চিঠির জবাব...

চিঠির জবাব...
 “মুক্তিসেনাদের ক্যাম্প থেকে লিখছি। এখন বাইরে বৃষ্টি হচ্ছে। তাঁবুর ফাঁক দিয়ে দেখতে পাচ্ছি সমস্ত দিগন্ত মেঘলা। মাঝে মাঝে বিদ্যুত চমকাচ্ছে। সকাল থেকে বৃষ্টি হচ্ছে কিনা, তাই মনটা ভালো না। আচ্ছা মা, সারা রাত এমনি চলার পর পূর্বাকাশে যে লাল সূর্য ওঠে, তার কাঁচা আলো খুব উজ্জ্বল হয় তাই না? এই মুহূর্তে আমার ছোটবেলার কথা মনে পড়ছে। বর্ষা এলে তুমি বাইরে যেতে দিতে না। একদিন তোমার অজান্তে বাইরে আসতেই পিছলে পড়ে পায়ে চোট লাগে। তখন তুমি চিতকার করে কেঁদে উঠেছিলে...কিন্তু আজ! আজ আমার অনেক সাহস হয়েছে রাইফেল ধরতে শিখেছি। বাংকারে রাতের পর রাত কাটাতে হচ্ছে  তবুও ভয় পাই না। শত্রুর আক্রমণের মুখে দাঁড়িয়ে প্রচন্ড পালটা আক্রমণে শিরায় উপ শিরায় রক্তের চাপ সৃষ্টি হচ্ছে। মা সত্যিই তোমাকে বোঝাতে পারবো না। ছোটবেলার কথা মনে পড়লে কেমন যেন লাগে। কিন্তু আমার একি আশ্চর্য পরিবর্তন, কারণ আমি আমার স্বদেশ, আমার বাংলাকে ভালোবাসি...।”

বাইপাস ধরে ছুটে যাচ্ছে বাসটা...জানলার কাঁচে টিপ টিপ বৃষ্টির ছিটে।
অসময়ের বৃষ্টি।
ঝিম ধরা এক আবহে আমার হাতে কুসুমরাঙা মলাটে একাত্তরের চিঠি
বাতিঘর ইলিনয় থেকে জানতে চেয়েছিলো বইমেলায় যাচ্ছি কিনা...পূর্বাশা বারবার তাগাদা দিচ্ছিলো...শেষের আগের দিনটা প্লিজ যাও...ধুলো আমার সহ্য হয়না বলে তুমিও যাবে না?...মহাশ্বেতা জানতে চেয়েছিলো কি কি বই কিনতে চাই...মৃণাল বলেছিলো এলে,  একবার আমাদের স্টলটা ঘুরে যাস...।  মাল্যবানদা...জয়ব্রত খোয়াবের প্রচারে জনজোয়ারে...
আমি তখন ধুলোয়...আমি লাইনে...আমি বইমেলায়।
আচ্ছা বাংলাদেশের প্যাভিলিয়নটা কোনদিকে?
তন্ন তন্ন করে খুঁজছি...
না...আসলে আমি তো মেইন গেট দিয়ে ঢুকেছি...
আনন্দের পাশে দেখুন...
কিন্তু আনন্দটা কোনদিকে?...
“আমি ক্যাম্পের মেয়েদের  জন্য কিছু শাড়ি সংগ্রহ করেছি। আপনি প্রয়োজন মতো তা বিলি করার ব্যবস্থা করে দেবেন। কাকিমার জন্য  একখানা লালপাড় শাড়ি পাঠালাম-তিনি যেন তা ব্যবহার করেন। বাচ্চাদের জন্য সামান্য কিছু কাপড় জামা পাঠালাম, আশা করি কাজে লাগবে। আমি সেলা ক্যাম্পে যাবার পর বালাট, ডাউকী, আমলারেং প্রভৃতি ক্যাম্পে ঘুরছি। অবস্থা দুর্দশার চরম সীমায়, খালি মুক্তিবাহিনীর ছেলেরাই অন্ধকারে আশার আলো বয়ে আনে। ভগবান তাদের স্বাস্থ্য ও দীর্ঘজীবন দিন...এই প্রার্থনা জানাই।”
কোন বইটা খুঁজতাছেন?
আসলে আমি অনেক দিন খুঁজছি জানেন...সেলিনা জাহানের গায়ত্রী সন্ধ্যা। আমার বন্ধু ইলিনয় থেকে এই বইটা পড়ার জন্য বলেছিলো।...আমার ব্লগের অনেকে এই বইটা নিয়ে কথা বলেছে...
সেলিনা জাহান?...না, না ভুল...হুসেন...সেলিনা হুসেন...আরে দ্যাখেন এই মাত্র লাস্ট সেটটা...
বিক্রি হয়ে গেলো?
আলী দ্যাখ তো...নীচের প্যাঁটরাটা...
একগাল শ্বেতশুভ্র দাড়ি আর পান খাওয়া ঠোঁটের পাশে বাংলার হাসি মুখ নিয়ে কি করিম মিঞা আমার দিকে তাকিয়ে?
গোয়ালভরা গাই...পুকুরভরা মাছ...গাছভরা কাঁচা মিঠের বোল...মাড়াইভরা ধান...ফেলে তিন মহিলা...কোলের এক শিশু...নিয়ে রাতের আঁধারে পূর্বপুরুষের ভিটে মাটি ছাড়ছেন...
দুহাত ঠেলে বাধা কাটাচ্ছেন করিম মিঞা...। রেডিওতে লালনের গান...
স্মৃতি উড়তে থাকছে ধূলোয়...জবানীতে...চিঠিতে...পঁয়ত্রিশ বছরের জীবনে...
“বর্তমানে যে পরিস্থিতি তা আর বলার নয়, রাস্তার ধারের মানুষের জীবনের নিরাপত্তা নেই। রোজ গরু, ছাগল, হাঁস,  মুরগী ছাড়াও যুবতী মেয়েদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে। প্রত্যেকদিন এইসব ঘটনা। বাড়িতে আগুন আর গুলি করে মানুষ মারার তো কথাই নেই। তাছাড়া লুঠতরাজ, চুরি আকাতি সব সময় হচ্ছে। কয়েকদিন বৃষ্টির জন্য রাস্তাঘাট কাদা হওয়ায় আমরা বেঁচে আছি। রাস্তাঘাট শুকনা  থাকলে হয়তো আমাদের এদিকেও আসতো। জানি না ভবিষ্যতে কি হবে। তবে ওরা শিক্ষিত এবং হিন্দুদের আর রাখবে না বলে বিশ্বাস। হিন্দু আর ছাত্রদের সামনে পেলে সঙ্গে সঙ্গে গুলি করছে।”
নাই বুঝলেন...এই যে শুনতাছেন...
আমি তাকিয়ে...
ঘাড়ের ওপর ভিড়ের ঢেউ এসে আছড়ে পড়ছে...ঠেলাঠেলি...
আমার হাত ধরে বৃদ্ধ স্টলের মধ্যে ঢোকালেন...
এমন আনমনা হয়ে চলেন ক্যামনে?
ঠিকানা বলেন...ডাকে না হয়...
পাঠাবেন?
আপনি চাইলে...
লিখুন...লিখুন আমার ঠিকানা...
জানেন রুবেলকেও মেইল করেছি...আমার লেখা এই প্রথম বাংলাদেশ থেকে প্রকাশিত হচ্ছে...না মানে অনেক বড় নয়...ছোট্ট একটা লেখা...কিন্তু...ওটা আমার কাছে...একটা ভেলা...জানেন...
এই ফর্মটা ফিলাপ করেন...
“আজ আমি চলে যাচ্ছি। জানি না কোথায় যাচ্ছি। শুধু এইটুকু জানি, বাংলাদেশের একজন তেজোদীপ্ত বীর স্বাধীনতাকামী সন্তান হিসেবে যেখানে যাওয়া দরকার আমি সেখানেই যাচ্ছি। বাংলার বুকে বর্গী নেমেছে। ...ছেলে হিসেবে আমার আবদার রয়েছে  আপনার ওপরে। আজ সেই আবদারের ওপর ভিত্তি করেই আমি জানিয়ে যাচ্ছি বাবা, আমি তো প্রবেশিকা পরীক্ষার্থী। আমার মনে কত আশা...কত স্বপ্ন...। আমি প্রবেশিকা পরীক্ষায় পাশ করে কলেজে যাব। আবার কলেজ ডিঙিয়ে যাবো বিশ্ববিদ্যালয়ের অঙ্গনে। মানুষের মতো মানুষ হব আমি...কিন্তু সব আশা, সব স্বপ্ন এক ফুতকারে নিভে গেলো। বলতে পারেন এর জন্য দায়ী কে? দায়ী যারা সেই সব নরঘাতকের কথা আপনিও জানেন। বাংলাদেশের প্রতিটা মানুষ ওদের কথা জানে...সর্গের চেয়েও উত্তম মা এবং মাতৃভূমি। আমি তো যাচ্ছি আমার সেই মাতৃভুমিকে শ্ত্রুর কবল থেকে উদ্ধার করতে। আমি যাচ্ছি  শ্ত্রুকে নির্মূল করে আমার দেশের মানুষের মুখে হাসি ফোটাতে।”
এই বইটা রাখেন। দাম নিয়ে দরাদরি করবেন না। এই লাস্ট কপি দ্যালাম আপনারে...দুইশত টাকা দ্যান...।
আমার হাতে একাত্তরে চিঠি।
আমার সামনে মাতৃভাষা দিবস...
আমার সামনে একুশে ফেব্রুয়ারীর অলৌকিক ভোর।
কিন্তু তোমার চিঠির কি জবাব আমি দেব ফারুক...?
এইমুহূর্তে? এই সমকালে?
এই পড়ন্ত সকালের মন কেমন করা রোদে আমি তো দেখতে পাচ্ছি তুমি চট্টগ্রাম সিটি কলেজিয়েট স্কুলের দশম শ্রেণীর ব্যাগ...পড়ার অছিলা...বড় হওয়ার স্বপ্নকে পেছনে ফেলে...নোয়াখালীর কোম্পানীগঞ্জ থানার বামনী বাজারের দক্ষিণে বেড়িবাঁধের ওপর গুলিবিদ্ধ অবস্থায় শায়িত আছো...
সবাই দেখেছে কি বীর বিক্রমের লড়াই তুমি করেছো ফারুক।
আমি দেখছি তোমার রক্তাত শরীর।
তোমার নিমীলিত চোখে দেশ জয়ের স্বপ্ন...
হে শহীদ...
তোমার ওই ক্ষত বিক্ষত শরীরে...
তোমার আরো অসংখ্য সহযোদ্ধার রক্তের তাপে আজ যে দিনটা আমার ছোট্ট ব্লগের মধ্যে প্রসারিত হচ্ছে ...
 ছুঁয়ে যাচ্ছে আমার মন...
এই মাত্র আমার বাড়ির সামনে দিয়ে যখন প্রভাত মিছিল যাচ্ছে...
এইমাত্র যখন আমি মুছে দিচ্ছি আমার দেশ কালের বন্ধন...
তখন আমার সামনে কতকগুলো স্বপ্ন...
কতকগুলো চিঠি...
যার জবাব সত্যি আমার জানা নেই বন্ধু।
 
কৃতজ্ঞতা
একাত্তরের চিঠি
প্রথমা প্রকাশন


মন্তব্যসমূহ

  1. this is a very hard hitting story of our own bengal,which is in danger right now.

    উত্তরমুছুন
  2. ঠিকই বলেছো চিরদীপ, সমস্যাটা বেশ জটিল এবং গভীর। ভালো থেকো।

    উত্তরমুছুন
  3. মন ছুঁয়ে যাওয়া এইসব ঘটনাটাগুলোই আমাদের ইতিহাস। এর কোন অংশই আমরা ভুলে যেতে পারিনা। শেয়ার করার জন্য আপনাকে ধন্যবাদ।

    উত্তরমুছুন
  4. ধন্যবাদ আপনাকেও। ভালো থাকবেন।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি