আমের আমি আমের তুমি
“এমন সময় তাহার দিদি দুর্গা উঠানের
কাঁঠাল তলা হইতে ডাকিল-অপু-ও অপু। সে এতক্ষণ বাড়ি ছিল না, কোথা হইতে এইমাত্র আসিল।
তাহার স্বর একটু সতর্কতামিশ্রিত। মানুষের গলার আওয়াজ পাইয়া অপু কলের পতুলের মতো
লক্ষ্মীর চুপড়ির কড়িগুলি তাড়াতাড়ি লুকাইয়া ফেলিল। পরে বলিল-কি রে দিদি? দুর্গা হাত
নাড়াইয়া ডাকিল-আয় এদিকে-শোন-। দুর্গার বয়স দশ এগারো বৎসর হইল। গড়ন পাতলা পাতলা, রং
অপুর মতো অতটা ফরসা নয়, চাপা। হাতে কাচের চুড়ি, পরনে ময়লা কাপড়, মাথার চুল
রুক্ষ-বাতাসে উড়িতেছে, মুখের গড়ন মন্দ নয়, অপুর মতো চোখ গুলি বেশ ডাগর ডাগর। অপু
রোয়াক হইতে নামিয়া কাছে গেল, বলিল,-কি রে? দুর্গার হাতে একটা নারিকেলের মালা। সেটা
সে নীচু করিয়া দেখাইল, কতকগুলি কচি আম কাটা। সুর নিচু করিয়া বলিল-মা ঘাট থেকে
আসেনি তো? অপু ঘাড় নাড়িয়া বলিল-উঁহু। দুর্গা চুপি চুপি বলিল-একটু তেল আর একটু নুন
নিয়ে আসতে পারিস? আমের কুশি জারাবো। অপু আহ্লাদের সহিত বলিয়া উঠিল-কোথায় পেলি রে
দিদি? দুর্গা বলিল-পটলিদের বাগানে সিঁদুরকোটোর তলায় পড়ে ছিল-আন দিকি একটু নুন আর
তেল? অপু দিদির দিকে চাহিয়া বলিল-তেলের ভাড় ছুঁলে মা মারবে যে? আমার কাপড় যে বাসি?...
তুই যা না শিগগির করে, মার আসতে এখন ঢের দেরী...। অপু বলিল নারকেল মালাটা আমাকে
দে। ওতে ঢেলে নিয়ে আসবো-তুই খিড়কির দোরে গিয়ে দেখ মা আসচে কিনা। দুর্গা নিন্মস্বরে
বলিল-তেল টেল যেন মেঝেতে ঢালিস নে, সাবধানে নিবি, নইলে মা টের পেয়ে যাবে-তুই তো
একটা হাবা ছেলে। অপু বাড়ির মধ্য হইতে বাহির হইয়া আসিলে দুর্গা তাহার হাত হইতে মালা
লইয়া বেশ করিয়া মাখিল,-বলিল নে হাত পাত। তুই অতগুলো খাবি দিদি? অতগুলো বুঝি হলো?
এই তো-ভারি বেশ-যা, আচ্ছা নে আর দুখানা-বাঃ দেখতে বেশ হয়েছে রে, একটা লঙ্কা আনতে
পারিস? আর একখানা দেবো তাহলে...” [পথের পাঁচালী/বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়]
একজন লেখক তাঁর জীবনের প্রথম উপন্যাস
লিখতে বসে একটা ফলকে ঘিরে দুই শিশু মনের যে আনন্দ ছড়িয়ে দিয়েছিলেন তা ওপরের ওই
কয়েকটা লাইন পড়লেই বোঝা যায়। ফলটি হল আম। আমাদের কাছে ফলের রাজা। শুধু তাই নয়
গেরস্থের বড় প্রিয় একটা গাছ। বাড়িতে এক ফালি জমি থাকলে সেখানে একটা আমের কলম
বসাবেন না এটা এই সেদিন পর্যন্ত কেউ ভাবতে পারতেন না। আম বরাবরই বাড়ির খুব আপনজন
হয়ে থেকেছে। এমনই আপনজন যে তার জাত কুল চরিত্রের বিচার করে বা কখনও না করে বাড়ির
লোকেরাই তার ডাক নাম দিয়েছে। তাই দুর্গা পটলিদের বাগান থেকে যে আমের গুটি নিয়ে আসে
তার নাম সিঁদুরকোটো। হয়তো সবুজের ওপর লালের ছোপ ছোপ রঙ দেখে বাড়ির লোক খুব আদর করে
নাম রেখেছিল। ছোট্ট থেকে আমার আম চেনাটা কিন্তু ঠিক এমন করেই। নানা রকমের সব নাম
দিয়ে। মামার বাড়ি ছিল এখনকার উত্তর চব্বিশ পরগণার আড়বেলিয়া গ্রামে। বাবার বাড়ি ছিল
সেই কবেকার অবিভক্ত ভারতের খুলনার কোলাপোতা গ্রামে। খুলনা আমি দেখি নি। কলাপোতাও
নয়। কিন্তু গল্প শুনেছি অনেক। পুকুর পাড়ের কাঁচা মিঠে গাছটার আম পড়ার গল্প আমার
পিসিমণি তার ছানি না কাটা চোখে দুপুরে কাসুন্দি রোদে পাহাড়া দিতে গিয়ে শোনাতো।
গাছের তলায় একটা পাতাও নাকি পড়ে থাকার জো ছিল না। পরিষ্কার নিকানো সেই গাছের নীচে
কি করে টুপটুপ করে কাঁচা মিঠে আমগুলো পড়তো আমি যেন মনির গল্পে মানসচক্ষে দেখতে
পেতাম। দু-কামরার আমাদের বাসায় তখন কিন্তু খাটের তলায় বোঝাই করা আমের পাহাড়। পাকা
আমারে গন্ধে বাড়ি যখন ম ম করছে। আমাদের হুলো কেলোটা সেই গন্ধে বিরক্ত। অথচ রাস্তায়
দাঁড়িয়ে প্রায় গর্জন করছে সবার কাছ থেকে এটা ওটা চেয়ে খাওয়া ভোলা ষাড়। তাকেও দিতে
হবে বসিরহাটের আম। আমার মনি খুব যত্ন করে আম খাওয়াতো ভোলাকে। তারপর এক বালতি জল।
বিড়বিড় করে বলতো দেখতিস আমাদের কলাপোতার কাঁচামিঠে পাকলে। তখন কোথায় যেত বসিরহাটের
আম? অনেক বড় হয়ে বুঝেছিলাম মনির কষ্ট হতো যেখানে তার ছোট ভাইয়ের শশুড় বাড়ি থেকে
আসছে গুচ্ছের আম। সেই আম নিয়ে আমার মা আনন্দে আটখানা। তখন মনির কোথাও মন পড়ে থাকতো
একটা এঁদো পুকুরের ধারে নিজের হাতে বসানো একটা গাছের কথা। যে মানুষ গুলো গরমের ওম
নিতো আম কাঁঠালের ছায়ায় তারা দশ ফুট বাই দশ ফুটের পলেস্তারা খসা দেওয়ালে কী করে যে
নিশ্বাস নিয়েছিল ভাবলে এখনও অবাক লাগে।
তবে আমার অতোসব দিকে খেয়াল থাকতো না।
গরমের ছুটিতে তখন আমি মামার বাড়ি। বিশাল বড় বাড়ি। একা দিদা। তার ছোট্ট ডানপিটে
নাতি। আর কি চাই গল্পের প্লট? মামার বাড়িতে অনেক গুলো গাছের নাম দিয়েছিল আমার
মায়ের ঠাকুমা। যেমন খানার ধারের ল্যাঙড়া ছিল বেশ টক। উঠোনের মৌটুসি ছিল এক্কেবারে
মধুর মতো মিষ্টি। চুষে চুষে খেতে হতো। আমি সারা দুপুর সেই গাছের ডালে উঠে বসে
থাকতাম। আমার ছোট মাসি মৌটুসি মাত্র ছয় বছর বয়সে এক দুরারোগ্য অসুখে ভুগে মারা
গিয়েছিল। তার নামে মায়ের ঠাম্মার উঠোনের গাছের ওই নামকরণ। কালের নিয়মে সেই গাছ
এখনও আছে। মৌটুসি আমের বোল ঝড়ায়। গুটি আসে। কাঁচা আম টুপ টুপ করে ঝড়ে ঝরে পড়ে।
পাকা আম রাঙা হয়ে মনে করায় কোন এক কালে এই বাড়িতে মৌটুসি বলে কেউ ছিল। ঠিক তেমনি
ছিল পুকুর পাড়ের ভুতোর ল্যাঙড়া। রায় বাড়ির ভুতো রথের মেলা থেকে একটা ল্যাঙড়া আমের
চারা নিয়ে এসে পুকুর পাড়ে বসায়। তারপর বেশ কয়েকবছর কেটে গেলেও সেই গাছে কিছুতেই
মুকুল আসে না। এদিকে ভুতোর ঠোটের ওপর কালো রেখা উঠতে শুরু করেছে। লোকজন খেপিয়েছে
গোফ হয়েছে তার। ভুতো উচ্চ মাধ্যমিক দিয়ে ফেলেছে। ভুতো কলেজে পড়তে ছুটলো। কিন্তু
পুকুর পাড়ে ল্যাঙড়া গাছে মুকুল এলো না। এবার একদিন ভুতো মিলিটারির চাকরী পেয়ে চলে
গেল কোন এক দূরের রাজ্যে। তার ঠিক কয়েকমাস পরে ঘন কুয়াশা মোড়া সকালে গ্রামের সব
চেয়ে বিচ্চু ছেলেটা যখন কফিনে করে ফিরে এলো তখন সবাই অবাক হয়ে দেখলো মাঘের শীত
গায়ে মেখে ল্যাঙড়া গাছে মুকুল এসেছে। সারা গাছ ছেয়ে আছে ফুলে। গ্রামের লোক তাদের
ছেলের নামে রাখলো ভুতোর ল্যাঙড়া। সেই কবেকার ভুতো অমর হয়ে থাকলো একটা গাছের
ডালপালায় তার ফলে, ফুলে।
আসলে একটা গাছ আর একটা ফল তো শুধু
তার খাওয়া বা স্বাদের মধ্যে আটকে থাকে না। সে তার নিজস্ব গল্প...চারপাশ সব কিছু
নিয়ে ব্যাগ বন্দী হয় আমাদের। আমরা যদি একটু জেনে নিতে পারি কৌশলে তাহলে যখন সেটা
খাই বা পাতে সাজিয়ে দিই তাতে আনন্দ বাড়ে বই কমে না। এই বিষয়ে শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায়
তাঁর ‘বাজার সফর সমগ্র’তে বারবার বলেছেন যে সবজী, মাছ, ফল কিনছি তার সম্পর্কে কি
অবহিত আছেন ক্রেতা? যদি না থাকেন তাহলে তিনি রান্না করার সময় সেই উপত্যকতাটা
দেখবেন কী করে? কিম্বা নদীর মাছটাকে? কিম্বা সেই জনপদকে যারা আমাদের মুখের কাছে
খুব যত্ন করে সাজিয়ে দিচ্ছে এইসব কিছু। বিশ্বাস করুন, তিন দিব্যি দিয়ে বলছি এইসব
জেনে খেতে বসলে তার মজাটাই একটা অন্যরকম হবে। তখন হয়তো আপনি আমাকে চিঠি লিখতে
বসবেন। কিম্বা নতুন করে প্রেমে পড়ার সংকল্প নেবেন।
যাক সে কথা। আমের বৈজ্ঞানিক নাম কি,
তা কোথায় কোথায় পাওয়া যায়, কত রমকমের আম আছে, দেশের কোথায় কোথায় কখন তা হয়...এইসব
কিছু আপনি এক্ষুনি আপনার স্মার্ট ফোন খুললেই পেয়ে যাবেন। বিশাল বিশাল লেখা আছে আম
নিয়ে। ভার্চুয়াল জগতে ঘুরে বেড়াচ্ছে তার উপকারিতা বিষয়ক অনেক অনেক কথা। খুব বেশী
খেলে তার অপকারিতার কথাও। কিন্তু কোথাও তেমন ভাবে লেখা নেই কেমন করে আম আমাদের এই
নাতিশীতোষ্ণ জলবায়ুর শুধু ফল হিসেবে থেকে গেলো না। তা আমাদের ঘরের মধ্যে সেঁধিয়ে
গেল। ছোট ছোট মাছের ছাঁচে, পদ্মপাতার কল্কায়, পাথরের থালায় পাকা আমের রস শুকনো হতে
থাকলো। কোন দিদা, কোন ঠাম্মা, কোন পিসি অপেক্ষা করে থাকলো কখন তারা বাড়ির সবচেয়ে
ছোট আর সবচেয়ে বড়দের হাতে তুলে দেবে আমসত্ত্ব। বিয়ের পিড়িতে, সত্যনারায়ণের সিন্নিতে,
লক্ষ্মী পুজোয় যে আলপনা দেওয়া হল নক্সায় ধরা পড়লো সেই আমের আদল। ঘটে দেওয়া হল আম
পল্লব। সরস্বতী পুজোর সময় যেমন মা সরস্বতীর দোয়াতে খাগের কলম, যবের শীষ দেওয়া হয়
তেমনই মায়ের পুজোতে ব্যবহার হয় আমের মুকুল মানে আমের ফুল। ঠিক তেমনি যারা নদীর
কাছাকাছি থাকেন। অথবা গ্রামের বাড়িতে বড় পুকুরের ধারে তারা নিশ্চই লক্ষ্য করেছেন
আম বারুনী বলে একটা ব্রত বাড়ির মা ঠাকুমা দিদিমারা খুব নিষ্ঠার সাথে পালন করে
থাকেন। বছরের প্রথম আমটা খাওয়ার আগে তাঁরা নদীকে জলকে সেই ফল উৎসর্গ করে থাকেন
পরিবারের কল্যান কামনায়। কোথাও মানুষের শুভ আকাঙ্খার সাথে জড়িয়ে গেল আম আজীবন।
শুধু আম কি খাওয়া, শুভ আর পূণ্যের
প্রতীক? না শুধু তাই নয়। বাংলার শেষ স্বাধীন নবাব সিরাজদৌল্লার পরাজয় ঘটেছিল
পলাশীর এক বিশাল আম বাগানের মধ্যে। যে বিশ্বাসঘাতকতার দীর্ঘ নিশ্বাস সেই মুহূর্তে
ছড়িয়ে ছিল আজও কি তা পলাশী বহন করছে না? মাত্র কয়েকবছর আগে একবার ঘুরতে গিয়েছিলাম
পলাশীতে। এক স্মৃতি সৌধ নির্মাণ করা আছে। লেখা আছে ইতিহাসের সেই ব্যাখ্যান। আর তার
চার পাশে একটু দূরে দাঁড়িয়ে আছে কত প্রাচীন সব আম গাছ। সেই গাছের গুড়ি, সেই গাছের
মধ্যে আরও নানা অর্কিডের বাসস্থান লক্ষ্য করলে বোঝা যায় গাছ গুলো কত পুরনো। একটু
এগিয়ে গিয়ে ওদের গায়ে হাত দিন। কোন প্রাচীন যুগের কথা যে ওরা শোনাবে তার হয়তো
হিসেব নিকেশ করা যাবে না। এবার হয়তো ভাবতে শুরু করেছেন এই লেখক নির্ঘাত পাগোল।
গাছের সাথে কথা? সেও কি সম্ভব? না হলে মাত্র এই তো একশো বছরেরও ঘটনা নয়
জগদীশচন্দ্র বসু এই বাংলার ছেলে হয়ে কী করে আবিষ্কার করলেন গাছেরও প্রাণ আছে? উত্তেজনায়
তারাও সাড়া দেয়। কি সাড়া দিয়েছিল সেই আম গাছ গুলো যেদিন বিশ্বাসভঙ্গের যুদ্ধে হেরে
গিয়েছিলেন সিরাজ? জানা যায় না। কিন্তু আজও গঙ্গা পেরিয়ে ওপারে আম বাগানের মধ্যে
শায়িত অসংখ্য কবর...অসংখ্য ঐতিহাসিক চরিত্র যারা মাটির নীচে শুয়ে আছে তাদের ওপরে
ছায়া দিয়ে যায় মুর্শিদাবাদের বিখ্যাত আম গোলাপখাস। অনেক ছোট বেলায় একজন ধূসর বৃদ্ধ
গাইড সময়ের সেই প্রত্নখননের কবরে দাঁড়িয়ে যেভাবে আমাকে শুনিয়েছিলেন পলাশীর যুদ্ধের
কথা তেমনভাবে আমি কোনদিন কোন বইতে পাইনি লেখা। বাংলা বিহার উড়িষ্যার নবাবের পরাজয়
তো শুধু নয় এতো ভারতের পরাধীনতার সূচনা লগ্নের গল্প। সেদিন কেঁদেছিল আকাশ বাতাস আর
সেই আম গাছ গুলো। তারও অনেক পরে গোলাপখাস খেয়ে দেখেছি। আমার তেমন একটা ভালো
লাগেনি। কোথাও যেন মনে পড়েছে সেই বৃদ্ধ গাইডের গল্প। মনে পড়েছে এক মন কেমনের দুপুর।
এক হেরে যাওয়া যুদ্ধের কথা। রক্তাক্ত প্রান্তর। এদিকে আবার একশো বছর বয়স পেরিয়ে যে
আম গাছটা বেলুড়মঠে দাঁড়িয়ে আছে। যার নীচে স্বামীজী খাটিয়া পেতে শুতেন। বসে থাকতেন।
ভক্তদের সাথে গল্প করতেন। তার কথাও জানা দরকার। হ্যাঁ এইবারেও সেই আম গাছে ফল
ধরেছ। মহারাজরা সেই গাছ খুব যত্ন করে লালন পালন করেন। বুড়ো ডালগুলো যাতে ভেঙে না
পড়ে তারজন্য সিমেন্টের স্তম্ভ করে রাখেন। আমরা সেই গাছের কাছে মাথা নীচু করে
দাঁড়াই। এক সময়ের কাছে দাঁড়ানোর মতো। শ্রদ্ধার মতো।
বুঝতে পারছি। উসখুস করছেন অনেকক্ষণ।
মনে মনে হয়তো বলছেন, থাক অনেক হয়েছে। একেই গরম, তার ওপর এমন মন ভারী করে দেওয়া
গল্প শুনলে এমনিতেই পেট গরম, পিত্ত পড়তে বাধ্য। তাল পাখাটাও এবারে কেনা হয়নি।
আমাদের উত্তরপাড়া বাজারে কেষ্টনগর থেকে যে লোকটি তালপাতার পাখা নিয়ে আসতেন তিনি আসছেন
না বেশ কয়েকমাস। শুধু কি তাই বাজার থেকে যেন ভ্যানিস হয়ে যেতে বসেছে ফলসা, তালশাস,
দেশী খেজুর, তালের বাতাসা, তাল পাটালি প্রায় সব কিছু। ভাবতেই পারেন আমের গুণকীর্তন
করতে বসে হঠাৎ এই গুলোর কথা লিখছি কেন? আসলে এগুলো একে অন্যের পরিপুরক। ফলার
খাওয়ার সময়ে ঠিক টের পাওয়া যায়। আচ্ছা তাহলে একটু বুঝিয়ে বলি। চিড়ে, মুড়কি, দই কলা
এইসব থাকলোই। তার সাথে পছন্দ মতো বেছে নিলেন আম।
আখের গুড়ের বদলে তালের বাতাসা বা পাটালি দিয়ে বেশ জাড়িয়ে নিলেন মিষ্টি।
ওপরে ছড়িয়ে দিলেন ঘন মেঘের রঙের ফলসা। টুপ টুপ করে ফুলের নক্সা তুললো যেন। সাদা
পাথরের থালায় তাল শাসের খোসা ছাড়িয়ে ফ্রিজ থেকে বের করে নিয়ে এলেন অল্প বরফ কুচি।
ভালো করে মিশিয়ে রাখলেন শীতলতার আলিঙ্গন পাবার জন্য। কোন অসুবিধে না থাকলে তার ওপর
ছড়িয়ে দিন কয়েক টুকরো গোলাপ পাঁপড়ি। আর যায় কোথায়? মন যখন এবার খাবো খাবো করছে তখন
খবরদার। পাখা চালাবেন না। এমনকি এসিও না। হাতের সামনে রাখুন একটা সুন্দর দেখতে তালপাতার
পাখা। এবার শুরু করুন হাপুস হুপুস করে ফলার খাওয়া। গ্রীষ্ণের দুপুরে আপনার শরীর
দিয়ে যখন দর দর করে ঘাম ঝড়ছে। মনে করছেন আপনি সেই বাঙালী যে নবজাগরণ এনেছিল, এই
বর্ণপরিচয় তৈরী করলেন বলে...এতোটাও মনের ওপর চাপ না দিয়ে এবার তুলে নিন বাঁ হাত
দিয়ে পাখাটা। হালকা হালকা নাড়ুন। বিশ্বাস করুন এই পৃথিবীর সবচেয়ে সুখী মানুষ মনে
হবে নিজেকে। গঙ্গায় জাহাজ ভাসানোর পরিকল্পনা ঠিক তারপর থেকেই মাথায় চাগাড় দিতে
শুরু করবে। কিম্বা...না থাক।
পাকা আম পাড়াটাও দেখার মতো একটা
অভিজ্ঞতা। একটা আম বাগান বিক্রি হয় সেই বাগানের গুনগত মানের ওপরে নির্ভর করে।
প্রথমে যিনি বাগান কিনবেন তিনি এসে দেখে যান গাছে কেমন মুকুল এসেছে। তিনি হয়তো
অগ্রিম দিয়ে বাগান কিনলেন। আবার এমন অনেকে আছেন যাঁরা প্রায় দু-তিন বছর বাগান কিনে
রাখেন। বা লিজ নিয়ে রাখেন। যিনি ফুল দেখে বাগান কিনলেন তিনি তারপর থেকেই গাছের পরিচর্যা
শুরু করে দেন। ঠিক যেমন এক গর্ভবতী মায়ের দেখাশুনো করে বাড়ির লোকজন। ভালোবাসে। ঠিক
তেমন। তারপর গুটি বেরোলে। আম বড় হলে। পাকতে শুরু করলে। এক এক পর্যায়ের দেখাশুনো এক
এক রকমের। বড় বড় বাগানের সাথে আম প্যাকিং করা এবং নিয়ে যাওয়ার ব্যবস্থা থাকে।
বাগান পাহাড়া দেওয়া থেকে শুরু করে গাছ পরিচর্যা এমনকি প্যাকিং-এর আলাদা আলাদা দক্ষ
শ্রমিক নিযুক্ত থাকেন। এমন যদি কোন এক বড় আম বাগানে গিয়ে আপনি এই গ্রীষ্মের দুপুরে
গিয়ে পড়তে পারেন এবং আপনি যদি আম-রসিক হন তাহলে তারা আপনাকে গাছ পাকা আম পেড়ে
দেখাবে। কী করে লগার আগায় জাল বেঁধে আম পাড়া হয়। কেমন করে তা কাটা হয় হাতের বিশাল
দা দিয়ে সুনিপুণ ভাবে। এবং গাছের ছায়ায় অস্থায়ী মাচায় বসিয়ে তা খাওয়ানো। দুপুর
বেলা ফিরে যেতে চাইলে জোর করে ধরে রেখে পাশের নদীর চুনো মাছ আর বাগানের একটু
দেরীতে আসা কচি পানশে আমের টকডাল না খাইয়ে কিছুতেই ছাড়বে না। এইসব সব কিন্তু আপনার
জীবন খাতার প্রতি পাতায় সোনার অক্ষরে লেখা হয়ে থাকবে। এইসব জায়গায় তখন সত্যি যদি
গিয়ে উঠতে পারেন তখন মনে হবে যেন উৎসব চলছে। সারা দিন, সারা রাত কাজ। পাশের চায়ের
দোকানে ভিড়। নানা জায়গা থেকে আসা লরির মেলা। ড্রাইভারদের গল্প। লগ্নির হিসেব নিকেশ
একটা মাত্র ফল আমকে ঘিরে। নদীয়ার মাঝদিয়া থেকে যখন অধ্যাপক বন্ধু প্রদীপ্ত বাগচীর
তত্ত্বাবধানে এবং ব্যবস্থাপনায় আম পাড়া দেখে বাড়ি ফিরছি তখন প্রাণ হু হু করছে মন
কেমনে অন্যদিকে গাড়ির ডিকিতে আমের বন্যা বলছে চল...ঘরকে চল।
একমাত্র আলু নির্ভরযোগ্য বাঙালীর
খাদ্য তালিকায় আম যেন মলয় প্লাবন। আম দুধ, আমসত্ত্ব, আমের আচার, আমের মোরব্বা,
ম্যাঙ্গো আইসক্রিম, ম্যাঙ্গো সুইটস, আম ভাতে, আম পাতে, আম সর্বস্ব। তাই হয়তো রসনার
বাসনায় কবি যখন বিশ্বকবি হননি তখনও তাঁর সেই প্রথম উচ্চারিত কবিতার খাতায় কোথাও
যেন ঠাঁই পেয়ে গিয়েছিল আম। “আমসত্ত্ব দুধে ফেলি/তাহাতে কদলী দলি/সন্দেশ মাখিয়া
দিয়া তাতে-/হাপুস হুপুস শব্দ/চারিদিক নিস্তব্ধ/পিঁপিড়া কাঁদিয়া যায় পাতে।” এই আমের
আমি...আমের তুমি নিয়েই আমাদের গেরস্থালি। আম আমাদের স্মৃতিতে, আমাদের ইতিহাসে,
আমাদের গল্পে, জীবন প্রবাহের প্রতিটা বাঁকে।
রোজকার অনন্যা জুন, ২০১৮ প্রকাশিত
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন