গায়ত্রী সন্ধ্যা
গায়ত্রী সন্ধ্যা
তখন শীতকাল। চারিদিকে কুয়াশায় মোড়া। মাঘের শীতের টুপটুপ হিম পড়ার শব্দ আমার আশে পাশে...আমার মগজে...রাস্তায়। শীতের কামড় এবার একটু বেশি...কলকাতায়...মফস্বলে...উত্তরপাড়ায়। বেড়িয়ে পড়ি রাস্তায়। কিছুক্ষণ আগেই প্রভাত ফেরী গেছে...কিছুক্ষণ আগে ব্লগে লিখেছি চিঠির জবাব। মনটা আজ একটু ফুরফুরে একটু বা এলোমেলো।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী।
সামনেই খেয়াঘাট। মাঝিরা সকালের চায়ে চুমুক দেয়। কথা বলে। জি টি রোডের ধারে শুকনো বটের পাতা জড়ো করে কিছু মানুষ আগুন পোহায়। তাদের হাত...আগুনের উত্তাপ...ঘন ধোঁওয়া মিশে যেতে থাকে সকালে। রোজ ঘুম থেকে তুলে দিতে হয় পূর্বাশাকে। ফোন করে, অনেকক্ষণ রিং হয়ে যায়। তারপর ঘুম ভাঙে। আর একটা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। না হলে ইউনিভার্সিটি যেতে দেরী হয়ে যাবে। আমি এগুলো দূর থেকে আঁচ করতে পারি। ওরা ফেলে আসা সময়কে ধরে রাখে, জমায়... মেটা-ডেটা ফাইলে...সিডিতে...ডিভিডিতে...বইয়ে...ক্যাসেটে।
বাতিঘর ইলিনয় থেকে মেইল করে...বইটা পেয়েছো?
কিন্তু বইটা আমি কিছুতেই পাই না। অনেক খোঁজা-খুঁজি...বইমেলা...কলেজস্ট্রিট...অধ্যাপক বন্ধুর বাড়ি...সবাই আমায় নিরাশ করে।
আমি বইটা খুঁজতে থাকি। শীত চলে যায়, বসন্ত চলে যায়, গ্রীষ্মের এক লু বওয়া দুপুরে আমার মোবাইল বেজে ওঠে।
দাদা বইটা পেয়েছি। এখুনি একবার নাগের বাজার চলে আসুন আমার গোডাউনে।
ওপাশ থেকে বাংলাদেশের বই বিক্রেতা রাজু জানায়।
চারিদিকে ধুলো...স্তূপাকৃতি বই...এলোমেলো ছেঁড়া পাতা উড়ে যাওয়া...লোক জনের হইচই...সবকিছু ছাপিয়ে, উপেক্ষা করে রাজু আমার হাতে তুলে দেয় তিন খন্ডের গায়ত্রী সন্ধ্যা।
আরে বলবেন না। এই গোডাউন পরিষ্কার করতে গিয়ে...আপনাকে সত্যি...কত যে ঘুরতে হল...।
শীতল হচ্ছে শহর। বাসের মধ্যে নেই গুমোট ভিড়...আজ কলকাতায় বৃষ্টি নামবে। আজ আমার সাথে সেলিনা হুসেন।
মহানন্দা নদীতে সেই ঢেউয়ের তরঙ্গে ছোট্ট নৌকায় পুষ্পিতা, আলি আহমেদ, কালো খালা, প্রদীপ্ত, মফিজুল, নসুরুল্লাহ, হাসনা বেগমের সাথে আমি। দেশ ছাড়ছি। যেমন করে মানুষগুলো ভয়ে সিঁধিয়ে আছে। যেমন করে তাদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, যেমন করে কালো খালার সামনে মারা হয়েছে তার ছেলে- মেয়ে- স্বামীকে...তেমন করে বর্ষার সেই মহানন্দায় ঝাঁপিয়ে যুঝিয়ে চলেছে নৌকাটি...কোনো রকমে সীমানা পার করে দেবে...তারপর স্টেশন...তারপর রাজশাহি। আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে পুষ্পিতা, আলী আহমেদ আর তাদের ছোট্ট ছেলে প্রদীপ্ত। এতোক্ষণে ছোট্ট ছেলেটি বুঝে গেছে...তাদের দেশ স্বাধীন হলেও এখন তারা ভয়ে...এখন তাদের বিপদ...তার মা রাতের আঁধারে, ভিড়ে গাদা ট্রেনের মধ্যে জন্ম দিয়েছে তার ভাই প্রতীককে। ঠিক আগে তারা যেমনটি ছিলো, আর তেমনটি থাকতে পারবে না...কে যেন চিতকার করে বলছে এ আজাদি ঝুঠা হ্যায়।
রাত নামে, বই পড়া শেষ হয় না। বড়মার কাছে বসি। আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনেও নেই অনেক কিছু। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি তোমার কথা একজন লিখেছে। চোখ বড় বড় হয়।
কি কথা?
সেই যে রাতের আঁধারে তুমি, ঠাম্মা, মণি পার করেছিলে সীমান্ত...সেই যে যারা বলেছিলো গ্রাম ছেড়ে দিতে...সকালে মোজাম্মেল কাকা এসে যখন কাঁদলো...ঠাম্মা যখন বলেছিলো কেন এমন চোরের মতো পালাবো...তোমার কোলে দাদা যখন বারো ঘন্টা দুধ পায়নি...।
লিখেছে? এইসব লিখেছে?
সওওব...তোমার কথা...ঠাম্মার কথা...মণির কথা। আরো তোমাদের মতো অনেকের কথা যারা স্বাধীনতার জন্য ভিটে মাটি হারিয়েছিলে...যাদের জীবনটা কোনোদিনই আর তেমনভাবে ঠিক হলো না...ছানি পড়া চোখের ওপর জেগে রইলো ফলসার গাছ...কাঁচামিঠের বাগান...গোয়ালভরা গাই।
ফিরে দেখি বড়মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আলী আহমেদ পুষ্পিতাকে নিয়ে এসেছেন রাজশাহী। সেখানে কলেজে তিনি অধ্যাপনা করবেন। আর তাদের ঘিরে আমরা অতিক্রম করবো সাতচল্লিশের দেশ ভাগ...তেভাগা...বাহান্ননোর ভাষা আন্দোলন...যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন।
ঘুম ভেঙে যায় ফিসফিস শব্দে...কারা যেন কথা বলছে...কালো খালার একমাত্র ছেলে ফজলে গাজী যে বেঁচে ছিলো দেশ স্বাধীনের পরেও...যাকে একমাত্র অবলম্বন করে বেঁচে ছিলেন কালো খালা, তাকে পাওয়া গেছে ফনি মনসার ঝোপে। গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে তার বুক। খুব তাড়াতাড়ি তাকে তুলে আনতে হবে ঝোপ থেকে...কলাপাতায় মুড়ে...কাউকে না দেখিয়ে...স্নান করিয়ে...কফন পড়িয়ে মোনাজত করতে হবে। তেভাগার শহিদ যদি টের পায় পুলিশ, তাহলে বাড়ির মেয়েদের পর্যন্ত ছাড়বে না।
ছাড়েনি নসরুল্লাহ-হাসনা বেগমের বাড়ি...গুন্ডারা যখন পোড়াচ্ছে...জ্বালিয়ে দিচ্ছে সব কিছু... কালো খালা তখন জ্বরে অচৈতন্য। ইলা মিত্র তখন পাকিস্তানি পুলিশের গণ ধর্ষনের শিকার। তার মুখে কথা ফোটাতে তার যোনি পথে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গরম সেদ্ধ ডিম। তারপর থেকে তিনি আর কোনোদিন সুস্থ হননি। কিন্তু রেখে গেছেন বিপ্লবের এক ইস্তেহার। ভূমিহীন সাঁওতাল চাষীদের ওপর পুলিশ চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার...তবু তারা ইলা মিত্রকে চিনিয়ে দেয়নি। গ্রাম জ্বলেছে...মানুষ জ্বলছে...পুড়ছে নসুরুল্লাহর বাড়ি আর সেই আগুনের তাপ এসে লাগছে আলী আহমেদের গা ভেদ করে আমার গায়ে। কোথাও যেন সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সেলিনা লিখছেন, আলী আহমেদ ভাবছেন “ মনে হয় এই ধ্বংসতো শেষ নয়, এটা তো শুরুও হতে পারে। ওরা তো বলে গেছে নতুন ঘর উঠিয়ে দেবে। ওর মাথার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একটা স্লোগান, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই...। স্লোগান আলী আহমেদের করোটি মুখর করে তোলে। ও শুনতে পায় কালো খালার বুকফাটা আর্তনাদ, দেখতে পায় নসুরুল্লাহর নিঃশব্দ অশ্রুপাত, হাসনা বেগমের হাহাকার, তরীকুলের বিষণ্ণ মুখ। এই সবের মধ্যে দিয়ে করোটি প্রবলভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে। বুঝতে পারে আলোরও ভাষা আছে, তা শব্দ করতে পারে, কথা বলে। এই ধ্বংস যোগ্যের সামনে দাঁড়িয়ে আলী আহমেদের সামনে এখন তেমন আলোকিত ভুবন।”
ঠিক এরকমই আলো আর অন্ধকারের ছায়া সরে সরে যায় প্রতিটা পাতায়। আমি মগ্ন হতে থাকি গায়ত্রী সন্ধ্যায়। যে বিস্তৃতির আখ্যান লেখিকা সযত্নে সাজিয়ে নিয়ে বসেন তাতে কোথাও মনে হয় না তথ্যের ভারে জর্জরিত হচ্ছেন পাঠক। বরং কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে সরে সরে গিয়ে গোটা অঞ্চল তিনি পরিভ্রমণ করেন। মেডিকেল কলেজ চত্ত্বরে শহিদ হয় মফিজুল। খুঁজে পাওয়া যায় না তার দেহ। যেমন পাওয়া যায় না অহিকে। বাংলাভাষার জন্য মরে যাওয়া অহি তবু কেমন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে...কথা বলে তার প্রিয়জনদের সঙ্গে। মরে যে অমর হয়ে গেছে...কিন্তু যাকে দেখতে পাচ্ছে একমাত্র তার বন্ধুরা। আমার মনে পড়ে যায় আর্জেন্টিনার পরিচালক সোলানাসের কথা। সাউথ ছবিতে তার নির্বাসিত নায়কের ঘরে ফেরার কথা। যেখানে নায়ককে ঘিরে ধরেছে তার প্রিয় জনেরা, শোনাচ্ছে কিভাবে দেশটা মুক্ত হলো...কিভাবে তারা মারা গেলো। যাদের পিছনের পথটা বিস্মৃত আর সামনের পথটা অজানা...। সেই বিস্মৃত অজানা পথে আমি সেলিনার সাথে হাঁটতে থাকি। ম্যাজিক বাস্তবতা ঘিরে ধরে আমাকে...সেলিনার সাথে আমিও এক এক করে টপকাই মৃত্যুর গন্ডি।
ঠাম্মার মুখটা মনে পড়ে যায়...মণির কথা...বাবার কথা...বড়মার কথা, ইতিহাসের লিপিতে ফুটে ওঠে। দূরে কোথাও শাঁখ বাজে সন্ধ্যার। এক বিষন্নতা ঘিরে ধরে আমাকে, যে মুখ গুলো হারিয়ে গেছে...যে মুখ গুলো থাকলে ভালো হতো তারা কি বারবার সংকেত পাঠায়? কি পাইনি...কি পেলাম না...আর কি পাওয়া উচিত ছিলোর পাশে শহীদ সাবির হঠাত উঠে আসেন, যাঁর তেজোদীপ্ত লেখায় গোটা দেশ উত্তাল হয়...যিনি মনে করেন এখনি এই মুহূর্তে একটা সূর্য সেন দরকার। কারা যেন গেয়ে উঠলো...আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...সেলিনা থামেন না রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে পথ হাঁটেন। তাঁকে যেতে হবে অনেক দূর।
দেশ সীমানার গন্ডি পেরিয়ে আমি তখন বিশ্বজনীন আলী আহমেদের কন্ঠস্বর শুনতে পাই, “ভয়ের কি? আমরাতো অচেনা দেশকেই আপন করেছি। আমাদের মরে যেতে হয়, আমাদের ঘর পুড়ে যায়, ফেনের জন্য আর্তনাদ করি, ফনিমনসার ঝোপে আমাদের লাশ গেঁথে থাকে, বুটের লাথিতে মুখে রক্ত ওঠে, সব সংস্কার ভেঙে আমরা নগ্ন বিবৃতি দেই- বলি, দেখো সভ্যতার বড়াই করে তোমরা কেমন বর্বর আচরণ করতে পারো, যে আচরণ পশুবৃত্তিকেও হার মানায়, ঘর বন্ধ করে গুলি চালিয়ে রক্তের মহানন্দা বানাতে বুক কাঁপে না-তবুতো আমরা এই স্বদেশের দিগন্ত দেখি, কীর্তিনাশার গর্জন শুনি, পুঁইয়ের মাচার ওপর দোয়েলের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং ভাতের জন্য মানুষের আর্তনাদ ভুলে হিংস্র থাবা মুষ্ঠিবদ্ধ হবার স্বপ্ন দেখি। ”
কৃতজ্ঞতা
গায়ত্রী সন্ধ্যা, সেলিনা হোসেন, বিদ্যা প্রাকাশ
বাতিঘর
রাজু
পূর্বাশা
তখন শীতকাল। চারিদিকে কুয়াশায় মোড়া। মাঘের শীতের টুপটুপ হিম পড়ার শব্দ আমার আশে পাশে...আমার মগজে...রাস্তায়। শীতের কামড় এবার একটু বেশি...কলকাতায়...মফস্বলে...উত্তরপাড়ায়। বেড়িয়ে পড়ি রাস্তায়। কিছুক্ষণ আগেই প্রভাত ফেরী গেছে...কিছুক্ষণ আগে ব্লগে লিখেছি চিঠির জবাব। মনটা আজ একটু ফুরফুরে একটু বা এলোমেলো।
আজ একুশে ফেব্রুয়ারী।
সামনেই খেয়াঘাট। মাঝিরা সকালের চায়ে চুমুক দেয়। কথা বলে। জি টি রোডের ধারে শুকনো বটের পাতা জড়ো করে কিছু মানুষ আগুন পোহায়। তাদের হাত...আগুনের উত্তাপ...ঘন ধোঁওয়া মিশে যেতে থাকে সকালে। রোজ ঘুম থেকে তুলে দিতে হয় পূর্বাশাকে। ফোন করে, অনেকক্ষণ রিং হয়ে যায়। তারপর ঘুম ভাঙে। আর একটা ছুটোছুটি শুরু হয়ে যায়। না হলে ইউনিভার্সিটি যেতে দেরী হয়ে যাবে। আমি এগুলো দূর থেকে আঁচ করতে পারি। ওরা ফেলে আসা সময়কে ধরে রাখে, জমায়... মেটা-ডেটা ফাইলে...সিডিতে...ডিভিডিতে...বইয়ে...ক্যাসেটে।
বাতিঘর ইলিনয় থেকে মেইল করে...বইটা পেয়েছো?
কিন্তু বইটা আমি কিছুতেই পাই না। অনেক খোঁজা-খুঁজি...বইমেলা...কলেজস্ট্রিট...অধ্যাপক বন্ধুর বাড়ি...সবাই আমায় নিরাশ করে।
আমি বইটা খুঁজতে থাকি। শীত চলে যায়, বসন্ত চলে যায়, গ্রীষ্মের এক লু বওয়া দুপুরে আমার মোবাইল বেজে ওঠে।
দাদা বইটা পেয়েছি। এখুনি একবার নাগের বাজার চলে আসুন আমার গোডাউনে।
ওপাশ থেকে বাংলাদেশের বই বিক্রেতা রাজু জানায়।
চারিদিকে ধুলো...স্তূপাকৃতি বই...এলোমেলো ছেঁড়া পাতা উড়ে যাওয়া...লোক জনের হইচই...সবকিছু ছাপিয়ে, উপেক্ষা করে রাজু আমার হাতে তুলে দেয় তিন খন্ডের গায়ত্রী সন্ধ্যা।
আরে বলবেন না। এই গোডাউন পরিষ্কার করতে গিয়ে...আপনাকে সত্যি...কত যে ঘুরতে হল...।
শীতল হচ্ছে শহর। বাসের মধ্যে নেই গুমোট ভিড়...আজ কলকাতায় বৃষ্টি নামবে। আজ আমার সাথে সেলিনা হুসেন।
মহানন্দা নদীতে সেই ঢেউয়ের তরঙ্গে ছোট্ট নৌকায় পুষ্পিতা, আলি আহমেদ, কালো খালা, প্রদীপ্ত, মফিজুল, নসুরুল্লাহ, হাসনা বেগমের সাথে আমি। দেশ ছাড়ছি। যেমন করে মানুষগুলো ভয়ে সিঁধিয়ে আছে। যেমন করে তাদের গ্রাম থেকে বিতাড়িত করা হয়েছে, যেমন করে কালো খালার সামনে মারা হয়েছে তার ছেলে- মেয়ে- স্বামীকে...তেমন করে বর্ষার সেই মহানন্দায় ঝাঁপিয়ে যুঝিয়ে চলেছে নৌকাটি...কোনো রকমে সীমানা পার করে দেবে...তারপর স্টেশন...তারপর রাজশাহি। আখ্যানের কেন্দ্রবিন্দুতে পুষ্পিতা, আলী আহমেদ আর তাদের ছোট্ট ছেলে প্রদীপ্ত। এতোক্ষণে ছোট্ট ছেলেটি বুঝে গেছে...তাদের দেশ স্বাধীন হলেও এখন তারা ভয়ে...এখন তাদের বিপদ...তার মা রাতের আঁধারে, ভিড়ে গাদা ট্রেনের মধ্যে জন্ম দিয়েছে তার ভাই প্রতীককে। ঠিক আগে তারা যেমনটি ছিলো, আর তেমনটি থাকতে পারবে না...কে যেন চিতকার করে বলছে এ আজাদি ঝুঠা হ্যায়।
রাত নামে, বই পড়া শেষ হয় না। বড়মার কাছে বসি। আজকাল শরীরটা ভালো যাচ্ছে না। মনেও নেই অনেক কিছু। কানের কাছে মুখ নিয়ে বলি তোমার কথা একজন লিখেছে। চোখ বড় বড় হয়।
কি কথা?
সেই যে রাতের আঁধারে তুমি, ঠাম্মা, মণি পার করেছিলে সীমান্ত...সেই যে যারা বলেছিলো গ্রাম ছেড়ে দিতে...সকালে মোজাম্মেল কাকা এসে যখন কাঁদলো...ঠাম্মা যখন বলেছিলো কেন এমন চোরের মতো পালাবো...তোমার কোলে দাদা যখন বারো ঘন্টা দুধ পায়নি...।
লিখেছে? এইসব লিখেছে?
সওওব...তোমার কথা...ঠাম্মার কথা...মণির কথা। আরো তোমাদের মতো অনেকের কথা যারা স্বাধীনতার জন্য ভিটে মাটি হারিয়েছিলে...যাদের জীবনটা কোনোদিনই আর তেমনভাবে ঠিক হলো না...ছানি পড়া চোখের ওপর জেগে রইলো ফলসার গাছ...কাঁচামিঠের বাগান...গোয়ালভরা গাই।
ফিরে দেখি বড়মা ঘুমিয়ে পড়েছে। আর আলী আহমেদ পুষ্পিতাকে নিয়ে এসেছেন রাজশাহী। সেখানে কলেজে তিনি অধ্যাপনা করবেন। আর তাদের ঘিরে আমরা অতিক্রম করবো সাতচল্লিশের দেশ ভাগ...তেভাগা...বাহান্ননোর ভাষা আন্দোলন...যুক্ত ফ্রন্টের নির্বাচন।
ঘুম ভেঙে যায় ফিসফিস শব্দে...কারা যেন কথা বলছে...কালো খালার একমাত্র ছেলে ফজলে গাজী যে বেঁচে ছিলো দেশ স্বাধীনের পরেও...যাকে একমাত্র অবলম্বন করে বেঁচে ছিলেন কালো খালা, তাকে পাওয়া গেছে ফনি মনসার ঝোপে। গুলি এফোঁড়-ওফোঁড় করে দিয়েছে তার বুক। খুব তাড়াতাড়ি তাকে তুলে আনতে হবে ঝোপ থেকে...কলাপাতায় মুড়ে...কাউকে না দেখিয়ে...স্নান করিয়ে...কফন পড়িয়ে মোনাজত করতে হবে। তেভাগার শহিদ যদি টের পায় পুলিশ, তাহলে বাড়ির মেয়েদের পর্যন্ত ছাড়বে না।
ছাড়েনি নসরুল্লাহ-হাসনা বেগমের বাড়ি...গুন্ডারা যখন পোড়াচ্ছে...জ্বালিয়ে দিচ্ছে সব কিছু... কালো খালা তখন জ্বরে অচৈতন্য। ইলা মিত্র তখন পাকিস্তানি পুলিশের গণ ধর্ষনের শিকার। তার মুখে কথা ফোটাতে তার যোনি পথে ঢুকিয়ে দেওয়া হয়েছে গরম সেদ্ধ ডিম। তারপর থেকে তিনি আর কোনোদিন সুস্থ হননি। কিন্তু রেখে গেছেন বিপ্লবের এক ইস্তেহার। ভূমিহীন সাঁওতাল চাষীদের ওপর পুলিশ চালিয়েছে অকথ্য অত্যাচার...তবু তারা ইলা মিত্রকে চিনিয়ে দেয়নি। গ্রাম জ্বলেছে...মানুষ জ্বলছে...পুড়ছে নসুরুল্লাহর বাড়ি আর সেই আগুনের তাপ এসে লাগছে আলী আহমেদের গা ভেদ করে আমার গায়ে। কোথাও যেন সেই ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপটে দাঁড়িয়ে সেলিনা লিখছেন, আলী আহমেদ ভাবছেন “ মনে হয় এই ধ্বংসতো শেষ নয়, এটা তো শুরুও হতে পারে। ওরা তো বলে গেছে নতুন ঘর উঠিয়ে দেবে। ওর মাথার মধ্যে উজ্জ্বল হয়ে ওঠে একটা স্লোগান, বাংলা ভাষার রাষ্ট্র চাই...। স্লোগান আলী আহমেদের করোটি মুখর করে তোলে। ও শুনতে পায় কালো খালার বুকফাটা আর্তনাদ, দেখতে পায় নসুরুল্লাহর নিঃশব্দ অশ্রুপাত, হাসনা বেগমের হাহাকার, তরীকুলের বিষণ্ণ মুখ। এই সবের মধ্যে দিয়ে করোটি প্রবলভাবে আলোকিত হয়ে উঠতে থাকে। বুঝতে পারে আলোরও ভাষা আছে, তা শব্দ করতে পারে, কথা বলে। এই ধ্বংস যোগ্যের সামনে দাঁড়িয়ে আলী আহমেদের সামনে এখন তেমন আলোকিত ভুবন।”
ঠিক এরকমই আলো আর অন্ধকারের ছায়া সরে সরে যায় প্রতিটা পাতায়। আমি মগ্ন হতে থাকি গায়ত্রী সন্ধ্যায়। যে বিস্তৃতির আখ্যান লেখিকা সযত্নে সাজিয়ে নিয়ে বসেন তাতে কোথাও মনে হয় না তথ্যের ভারে জর্জরিত হচ্ছেন পাঠক। বরং কেন্দ্রীয় চরিত্র থেকে সরে সরে গিয়ে গোটা অঞ্চল তিনি পরিভ্রমণ করেন। মেডিকেল কলেজ চত্ত্বরে শহিদ হয় মফিজুল। খুঁজে পাওয়া যায় না তার দেহ। যেমন পাওয়া যায় না অহিকে। বাংলাভাষার জন্য মরে যাওয়া অহি তবু কেমন রাস্তায় রাস্তায় ঘোরে...কথা বলে তার প্রিয়জনদের সঙ্গে। মরে যে অমর হয়ে গেছে...কিন্তু যাকে দেখতে পাচ্ছে একমাত্র তার বন্ধুরা। আমার মনে পড়ে যায় আর্জেন্টিনার পরিচালক সোলানাসের কথা। সাউথ ছবিতে তার নির্বাসিত নায়কের ঘরে ফেরার কথা। যেখানে নায়ককে ঘিরে ধরেছে তার প্রিয় জনেরা, শোনাচ্ছে কিভাবে দেশটা মুক্ত হলো...কিভাবে তারা মারা গেলো। যাদের পিছনের পথটা বিস্মৃত আর সামনের পথটা অজানা...। সেই বিস্মৃত অজানা পথে আমি সেলিনার সাথে হাঁটতে থাকি। ম্যাজিক বাস্তবতা ঘিরে ধরে আমাকে...সেলিনার সাথে আমিও এক এক করে টপকাই মৃত্যুর গন্ডি।
ঠাম্মার মুখটা মনে পড়ে যায়...মণির কথা...বাবার কথা...বড়মার কথা, ইতিহাসের লিপিতে ফুটে ওঠে। দূরে কোথাও শাঁখ বাজে সন্ধ্যার। এক বিষন্নতা ঘিরে ধরে আমাকে, যে মুখ গুলো হারিয়ে গেছে...যে মুখ গুলো থাকলে ভালো হতো তারা কি বারবার সংকেত পাঠায়? কি পাইনি...কি পেলাম না...আর কি পাওয়া উচিত ছিলোর পাশে শহীদ সাবির হঠাত উঠে আসেন, যাঁর তেজোদীপ্ত লেখায় গোটা দেশ উত্তাল হয়...যিনি মনে করেন এখনি এই মুহূর্তে একটা সূর্য সেন দরকার। কারা যেন গেয়ে উঠলো...আমার সোনার বাংলা আমি তোমায় ভালোবাসি...সেলিনা থামেন না রবীন্দ্রনাথকে সঙ্গে নিয়ে একটু একটু করে পথ হাঁটেন। তাঁকে যেতে হবে অনেক দূর।
দেশ সীমানার গন্ডি পেরিয়ে আমি তখন বিশ্বজনীন আলী আহমেদের কন্ঠস্বর শুনতে পাই, “ভয়ের কি? আমরাতো অচেনা দেশকেই আপন করেছি। আমাদের মরে যেতে হয়, আমাদের ঘর পুড়ে যায়, ফেনের জন্য আর্তনাদ করি, ফনিমনসার ঝোপে আমাদের লাশ গেঁথে থাকে, বুটের লাথিতে মুখে রক্ত ওঠে, সব সংস্কার ভেঙে আমরা নগ্ন বিবৃতি দেই- বলি, দেখো সভ্যতার বড়াই করে তোমরা কেমন বর্বর আচরণ করতে পারো, যে আচরণ পশুবৃত্তিকেও হার মানায়, ঘর বন্ধ করে গুলি চালিয়ে রক্তের মহানন্দা বানাতে বুক কাঁপে না-তবুতো আমরা এই স্বদেশের দিগন্ত দেখি, কীর্তিনাশার গর্জন শুনি, পুঁইয়ের মাচার ওপর দোয়েলের দিকে তাকিয়ে থাকি এবং ভাতের জন্য মানুষের আর্তনাদ ভুলে হিংস্র থাবা মুষ্ঠিবদ্ধ হবার স্বপ্ন দেখি। ”
কৃতজ্ঞতা
গায়ত্রী সন্ধ্যা, সেলিনা হোসেন, বিদ্যা প্রাকাশ
বাতিঘর
রাজু
পূর্বাশা
my goodness..its horrible...its not only a piece about freedom fighters ..its their trauma..pain..sufferings...their unmatched attitude.love for their country..GOD BLESS THEIR SOULS
উত্তরমুছুনচিরদীপ আসলে আমরা মাঝে মাঝে আমাদের অতীতটাকে ভুলে যাই। পিছনের পথটা বিস্মৃত হয়ে পড়ি। ভুলে যাই কত লাশের ওপর দিয়ে আমরা হেঁটে এসেছি। ভুলে যাই খুব সহজে আমরা সব কিছু পাইনি। আর যারা আজকে আমাদের অনেক কিছু পাওয়ার জন্য লড়াই করেছিলেন...তাঁরা নিজেদের জীবনে সত্যি কিছু পাননি। একটু ভেবে দেখিস...।
উত্তরমুছুনআমি প্রায় বাকহারা গায়ত্রী সন্ধ্যার এই অসাধারণ রিভিউ পড়ে। এতটা দরদ দিয়ে কোন বইয়ের রিভিউ লিখতে দেখিনি আমি। গায়ত্রী সন্ধ্যা বইটা আমার ছিল না। কিন্তু আপনার এই লেখাটা পড়ে বইটা যে কিনতে হবে তাতে সন্দেহ নেই। আর সবশেষে বাতিঘরকে ধন্যবাদ দিতেই হয় আপনার এই রিভিউর খোঁজটা দেবার জন্য। নইলে আমার জানাই হতো না। ভালো থাকুন।
উত্তরমুছুননীড় সন্ধানী
বইটা অনেক দিন ধরে খুঁজছিলাম। আর যখন পেলাম, পড়লাম, তখন কেন যেন মনে হল এটা আমারাই কথা। আমার ফেলে আসা সময়ের কথা। কিম্বা আমি যে সময়ে এই মুহূর্তে দাঁড়িয়ে আছি তার কথা। আমি বেশ খানিকটা কাঁদমাল আর অবশ হয়ে থাকলাম বেশ কিছুদিন। এখোনো এর দুটো খন্ডে হাত দিই নি। কারণ আমি জানি তখন কোনো কাজ করার ক্ষমতা আমার থাকবে না। এই বিশাল এক ব্যাপ্ত সময়কে সেলিনা হোসেন যেভাবে ধরেছেন তা বাংলা সাহিত্যে গর্ব করার মত বিষয়। বাতিঘর এই লেখিকার সাথে আমার প্রথম পরিচয় করায়। আর আমি খুঁজতে থাকি। আমার খুব ভালো লাগছে আপনি আমার লেখাটা পড়েছেন আর মন্তব্য করেছেন। ভালো থাকুন। অনেক শুভেচ্ছা রইলো।
উত্তরমুছুনএই মন্তব্যটি একটি ব্লগ প্রশাসক দ্বারা মুছে ফেলা হয়েছে।
উত্তরমুছুন