দিপালী নাগ
দিপালী নাগ (১৯২২-২০০৯)
এই শীতের সকালবেলা ঘুম থেকে উঠেই চোখে পড়লো খবরের কাগজের এক ছোট্ট শব্দ বন্ধ। চারপাশের কুয়াশা ভেদ করে আমি ছুটতে থাকলাম এক বছর আগের এক দুপুর বেলা। আমি ছুটতে থাকলাম সৌরভের পাড়ায়। বেহালায়। রাস্তার মোড়ে জানতে চাইলাম এখানে দিপালী নাগের বাড়ি...দুই-একজন বলতে পারলো না...কিন্তু পানের দোকানদার বলে দিলো হাঁ...হাঁ...ম্যাডামকা ঘর...সিধে যা কর ডাহিনা...। সৌরভের বিশাল বাড়ি ছাড়িয়ে একটু দূরেই হলুদ রঙের দেড়তলা বাড়ি। চারিদিকে নানা রকমের গাছ...পাখি...ওই ঘিঞ্জি পাড়াতে বাড়িটা যেন এক দ্বীপের মতো...। ওয়েট করছিলেন দিপালীদি। যেতেই ধমক খেলাম আমরা। কারণ পাঁচ মিনিট লেট ছিলো আমাদের সূচী। আর উনি ওঠাবসা করেন ঘড়ির কাঁটায়।
"বাঙালিদের সবচেয়ে বড় কি দোষ জানো?...ঠিক সময় মেনে না চলা..." আমি, বি্ক্রম, সুচন্দা কাঁচুমাচু মুখ করে দাঁড়িয়ে রইলাম। আর উনি আমাদের চমকে দিয়ে "বললেন বলো কি খাবে? বিয়ার না চা? যা গরম একটা পড়েছে।"
আমরা গেছি একটা ডকুমেন্টারির কথা ভেবে। ঠিক ডকু নয়...কলকাতার গান নিয়ে আমাদের অনুষ্ঠান শুরু হবে আকাশ বাংলায়...বিভিন্ন সঙ্গীত ব্যক্তিত্ত্বকে ক্যামেরা বন্দি করবো এই আমাদের প্ল্যান। তাই ঠিক হলো প্রথমেই আমরা যদি দিপালীদিকে দিয়ে শুরু করি?...রাজী হবেন? তার আগে টিভি চ্যানেলের সাথে কথা বলতে হবে। চ্যানেল নিম রাজী হলো...বলা হলো..."আসলে বুঝতেই পারছিস...এখন সব ঝাঁ চকচকের যুগ...একজন মহিলা...বয়স আশির কোটা প্রায় পেরোতে চললো..." জেদ ধরলাম আমরা...দিপালীদিকে দিয়ে শুরু হবে কলকাতা গান।
তার মধ্যে শুরু হয়ে গেছে নেট ঘাঁটা...বিহানের সিডি নিয়ে এসেছে বিক্রম...শুনছি...
"আগ্রা ঘরানা সম্বন্ধে কিছু জানা আছে?" আমার দিকে তাকিয়ে দিদি। না, মানে কিছুটা...ওই নেট...বিহানের ক্যাসেট...
আমি ঢোক গিলি। বিক্রম ধরে নেয়, " ওস্তাদ ফৈয়াজ খাঁ...আপনার ছোটবেলা...সেই আগ্রা শহর...আপনার বাবা তো একজন বিখ্যাত ঐতিহাসিক...অধ্যাপক...মোঘল সাম্রাজ্য তাঁর গবেষণার বিষয়...।"
জানো ছোটবেলার আগ্রা শহরটা আমার চোখের সামনে ভাসে। আমার বাবা, মা...আমাদের সেই বাড়িটা...আমার সঙ্গীত চর্চা...বাবার উতসাহ..." টেনে নিলেন হারমোনিয়াম..." হঠাত আমাকে কেনো বলোতো? আমি তো ইভি দেখার সময় পাই না...একা থাকি...সবসময় লোকজন আসছে...সঙ্গীত একাদেমিতে যেতে হচ্ছে...ভেবেছিলাম একটা বই লিখবো...আমার সময়টা ধরে...শুনবে একটা গান?...জানো তো নজরুলকে দেখতে কি সুন্দর ছিলো..."
দুপুর গড়িয়ে বিকেল... চললো গান...কথা...অনেকবার অনেককে বলা আবার না বলা কথা ...সেদিন তো কোনো প্রস্তুতি নেই...সেদিন তো রাজী করানো...সেদিনের কথা গুলো তাই বেবাক গেঁথে আছে মস্তিস্কে...যতদিন না বিস্মৃতি এসে গ্রাস করে...। সেদিন নেই কোনো ক্যামেরা...সেদিন নেই কোন শিফটের হিসেব...সেই সুন্দর বাড়ির হলুদ দেওয়ালে আহ্নিক গতির চলাচলের ছবি পড়ে...বিকেল গড়াতে থাকে।
"শোনো বাপু...আমার এই ছাদটা খুব প্রিয়। যখন তোমরা তোমাদের ওইসব শ্যুটিং করবে...এর একটা ছবি তুলো...আর মাঝে মাঝে এসো...লোকজন আমার খুব ভালো লাগে...আমার মনে থাকবে না কিন্তু...কিছু মনে রাখতে পারিনা আর...লিখে দিয়ে যাও কবে আসবে...আর হ্যাঁ...সেদিন এসে অবশ্যই এখানে দুপুরে খাবে কেমন..."।
রাজী হয়ে গিয়েছিলেন দিপালীদি...।
এরপরে একদিন ধুমধাম করে অনেক লাইট...লোক-লস্কর নিয়ে আমরা শ্যুটিং করলাম...। কত কথা বললেন সেদিন...গান গাইলেন...।
২০০৮ এর এক গরমের সন্ধ্যেতে আমরা কাজ শেষ করে বেরিয়ে এলাম।
টেলিকাস্টের দিন একটা ফোন করে ছিলাম। বাড়ি ছিলেন না।
আর কনো কথা হয়নি...বাড়ি যাওয়া হয়নি আর...
শুধু বিরল মুহূর্তের সাক্ষী থাকলো জীবন।
জানা হল না অনেক কিছু...কিম্বা জানার কোনো আগ্রহও হয়তো ছিলো না...আরো একটা বছর কেটে গেলো...
ওই হলুদ বাড়িটায় কি এখোনো আহ্নিক গতি খেলা করে?
নাকি...ওই পাড়ার মতো...ওখানেও একটা গজিয়ে উঠবে ফ্ল্যাট?
চোখ বন্ধ করি...আমার সামনে তখন দিপালীদির বসার ঘর...এই নতুন বছরে অপেক্ষায় তার শূন্যতা নিয়ে চেয়ে আছে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন