সুবর্ণরেখা

সুবর্ণরেখা
এই শীতে মনে হয় পায়ের তলায় সর্ষে রেখেছে কেউ। মনে হয় দরজার আগল খুলে কেউ বুঝি এগিয়ে দিচ্ছে হাত। মন বলছে এবার বেড়িয়ে পড়ো। মন বলছে আজ জলকে চল।
আমিও বেড়িয়ে পড়েছিলাম একদিন সকালে। উত্তরপাড়া থেকে হাওড়া। হাওড়া থেকে মেদিনীপুর লোকালে খড়্গপুর। সেখান থেকে ভসরা...বাসে। আমি যাচ্ছিলাম...যেতে চাইছিলাম আমার দিদির বাড়ি নয়া গ্রামে। যে গ্রাম এখন এই মহুর্তে মাওবাদীদের লিস্টে...যে গ্রামে হাতি ঘুরে বেড়ায় গাভীর মতো...যে গ্রামে আমার দিদির বাড়ি। শুধু মাঝখানে একটা বিভাজন ...সুবর্ণরেখা।
প্রতিদিন এই পথ দিয়ে যাতায়াত করেন অসংখ্য মানুষ। প্রতিদিন এই একটা মাত্র রাস্তা নয়াগ্রামের সাথে যোগাযোগ রেখে চলে। না, স্বাধীনতার এতোদিন পরেও একটা সাঁকো করা যায় নি। উন্নয়নের ধারাপাত শুধু বইয়ের ভাষায়, সরকারী তত্ত্বে, আর নেতাদের বুলিতে সীমাবদ্ধ।
জঙ্গল উঁচু -নীচু এবড়ো খেবড়ো রাস্তা পার হয়ে তারপর সুবর্ণরেখা। শীতকালে একটা কাঠের সাঁকো তৈরী করা হয়, তখন বাস, ট্রেকার সব নয়া গ্রামের মধ্যে যেতে পারে, স্থানীয় মানুষের মুখে হাসি ফোটে। কিন্তু বর্ষাতে সুবর্ণরেখা ফুলে ফেঁপে উঠলে কাঠের সাঁকো ভেসে চলে যায়, আবার পরের বছর ব্রীজ হবার অপেক্ষায় থাকে স্থানীয় মানুষ। তবু একটা সেতু নির্মাণ করা যায় না।
ভসরা থেকে ডাহির নৌকোতে আমরা উঠে পড়লাম। যেতে মিনিট পাঁচেক সময় লাগলো। মন ভরে গেলো সুবর্ণরেখার রূপে, তারপর আবার হাঁটা...তারপর ট্রেকার। তারপর নয়াগ্রাম।
পশ্চিম মেদিনীপুরের নয়াগ্রামের মানুষরা মূলত কৃষিজীবি। চারিদিকে জঙ্গল...তাই অনেকে জঙ্গলের ওপরেও নির্ভরশীলকৃষি মূল জীবিকা হলেও হাতির দাপটে অনেকেই সেই ফসল ঘরে তুলতে পারেন না। নয়া গ্রামে আছে থানা, ফরেস্টের অফিস, বাংলো, উচ্চবিদ্যালয়, বাজার... এতসব কিছু অনুন্নত এলাকায় থাকে না। নয়া গ্রাম অনুন্নত নয়। কিন্তু অনুন্নতের সব চিহ্ন তার দেহে। দিন আনা দিন খাওয়া পরিবারের সংখ্যাও তো নেহাত কম নয়।
কেউ কেউ এই অনুন্নয়নের...দারিদ্রের সাথে লড়াই করছেন। পুনগিরি গ্রামে এক মহিলা খড়্গপুর আই আই টি থেকে ট্রেনিং নিয়ে বাবুই ঘাস থেকে হাতের কাজ করছেন। দিনে ষাট...সত্তর টাকা আয় করেন।
কিন্তু সবাই এই প্রথা ভাঙতে পারেননি। সবাই খড়্গপুর আই আই টি তে ট্রেনিং এর সাহস দেখাননি। তাঁরা নির্ভর করছেন পঞ্চায়েতের একশো দিনের কাজের ওপর। কিন্তু সে কাজ কোথায়? বছরে পনেরো থেকে ত্রিশ দিন...খুব বেশি হলে।
প্রবাদ বলে মনে হতে পারে...কিন্তু এখানে এলে মনে হবে এখানে হাতি গাভীর মত চড়ে। শহরের মানুষের বিনোদন, ফরেস্টের সংরক্ষণ আর সাধারণ মানুষের নির্যাতন। ধান রোয়া থেকে শুরু...চলবে ফসল কাটা পর্যন্ত তাদের অত্যাচার।
যাঁরা ঘরে ফসল তুলতে পারবেন তাঁরা নবান্নের প্রস্তুতি নেবেন। মাটির মেঝেতে আঁকা হবে আলপনা।
এই শীতের সন্ধ্যেতে কেউ কেউ ভাজতে বসবেন পাটিসাপটা।
সুবর্ণরেখার পাশের এই গ্রাম তার বারোমাস্যায় ডুব দেবে চিরদিনের মতো। উন্নয়ন আর অনুন্নয়নের ফারাকটা বোঝা যাবে না ট্যুরিস্ট বাবুদের লেখায়...ছবিতে। মাওবাদীর হুমকি...বিরীধীদের খেয়োখেয়ি আনুপাতিক ধারাপাতের মতো ফুটে উঠবে না দেওয়ালে। বরং দেওয়াল অন্য কথা বলবে। যেখানে জীবনটা গুমোট নয়। বরং জীবনটা তার থেকে অনেক কিছু...



মন্তব্যসমূহ

  1. আজ আমার স্হানীয় চকোলেট ফ্যাক্টরীতে যাবার কথা থাকলেও উটকো সমস্যার কারণে আর যাওয়া হলোনা । কোথাও যাবার প্রস্তুতি নিয়েও যেতে না পারাটা আমার কাছে ভারী মন খারাপের....হয়ত মন খারাপকে সামান্য ছুঁতোয় আপন করতে ভালোবাসি বলেই এমনটা স্বভাবে বাসা বেঁধেছে....সে যাই হোক, মনটা আসলেই একটু মুখভার করেই ছিলো সারাদিন । কিন্তু, সন্ধ্যারমুখে কল্লোল তোমার চিঠির হাতধরে যে আমার এমন অদ্ভূত সুন্দর একটা গ্রাম ঘুরে দেখা হয়ে যাবে ভাবিনি!!!সুবর্ণরেখা! নামের মধ্যেই মায়ার হাতছানি যেনো ....কৃষি আর ভাগ্যের উপর নির্ভর করে থাকা ভীষণসহজ প্রাণের মানুষগুলোর জন্য আমার শুভ কামনা থাকলো ।প্রথা ভেঙ্গে বেরিয়ে আসা পুনগিরি গ্রামের 'নারীটির' জন্য আমার উষ্ণ অভিনন্দন!ফি বছর কাঠের সাঁকোর পেছনে ব্যয় না করে স্হায়ী একটি সেতু হোক, হররোজই সুবর্ণগ্রামের মানুষগুলো পাক যানবাহনের যাবতীয় সুবিধা । কারণ অনেক গ্রামের চেয়েই সুবর্ণগ্রাম বেশ উন্নত ...স্হায়ী সেতু সেই উন্নয়নে আরেকটা মাত্রা যোগ করুক । নোংরা রাজনীতির রেষারেষি থেকে মুক্ত হয়ে, দীর্ঘদিন সুবর্ণরেখা ফুটে থাকুক প্রকৃতির বুকে নির্মল হাসি নিয়ে......কল্লোল বলতে দ্বিধা নেই, সকালের মনভার ভাবটা তোমার ছবিরগ্রাম ঘুরে কোথায় মিলিয়ে গেলো...মন ছুঁয়ে দেয়া লেখা আর ছবির জন্য তোমাকে এক পৃথিবী ভালোবাসা ।

    উত্তরমুছুন
  2. ধন্যবাদ বাতিঘর। তোমার এই আন্তরিক উক্তি আমার লেখাকে আরো উজ্জীবিত করলো। ভালো থেকো। তোমার জন্য রইলো অনেক শুভেচ্ছা।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি