হলদে টিকিটের শ্রদ্ধার্ঘ্য


হলদে টিকিটের শ্রদ্ধার্ঘ্য


গরমের ছুটিটা বেশ মজা করে জাঁকিয়ে কাটানো যাবে ভেবে মনটা চাঙ্গা হয়ে উঠেছিলো সকাল থেকে তার আগে বাবার হাত ধরে বাজার করতে যাওয়া কিন্তু একি গঙ্গার ধারে এই বিশাল প্যান্ডেল...কি হবে এখানে? কেউ একজন সাইকেলে চড়ে যেতে যেতে বলে গেল মাষ্টারমশাই...বালীতে ফিল্ম উতসব হচ্ছে গো...

ফিল্ম উতসব কি বাবা?

যেখানে অনেক ভালো ছবি একসঙ্গে দেখানো হয়...ছবি নিয়ে সবাই আলোচনা করেন...মশগুল হয়ে থাকেন কয়েকটা দিন

আমরা মুশগুল হব না?

বাবা হাসেন, কোনো জবাব দেন না আমরা এগিয়ে যাই প্যান্ডেলের দিকে অনেক পোষ্টারের সাথে একটা পোষ্টার আমার চোখকে টানে সবে শেখা বর্ণমালার অক্ষরজ্ঞান কাজে লেগে যায় বানান করে পড়তে শুরু করি আ...কা...লে...র স...ন...ধা...নে এক মহিলা মাথায় পুঁটুলি, ঘোমটার খুঁটটা দাঁত দিয়ে চাপা, মুখে কষ্ট...মায়ের মতোই কপালের সিঁদুরটা তেলতেলে ল্যাপটানো আশির দশকের গোড়ায় সেই প্রথম আমার স্মিতা পাতিলকে দেখা (ছবির নায়িকা)...মৃণাল সেন নামটা মনের কোথাও ঝুলতে থাকা...পরিচিত হওয়া কতকগুলো শব্দের সাথ... ফিল্ম উতসব...ভালো ছবি...আর্ট ফিল্ম বাজার ফিরতি পথে পুঁইশাক, চিংড়ি, চৌসা আমের বাজার ভর্তি ব্যাগের সাথে সাতটা হলদে টিকিট আজ ফিল্ম উতসব, মশগুল হওয়ার দিন


একি ছবির মধ্যেই ছবি তৈরীর গল্প হ্যাঁ ঠিক এই ভাবে গাছের তলায় এসে দাঁড়ান স্মিতা আঁচলের খুঁটটাকে দাঁতে চেপে ধরুন...ফিরে তাকান একবার আপনার গ্রামের দিকে...ঠিক ওখানে আর কোনো দিন...আর কোনো দিন ফিরে যেতে পারবেন না... কেঁদে ওঠেন পর্দার স্মিতা পর্দার পরিচালক কাট বলেন ফিরে দেখি পাশে বসা পিসির চোখে জল...ও বাড়ির হাবুলের বাবা হাউ হাউ করে কাঁদছে মন্বন্তরের গল্প শুনতে বসে দেশ ছাড়া ভিটে ছাড়া মানুষ গুলোর চোখে বেদনার ধারা পরের কদিন পাড়ার সবার মুখে গানটা ফিরে ফিরে ঘুরলো হেই সামালো ধান হো...কাস্তেটা দাও শান হো...জান কবুল আর মান কবুল...



একেই কি ভালো ছবি বলে বাবা?

প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক সেদিন আমাকে কোনো জবাব দেন নি। এর অনেক পরে যখন সিদ্ধান্ত নিলাম ছবি নিয়ে পড়াশুনো করবো তখনো বাবা কোনো বাধা দেন নি। কিছু বলেন নি। বন্ধুবান্ধব আত্মীয়-স্বজনরা বারবার ভেবে দেখতে বলেছিলো, ওটা আমদের লাইন নয়। আমি তখন বে-লাইন হওয়ার মতলবে। আমি তখন ভালো ছবির উতস সন্ধানে।


আমার কোনো তথ্যচিত্র...প্রথম চিত্রনাট্য লেখা ছবির মুক্তি কিছুই বাবা দেখে যেতে পারেন নি। তারো অনেক আগে...অনেক আগে... শীতের এক দুপুরে বাবা তার কলাপোতার স্মৃতি জড়ানো চোখ বন্ধ করে পৃথিবী থেকে সরে গেছেন। কিন্তু কোথাও রেখে গেছেন গরমের এক ছুটির সকাল... ফিল্ম উতসব...ভালোলাগা ছবি...।

এরপর অনেক বার অনেক অনুষ্ঠানে খুব কাছ থেকে দেখেছি মৃণাল সেনকে। শুনেছি তাঁর অন্তরঙ্গ আড্ডা। কিন্তু কখোনো বলতে পারিনি এক সকালে পুঁই শাক, চিংড়ির সাথে গোটা সাতেক হলুদ রঙের টিকিটের কথা। বলতে পারিনি হাবুলের বাবার হাউহাউ কান্না...পিসির বিষাদ...।

বলতে পারিনি কারণ এটাই হয়তো বলতে না পারার ভালো লাগা।

এটাই হয়তো আজ তাঁর সাতাশির জন্মদিনে আমার তরফ থেকে তাঁকে দেওয়া হলদে টিকিটের শ্রদ্ধার্ঘ্য।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি