ছোট্ট রবির সাথে…
ছোট্ট রবির সাথে…
সেদিন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে সাজ সাজ রব। কারো এতটুকু নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। কাজের লোক থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন সবাই তটস্থ...নিয়মের এতটুকু যেন এদিক থেকে ওদিক না হয়। সময়ের কাজ যেন সময়ে হয়...ফাঁকি দেওয়া...পড়ে থাকা কাজ মোটেই পছন্দ নয় মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের। তাই সবকিছু হচ্ছে পরিপাটি নিয়ম অনুযায়ী। আর হবেই বা না কেনো? আজ তো ছোট্ট রবি এই প্রথম বাবার সাথে বাইরে বেরোবে। যাবে অনেক দূর...সেই হিমালয়। সকাল থেকে তাই রবির খুশি আর ধরে না। কোথায় বেঙ্গল একাডেমিতে একঘেয়ে ক্লাস আর কোথায় পাহাড় ঘেরা...সেই অনেক পুরোনো গাছের ছায়ায় রূপকথার পথ। যা এতদিন রবি শুধু গল্পই শুনে এসেছে।
তুমি যেমন বাবার সাথে খুব লাফাই-ঝাঁপাই করো...কথায় কথায় বাবার ওপর রেগে যাও...বায়না করো...ছোট্ট রবির কিন্তু সেসব করার কোনো সুযোগই ছিলো না। বাবাকে সেতো কাছেই পায়নি কোনোদিন। বাবা থাকতেন বেশিরভাগ সময়টাই বাড়ির বাইরে, অনেক দূরে, পাহাড়ের কোলে। বাড়ি যখন ফিরতেন তখন ছোট্ট রবি কখোনো আড়াল থেকে আবার কখোনো বা লুকিয়ে বাবাকে দেখতো। তেতালার বারান্দাতে যেখানটায় অনায়াসে ছোটাছুটি করে খেলা যায়...সেখানেও খেলা বারণ হয়ে যেত রবিদের।
ছোট্ট ছেলে লক্ষ্য করতো বাবা বাড়ি এলে সবাই কেমন যেন নিয়মের আড়ালে চলে যায়। গমগম করে উঠতে থাকে বাড়িটা। এতোদিন যে ছন্নছাড়া...গা ভাসানো ব্যাপার চলতো তা যেন নিমেষে বন্ধ হতো। মা নিজে গিয়ে রান্নার তদারকি করতেন। গুরুজনেরা গায়ে জোব্বা পরে, সংযত পরিচ্ছন্ন হয়ে, মুখে পান থাকলে তা ফেলে দিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে যেতেন। বুড়ো কিনু হরকরা তার তকমাওয়ালা পাগড়ি আর শুভ্র চাপকান পড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখন কি দরকার হয় মহর্ষির...সেই দিকে তার খেয়াল।
সে যাই হোক আজ তো রবির আর একটুও দেরী করতে ইচ্ছে করছে না। কখন সে বাইরে বেরোবে? কখন সে ট্রেনে উঠবে? ট্রেনে উঠলে নাকি মানুষ ছিটকে যায়? এইসব ভাবনা তার মাথায় ভিড় করে আসে। কিন্তু তার এই উতকন্ঠা...আনন্দ সে যেন নিজের মনের মধ্যেই চুপ করে রেখে দেয়। খুব একটা কিছু বলতে পারে না। শুধু সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। সবে পৈতে হয়েছে, ন্যাড়া মাথা নিয়ে কিভাবে স্কুলে যাবে? কয়েকজনকে রবি এই প্রশ্নটা করেছে কিন্তু তেমন কোনো উত্তর পায়নি। কেউ চোখ বড় বড় করে শাসন করেছে আবার কেউ বা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু। আর পৈতের আগেও তো কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়নি, বৈদিক মন্ত্র রীতিমতো মুখস্থ করতে হয়েছে রবিদের। বেচারামবাবু রোজ এসে সেগুলো মুখস্থ করিয়েছেন। তাও নয় সহ্য করা গেছে কিন্তু এখন এই ন্যাড়া মাথা নিয়ে কি করে ফিরিঙ্গি বন্ধুদের মাঝে গিয়ে বসবে তাই ভেবে উঠতে পারে না রবি। এমন সময় একদিন তেতালায় বাবার ঘর থেকে ডাক আসে। খুব ধীর পায়ে রবি গিয়ে দাঁড়ায় শ্বেতশুভ্র পোষাকে আবৃত প্রায় ধ্যানস্থ পিতার সামনে। মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন রবি হিমালয়ে যেতে চায় কিনা।
হ্যাঁ...এই কথাটা যদি সে চিতকার করে বলতে পারতো তাহলে হয়তো সেদিন সে আরো বেশি খুশি হতো। রবির জন্য এই প্রথম পোষাক বানানো হলো। যেমন তেমন নয় মখমলের কাজ করা জরির গোল টুপি, তার সাথে মানানসই জোব্বা আরো কতকিছু। বেরোনোর আগে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বাবা বাড়ির সকলকে নিয়ে দালানে উপাসনায় বসলেন। উপাসনা শেষে বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করে রবি বাবার সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলো। মাঝে মাঝে টুপি খোলার চেষ্টা করেছিলো...কিন্তু বাবার আপত্তিতে তাকে সেটা মাথায় পরে বসে থাকতে হলো। ট্রেনে উঠে রবি একটুও ভয় পেলো না। ছিটকেও পড়লো না। তার হাসি পেলো, ট্রেনে চড়ার সেই আজগুবি গল্পের কথা মনে করে।
দুপাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালি...ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর গ্রাম...। রবি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এর আগে তো মাকে ছেড়ে, বাড়ির দাদাদের ছেড়ে, অনেক দূরে রবি কোথাও যায়নি...কিন্তু একটুও মন কেমন করে না। বরং ভালো লাগে। সন্ধ্যার সময় তারা বোলপুরে নামে।
এর আগে এই বোলপুরের কথা রবি অনেকের কাছে শুনেছে। তার দাদারা, বৌদিরা এমনকি তার খুব কাছের বন্ধু সত্যও ঘুরে গেছে। পালকিতে উঠেই রবি চোখ বন্ধ করে। মনে মনে ভাবে সক্কালবেলা সে চোখ খুলবে...তাহলেই হয়তো সে দেখতে পাবে সেই পথটা যেখানে রোদ বৃষ্টি কিচ্ছুটি গায়ে লাগে না। অন্তত সত্যর লাগে নি। রবি যতক্ষণ চোখ বুঁজে আছে আর পালকিতে করে চলেছে ততক্ষণে চলো আমরা দেখি এই বোলপুরে হঠাত মহর্ষি তার ছেলেকে নিয়ে এলেন কেন।
আসলে এটা তাঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিলো। ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ১৮ ফাল্গুন প্রায় কুড়ি বিঘা জায়গা তিনি কিনে নেন । কিন্তু কেন কিনলেন? শোনা যায় এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার একটা ছাতিম গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। হঠাতই তাঁর মনে এক অনাবিল পবিত্র আনন্দের সঞ্চার হয়। পরম ঈশ্বরে বিশ্বাসী দেবেন্দ্র নাথ এখানে একটি বাড়ি তৈরী করে নাম দেন শান্তিনিকেতন। পরে একটা উপাসনা গৃহ নির্মাণ করেন যেখানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোক এসে নির্জনে উপাসনা করতে পারবেন। মাঝে মাঝেই এখানে আসতেন মহর্ষি। ছোট্ট রবিকেও তিনি নিয়ে এলেন এখানে।
কিন্তু সত্যর গল্পের সাথে কোথাও যেন মিলছে না বোলপুর। কোথায় রাখাল? কোথায় সেই বিস্তৃত ধান ক্ষেত। যেখানে বসে সত্য ধান ক্ষেত থেকে ধান তুলে ভাত রান্না করে রাখালদের সাথে খেতো? রবি বুঝতে পারলো সে গুলো গল্প কথা। আসলে বোলপুর শুকনো জায়গা...সেই লাল পাথুরে মাটিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো লেগে যায় ছোট্ট রবির। সে চারিদিক ঘুরে বেড়ায়...আর কোথায় যেন প্রকৃতির সাথে...বাবার সাথে একটু একটু করে পরিচিত হতে থাকে সে। বাবা এইসময় ছোট্ট রবিকে অনেক অনেক দায়িত্ত্ব দেন। তাঁর সোনার ঘড়িতে দম দেওয়া, নিয়মিত পড়াশুনো করা, ঘুরে বেড়ানো...সবকিছু... সেটা যেন রবির নিজেরই দায়িত্ত্ব।
ভালো লেগে যায় রবির বোলপুর। শান্তিনিকেতন।
কোথাও যেন বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডি নেই। বাবার সাথে প্রকৃতির পাঠ নিতে নিতেই কি রবির মনে হয়েছিলো যে স্কুলের পড়া থেকে এই পড়া অনেক অনেক ভালো। যেখানে গাছ তার নিবিড় ছায়া দিলো, পাখি দিলো সঙ্গ... প্রকৃতি মেলে দিলো তার সবুজ আঁচল। ছোট্ট রবি যেন বিশ্ব দীক্ষায় দিক্ষীত হলো। নতুন করে চিনতে শিখলো সে সব কিছু।
এরপর সে যখন অনেক বড় হলো। লোকে যখন তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে চিনতে শুরু করলো...তার গান শুনে, লেখা পড়ে লোকে যখন তাকে ভালো বাসলো তখন তিনি শান্তিনিকেতনে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সেই বিদ্যালয় একটা সময় তার ডালপালা মেলে অনেক বড় হলো। ১৯২১ সালের ২২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো বিশ্বভারতীর।
রবির ইচ্ছায় প্রকৃতির পাঠশালায় সবাই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলো। শুধু পাঠ্য বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা নয় এখানকার ছেলেমেয়েরা শিখলো গান গাইতে, ছবি আঁকতে, নাচতে, হাতের কাজ করতে।
একদিন কলকাতায় নিজের বাড়ির গন্ডি টপকিয়ে যে ছোট্ট ছেলেটি বাবার হাত ধরে বোলপুরে এসেছিলো...সেই একদিন গোটা বিশ্বের কাছে তাকে পরিচিত করালো। ভারতের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক পিঠস্থান হয়ে উঠলো বিশ্বভারতী।
যদি কখোনো তুমি শান্তিনিকেতনে যাও...গাছের সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটো...দেখবে নানান ফুল তোমাকে ঘিরে ধরছে...অনেক পুরোনো পুরোনো গাছ তোমাকে সেই লাল মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে...যে পথ দিয়ে একদিন ছোট্ট রবি তার বাবার সাথে হেঁটেছিলো।
ইচ্ছামতীর গ্রীষ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
সেদিন জোড়াসাঁকোর ঠাকুর বাড়িতে সাজ সাজ রব। কারো এতটুকু নিশ্বাস ফেলার সময় নেই। কাজের লোক থেকে শুরু করে আত্মীয়-স্বজন সবাই তটস্থ...নিয়মের এতটুকু যেন এদিক থেকে ওদিক না হয়। সময়ের কাজ যেন সময়ে হয়...ফাঁকি দেওয়া...পড়ে থাকা কাজ মোটেই পছন্দ নয় মহর্ষি দেবেন্দ্র নাথ ঠাকুরের। তাই সবকিছু হচ্ছে পরিপাটি নিয়ম অনুযায়ী। আর হবেই বা না কেনো? আজ তো ছোট্ট রবি এই প্রথম বাবার সাথে বাইরে বেরোবে। যাবে অনেক দূর...সেই হিমালয়। সকাল থেকে তাই রবির খুশি আর ধরে না। কোথায় বেঙ্গল একাডেমিতে একঘেয়ে ক্লাস আর কোথায় পাহাড় ঘেরা...সেই অনেক পুরোনো গাছের ছায়ায় রূপকথার পথ। যা এতদিন রবি শুধু গল্পই শুনে এসেছে।
তুমি যেমন বাবার সাথে খুব লাফাই-ঝাঁপাই করো...কথায় কথায় বাবার ওপর রেগে যাও...বায়না করো...ছোট্ট রবির কিন্তু সেসব করার কোনো সুযোগই ছিলো না। বাবাকে সেতো কাছেই পায়নি কোনোদিন। বাবা থাকতেন বেশিরভাগ সময়টাই বাড়ির বাইরে, অনেক দূরে, পাহাড়ের কোলে। বাড়ি যখন ফিরতেন তখন ছোট্ট রবি কখোনো আড়াল থেকে আবার কখোনো বা লুকিয়ে বাবাকে দেখতো। তেতালার বারান্দাতে যেখানটায় অনায়াসে ছোটাছুটি করে খেলা যায়...সেখানেও খেলা বারণ হয়ে যেত রবিদের।
ছোট্ট ছেলে লক্ষ্য করতো বাবা বাড়ি এলে সবাই কেমন যেন নিয়মের আড়ালে চলে যায়। গমগম করে উঠতে থাকে বাড়িটা। এতোদিন যে ছন্নছাড়া...গা ভাসানো ব্যাপার চলতো তা যেন নিমেষে বন্ধ হতো। মা নিজে গিয়ে রান্নার তদারকি করতেন। গুরুজনেরা গায়ে জোব্বা পরে, সংযত পরিচ্ছন্ন হয়ে, মুখে পান থাকলে তা ফেলে দিয়ে বাবার সাথে দেখা করতে যেতেন। বুড়ো কিনু হরকরা তার তকমাওয়ালা পাগড়ি আর শুভ্র চাপকান পড়ে দরজার কাছে দাঁড়িয়ে থাকতো। কখন কি দরকার হয় মহর্ষির...সেই দিকে তার খেয়াল।
সে যাই হোক আজ তো রবির আর একটুও দেরী করতে ইচ্ছে করছে না। কখন সে বাইরে বেরোবে? কখন সে ট্রেনে উঠবে? ট্রেনে উঠলে নাকি মানুষ ছিটকে যায়? এইসব ভাবনা তার মাথায় ভিড় করে আসে। কিন্তু তার এই উতকন্ঠা...আনন্দ সে যেন নিজের মনের মধ্যেই চুপ করে রেখে দেয়। খুব একটা কিছু বলতে পারে না। শুধু সেই দিনটার কথা মনে পড়ে যায়। সবে পৈতে হয়েছে, ন্যাড়া মাথা নিয়ে কিভাবে স্কুলে যাবে? কয়েকজনকে রবি এই প্রশ্নটা করেছে কিন্তু তেমন কোনো উত্তর পায়নি। কেউ চোখ বড় বড় করে শাসন করেছে আবার কেউ বা হেসেই উড়িয়ে দিয়েছে সব কিছু। আর পৈতের আগেও তো কম ঝামেলা সহ্য করতে হয়নি, বৈদিক মন্ত্র রীতিমতো মুখস্থ করতে হয়েছে রবিদের। বেচারামবাবু রোজ এসে সেগুলো মুখস্থ করিয়েছেন। তাও নয় সহ্য করা গেছে কিন্তু এখন এই ন্যাড়া মাথা নিয়ে কি করে ফিরিঙ্গি বন্ধুদের মাঝে গিয়ে বসবে তাই ভেবে উঠতে পারে না রবি। এমন সময় একদিন তেতালায় বাবার ঘর থেকে ডাক আসে। খুব ধীর পায়ে রবি গিয়ে দাঁড়ায় শ্বেতশুভ্র পোষাকে আবৃত প্রায় ধ্যানস্থ পিতার সামনে। মহর্ষি জিজ্ঞাসা করলেন রবি হিমালয়ে যেতে চায় কিনা।
হ্যাঁ...এই কথাটা যদি সে চিতকার করে বলতে পারতো তাহলে হয়তো সেদিন সে আরো বেশি খুশি হতো। রবির জন্য এই প্রথম পোষাক বানানো হলো। যেমন তেমন নয় মখমলের কাজ করা জরির গোল টুপি, তার সাথে মানানসই জোব্বা আরো কতকিছু। বেরোনোর আগে চিরাচরিত প্রথা অনুযায়ী বাবা বাড়ির সকলকে নিয়ে দালানে উপাসনায় বসলেন। উপাসনা শেষে বাড়ির গুরুজনদের প্রণাম করে রবি বাবার সাথে ঘোড়ার গাড়িতে চেপে বসলো। মাঝে মাঝে টুপি খোলার চেষ্টা করেছিলো...কিন্তু বাবার আপত্তিতে তাকে সেটা মাথায় পরে বসে থাকতে হলো। ট্রেনে উঠে রবি একটুও ভয় পেলো না। ছিটকেও পড়লো না। তার হাসি পেলো, ট্রেনে চড়ার সেই আজগুবি গল্পের কথা মনে করে।
দুপাশ দিয়ে পেরিয়ে যাচ্ছে গাছ-গাছালি...ছোট্ট ছোট্ট সুন্দর গ্রাম...। রবি অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকে। এর আগে তো মাকে ছেড়ে, বাড়ির দাদাদের ছেড়ে, অনেক দূরে রবি কোথাও যায়নি...কিন্তু একটুও মন কেমন করে না। বরং ভালো লাগে। সন্ধ্যার সময় তারা বোলপুরে নামে।
এর আগে এই বোলপুরের কথা রবি অনেকের কাছে শুনেছে। তার দাদারা, বৌদিরা এমনকি তার খুব কাছের বন্ধু সত্যও ঘুরে গেছে। পালকিতে উঠেই রবি চোখ বন্ধ করে। মনে মনে ভাবে সক্কালবেলা সে চোখ খুলবে...তাহলেই হয়তো সে দেখতে পাবে সেই পথটা যেখানে রোদ বৃষ্টি কিচ্ছুটি গায়ে লাগে না। অন্তত সত্যর লাগে নি। রবি যতক্ষণ চোখ বুঁজে আছে আর পালকিতে করে চলেছে ততক্ষণে চলো আমরা দেখি এই বোলপুরে হঠাত মহর্ষি তার ছেলেকে নিয়ে এলেন কেন।
আসলে এটা তাঁর খুব প্রিয় জায়গা ছিলো। ১২৬৯ বঙ্গাব্দের ১৮ ফাল্গুন প্রায় কুড়ি বিঘা জায়গা তিনি কিনে নেন । কিন্তু কেন কিনলেন? শোনা যায় এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এখানকার একটা ছাতিম গাছের তলায় বিশ্রাম নিচ্ছিলেন দেবেন্দ্রনাথ। হঠাতই তাঁর মনে এক অনাবিল পবিত্র আনন্দের সঞ্চার হয়। পরম ঈশ্বরে বিশ্বাসী দেবেন্দ্র নাথ এখানে একটি বাড়ি তৈরী করে নাম দেন শান্তিনিকেতন। পরে একটা উপাসনা গৃহ নির্মাণ করেন যেখানে সব ধর্ম ও সম্প্রদায়ের লোক এসে নির্জনে উপাসনা করতে পারবেন। মাঝে মাঝেই এখানে আসতেন মহর্ষি। ছোট্ট রবিকেও তিনি নিয়ে এলেন এখানে।
কিন্তু সত্যর গল্পের সাথে কোথাও যেন মিলছে না বোলপুর। কোথায় রাখাল? কোথায় সেই বিস্তৃত ধান ক্ষেত। যেখানে বসে সত্য ধান ক্ষেত থেকে ধান তুলে ভাত রান্না করে রাখালদের সাথে খেতো? রবি বুঝতে পারলো সে গুলো গল্প কথা। আসলে বোলপুর শুকনো জায়গা...সেই লাল পাথুরে মাটিকে কিছুক্ষণের মধ্যেই ভালো লেগে যায় ছোট্ট রবির। সে চারিদিক ঘুরে বেড়ায়...আর কোথায় যেন প্রকৃতির সাথে...বাবার সাথে একটু একটু করে পরিচিত হতে থাকে সে। বাবা এইসময় ছোট্ট রবিকে অনেক অনেক দায়িত্ত্ব দেন। তাঁর সোনার ঘড়িতে দম দেওয়া, নিয়মিত পড়াশুনো করা, ঘুরে বেড়ানো...সবকিছু... সেটা যেন রবির নিজেরই দায়িত্ত্ব।
ভালো লেগে যায় রবির বোলপুর। শান্তিনিকেতন।
কোথাও যেন বাঁধাধরা নিয়মের গন্ডি নেই। বাবার সাথে প্রকৃতির পাঠ নিতে নিতেই কি রবির মনে হয়েছিলো যে স্কুলের পড়া থেকে এই পড়া অনেক অনেক ভালো। যেখানে গাছ তার নিবিড় ছায়া দিলো, পাখি দিলো সঙ্গ... প্রকৃতি মেলে দিলো তার সবুজ আঁচল। ছোট্ট রবি যেন বিশ্ব দীক্ষায় দিক্ষীত হলো। নতুন করে চিনতে শিখলো সে সব কিছু।
এরপর সে যখন অনেক বড় হলো। লোকে যখন তাকে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলে চিনতে শুরু করলো...তার গান শুনে, লেখা পড়ে লোকে যখন তাকে ভালো বাসলো তখন তিনি শান্তিনিকেতনে একটি বিদ্যালয় স্থাপন করলেন। সেই বিদ্যালয় একটা সময় তার ডালপালা মেলে অনেক বড় হলো। ১৯২১ সালের ২২ ডিসেম্বর আনুষ্ঠানিক ভাবে প্রতিষ্ঠিত হলো বিশ্বভারতীর।
রবির ইচ্ছায় প্রকৃতির পাঠশালায় সবাই শিক্ষা গ্রহণ করতে শুরু করলো। শুধু পাঠ্য বইয়ে মুখ গুঁজে পড়ে থাকা নয় এখানকার ছেলেমেয়েরা শিখলো গান গাইতে, ছবি আঁকতে, নাচতে, হাতের কাজ করতে।
একদিন কলকাতায় নিজের বাড়ির গন্ডি টপকিয়ে যে ছোট্ট ছেলেটি বাবার হাত ধরে বোলপুরে এসেছিলো...সেই একদিন গোটা বিশ্বের কাছে তাকে পরিচিত করালো। ভারতের এক অন্যতম সাংস্কৃতিক পিঠস্থান হয়ে উঠলো বিশ্বভারতী।
যদি কখোনো তুমি শান্তিনিকেতনে যাও...গাছের সারির মধ্যে দিয়ে হাঁটো...দেখবে নানান ফুল তোমাকে ঘিরে ধরছে...অনেক পুরোনো পুরোনো গাছ তোমাকে সেই লাল মাটির রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাওয়ার নিমন্ত্রণ জানাচ্ছে...যে পথ দিয়ে একদিন ছোট্ট রবি তার বাবার সাথে হেঁটেছিলো।
ইচ্ছামতীর গ্রীষ্ম সংখ্যায় প্রকাশিত।
সুন্দর ব্লোগ .. ভালো লাগলো
উত্তরমুছুনhttp://rituondnet.blogspot.com/
@ Rupam , apni amake mail karte paren. amar mail id kallolcine@gmail.com
উত্তরমুছুনdhonnyobad sir, khub bhalo laglo lekhata pore....pronam neben
উত্তরমুছুন