আমলাগুড়ি রাভা

বেশ ক্লান্ত ছিলাম আমরা সবাই। বাড়ি থেকে সেই কবে বেরিয়েছি। পাহাড়ের ওপরে ডুকপাদের গ্রাম গুলোতে ঘুরেছি...দিনে প্রায় পাঁচ ঘন্টা মতো হাঁটা, পাহাড়ি রাস্তায়। তার সাথে শ্যুটিং। ভালো ভাবে স্নান নেই,  খাওয়া নেই। কারো শরীর আর চলছে না। পাহাড় থেকে নেমে রাজাভাতখাওয়ায় এক দিন থেকে জামা কাপড় কেচে একটু ঘুমিয়ে আবার বেড়িয়ে পড়া। যাবো আন্দু বস্তি, কুরমাই, কোদাল বনবস্তি। সব কটিই জঙ্গলে ঘেরা...জঙ্গলের মধ্যে অবস্থিত গ্রাম। এই গ্রাম গুলোকে আমি বেশ ভালোভাবে চিনি। এখানকার কয়েকজন মানুষের সাথে আমার বেশ পরিচয়। কাজের সূত্রে...দীর্ঘদিন এই অঞ্চলে থাকার জন্য। ঠিক যেমন ভাবে চিনি রামদাসকে, তেমনি আমলা রাভাকেও।
২০০৫ সালে আমরা ঠিক করেছিলাম হাতি নিয়ে যে ছবিটা হতে চলেছে তার মূল জায়গাটি হবে জলপাইগুড়ি জেলার চিলাপাতা জঙ্গল। এছাড়া ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে আরো নানান বনাঞ্চল।  এই জঙ্গলেই বন দপ্তরের কর্মী হিসেবে কাজ করে টারজান হাতি আর তার মাহুত রামদাস। জলপাইগুড়ি জেলার মধ্যে যে কটি বনবস্তি আছে এবং তাদের মধ্যে যে কটিতে রাভা জনজাতির মানুষরা থাকেন তাদের মধ্যে বেশ পুরোনো হচ্ছে আন্দু বস্তি। এর পাশেই আরো কয়েকটি রাভাদের গ্রাম। সেখানেই আমার সাথে প্রথম পরিচয় আমলার । বন্ধু বিক্রম পরিচয় করিয়ে দিয়েছিলো ।“আজ থেকে আমলা থাকবে। হ্যাঁ তোর গ্রুপে। আজ থেকেতো তোরা তোর্সার ওইদিকটায় যাবি...ওখানে ঘন জঙ্গল। আমলা পথ দেখাবে।”
 আমলা শুধু পথ দেখায়নি কয়েক দিনে ও আমাদের খুব কাছের বন্ধু হয়েছিলো। এরপর যখনই জঙ্গলে গেছি...কাজ করেছি...আমলা থেকেছে। কোদালবস্তির ওপর দিয়ে যখনই গিয়েছি দেখা করেছি আমলার সাথে। ঠিক এইবারেও।  এবারে আমরা খুব ক্লান্ত হয়ে পৌঁছেছিলাম কোদাল বনবস্তিতে।
এবারেও আমলা নিয়ে গিয়েছিলো তার বাড়িতে। কেটে দিয়েছিলো পাকা আনারস। বলেছিলো, চলুন তোর্সার পাড় থেকে একটু ঘুরে আসি...হাতি বেরনোর সময় হলো।
এবারো অমায়িক হাসি। এবারেও সেই আমাদের পরিচিত আমলা। বলেছিলাম, আমলা পাকা আনারসের ছবি তুলবো...ইচ্ছামতীর পাঠকদের জন্য। বলেছিলাম আরো অনেক কিছু আর
জিজ্ঞেস করেছিলাম “আমলা তোমার নামের মানে কী?”
আসলে এটা একটা জায়গার নাম বুঝলেন...আমলাগুড়ি। সেখানে হয়েছিলাম কিনা...তাই বাবা ওই নাম রেখেছে।

আমলা কাজ করছিলো নেসপনের সাথে। কাজ করছিলো জঙ্গলের মানুষের অধিকার ফিরিয়ে দেওয়ার জন্য। কাজ করছিলো একশো দিনের কাজের দাবী দাওয়া নিয়ে। কাজ করছিলো বনবস্তির মানুষদের যেন সহজেই কেউ আর অত্যাচার করতে না পারে। ফিরিয়ে দিতে পারে তাদের জমির অধিকার। বাঁচার অধিকার।
একটা ছোট খাটো মানুষ...তার মধ্যে প্রাণের প্রাচুর্য অফুরন্ত।
রাভাদের ওপর তথ্যচিত্র হবে জেনে তার আর আনন্দের সীমা পরিসীমা ছিলো না। বন্ধু অর্ণব আমার ফোন নাম্বার দিয়েছিলো আমলাকে। আর মাঝে মাঝে জানতে চাইতো আমরা কবে আসবো।
তারপর সত্যি একদিন অনেক পাহাড়ী রাস্তা হেঁটে...অনেক ক্লান্তি নিয়ে যখন চিলাপাতায় পৌঁছোলাম...যখন আমলার গ্রামে গেলাম...নলরাজার গড়ে হাঁটলাম...তখন কোথাও যেন উবে গেলো দেহের সেই কষ্ট।
আমলা আমাদের নিয়ে অনেক হাঁটলো।
একদিন শ্যুটিং শেষ হলো।
প্রজেক্ট জমা পড়লো।
আর মার্চের কোনো এক দুপুরে অর্ণব ফোন করে জানতে চাইলো “হ্যাঁরে...তোর কাছে কি আমলার কোনো ছবি আছে?”
আমি একটু ইয়ার্কি মেরেই জানতে চাইলাম কেনো...আমলা কি এবার ভোটে দাঁড়াবে?
অর্ণব উত্তর দিলো “ না আসলে ওর স্মরণ সভায় লাগবে”।
ফোনের দুপাশ থেকে সেদিন আর কথা বলেনি কেউই।
শুধু তন্ন তন্ন করে খুঁজেছি আমলার ছবি...
কমপিউটারের কোনায় কোনায়...না কোথাও আমলা নেই।

 গত ছমাসে সে যখন ক্যানসারের সাথে লড়াই করছে আমি তখন আমার এডিট স্যুটে...টাইম লাইনে শট আগু-পিছু করছি। তিলেশ্বর রাভার কোন গানটা রাখবো ঠিক করছি। বন্ধুদের ডেকে দেখাচ্ছি...আরে ফার্স্ট পোর্সানের জার্কটা ভালো লাগছে তো? মিনিং ফুল তো?...রুদ্রকে বলছি ...আরে শটটা আগে কাট। সাবটাইটেলের কাজ করতে এসে পূর্বাশা বলছে জায়গাটা বড় lengthy  লাগছে। অযথা টেনো না...।
আমি ডুবে থাকছি কাজে আর দূরে কোথাও মরছে আমলা।
যারা জন্মে থেকে পায়না জীবন ধারনের প্রাথমিক এবং আবশ্যকীয় সুযোগ সুবিধে গুলো।
যারা বরাবরই কাঠ চুরির তকমা পিঠে নিয়ে ঘোরে। যাদের প্রতি বছর কাউকে না কাউকে মরতে হয় বন দপ্তরের কর্মীর গুলিতে। আজও।
শেষ পর্যন্ত আমি সত্যি ছবি খুঁজে পাইনি। কিন্তু বন্ধু প্রদীপ্ত আমলার যে দীর্ঘ সাক্ষাতকারটা নিয়েছিলো সেটা থেকে সে উদ্ধার করলো কয়েকটা ফ্রিজ ফ্রেম।
হ্যাঁ, যেখানে সময় থমকে আছে।
হ্যাঁ, যেটা প্রতি নির্মাণ...
যে ফ্রেমে শুধু আমলাকে খুঁজলে ভুল করা হবে।

মন্তব্যসমূহ

  1. ami aj elam amar facebooke home e dekhe j Kallol da abar 1 ta lekha share koreche...vebe esechilam comment korbo valo kichu...kintu lekhata amay nariy diye galo...Amla der moto hero der salute janalam

    উত্তরমুছুন
  2. দারুণ লেখা!! ভেতরে কোথায় একটা নাড়া দিয়ে গেল...

    উত্তরমুছুন
  3. ধন্যবাদ চিরদীপ, ধন্যবাদ দিগন্ত। ভালো থাকবেন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি