে “কবিতার কথা বলছিলাম নাকি? আমি তো সূচ খুঁজছিলাম। একটা ফুল তুলবো রুমালে।
তোর বাবা বলেছিল একটা ফুল দেওয়া রুমাল লাগবে স্কুলে।”ভুলে গেছে বড়মা। ভুলে গেছে
বাবা অনেক দিন বেঁচে নেই। ভুলে গেছে এই মুহূর্তকাল আগে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের
নামটা নিজেই আমাকে মনে করিয়ে দিয়েছে। আমাকে ডাকছে আমার ল্যাপটপ। আমাকে বলছে আর
একবার শোনাও তো মিছিলের কবিতাটা। ব্লগ স্পট বলছে এখনি লিখে ফেলতে হবে পাঁচ নম্বর
অধ্যায়টা। আর সেই কবেকার কবিতার বইটা আমার দিকে তাকিয়ে বলছে “মনে আছে টুকনু
আমাকে?”
সামনে পিছনে
ডানে বাঁয়ে
মাত্র কয়েকটি
পুরনো মুখ;
আর যারা,
একাবারেই কিশোর
আর যারা,
জেলের অন্ধকারে বহুদিন হারিয়ে যাওয়া শিশুগুলির
কেউ মা, কেউ
বোন...।
চুপ করে থাকে
গোরা নকশাল। তখনও কবিতার রেশ ছেয়ে আছে সারা ঘরে। দাদার হাতে খোলা কবিতার চটি
বইখানা। কিছুক্ষণ আগে সুশান্তকে পুলিশ মারতে মারতে নিয়ে গেছে জুটমিলের সামনে থেকে।
আর আমি দেখেছি ছিটকে পড়েছে ছিপপছিপে রোগা ছেলেটার চোখ থেকে চশমা। লাঠির আঘাতে
কুঁচকে গিয়েছে শরীর। তবু একফোঁটা চিৎকার করেনি সে। ঠাম্মা বেরিয়ে এসেছে। বাবা ছুটে
গেছে স্কুল থেকে। কারো কথা শোনেনি ওরা। পুলিশের জিপে দুমড়ে মুচড়ে তুলে নিয়ে গেছে
তাকে। আমি শুধু দৌড়ে গিয়ে হাতে দিয়ে আসতে পেরেছিলাম কাঁচ ভাঙা চশমাটা। আমি জানতাম
চশমা ছাড়া সুশান্ত দেখতে পায় না। কিন্তু সুশান্তকে যে আমি আর কোনোদিন দেখতে পাবো
না সেটা তখনো জানতাম না।
গোরানকশাল?
ফিরে তাকায়
কোঁকড়াচুলের দাড়িভর্তি ফরসা মুখের লোকটা।
ওরা
সুশান্তকে কোথায় নিয়ে গেলো? আমার প্রশ্নে গোরা নকশালের চোয়াল শক্ত হয়। গঙ্গার
ধারের চিলেকোঠার ঘরের মধ্যে এখন উড়ে বেড়াচ্ছে চড়ুইয়ের বাচ্চা গুলো। ওরা বড় হয়ে
গেছে। ওরা উড়তে শিখেছে। গোরা নকশাল আমাকে ইশারায় ডাকে। আমি এগিয়ে যাই। ফিসফিস করে
বলে “ওই ওখানে রাখা বাটিটা নিয়ে আয়।” আমি খুব খুশি মনে তাড়াতাড়ি যাই। নিশ্চই
কালকের মতো কোনো সন্দেশ রেখে দিয়েছে গোরা নকশাল। খুলনার কলাপোতার চিট সন্দেশের
নামে সবাইকে পাগল করে দিয়েছিলাম আমি। বাটিটা হাতে নিতেই মনটা খারাপ হয়ে যায়। একি
এটা তো আটা মাখা। মুখে কিছু বলি না। এগিয়ে দিই গোরা নকশালের দিকে। “আজ আমার চড়াই
গুলোকে একটু খাওয়াতো টুকনু...বাইরে নিয়ে যা...অল্প অল্প করে আটার ডেলা বানিয়ে
ছুঁড়ে দে... দেখবি ওরা কেমন টুপ টুপ করে এসে খাবে!” মনের সাথে মেজাজ খারাপ হয়ে যায়
আমার। একে বাড়িতে আছে হাঁদার নকশাল। সে প্রায়ই আমার পড়ার এ্যালুমিনিয়ামের
বাক্সটাতে সবুজ হাগু করে রাখে। তখনই বাড়ির লোকের টনক নড়ে আমি নাকি অনেক দিন পড়িনি।
এক নম্বরের শত্রু হল হাঁদার নকশাল। আর এখন আবার চড়াই! পেছন থেকে আমাকে জড়িয়ে ধরে
গোরা নকশাল। “আচ্ছা টুকনু আমি যখন থাকবো না...তখন আমার এই চড়াইদের কে খাবার দেবে?”
আমি বিরক্তি নিয়ে বলি... “আমি পায়রা, চড়াই এদের কাউকে ভালোবাসি না...। এরা সব সময়
আমার আমার পড়ার বাক্সতে হাগু করে রাখে। আর মা বলে আমি নাকি অনেক দিন বাক্সই
খুলিনা...আমি পড়ি না...।” হো হো করে হেসে ওঠে গোরা নকশাল। চেপে ধরে আমাকে। আমিও
কেমন যেন নিস্তেজ হয়ে পড়ি। আমি কেমন যেন একটা গন্ধ পাই লোকটার গায়ে। যে গন্ধ জড়ানো
থাকে লেপের মধ্যে...শীতের চাদরের কুন্ডুলীতে... দেশ ছাড়া ঘর ছাড়া মানুষগুলোর সার
বেঁধে রাতে শোয়ার স্বপ্নের মধ্যে। হাঁদা, ঠাম্মা, মণি সবার গায়ের গন্ধ...জেলের
গন্ধ...আমার মন কেমন করায়। আমার ঘুম পায়। আমি ঘুমিয়ে পড়ি।
তাকিয়ে থাকে
লোকটা অপলক টুকনুর দিকে। তার ছোট্ট জোড়া ভুরুর দিকে। কান রাখে গোরা নকশাল টুকনুর
বুকে। ওখানে শুনতে পায় ধুকপুক ধুকপুক আওয়াজ। ওখানে প্রান আছে...ওখানে ক্ষিদে
আছে...ওখানে আছে অধিকার বুঝে নেওয়ার বীজ মন্ত্র। বারবার ফিরে ফিরে গোরা নকশাল একই
কথা বিরবির করে। আর করবে নাই বা কেনো? বুকে কান রাখলে গোরা নকশাল যেন শুনতে পায়
ধামসার ডিমি ডিমি দ্রুম দ্রুম শব্দ। হঠাত যেন সামনে চলে আসে সেদিনের সেই সকালটা।
যন্ত্রনায় যখন কুঁকড়ে যাচ্ছে শরীর। ভোরের আলো যখন প্রথম এসে পড়েছে প্রায় অন্ধকার
খুপরিরি মেঝেতে ঠিক তখনি গোরা নকশাল শুনতে পেয়েছে একটা নবজাতকের চিৎকার। তাহলে
অমিয়ার সন্তান জন্ম নিলো আজ এই মারাত্মক সকালের রক্তভেজা আলোর বিচ্ছুরণের মধ্যে
দিয়ে? অমিয়া কি জানে তার সন্তানের বাবা প্রিয়াংশু নিহত হয়েছে এই কিছুক্ষণ আগে
পুলিশ কাস্টডিতে! অমিয়া কি জানে প্রথমে ওরা প্রিয়াংশুর চোখটা খুবলে নিয়েছে তারপর
গুলি করে খুলি উড়িয়ে দিয়েছে। ছিটকে লেগেছে ঘিলু গোরা নকশালের গায়ে। গোরা নকশাল
চিতকার করে উঠেছে প্রি...য়াং...শু...। গোরা নকশাল দেখেছে কেমন করে যেন ছুটছে ওরা
দুজনে একটা সরু গলির মধ্যে দিয়ে। পেছনে ছুটে আসছে পুলিশের একটা বড় দল। সামনে একটা
পাঁচিল...। দুজনে টপকাতে যাচ্ছে। কিন্তু পারছে না প্রিয়াংশু। “ধরা দিয়ে দিন কমরেড
গোরা...। না হলে ওরা আমাদের মেরে ফেলবে। অমিয়া প্রেগনেন্ট...আমি চলে গেলে ওকে...”
কথা শেষ করতে পারে না প্রিয়াংশু। সামনে পাঁচিলের ওপর পুলিশের আর এক দল। ওদের হাতে
বন্দুক। তাক করা দুই বন্ধুর দিকে। “চক্রব্যুহর মধ্যে ঢুকে অভিমন্যু কি বলেছিল মনে
আছে আপনার?” প্রিয়াংশু ফিসফিস করে বলে। গোরা কোনো জবাব দেয় না। “আমার বড় অমিয়াকে
দেখতে ইচ্ছে করছে গোরা।” ততক্ষণে পিছমোড়া করে বাঁধা হয়ে গেছে ওদের। ঘেষটে ঘেষটে
তোলা হচ্ছে দুই ছেলেকে। আশে পাশের বাড়ির লাইট বন্ধ হয়ে যাচ্ছে। ওরা কোনো কিছুর
সাক্ষী থাকবে না। ওরা থাকতে চায় না। ওরা চায় সুখী গৃহকোণ।
কিন্তু
প্রিয়াংশু কী চেয়েছিল? একটা খুলি ওপড়ানো মৃতদেহের দিকে ঘষটে ঘষটে এগিয়ে যেতে থাকে
গোরা নকশাল। কারণ গোরা নকশাল স্পষ্ট দেখছে প্রিয়াংশুর ঠোঁট নড়ছে এখনও । প্রিয়াংশু
কিছু বলছে। “এ্যাই প্রিয়াংশু...এই প্রিয়াংশু...কী বলছেন...কী বলছেন...।” নখ বিহীন
রক্তাক্ত আঙুলের ওপর ভর দিয়ে এগোয় গোরা নকশাল। যতবার এগোয় ওরা ততবার গোরার পায়ে
লোহার রড দিয়ে মারতে থাকে। চিতকার করে ওঠে গোরা নকশাল। “প্রিয়াংশু কিছু বলতে
চায়...আপনারা শুনতে পাচ্ছেন কী? এই যে সরুন...সরুন...ও কিছু বলতে চায়...।” পুলিশ
গুলো হাসতে থাকে। “এই যে শুনছেন প্রিয়াংশু কিছু বলতে চায়...”। অপলক তাকিয়ে আছে
প্রিয়াংশু...। গোরা নকশাল কোলের ওপর তুলে নিয়েছে খুলিহীন একটা মাথা। “প্রিয়াংশু
কিছু বলছে আপনারা শুনুন...প্রিয়াংশু বলছে আপনারা মানুন...কমরেড...কমরেড বুঝতে
পারছেন না কেন...ওর একটা বাচ্চা হবে...ওর স্ত্রী আসন্ন প্রসবা...এ্যাই প্রিয়াংশু
কিছু বলছেন কি আপনি? কমরেড প্রিয়াংশু...।” সংজ্ঞা হারিয়ে যায় গোরা নকশালের। সেদিন
কেন গোরা নকশালের খুলি উড়িয়ে দেওয়া হয়নি সেটা সে ভেবে উঠতে পারে না। এক উদ্বাস্তু
মরে গেলে তার মা ছাড়া আর কেউ কাঁদার থাকে না। কিন্তু প্রিয়াংশুর ছিল। অনেকে ছিল।
তারও অনেকদিন
পরে গোরা নকশাল জানতে পেরেছিল সেদিন ভোরে যখন প্রিয়াংশুর খুলি ছিটকে পড়ছে দেওয়ালের
আর এক দিকে। ঠিক তখনি মিনিট পাঁচের দূরত্ত্বের সেলে জন্ম নিচ্ছে তার মেয়ে আনন্দি।
লেকের মাঠে সকালে প্রাতভ্রমণে বেরিয়ে এক অবসর প্রাপ্ত ব্যাঙ্কের ম্যানেজার পুলিশকে
ফোন করে জানাচ্ছে “খুলিহীন এক মৃত দেহ লেকের জলে ভাসছে।” তিনদিনের বাসি পচা গলা
দেহকে প্রিয়াংশু বলে সনাক্ত করে আনন্দির মা প্রিয়াংশুর বউ অমিয়া। কোথাও কোনো
প্রমান ছিল না এতোদিন প্রিয়াংশু জেলে ছিল না বাইরে। সেদিন ভোরে কী বলতে চেয়েছিল
প্রিয়াংশু? শীত করতে থাকে গোরা নকশালের। জীবনের, পরম প্রাণের উষ্ণতাটুকু নেওয়ার
জন্য প্রানপণে জড়িয়ে ধরে ঘুমন্ত টুকনুকে। প্রিয়াংশু সেদিন কী বলেছিল টুকনু
জানিস...? গোরা নকশাল আকাশের দিকে মাথা তোলে। তার চোখের কোন থেকে বেরিয়ে আসে
একবিন্দু জলের ধারা। সুশান্তকে পুলিশ উঠিয়ে নিয়ে যাওয়ার জন্য তার এই দুঃখ নাকি
প্রিয়াংশুর জন্য...? এই মুহূর্তে লেখক তা জানে না। লেখকের সব কিছু জানা থাকে না।
কেউ তাকে জানিয়ে দিয়ে যায় বারবার।
ঘুমন্ত ছেলের
কপালের ওপরের চুল গুলো সরাতে সরাতে গোরা নকশাল বিড় বিড় করে...প্রিয়াংশু অমিয়াকে
নিয়ে ঘর করতে চেয়েছিল...প্রিয়াংশু দেখতে চেয়েছিল আনন্দির মুখ...প্রিয়াংশু দেখতে
চেয়েছিল সবাই দুবেলা পাবে দুমুঠো ভাত...সবাই পাবে পরার কাপড়...মাথা গোঁজার
ঠাই...শিক্ষার প্রাথমিক অধিকারটুকু...। প্রিয়াংশু দেখে যেতে পারেনি...প্রিয়াংশুকে
আমরা উপহার দিয়েছে এক খুলি বুলেট। গোরা নকশালের চোখের টিপ টিপ জল টুকনুর কপালে
বৃষ্টির ধারার মতো ঝরে পড়ে। ওখানেই যেন কোথায় লিখে রাখা হয়ে যায় টুকনুর ভবিষ্যতের
ললাট লিখন...
“দিনের পর
দিন রক্তের সমুদ্রে সাঁতরিয়ে মানুষ জেনেছে/ভালোবাসার আরেক নাম ঘৃণা;/ রাতের পর রাত
স্পর্ধার পাহাড়ে আছাড় খেতে খেতে সে জেনেছে,/ ভালোবাসার আর এক নাম প্রতিবাদ”...।
ছয়
“ও আলোর পথ
যাত্রী...এযে রাত্রী...এখানে থেমো না...”
এমনিতেই
পড়াশুনো আমার ধাতে সয় না। তার ওপর গরমের ছুটি। সকালে একপাতা হাতের লেখা আর
সন্ধ্যেবেলা ঢুলতে ঢুলতে দাদার পাশে বসে কোনো মতে কয়েকটা ভাগ, দুই তিনটে যোগ আর
মুষ্টিমেয় আনা খানেক গুণ করলেই আমাকে আর দেখে কে। মা সরস্বতী তখন আমার
এ্যালুমোনিয়ামের পড়ার বাক্সে বন্দি। আর নকশাল তখন গরমের চোটে নীচের বারান্দায় নামা
দূর অস্ত, দানা পানি খেতেও ভুলে যায়। কন্টিদের বাড়ির ছোটো পেয়ারা গাছটার ওপর বসে
থাকে। আর মাঝে মাঝে একটু একটু উড়ে গিয়ে পুকুরপাড়ে বিজয় কাকুদের জামরুল গাছে কচি
ডাঁসা জামরুলের পাশে বসে পুকুরের হাওয়া খায়। কাজেই কারো আর নজরে পড়ে না টুকনু পড়ছে
কিনা। জাত শত্রু নকশালও ভুলে যায় তার নিত্যনৈমিত্তিক বজ্জাতি গুলো। সচরাচর যেগুলো
সে আমার সাথে করে থাকে সেগুলোয় কোথাও যেন ছেদ পড়ে। আমার পড়ার এ্যালুমনিয়ামের
বাক্সে তার সবুজ হাগু বন্ধ হয়। আমাকে তখন গঙ্গার ঘাট ডাকে। পাপ্পুদের চিলেকোঠা
ডাকে। মণির পাশে কাসুন্দি পাহাড়া দিতে দিতে গরমের দুপুরে মণির দেশের সেই পুকুর
পাড়ের ফলসা গাছ ডাকে। আমার চোখে ঘুম নামে না। আমি ঘুমিয়ে পড়ি না। জানো না আমারও
ঠিক কয়েকদিন পরেই দাদার মতোই ঠোঁটের নীচে কালো একটা রেখা বেরোবে। আর আমিও গম্ভীর
হয়ে কে সি নাগের অঙ্ক বই খুলে বসে বসে অঙ্ক কষবো।
মণি হাসে।
তাল পাতার পাখাটা আমার মাথার ওপরে আরো জোরে জোরে নাড়ে। কপালের ওপর এসে পড়া অবাধ্য
চুলগুলোকে সরিয়ে দেয়। আর মাঝে মাঝেই নজর রাখে কাসুন্দির ওপর। রোদ সরে গেলে কাঁচের
বয়াম আবার রোদের কাছে নিয়ে যাবে মণি। দাদা বলেছে মণির কেউ নেই। ও কিছু বোঝে না।
কারোর কোনোদিন কেউ নেই এমনটা হয় নাকি? এই তো আমি আছি...বাবা আছে...মা আছে...ঠাম্মা
আছে...হাঁদা আছে...তুই আছিস...। দাদা বলে তাও। মণির কেউ নেই। মণির বর নেই। মণির
বাচ্চা নেই। মণির কলাপোতা নেই...মণির খুলনা নেই...। দেখিসনা মণি কেমন চুপ করে
থাকে। দেখিস না মণি কেমন জপ করার সময় কাঁদে? দাদার অদ্ভুত যুক্তি গরমের সকালে আমার
পানষে লাগে। বলি তোর মন্ডু আর আমার মাথা...। জপ করার সময় মণি কাঁদে না। ঠাকুরের
সাথে কথা বলে। তাই তো মণি মাথায় ফুঁ দিয়ে জ্বর সারিয়ে দেয়। ঘাড়ের ওপর হাত বুলিয়ে
ব্যাথা কমিয়ে দেয়। কাঁদে! ইশ...ঠুলি ঠিক বলে...। সব সময় অঙ্ক করলে আর সব সময়
ক্লাসে ফাস্ট হলে বুদ্ধি কমে যায়। দাদা রেগে যায়। চিতকার করে বলে ওই দেখো মা...ভাই
আবার ঠুলিদের সাথে মিশছে। উলটো দিকের রান্নাঘর থেকে ভেসে আসে মায়ের গলা দাঁড়া এবার
ওকে কোমড়ে দড়ি পড়াতে হবে। আমি ভয় পাই। ছুট্টে বেরিয়ে যাই
ঘর থেকে। কোমড়ে দড়ি ওরা সুশান্তকেও পড়িয়ে ছিল। আর পিটতে পিটতে পুলিশের ভ্যানে
তুলেছিল। সুশান্তকে তারপর থেকে আর খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। সুশান্তকে খুঁজে চলেছে
মরিয়া হয়ে সবাই। জুটমিলের শ্রমিকরা হাঁদার দোকানের সামনে পোষ্টার দিয়েছে। পুলিশে
ধরা...পুলিশের কাছ থেকেই ভ্যানিশ হয়ে যাওয়া সুশান্তর হারিয়ে যাওয়া ব্যাপারে খোঁজ
খবর নিয়েছে। কেউ কিছু বলতে পারেনি।
“মেরে
ফেলেছে”...আমার দিকে না তাকিয়েই এই অমোঘ কথাটা আমাকে বলেছিল ঠুলি গঙ্গার ঘাটে পয়সা
কুড়োতে কুড়োতে। মাটির মালসার একটা দিক ভেঙে জল ছেঁচে ছেঁচে পয়সা তোলে ঠুলি। দশ
আনা, পাঁচ আনা যাই পায় মুখের মধ্যে পুড়ে দেয় টুপ করে। লজেন্স খাওয়ার মতো দুই দিকের
গাল ফুলে ওঠে খুচরো পয়সায়। সেই পয়সা ঠুলি কিছুটা জমায় সামনের বিশ্বকর্মা পুজোয়
মাঞ্জা দেবে বলে আর কিছুটা পয়সায় সে রোজ মিঠাই বরফ খায়, সকালবেলা মুড়ি চানাচুর
খায়। কখোনো কখোনো কাশির দোকান থেকে তেঁতুলের আচার কেনে। আমাকে দেয়। ঠুলি এখন আমার
বন্ধু। দাদা...মা কেউ পছন্দ করে না ব্যাপারটা। তাই লুকিয়ে, চুরিয়ে কাউকে না বলে
আমি ঠুলির সাম্রাজ্যে প্রবেশ করি। আর করবো নাই বা কেনো? ঠুলির ওপর যে আমার অগাধ
আস্থা! আমাকে সে এনে দেবে বলেছে পায়রা ধরার ফাঁদ। যে ফাঁদে আমি টুপ করে বজ্জাত
নকশালটাকে ধরবো আর ওই বিশালদের বড় হুলোটাকে খাওয়াবো। ঠুলি হাসে। তার বড় বড় চোখ
গুলো নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে বলে “টুকনু...তুই তো পুলিশ গুলোর থেকেও বেল্লিক
মাইরি...! শালা...কি নিষ্ঠুর তুই...!” আমিও ছাড়ি না। “মাইরি...শালা...” এই শব্দগুলো খারাপ, দাদা বলেছে! ঠুলি আরো জোরে হাসে।
আর আমি বেল্লিক না। নিষ্ঠুরও না। ও আমার পড়ার বাক্সে কেন রোজ হাগবে? ঠুলি বলে কে?
ওই পায়রাটা? হা হা হা...ও তো শালা তোর দাদার সাথে থাকতে থাকতে হেবি গান্ডু হয়ে
গেছে মাইরি...! বলেই আবার জিভ কাটে। আমি চিৎকার করে বলি দেখলি তো...দেখলি...! আবার
গালাগালি দিচ্ছিস। তারপর তোর সাথে থাকতে থাকতে আমারও গালাগালি দিতে ইচ্ছে
করবে...আর তখন আমাকে আমার মা বাড়ি থেকে তাড়িয়ে দেবে! ঠুলি হঠাৎই চুপ করে যায়। কিছু
বলে না। মাথা নীচু করে ঘাড় গুঁজে বসে থাকে ঠুলি। আমি হাত দিয়ে মাথা ধরে ঝাঁকাই। এই
ঠুলি...এই ঠুলি...কী হলো? ঠুলি মুখ তোলে। এই গরম কালেও বর্ষার মেঘের মতো তার চোখের
ওপর ভার নেমেছে জলের। আমার থেকে বছর কয়েকের বড় ঠুলি তখন কেমন যেন আনমনা। ঠুলি
বলে...তাও তোকে তোর মা বাড়ি থেকে বের করে দেবে বলেছে। আর আমার মাতো কোন সেই
ছোট্টবেলায় আমাকে রেখে কোথায় চলে গেছে...! গাল বেয়ে জল নামে ঠুলির। ঠুলির মা
নেই...বাবা নেই...ঘর নেই...কেউ নেই! ঠুলি থাকে লালবাবা আশ্রমে। সেখানে রোজ রাতে
বাসন মাজার পর প্রসাদী রুটি সুজি খেয়ে ঘুমিয়ে পড়ে। তাহলে ঠুলিও কী রোজ রাতে মণির
মতো চোখের পাশ দিয়ে জল বের করে? ঠুলি কি তাহলে মণির মতো?
ঠিক সেই সময়েই পোঁ করে সাইরেন বেজে ওঠে। দুজনের কান সজাগ হয়। এটা তো জুটমিলের
সাইরেন নয়। আর জুটমিল তো বন্ধ! তাহলে? ঠুলি বলে ভরা কোটালের সাইরেন। তার মানে
গঙ্গায় এক্ষুনি জোয়ার আসবে। বড় বড় ঢেউ...। আছড়ে পড়বে আমাদের ঘাটে। ওই দূরে ওপারের
কাঁচের মন্দিরে... দক্ষিণেশ্বরের কালি বাড়ির পাড়ে...। ছুট...ছুট...ছুট...। আমি আর
ঠুলি ঊর্ধশ্বাসে দৌড় দিই। গঙ্গার ধারে তখন মেলা লোকের ভিড়। সবাইকে সরিয়ে একদম
পাড়ের কাছে গিয়ে দাঁড়াই। ঢেউয়ের পরে ঢেউ গিয়ে লাগছে আমাদের ঘাটের সিঁড়িতে। আছড়ে
পড়ছে গঙ্গার ঢেউ। কেউ তাদের মধ্যেই বলে উঠছে...চিৎকার করছে জয় মা গঙ্গা...জয় মা
গঙ্গা...। আর গঙ্গার ঘোলা জল ঘুরে ঘুরে পাক খেতে খেতে আছড়ে পড়ছে সিঁড়িতে। সেই
গরমের দুপুরের গঙ্গার জলের ছিটে এসে লাগছে আমার বুকে...আমার মুখে...আমার ছোট্ট
বেলার হারিয়ে যাওয়া দিন গুলোতে। কিন্তু ওটাকি? ওই তো...ওই তো জলের সাথে ঘুরে ঘুরে
এগিয়ে আসছে। গুঞ্জন ওঠে ঘাটের মধ্যেই। একটা মানুষ না? ভিড়ের মধ্যে পাঁচুর ঠাকুমা
গুরাকু দিয়ে দাঁত মাজতে মাজতে বলে ওঠে। আহার রে...কার বাছা আবার জলে ডুবলো...ওগো
তোমরা কেউ কিছু করো গো...বাঁচাও গো...। কেউ শোনে না পাঁচুর মার কথা...। বেশ
দূরে...বেশ দূর দিয়ে বয়ে যাচ্ছে দেহটা...। পঞ্চনন তলার হরি মিত্র এসেছিল ঘাটে
স্নান করতে। পঞ্চায়েতের সদস্য সে। কিছুদিন আগেই হাত চিহ্নে ভোট দিন বলে চিতকার
করতে করতে মিছিল করে যেত। আমাদের বাড়ির সামনে বড় পাঁচিলটায় লিখেছিল “দিনের বেলায়
কৌটো নাড়ায়/ রাতে করে ফিস্ট/ তারাই আবার চেঁচিয়ে বলে/ আমরা কমিউনিস্ট।” লোকটাকে
কেউ দু-চক্ষে দেখতে পারে না। কানা ঘুঁশো শোনা যাচ্ছে জুটমিল বন্ধ হওয়ার পেছনে
লোকটার একটা লম্বা হাত আছে।
গরমের রাতে
দাদার কাছে জানতে চেয়েছিলাম মানুষের লম্বা হাত কী করে হয় রে? তাহলে একবার
চেষ্টা করে দেখবো ব্যাপারটা। তখন আর আঁকশি দিয়ে বিজয় কাকুদের জামরুল পাড়তে হবে না।
কন্টিদের বাড়ির পেয়ারা গাছে চুপি চুপি লম্বা হাতে পেয়ারা পেড়ে নেব। দাদা মাথায়
গাট্টা মারে। টনটন করে ওঠে মাথা। চিৎকার করতে গেলেই ফিসফিস করে বলে ওঠে মাকে
কিন্তু বলে দেব...আজ তুই ঠুলির সাথে কোথায় গিয়েছিলিস। বলে দেব রোজ তুই ঠুলির সাথে
শ্মশান ঘাটে গিয়ে পয়সা কুড়োস। আমি কথা বলি না। চোখের কোনে বিন্দু বিন্দু
বঙ্গোপসাগরের নিম্নচাপ নিয়ে ঘুমিয়ে পড়ি। ঘুমের মধ্যে কেউ আসে না। শুধু দেখি হরি
মিত্র তার লম্বা হাত দিয়ে বিজয় কাকুর গাছের সব কচি ডাঁসা জামরুল পেড়ে নিচ্ছে। আর
বলছে লম্বা হাতের উপকারিতার কথা। আমাদের বাড়িতে ভোট চাইতে এসে তার লম্বা হাতটা বের
করে বলছে ভুলে যাবেন না রবি বাবু...কংগ্রেস সরকার আপনাদের মতো রিফিউজিদের জন্য
অনেক করেছে! লম্বা হাত গুটিয়ে চলে যাচ্ছে হরি মিত্র। কিন্তু কোথায় যাচ্ছে? ওই তো
দাঁড়িয়ে সে। গঙ্গার ঘাটে হম্বিতম্বি করছে। খবরদার...খবরদার বলছি কেউ নামবে না জলে।
কার না কার লাশ...। তার জন্য দরদ একেবারে উথলে পড়ছে গো...। হরি মিত্র গলা
চড়ায়...গুড়াকুর নেশায় পাঁচুর ঠাকুমা তার থেকেও বেশি চিতকার করে থুথু ছিটিয়ে বলে
...আহারে কার ঘরের বাছা রে...ওরে কেউ কি ওকে বাঁচাবি নারে...। হরি মিত্র ধমকে ওঠে।
আহঃ মলো বুড়ি...দেখছো না গন্ধ উঠে গিয়েছে? সত্যি ঠিক তখনি পচা গন্ধে চারপাশ ভরে
যাচ্ছে। বুড়ি তবু থামছে না...আহা গো লাশের তো ঘর থাকে গো...। তারও তো মা থাকে
গো...দেখো না গো...জোয়ান ছেলেটা গো...। ওর বুঝি কেউ নেই গো...। বিলাপের মতো শোনায়
পাঁচুর ঠাকুমার গলা। মণির কেউ নেই...ঠুলির কেউ নেই...ওই যে ওই দেহটা ভেসে যাচ্ছে
ওর কেউ নেই...? ভাবনা গুলো যখন জট পাকাচ্ছে আমার হাফপ্যান্ট পড়া শৈশবের গঙ্গার
ঘাটে ঠিক তখনি সঙ্গে সঙ্গে কান্ডটা ঘটাচ্ছে ঠুলি।
সেই বিশাল
ঢেউয়ে ফুঁসে ওঠা গঙ্গায় তিন ভল্টে ঝাঁপ দিচ্ছে ঠুলি। সবাই আঁক করে উঠছে। অনেক
গভীরে ঝাঁপ দিয়ে...অনেকটা ডুব সাঁতার আর মরিয়া স্রোতে টানতে টানতে কাকে যেন নিয়ে
আসছে ঠুলি ঘাটের ধারে। পাড়ার বেশ কিছু লোক তখন নেমে পড়েছে আরো কিছুটা জলে। মরে
যাবে তো ছেলেটা। কে বলোতো ছেলেটা? আরে ওই যে দীন দুঃখী লালবাবাতে থাকে। ওদের কি
আবার মা বাবার ঠিক আছে? যাদের মা বাবার ঠিক নেই...তাদের মা গঙ্গাও বড় ভালোবাসে। না
হলে ওই রকম প্রচন্ড জলের তোড়ে...ওই রকম ভয়ঙ্কর স্রোতে কী করে সাঁতার কাটতে পারে
ঠুলি? মা গঙ্গা ফিরিয়ে দেয় ঠুলিকে...ঢেউয়ের পর ঢেউ বেয়ে হাতে ধরা একটা জামার খুট
শুদ্ধু দেহ টেনে এনে ঘাটের সিঁড়িতে শুইয়ে দেয় ঠুলি। আর ঠিক তখনি। গরমের
দুপুরে...লু বইতে থাকা গ্রীষ্মের পরিমন্ডলে আমার চোখের সামনে ঘটে যায় আমার জীবনের
প্রথম মর্মান্তিক বিপর্যয়। আমি এই প্রথম...আমার খুব ভালোলাগা...ভালোবাসার মানুষের
মৃতদেহ দেখি চোখের সামনে। আমি কিছু বলতে পারিনা। আমি একটা মিছিলকে দেখি। গান গাইতে
গাইতে এগিয়ে চলেছে যে মিছিল। এক সাথে গাইছে সবাই “ও...আলোর পথ যাত্রী...এযে
রাত্রী...এখানে থেমো না...”। মিছিলের সামনে বড় লাল পতাকাটা কেউ যেন উঁচু করে ধরে
আছে। কেউ যেন আমার দিকে তাকিয়ে মোটা কাঁচের চশমার আড়ালে বলছে “ও তাহলে এই টুকনু”?
কেউ যেন মাকে বলছে “বাচ্চাদের মারবেন না...ছোটদের মারতে নেই।” পুলিশের মারে লুটিয়ে
পড়ছে ছেলেটা। ছিটকে পড়ছে তার চোখ থেকে চশমা? পুলিশের ভ্যানে তাকে দুমড়ে মুচড়ে
উঠিয়ে দিচ্ছে কয়েকটা নরখাদক পুলিশ...। আমি কুড়িয়ে নিচ্ছি ভাঙা চশমাটা। ও যে খালি
চোখে দেখতে পায় না কিছু...। ছেলেটা হাসছে। তার কষ বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে রক্ত। তার
মধ্যেই ছেলেটা আমার থেকে চশমা নিয়ে বলছে “বিদায় কমরেড...দেখা হবে আপনার সাথে আগামী
বসন্তে।” কানের কাছে গরম হাওয়ায় আমার সাড় ফেরে। ঠুলি কানের কাছে মুখ নিয়ে এসেছে।
ফিসফিস করে বলে...একি রে...এই ছেলেটা তোদের বাড়ি এসে ছিল না? মিছিল করছিল না? এই
ছেলেটাকে পুলিশ এসে ধরে নিয়ে গিয়েছিল না? আমি তখনো ঠায় তাকিয়ে লাল গেঞ্জি...। কালো
প্যান্ট...। গলার কাছে হাঁ হয়ে থাকা খাদ্য নালীর দিকে। ছেলেটার চোখে শুধু চশমাটুকু
নেই। ওরা কি জানে না চশমা ছাড়া সুশান্ত দেখতে পায় না?
গঙ্গার ঘাটে
ভিড় বাড়তে থাকে। জুটমিলের লোকজন এসে হাজির হয়। আর সব শেষে যে লোকটা আসে খুঁড়িয়ে
খুঁড়িয়ে তাকে তোমরা সবাই চেনো। এতোদিনে চিনে গেছো। সে আমার গোরা নকশাল। থমকে
দাঁড়ায় লোকটা সুশান্তর ফুলে যাওয়া দেহটার সামনে। বিড়বিড় করে বলে “মেরে ফেললো?”
চকিতে নজর পড়ে আমার দিকে। টুকনু...! তুই এখানে? আমি কেমন যেন হয়ে যাই। আমি নড়তে
পারি না। আমি হাঁটতে পারি না। আমি এগিয়ে যেতে পারিনা গোরা নকশালের কাছে। নিজেই
এগিয়ে আসে লোকটা। কোলে তুলে নেয়। আমার চোখ দিয়ে তখন নেমে আসছে গঙ্গার ধারা। ভিজে
যাচ্ছে গোরা নকশালের সাদা পাঞ্জাবি...। এই দুপুরে বাড়ি থেকে কেউ বেরোয়? জানতে চায়
গোরা নকশাল আমার কাছে। আমি পাল্টা প্রশ্ন করি... কেন মরে গেলো সুশান্ত? গোরা নকশাল
উত্তর দেয়। কখন থেকে বসে আছি তুই আসবি...। সুশান্ত কেন সাঁতার কাটতে পারলো না?
এবার গোরা নকশাল ঘাড় ঘুরিয়ে তাকায়। দেখে চিকচিক করছে টুকনুর চোখ। চিকচিক করছে
টুকনুর গাল। ভর দুপুরে পূর্ণিমার জ্যোৎস্না এলো কোথা থেকে? এই জ্যোৎস্নার আলোকিত
ভুবনকেই কি খুঁজে বেড়াচ্ছিল গোরা নকশালরা? এই জ্যোৎস্নার রাতেই তো ছেড়ে দিয়েছে বলে
দাবী করেছিল পুলিশ? এই জ্যোৎস্নার রাতেই তো বাড়ি ফিরে আসার কথা ছিল সুশান্তর।
খাতায় সই ছিল। সুশান্তর বেরিয়ে যাওয়ার সাক্ষী ছিল...কিন্তু সুশান্ত ঘরে ফিরে
আসেনি। তাহলে কী হলো পরিবর্তনের? কী হলো রাইটার্সের মাথায় লাল পতাকা উড়িয়ে? কী হলো
জীবনের দশটা বছর জেলের পেছনের অন্ধকারে কাটিয়ে। পা ভেঙে...। অসুস্থ হয়ে...। প্রিয়াংশুর
মতো বন্ধু হারিয়ে? ছেলেটার মুখের ওপর মাছি বসছে দেখেছিস টুকনু? যারা প্রতিবাদের
কথা বলে...যারা প্রাপ্য চাহিদার কথা বলে...যারা বলে ফিরিয়ে দাও আমাদের
অধিকার...আমাদের স্বাধীনতা...আমাদের দুবেলা দু-মুঠো অন্নের অধিকার...তাদের
প্রতিবার...প্রতি জনসমুদ্রে এইভাবেই ভাসিয়ে দেওয়া হয়...এইভাবেই বার বার কন্ঠ নালী
কেটে...রক্তের গঙ্গায় বিসর্জন দেওয়া হয়...। গোরা নকশাল আস্তে আস্তে নামিয়ে দেয়
টুকনুকে কোল থেকে। বাড়ি চলে যাও টুকনু...। আর ভুলে যেও না...তুমি সুশান্তকে
দেখেছিলে। কোনোদিন ভুলে যেও না...তোমার সুশান্তকে কারা যেন মেরেছিল।
বাহঃ...বেশ...মাথায়
ফট্টি পড়াচ্ছেন তো দেখছি এই বাচ্চা ছেলেটার...। জেলেও আপনারা শুধরোলেন না। কেউ
পালালো বিদেশে...কেউ মরলো...আর কিছু পড়ে রইলো হাত পা ভেঙে হ্যান্ডিক্যাপট হয়ে...।
হাসালেন মাইরি আপনারা নকশালরা...। হরি মিত্র ভিজে গা মুছতে মুছতে চলে যায়। গোরা
নকশাল কিছু বলে না। গাছের ছায়ায় বসে পড়ে। বিকেল হতে শুরু করেছে। পাশের সন্ধ্যামণির
গাছটায় আস্তে আস্তে ফুল ফুটছে। বাবা এসে সামনে দাঁড়ায় গোরা নকশালের। গোরা নকশাল
তাকিয়ে থাকে। স্কুল থেকে ছুটে এসেছে বাবা। সুশান্ত আর নেই? গোরা নকশাল বলে
ওঠে...গাছেরা ঘুমিয়ে পড়লে ফুলেরাও আজকাল ঘুমিয়ে পড়ে রবিদা...। ওই দেখ...আর একটা
ফুল ঘুমিয়ে পড়লো। সুশান্তর দিকে তখন অপলক দৃষ্টিতে তাকিয়ে মাথায় জবজবে তেল মাখা
আমার ফাস্ট হওয়া দাদা। যে একদিন সত্যিই প্রেসিডেন্সি কলেজে সুশান্তর মতো ভর্তি
হবে। আমাকে খুঁচিয়ে মনে করাবে কতদিন আগে গঙ্গার ঘাটে পড়ে থাকা এক লাশের কথাকে।
আমাকেও হাঁটতে হবে স্মৃতির মিছিলে। আমাকেও বলতে হবে ভুলে যাইনি সুশান্ত তোমাকে।
অনেক রাতে দাদা এসে বলবে...চারু মজুমদারের এই বইটা পড়েছিস ভাই? আর ঠিক তখনি কোথাও
যেন চটকলের খুন হয়ে যাওয়া চৌকিদারের বিধবা বৌ এগিয়ে আসে। সুশান্তর সেই ভিজে গায়ের
ওপর হাত বোলায় সে। তারপর বলে ঠান্ডা লাগছে আমার বাবুয়ার...। ওর ঠান্ডা লাগছে। ওরে
আমার বাবুয়ার ঠান্ডা লাগে...। কেউ এসে সুশান্তর গায়ের ওপর বিছিয়ে দেয় একটা লাল
রঙের পতাকা। কারা যেন গুমরে গুমরে গেয়ে ওঠে... “হাম ভুখ সে মরনে বালো...ইয়া মৌত সে
ডরনে বালো...আজাদিকা ঝান্ডা উঠাও...।” মিছিলটা আস্তে আস্তে একটা অজগর সাপের মতো
চেহারা নেয়। ঠুলিকে খুঁজে বেড়াই আমি...। কোথাও খুঁজে পাই না তাকে। অত ভিড়ে। পাবো
কী করে? সে তখন মিছিলের এক্কেবারে সামনে। একটা বড় লাল পতাকা হাতে...। ঠুলির চোখে
কি জল? না ঠুলির চোখে জল নয়...ঠুলির চোখে তখন সুশান্তর স্বপ্ন...। এক খুন হয়ে
যাওয়া মৃত কমরেডের কাছ থেকে এটাই তার একমাত্র উত্তরাধিকার।
সাত
ওরা তোমাকে
হত্যা করে কোথায় কবর দিয়েছে
আমাকে কিছুই
জানালো না
সেই থেকে
পুরো স্বদেশ তোমার কবর হয়ে গেলো
মাতৃভূমির
প্রতি ইঞ্চি মাটিতে, যেখানে তুমি নেই
সেখানেও তুমি
জেগে উঠলে।
ওরা ভেবেছে,
তোমাকে গুলি করে হত্যা করবে
কবর দিয়ে
নিশ্চিহ্ন করে দেবে।
কিন্তু ওরা
মূলতঃ
বিপ্লবের বীজ
বপন করেছে।
(এপিটাফ/
এর্নেস্তো কার্দেনাল/ অনুবাদ-পারভেজ চৌধুরী)
এক অন্তর্বতী
আলোর গহ্বরের মধ্যে দিয়ে এঁকে বেঁকে চলেছে যে স্মৃতির মালা সেই উপাখ্যানের
পুরোভাগে এক মানুষ জ্যোতির্বলয়ের মাঝখানে দাঁড়িয়ে নীরিক্ষণ করছেন এক শোক মিছিল।
তাঁর প্রিয়, তাঁর সুজনের বছর বাইশের এক তরুণের দেহ। কে ও? শুধুই কি সুশান্তর একটা
লাশ? তার জলে ডোবা ফুলে ওঠা চেহারায় শুধুই কি মায়ার আস্তরণ? নাকি ওই দেহপটের
প্রতিটা পচে যাওয়া গলনাঙ্কের মধ্যে আছে প্রতিবাদের বারুদে ঠাসা মশলার বুনোট। এই
এক্ষুনি...এক্ষুনি যেন ফেটে পড়বে সে। দুরন্ত গতিতে আগুনের ঝলকানি নিঃসৃত হবে তার
পচে যাওয়া, গন্ধ বেরোনো দেহপট থেকে। ঠিক যেমন বেরিয়েছিল সেবার। জঙ্গলের মধ্যে
দাবানল ভেবে এগিয়ে এসে সেই সাঁওতাল বৃদ্ধ রমনী জানতে চেয়েছিল “তোরা খেপাইচ্ছিস
ক্যান জঙ্গলটারে?...আমার জঙ্গলের শাল পাতা...কেন্দু পাতা... পোড়াইলি ক্যান তোরা?”
আগুনের বর্ণমালার এক নতুন ভাষা রচিত হচ্ছিল কোথাও যেন গোটা জঙ্গলের বহ্ন্যুৎসবে।
গোরা নকশাল
সেই লেলিহান শিখার সামনে দাঁড়িয়ে কোনো এক শীতালু ভোরের উষ্ণতায় পারদের তাপ মাত্রা
নির্ণয় করছিল না। বরং তার তরুণ শক্তিতে ধামসার দিম দিম... দ্রুম দ্রুম...শব্দে যে
তরঙ্গ ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হতে শুরু করেছিল সেটা কোথাও যেন তার বিজয় পথের এক অলীক
স্বপ্নের সূচনা করছিল। প্রতিটা আগুনের লেলিহান শিখায় মিশেছিল বারুদের গন্ধ। ভারী
হয়ে আসছিল কালো ধোঁওয়ায় জঙ্গলের সুললিত বাতাস। কোথায় হে কালীদাস...? আজ কি দেখছো
না তোমার শকুন্তলের অরণ্য ভাঙছে? আজ জ্বলছে সে...? জ্বলছে সে দিমি দিমি দ্রুম
দ্রুম ধামসার শব্দে...। জ্বলছে শ্রেনীহীন সমাজের বাসনায়। আজ জ্বলছে সে অন্ন
চাই...অধিকার চাই...কাজ চাইয়ের অনন্ত ক্ষিদে বুকে নিয়ে। ভোরের আলোয় কারা যেন গেয়ে
উঠছে... “একদিন সূর্যের ভোর...’’। কারা যেন এগিয়ে যাচ্ছে...। আর ঠিক সেই
সময়ে...সেই ঊষাকালীন ব্রাহ্ম মুহূর্তে...কোথা থেকে যেন ছুটে আসছে...সেই লেলিহান
শিখা...সেই স্বপ্নের রাষ্ট্র গড়ার জীয়ন কাঠিকে ছিন্ন বিচ্ছিন্ন করে দিচ্ছে ঝাঁক
ঝাঁক বুলেট...। মিলিটারীর বুটের আওয়াজ গমগম করছে...নিরেট ধাতব শব্দ তুলছে শুকনো
পাতা আর রুক্ষ মাটির ওপর। কুয়াশার শাদা চাদর আর ঘন কালো ধোঁওয়ার আস্তরণ ভেদ করে
ওরা সত্যি সত্যি ছিনিয়ে নিচ্ছে অধিকার। ওরা বলছে “এই রাষ্ট্র আমার...এই যন্ত্র
আমার...এই মাটি আমার...এই দেশ আমার...”। এক-একটা বুলেট...এক একটা নিশানায় এসে
হৃৎপিন্ডটাকে এফোড় ওফোড় করে দিচ্ছে। বড় প্রিয়জন...বড় কাছের মানুষরা শুয়ে পড়ছেন
অন্তিম শয্যায়...। কেউ কাউকে এগিয়ে দিচ্ছে না জল। কেউ কাউকে গন্ডুষে পান করাচ্ছে
না জীবনের অমৃত মন্ত্র। কেউ কাউকে বলছে না... “সুদিন আসছে কমরেড...জাতের
নামে...ধর্মের নামে...দেশের নামে ভাগ করা চলবে না কাউকে...”।
কিন্তু এই
আরণ্যক পরিবেশে ওই মানুষটা কে? হাতে তীর...ধনুক...এগিয়ে আসছে সে...। দাউ দাউ করে
জ্বলতে থাকা অরণ্যের মধ্যে দিয়ে কে ছুটে আসছে? তুমিই কি তাহলে পার্থ...? পিতামহ
ভীষ্মকে এক গন্ডুষ জল উপহার দেবে তার অন্তিম নিঃশ্বাস কালে? দাও...দাও...হে
বন্ধু...আমার চিরসখা...ওই দেখ...ওই দেখ...ওখানে পড়ে আছে কমরেড বিমল...ওই
দেখ...ছিন্ন ভিন্ন হয়ে গেছে কামানের গোলায় আত্রেয়ীর দেহ...ওই দেখ...ওখানেই আছে
সুচারু...যে একটু আগে একটু আগে চেয়েছিল প্রাণভিক্ষা নয়, মৃত্যুর মহান অধিকার...।
হে পার্থ...জল দাও...হে পার্থ...মৃত্যুর অধিকার দাও...হে পার্থ আমার দেশ
দাও...আমার স্বাধীনতা দাও...আমাকে ফিরিয়ে দাও আমার শেকল ভাঙার গান...। তুমি কি
দেখছো না ভাই ভাইয়ের রক্তে রাঙিয়ে নিয়েছে হাত...তুমি কি দেখছো না এক ষড়যন্ত্রের
শিকার হয়েছি আমরা। তুমি কি দেখছো না নিজ দেশে পরবাসী হয়ে গেছে সবাই...?
সেই আরণ্যক
ভূমিতে হাঁটু মুড়ে বসে পড়ে গোরা নকশাল। কড়জোড়ে প্রার্থনা করে মৃত্যুর। এযাবৎ কাল
যে স্বপ্ন চোখে যৌথ খামারের নক্সা এঁকে দিল...এযাবৎ কাল যাদের মনে করলাম এরাই হবে
আগামীর কান্ডারী...তারা আজ কেউ নেই পার্থ...তোমার মতো...তোমার মতো একা...এই রণে
ভগ্ন শরীরে বেঁচে আছি আমি। এই জীবন আমার নয়...এই জীবন আমি চাইনি কোনোদিন...এই জীবন
আমার লাল পতাকার আচ্ছাদনে সাতরঙা রামধনু হয়ে ফিরে আসবে না। এই বিষাদময়
ভোরে...আমাকে...আমাকে গ্রহণ করো। গোরা নকশাল ভাবে আর অবাক হয়। এই প্রলাপ...এতো তার
নিষিদ্ধ ইস্তেহার নয়। এতো তার মহাকাব্যোচিত ট্রাজিক বীরত্ত্বের শোকগাথা নয়। এতো
একনায়কতন্ত্র? তাহলে এতোদিন...এতোদিন যা শিখেছিল...তা ভুল? কেন বারবার মনে পড়বে
কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধে অসহায় পার্থকে। যে লড়তে চায়নি...। যাকে মিথ্যে বলে...ধর্মের
দোহাই দিয়ে নামিয়ে দেওয়া হয়েছিল সংশয়ে। ভাবতে পারে না গোরা নকশাল আর। নাকে পোড়া
মাংসের গন্ধ...বারুদের গন্ধ...রক্তের গন্ধ নিয়ে সজ্ঞা হারায়। আর ঠিক তখনি...ঠিক
তখনি...সেই গান্ডীবধারী কোঁকড়া চুলের যুবক এক ঝটকায় পিঠের ওপর তুলে নেয় গোরা
নকশালকে। তারপর অরণ্যের আদিম প্রগলভতায় সে ছুটতে থাকে...। কারণ সে জানে যাকে নিয়ে
সে এগিয়ে যাচ্ছে এই আগুনখোকো জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে সেই মানুষটা আসলে তার গ্রামের
হন্তারকদের বিচার দিতে এসেছে। সে এসেছে তাদের জঙ্গলের অধিকার ফিরিয়ে দিতে। ছুটছে
তাই ঝাঁকড়া চুলের বড় টানা টানা চোখের মঙরু...। ছুটছে...ছুটছে...আর ওদিকে মাথা
নীচের দিকে...কপালের পাশ থেকে গড়িয়ে পড়া রক্তের টিপ টিপ বর্ষণে গোরা নকশাল দেখছে
এক আদিম জনভূমি...যেখানে আর্য নেই...যেখানে সভ্যতা নেই...যেখানে প্রতিষ্ঠান
নেই...। চোখের ওপর রক্তের প্রলেপ আঁকা বিহ্বল নিয়ে গোরা নকশাল জানতে চাইলো কে
তুমি? মঙরু উত্তর দিল না। গোরা নকশাল বুঝতে পারলো...গোরা নকশাল বললো... আমার আর্য
শিক্ষার পাশে...এক অনার্য ভারত আমাকে দিক নির্দেশ করছে নতুন ইতিহাসের...নতুন
যুগের...সিধো কানু... তিতুমীরের...। আমার দেশ তার বার্তা পাঠাচ্ছে...। তোমরা কেউ
শুনতে পাচ্ছো কী?
অচৈতন্য গোরা
নকশালকে চেতনায় নিয়ে এসেছিল যে মানুষগুলো তাদের কাছ থেকে সে এখন সহস্র যোজন মাইল
দূরে...। কেন এতো দূরে? কেনো? গোরা নকশাল নাক টেনে জঙ্গলের গন্ধ নেওয়ার চেষ্টা
করে। সবুজ পাতার সোঁদা গন্ধের বদলে তার নাকে আসে পোড়া মাংসের গন্ধ। মাথা তুলতে
পারে না গোরা নকশাল..। তুলতে পারে না কারণ হঠাত যদি...সে দেখতে পায় সেই আরণ্যক
ভূমিকে? হঠাত যদি সে দেখতে পায় মঙরুকে। হঠাত যদি তার মনে হয় এই যে
সামনে সুশান্তর দেহটা বারুদের মতো জ্বলছে চিতায় সেখানে যদি ব্লাস্ট হয়। সুশান্ত
যদি নিজেকে ব্লাস্ট করায়! “কমরেড গোরা...ভেঙে ফেলুন নিজের মনের মধ্যের প্রতিটা
প্রাচীর। কমরেড গোরা মানুষ কাঁদছে...। কমরেড গোরা আপনি বুঝতে পারছেন না ওরা জাতের
নামে...ধর্মের নামে...বিষ দিচ্ছে...ওরা ওদের শ্রমিকদের প্রাপ্য টাকা দিচ্ছে না।
ওরা মঙরুকে মেরে ফেলেছে। ওরা জেলে প্রিয়াংশুকে মেরে ফেলেছে...ওরা আপনার সব বন্ধুকে
গুম করে দিয়েছে। ওরা আপনার শেষ আশা সুশান্তকেও ওই চিতায় পুড়িয়ে দিচ্ছে...তবুও...
তবুও আপনি একবার...একবার...শেষবারের মতো জ্বলে উঠবেন না গোরা নকশাল?” কে বলে এই
কথা? কার কন্ঠ স্বর প্রক্ষেপণ হয়ে ঘুরে বেড়ায় তার চারপাশে? মোহজাল বিস্তার করে আবার
পথের নামার। আবার এগিয়ে চলার। আবার এক একটা লাশের সীমানা টপকে স্বপ্নটাকে আঁকড়ে
ধরবার? গোরা নকশালের চোখের পাশ দিয়ে বিন্দু বিন্দু জলের ধারা গড়িয়ে পড়ে।
পাশে দাঁড়ানো
টুকনুর হাতে টুপ টুপ জল পড়লে মনে হয় বৃষ্টি। টুকনু আকাশের দিকে চোখ তুলে দেখে গোটা
আকাশ জুড়ে গরম কালের স্বচ্ছ মেঘ। সেই মেঘে জল নেই আছে উষ্ণতা, আছে তাতিয়ে দেওয়ার
উন্মাদনা। তাহলে এই কয়েক ফোটা্র আজলা জল এলো কোথা থেকে? টুকনু তাকায়। আর টুকনু
আবিষ্কার করে এই প্রথম...এই প্রথম পাশের মানুষটার চোখে বৃষ্টির
ঘনঘটা। এতোদিন সে জানতো একমাত্র সেই কাঁদে। পাপ্পুকে অঙ্কের স্যার মারলে পাপ্পু
কাঁদে। বিহারীর ছোট মেয়েটা খাটিয়াতে বসে কাঁদে। কিন্তু...অতবড় একটা মানুষ...যে
প্রতি সপ্তাহে থানায় যায় হাজিরা দিতে... যে মানুষ ভয় পায় না পুলিশকে... অন্ধকারে
মণির মামদো ভূতকে...। যাকে ভালোবেসে শ্রমিকরা ঘিরে ধরে...বাড়ির সবাই যার সম্বন্ধে
কত কথা বলে... ঠাম্মা যত্ন করে খাওয়ায়...সেই লোকটা...সেই গোরা নকশাল কাঁদছে?
কান্নাটা এক ছোঁয়াচে প্রতিক্রিয়াশীল উপাদানের মতো এসে লাগে টুকনুর বুকে। আর এই
প্রথম...এই প্রথম সবার মাঝে...লেলিহান অগ্নি শিখার মাঝে...একটা মানুষ পোড়ার উৎকট
গন্ধের মাঝে...শ্মশান চিরে কেঁদে ওঠে টুকনু...। জোরে...চিতকার করে। সবাই ভাবে ভয়
পেয়েছে ছেলেটা। ততক্ষণে খুলি উপড়ে...ফাটানো হয়েছে সুশান্তর মাথা। যে ছেলেটা চশমা
ছাড়া দেখতে পেতো না। যে ছেলেটার চোখের মণি খুঁজে পাওয়া যায়নি। যাকে ভয় দেখিয়ে চুরী
করে মারা হলো...। সেই নিঃসহায় বিপ্লবীর দেহ পুড়ছে ছাই হয়ে আশির দশকের কোনো এক
মধ্যবৃত্তীয় ঘেমো বিকেলে।
টুকনুকে বাড়ি
নিয়ে যায় তার হাঁদা। এতো ছোটো ছেলের এইসব কি পোষায়? আর গোরা
নকশাল ভাবে কোথাও যেন পুঁতে দেওয়া হল বীজ...যে বীজ একদিন মাথা চাড়া দেবে। যে বীজ
ভুলবে না...মরেও ভুলবে না...একদিন...একদিন কারা যেন সুশান্তকে খুন করেছিল। একদিন
কারা যেন খুন করেছিল গণতন্ত্রের...অধিকারের...বেঁচে থাকার মূল মন্ত্রকে।
আট
“ছোট্টমোরগ
ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে
প্রাসাদের
ভেতর রাশি রাশি খাবার!”
(মোরগের
কাহিনী/সুকান্ত ভট্টাচার্য)
মাথার কাছে
অনবরত বেজে চলেছে মোবাইলটা। আমি তখনো ঘুমের ঘোরে। আমি তখোনো স্বপ্নে। হাতড়ে হাতড়ে
খুঁজে চলেছি তাকে যে আমার এই মুহূর্তের ঘুম নষ্ট করছে। স্বয়ংক্রিয় দূরাভাষের
যন্ত্রটি জানাচ্ছে এই এতো ভোরের সংবাদ সুখের নয়। পূর্বের অভিজ্ঞতা বলছে এই বার্তা
এনে দিতে পারে অমোঘ নিষ্ঠুর পরিণতি। ঠিকুজি, কুলজি বলছে এই বংশের বেশিরভাগ মৃত্যু
শীতকালীন। এবং ঊষা লগ্নে। জড়তা, স্বপ্ন, আখ্যানের অঙ্গ সজ্জা ত্যাগ করে জানতে পারি এই মুহূর্তে টিবি হসপিটালে ১৩৮
নম্বর বেডের পেশেন্টের অবস্থা সুবিধের নয়। যত তাড়াতাড়ি সম্ভব হাজির হওয়া দরকার।
আপনি বাড়ির লোক তো? দেখলাম আপনার নাম্বারটাই এখানে দেওয়া আছে। আসছেন তো? আমার
হ্যাঁ বা না বলার মতো কোনো অবকাশ থাকে না। কে যেন খামচে ধরেছে আমার পা। কে যেন
শিথিল করছে স্নায়ু। কে যেন বলছে কোনো এক মাঘের শীত গায়ে চাপিয়ে কার সাথে যেন
সাক্ষাৎ ঘটেছিল?
সেদিন
শ্রীরামপুর লোকাল আসতে চলছিল। ঘন কুয়াশায় ঢেকে ছিল রেল পথ। ঘন কুয়াশায় ঢেকে ছিল
আমার প্রায় তারুণ্য পেরোনো দিন গুলো। আমাদেরও কোনো তাড়া ছিল না সেদিন। হাতে ছিল না
শীতলার মিষ্টির প্যাকেট, ওষুধের ফর্দ, মায়ের রান্না করে দেওয়া খাবার। ফ্লাস্ক
ভর্তি গরম জল। ছিল না অনেক কিছু গিয়ে বলার...অনেক কিছু গল্পের অবকাশ। ঠিক সেই সময়ে
জানলার ধারে গাছগুলো শিশিরে আর কুয়াশায় স্নান করছিল অবিরত। কোনো এক কালে কোনো এক
মা তার একমাত্র ছেলের মৃত্যুতে শোকে পাথর হয়ে এই হসপিটালটা করেছিলেন। তারপর থেকে
মুমূর্ষ টিবি রোগীরা এখানে ঠাঁই পান সরকারী খরচায়। সরকারী অতিথি হয়ে শেষ নিঃশ্বাস
ত্যাগ করেন। আমার যে সুজন এখানে ভর্তি, তিনিও বেশ কিছুদিন সরকারী অতিথি। এর আগেও
জীবনের শুরুর বছর গুলোতে তিনি অনেকবার অনেক জায়গায় শুধু সরকারী অতিথি হয়েই কাটিয়ে
দিয়েছেন। অনেক গুলো বছর। তার প্রমান স্বরূপ তার একটা পা ভাঙা। একটা চোখে ভালো
দেখতে পান না। হাতের মাংস খোবলানো। থমকে দাঁড়িয়ে যাই। একটা ফলকের সামনে। ক্ষয়াটে
পাথরের ফলকটা মনে করাচ্ছে এই হসপিটালের স্থাপিত হবার দিনক্ষণ। সবে তখন টিবির
চিকিৎসা শুরু হয়েছে। আর তারিখটা বলছে তার কিছুদিন আগে চলে গেছেন এক কিশোর কবি।
যিনি পূর্ণিমার চাঁদকে বলেছিলেন “ঝলসানো রুটি”। একজন
নার্স আমাদের দিকে এগিয়ে আসেন। ১৩৮ নম্বরের বাড়ির লোক তো? আমি দাদার দিকে তাকাই।
আমার সেই ছোট্ট থেকে ক্লাসে প্রথম হয়ে আসা দাদা এখন তার কর্পোরেট অফিসের বড় বাবু
সুলভ গাম্ভীর্য এনে বলে হ্যাঁ। আমরাই বাড়ির লোক। কোন দিকে যাবো? ভদ্র মহিলা দোতলার
সিঁড়ি দেখান। আমি দাঁড়িয়ে থাকি। উঠতে পারি না। এগোতে চায় না আমার পা। দাদা সেই
ছোট্ট বেলার মতো আমার দিকে হাত বাড়ায়। আয় টুকনু। আমি হাত বাড়িয়ে দিই। দাদা শক্ত
করে ধরে আমার হাত সেই ছোটবেলার মতো। আমি এগিয়ে যাই।
ঠিক তখনি
হসপিটালের লম্বা করিডোরটাকে আমার মনে হয় একটা বিশাল স্টেজ। ঘুমন্ত রোগগ্রস্ত মানুষ গুলোকে মনে হয় সেদিনের
সেই জনসভার একমাত্র সাক্ষী। হাততালি পড়ে। ঝলকে ওঠে ফ্ল্যাশের আলো। এক পাদ প্রদীপের
তলায় এই যুগের এক অখ্যাত মেগা সিরিয়াল লেখক হাত জোড় করে দাঁড়ায়। ফ্ল্যাশব্যাকে
ফিরে যায় আখ্যানের পরিসর। মাইকের আওয়াজ গমগম করতে থাকে। পাড়ার জলসায় বাম ফন্ট্রের
নবতম জিতে আসা কোনো এক ভোটের বিজয় উল্লাসে কাঁচের ফ্রেমের মধ্যে থেকে এক তরুণকবি
গালে হাত দিয়ে খুব মিষ্টি মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকেন রজনীগন্ধার মালার আড়াল থেকে ঠিক
আমারই দিকে। আর আমার সেদিনের সেই বড় আদরের টুকনু এবার তাকায় তার সামনের সম্মিলিত
জনগণের দিকে। সে কোথাও খুঁজে পায় না তাকে যে একটা কবিতা প্রায় রোজ বলে বলে মুখস্থ
করিয়ে দিয়েছে। কেমন ভাবে স্টেজে উঠে বলতে হবে, দাঁড়ি, কমা, হসন্ত দেখে নিশ্বাসের গতি থামাতে
হবে। কোন লাইনে, কোন শব্দবন্ধে গলার খাদ উঠবে, পড়বে, কোরাসের মতো এগিয়ে যাবে, কোথায় গিয়ে
থামতে হবে, আর কোথায় গিয়ে একটুও থামবে না সেইসব গোপন স্বর
প্রক্ষেপণের কারিগরী শিখিয়ে দিয়েছে যে টুকনুকে, না সে কোথাও নেই। সেই মুখভর্তি
কোঁকড়ানো দাড়ি, মন ভালো করে দেওয়া হাসি। মন থেকে না মোছা মণির
মামদোটা কই? যে টুকনুকে এক মুহূর্তের জন্য ছেড়ে যায় না। অনেক
দূরে থেকেও যার ছায়া, প্রচ্ছায়া অনুভব করে সে।
মুহূর্তের
সময় মুহূর্তেই কেটে যায়।
সামনের
দর্শকের সারি থেকে গুঞ্জন ওঠে “ভুলে গিয়েছে রে টুকনু...কবিতা ভুলে
গিয়েছে”। উইংসের আড়ালে দাদা একটু অস্থির হয়। দূরে দেখতে
পাই হাঁদা চায়ের দোকানের বাইরে এসে দাঁড়িয়েছে। হয়তো মণি, ঠাম্মা, মা সবাই বাড়ির জানলায় এতোক্ষণ। বাড়ির পেছনের
লাইটপোস্টে বাঁধা মাইকে আমার নাম শোনা মাত্র সবাই ছুটে এসেছে। মনে মনে দুষ্টু
নকশালটা কি করছে ভাবার চেষ্টা করলো টুকনু। হয়তো ওর খুব হিংসে হয়েছে। টুকনু কবিতা
বলছে দেখে, আজ বিকেলের পর থেকে একটুও উঠোনে নামেনি সে। এক
সপ্তাহ ধরে কবিতা আবৃত্তি শুনেছে পাঁচিলের ওপর বসে বসে। গলা ফুলিয়ে যেই বকম বকম
করতে এসেছে ঠিক তখনি টুকনু ওর দিকে তাকিয়ে গড় গড় করে বলে দিয়েছে কবিতাটা। কী বলেছে? ...একি ভুলে যাচ্ছে নাকি টুকনু সত্যি সত্যি কবিতার প্রথম লাইনটা? ইশ, এক্ষনি সবাই হাসতে শুরু করবে হয়তো। এই যে এতবার সে প্র্যাক্টিস করলো। এই
যে এতোবার সে বিজয় কাকুর জামরুল গাছকে শোনালো। জুটমিলের রামদেওকে শোনালো। জমাদার বৌ
প্যায়ারীকে শোনালো। গঙ্গায় পয়সা কুড়োতে কুড়োতে ঠুলি শুনলো। বুড়ির মার পোয়াতি
গোরুটা শুনলো। আর এখন? এতো লোকের মাঝে সে প্রথম লাইনটাই ভুলে গেল? হাত-পা ঠান্ডা হয়ে আসে টুকনুর। জিভের ওপর, মুখের ভেতর ভিড় করে আসে থুথুর স্রোত।
ঢোক গিলতে গেলে কোথাও গলার কাছে ব্যাথা করে। হিসি পায়। ছোট্ট দুটো চোখ তন্ন তন্ন
করে একজনকে খোঁজে। নাহ, সেই লোকটা কোথাও নেই। কোত্থাও না। যে বলেছিল আসলেই আমরা
কিছু ভুলে যাই না টুকনু। আমাদের সব কিছু ভুলিয়ে দেওয়া হয়। কে ভুলিয়ে দিল টুকনুকে? ওই পাজি হতচ্ছাড়া নকশালটা? একদিন যদি না তোর ওই মোরগের মতো
অবস্থা হয় তাহলে আমার নাম...। থেমে যায় টুকনুর ভাবনাটা। মোরগ...ঠিক...মনে পড়ে
গেছে...মোরগ...। আরে এই তো কবিতাটা মনে পড়ে গেছে। নমস্কার। কিশোর কবি সুকান্ত
ভট্টাচার্যের লেখা। একটি মোরগের কাহিনী...।
“একটি মোরগ হঠাৎ আশ্রয় পেয়ে গেল
বিরাট
প্রাসাদের ছোট্ট এক কোণে
ভাঙা
প্যাকিং বাক্সের গাদায়
আরো
দু-তিনটি মুরগীর সঙ্গে।
আশ্রয় যদিও
মিললো,
উপযুক্ত
আহার মিললো না।”
বাঁধ ভাঙা
হাততালির মধ্যে গড়গড় করে বলে চললো টুকনু কবিতাটা। একবারও না থেমে, এতোটুকু না আটকে। একবারও আর না ভুলে গিয়ে। সবটা। কিন্তু টুকনুর এতে তো আনন্দ
হবার কথা। ওই তো ডায়াসে উঠে দাদা এসে তাকে নামিয়ে নিয়ে যাচ্ছে কোলে করে। সবাই
সাবাশ সাবাশ করছে। তবুও টুকনুর চোখে জল কেন? একি কাঁদছে টুকনু? নাকি এটাও তার একটা বদমাইশি?
“মন খারাপ তোমার টুকনু?” ঠাম্মা ল্যাম্ফোর আলো জ্বেলে সামনে ধরেন। “বুঝতাছি গোরার জন্য তোমার মন খারাপ।
ওরে আমি কেমন বকুম একবার দেখিস তুই”। ঠাম্মা গোরা নকশালকে বকেছিল কিনা
টুকনুর মনে পড়ে না। সে জানে তার ঠাম্মা মিথ্যে কথা বলছে। এই বাড়িতে গোরা নকশালের
নামে কেউ খারাপ কথা বলে না। কেউ তাকে বকে না। সবাই তার সামনে আস্তে আস্তে কথা বলে।
গঙ্গার ধারে চিলে কোঠার বই ভর্তি ঘরে কত মানুষ আসে, কত আলোচনা হয়, কত লোক কত অভিযোগ জানায়, গোরা নকশাল চুপ করে শোনে। আর দরজার
পাশে লুকিয়ে থাকা টুকনুকে দেখতে পেলে দাড়ি ভর্তি মুখে হাসির জোয়ার ওঠে। হঠাৎ মাঝে
মাঝে কাশির দমক বাড়লে গোরা নকশাল কোথায় যেন চলে যায়। বাড়ির কেউ কিছু জানে না। “লোকটা অনেক
কিছু লুকোয়। অনেক কিছু...।” একদিন বাবা, মাকে বলছিল
কথাগুলো। মটকা মেরে ঘুমের ভান করে পড়ে থেকে সব শুনে নিয়েছে টুকনু। শুনে নিয়েছে এক
উদ্বাস্তুর লড়াইয়ের কিছু টুকরো অংশ। আর লুকিয়ে লুকিয়ে দেখেছে কাশির দমকে মুখ দিয়ে
রক্ত উঠেছে গোরা নকশালের। হাতের সাদা রুমাল লাল হয়ে যাচ্ছে। ভয় পেয়েছে টুকনু।
কাউকে বলেনি সে কথা কোনোদিন। তারপরে অনেক পরে... অনেক অনেক পরে...। যাদবপুরে যখন
সে ফিল্ম নিয়ে পড়তে গেছে, তখন সাদা পর্দায় দেখেছে কাশির দমকে
মুখ দিয়ে রক্ত ওঠা একটা মেয়েকে। ঘাড় কাত করে মেয়েটা চেয়ে থেকেছে তার বাড়ির লোকের
দিকে। কেউ তাকে পাত্তা দেয়নি। তারপর একদিন সবার অলক্ষ্যে মরে গেছে সে। মনখারাপ হয়ে
যায় টুকনুর। অনেক রাতে সে ফিরে আসে ভাঙাচোরা বাড়িটার কাছে আরো ভাঙা চোরা চিলে
কোঠার ঘরে। দেওয়ালে ফিকে হয়ে আসা চে’র ছবির নীচে ভাঙা ফ্রেমের চশমা পড়া
অমলিন হাসির লোকটাকে জিজ্ঞেস করে “তোমার শরীর এখন কেমন? গোরা নকশাল মুখ তুলে তাকায়। আর অমলিন হাসিতে ভরে যায় তার মুখ। আরে সামনে আয়।
দেখি দেখি...যাদবপুরে গিয়ে আমার টুকনু আমার চে’র মতো দাড়ি রাখছে নাকি? লজ্জা পেয়ে
যাই আমি। জানতে এসেছিলাম তুমি ওষুধ গুলো ঠিক করে খাচ্ছো? গোরা নকশাল হাতের বইটা
ভাঁজ করে রেখে পাশে বসায় তার বড় হয়ে যাওয়া টুকনুকে। “এই বইটা
পড়েছিস?” টুকনু হাতে নেয় বইটা। ‘চিলিতে
গোপনে’? কই না তো? গাব্রিয়েল গার্সিয়া মার্কেজ? অনুবাদ করেছেন
বুদ্ধদেব ভট্টাচার্য? তুমি এখন এই বই কেন পড়ছো গোরা নকশাল? কিছু বলে
না লোকটা। টুকনুর নীল রঙের কাপড়ের ঝোলার
মধ্যে ঢুকিয়ে দেয় বইটা। তারপর সেই উজ্জ্বল দৃষ্টি নিয়ে টুকনুর দিকে তাকিয়ে বলে “শুনলাম
টুকনু ফিল্ম নিয়ে পড়ছে। তাই মনে হল আমিও একটু পড়াশুনো করি। এই যে লোকটাকে নিয়ে
লেখা...সেই মিগুয়েল লিতিন তো কলকাতায় এসেছিলেন। শুনতে গিয়েছিলাম তার কথা।” আমাকে অবাক
করে দিয়ে হোহো করে হেসে ওঠে লোকটা। তরঙ্গায়িত হাসির ধারা ছড়িয়ে পড়ে আশেপাশে। ভাঙা
বাড়ির শরিকী ঝামেলা ঝঞ্ঝাটের কড়িতে বড়্গায়। ফাঁকে ফোঁকড়ে। রাতের গঙ্গায় জেলেদের
ছোট ছোট ডিঙি আর ছোট ছোট ডিঙিতে টিপ টিপ হ্যারিকেনের আলোয়। জানলা থেকে মুখ সরিয়ে
বলি, কিন্তু যেটা বলতে চাইছিলাম সেটা তোমাকে বলা হলো না যে। এখন তো রিলিফ ক্যাম্প
নেই। এখন তো স্বাস্থ্যকেন্দ্র। যাদবপুরের কাছে...মানে আমার ইউনিভার্সিটির পাশেই
একটা ভালো হসপিটাল আছে। চলো একবার...। ডাক্তার কাকিমা বলেছে তিনমাস অন্তর একটা
এক্সরে করতে হবে। দাদা কিন্তু নিয়মিত চিঠি লিখছে আর ধমকাচ্ছে। গোরা নকশাল আমার
দিকে মিটিমিটি চায় আর হাসে। এখন রোজ অঙ্ক করতে পারছে না তো তাই রোজ চিঠি লিখছে।
পারা যায় না তোমার সাথে। বেরিয়ে আসি আমি। ভেতর থেকে ভেসে আসে সেই চেনা স্বর, যাওয়ার
সময় দরজাটা বন্ধ করে দিয়ে যাস টুকনু। বাল্বের এই হালকা সিপিয়া আলোটা এখন অনেক রাত
পর্যন্ত থাকবে এইঘরের চারপাশ জুড়ে। গঙ্গার জলের ওপর ছায়া ফেলবে। মাঝিরা জানে লোকটা
ঘুমোবে না প্রায় সারা রাত। লোকটা জেগে থাকবে। কী করে সারা রাত ধরে গোরা নকশাল? কেউ জানে না। দিনবদলের স্বপ্ন দেখা চোখে ঘুম নামে না আর। ঘুমের ওষুধ খেতে চায়
না লোকটা। পাছে যদি সত্যি সত্যি দিন বদলটা সে না দেখেই ঘুমিয়ে পড়ে!
কিন্তু আজ
এতো ঘুম এলো কোথা থেকে? সকালের নরম রোদ এসে পড়েছে ১৩৮ নম্বর বেডের
পেশেন্টের গায়ে। আজ এই মুহুর্তে গোরা নকশালের চোখ বন্ধ। পাশে পড়ে আছে অর্ধ সমাপ্ত
স্যালাইনের বোতল। একটা অক্সিজেনের সিলিন্ডার। গায়ে ওপর ছড়ানো আছে লাল রঙের কম্বল।
টুকনু দাঁড়িয়ে থাকে মাথার কাছে। ডাক্তার ফিসফিস করে বলে যায় চার ঘন্টার আগে কিন্তু
বডি ছাড়া হবে না। একে একে রোগীরা এসে
দাঁড়ায়। দাদা কাদের যেন ফোন করে চলেছে অনবরত। কারা যেন সিঁড়ি দিয়ে উঠে আসছে একে
একে। কারা যেন ফিস ফিস করে একটা কবিতা বলছে... “একটা মোরগ ঘাড় উঁচু করে স্বপ্ন দেখে
প্রাসাদের ভিতর রাশি রাশি খাবার...”। কেউ যেন বলে উঠছে... “টুকনু ভুলে
যেও না ওরা তোমার সুশান্তকে মেরেছিল...। ওরা আমাদের শিক্ষার অধিকার
দেয়নি...স্বাস্থ্যের অধিকার দেয়নি...ওরা আমাদের দুবেলার খাবার নিশ্চয়তা দেয়নি। ওরা
আমাদের দিন বদলটা আটকে দিয়েছে। ওরা আমাদের শুধু জেলের মধ্যেই মারেনি ওরা আমাদের
জ্যান্ত লাশ করে দিয়েছে।’’
সোনালী রোদে
ওই যে ডানা ঝাপটিয়ে উড়ে বেড়াচ্ছে পাখিটা ওটা কি হাঁদার নকশাল? আমি ঠিক জানতাম, যারা উড়তে পারে তাদের নকশাল বলে। নকশাল আসলে পায়রাদের টাইটেল। কিন্তু নকশালের
হ্নন্তারক কি আমিও ছিলাম না? আমিও কি দীর্ঘ দিন অপেক্ষা করিনি
সত্যিই হাঁদার বদমাইশ নকশালটাকে কবে ও বাড়ির হুলোটা এসে নিয়ে যাবে। আর যেদিন সত্যি
ও বাড়ির হুলোটা এসে ঘাড় মটকে রক্তের বিন্দু বিন্দু ছিটে ফেলতে ফেলতে নিয়ে গেলো
নকশালকে তখন আমি বাধা দিই নি কেন? কারণ টুকনু বড় ভয় পেয়েছিল তার একমাত্র বন্ধুর
মৃত্যুতে। তার ভয়টা কেউ বিশ্বাস করতে পারেনি। কবেকার হারিয়ে যাওয়া ঠুলিও কি সেদিন
টুকনুর দিকে তাকিয়ে বলেনি...কি নিষ্ঠুর তুই টুকনু...? আমি কেঁদেছি...আমি হাতড়িয়েছি কিন্তু কোথাও খুঁজে পাইনি আর নকশালকে। আমার ফেলে
আসা শৈশবকে। আজ যেখানে দাঁড়িয়ে সেটাও তো একটা মৃত স্বপ্ন। কিন্তু সত্যিই কি তাই? তাহলে না জানা, না চেনা লোকগুলো ভিড় করে এসেছে কেন বার্নিং ঘাটে?
যার মুখাগ্নি হবে না। যার আত্মার আত্মীয় বলে কেউ নেই। যার গঙ্গার ধারের চিলে কোঠা
চলে যাবে কয়েকদিনের মধ্যে কোনো এক বড় প্রোমোটারের কাছে। যেখানে অনেক উঁচুতে থাকার
লোভ নিয়ে অনেক টাকার ই এম আই এর কিস্তি জুগিয়ে যাবে আরো কিছু মানুষ। যাদের চোখে
কোথাও কোনদিন দিন বদলের স্বপ্ন থাকবে না। একটা মৃত স্বপ্নের ওপর কি দাঁড়িয়ে থাকবে
একটা মৃত গাছ? তাহলে এই সময় কি মিথ্যে? এই আখ্যান মিথ্যে?
হয়তো না।
কারণ যে
জনপদের গল্প বলতে বসেছিল টুকনু সেই জনপদ মিথ্যে হতে পারে না। ওই তো বিউগল বেজে
উঠছে। ধামসা বেজে উঠছে দ্রিমি দ্রিমি দুম দুম। ওই তো মেথর পাড়া থেকে এসেছে রামদহীন, জেলে পাড়া থেকে এসেছে লঙ্কেশ...ওই তো বন্ধ হয়ে যাওয়া জুটমিলের শ্রমিকরা। ওই তো
লাল শালু ঢেকে দিচ্ছে ওরা। ওই তো ওরা গেয়ে উঠছে... “হাম ভুখ সে মরনেবালো ইয়া মত সে
ডরনেবালো আজাদিকা ঝান্ডা উঠাও...”। ওই তো ভেঙে পড়ছে চিলে কোঠার ঘরটা।
চে’র মুখের ছবি চূর্ণ বিচূর্ণ হচ্ছে। ওই তো খুলে যাচ্ছে চুল্লির স্বয়ংক্রিয় দরজা ইলেকট্রনিক আগুনের রক্তাভ বিকিরণের মাঝে ঢুকে পড়ছে একটা স্বপ্ন। যে স্বপ্নের
মৃত্যু নেই...। যে স্বপ্ন সংক্রমিত হচ্ছে জ্বলন্ত এক দেহ থেকে সমষ্টির দেহে। কমরেড
গোরা জ্বলছে। পুড়ে যাচ্ছে অস্থি...। যদিও এই মুহূর্তে সেই আলোকিত শবাধারের মধ্যে
নেই কোনো নতুন ভোরের সঙ্কেত। আছে শুধু এগিয়ে চলার আহ্বান। (সমাপ্ত)
ঋণ- সেই সব
গোরা, যারা ঘরে ফিরতে চেয়েছিল কিন্তু ঘরে ফিরতে পারেনি। আর সেই সময় যা আমাকে প্রতিনিয়ত তাড়া করে বেড়ায়।
কৃতজ্ঞতা-
সেইসব বন্ধুরা যারা আমাকে প্রতিনয়ত লেখার প্রেরণা জোগায়।
গল্পপাঠ। গুরুচন্ডালী।
ব্লগস্পট। গুগুল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন