বিভূতিভূষণের চলচ্চিত্র চিন্তা

বিভূতিভূষণের চলচ্চিত্র চিন্তা
(Bibhutibhushaner chalochitra chinta)

এক

অতীত ও ভবিষ্যত দুই প্রান্তে পা মাথা শয়ান
তোমার এখানে দেশ,অতীত অদৃষ্ট জলদাম

এখানে তোমার মাটি দেশ- জয় গোস্বামী

বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়ের জন্ম শতবর্ষ অতিক্রান্ত হয়েছে বেশ কয়েক বছর হল তাঁকে নিয়ে লেখালেখি, বই প্রকাশ, সেমিনারের ভারও নেহাত কম নয় তবে বেশ কিছুদিন শুরু হয়েছে নিস্তব্ধতার জাল বোনা কিছুটা হলেও দমে গেছে আমাদের মারাত্মক সাংস্কৃতিক বহুলতার জোয়ার কোনো সমালোচনা নয়-এ যেন নিজেকে আয়নার সামনে বারবার দেখা যখন সম্পাদকের কাছ থেকে আর্জি এলো বিভূতিভূষণকে এক অন্য দৃষ্টিভঙ্গীতে দেখার, বিচার বিশ্লেষণ করার তখন বেশ কিছুটা ভয় নিজেকে গুটিয়ে রাখার মন্ত্রণা দিল কিন্তু যতই ওল্টাতে থাকলাম অপ্রকাশিত দিনলিপির পাতা গুলো ততই এক অন্য বিভূতিভূষণের সাথে পরিচিত হতে থাকলাম এই বিভূতিভূষণ একজন চলচ্চিত্র প্রেমিক যিনি নিজেকে সমৃদ্ধ করতে চেষ্টা করেছিলেন শিল্প মাধ্যমের নানা বিষয়ে চর্চ্চা করে ১৯৩২ সালে অপরাজিত শেষ করার সময় ভেবেছিলেন, “সাধনা ভিন্ন উচ্চ out look কি করে develop করবে? খানিকটা মাত্র আমার করেছে...আরও চাই...আরও অনেক চাই” এই অঙ্গীকার যেন বিভূতিভূষণের প্রাত্যহিকতায় মিশে থাকে দেশী-বিদেশী মূল্যবান লেখাগুলো যেমন বাদ পড়ে না তেমনই সেই সময়ে তাঁর বায়োস্কোপ দেখার বহরে বিস্ময় প্রকাশ করতে হয় আমরা তিরিশের দশকটিকে আলোচনার মধ্যমণি করতে চাই কারণ এই সময়ে দিনলিপির পাতায় ব্যস্তসমস্ত লেখকের চলচ্চিত্র চিন্তার রূপটি প্রত্যক্ষ না হলেও পরোক্ষভাবে ধরা পড়ে একদিকে শিক্ষকতা, বঙ্গশ্রীতে বন্ধুদের সাথে আড্ডা, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে পড়াশুনো, বেড়াতে যাওয়া, নিয়মিত লেখা তারই সাথে থিয়েটার আর সিনেমা দেখা আর এক অন্য বিভূতিভূষণ


বিভূতি জীবনের যে সময় পরিধির মধ্যে দিয়ে আমরা ছুটে চলেছি অতীতে, তার অনেকখানি জুড়ে রয়েছে কলকাতা ৪৩ নম্বর মির্জাপুর স্ট্রীটের এক হোটেলে তাঁর আস্তানা সামনে দিয়ে বয়ে চলেছে ব্যস্ত জীবনের মিছিল, আছড়ে পড়ছে শব্দ স্রোত তবু তাঁর ভালো লাগে মির্জাপুর এই ইঁট-কাঠ-পাথর বেষ্টিত সার্থান্ধ মানুষের শহরের আগে ugly বিশেষণ বসিয়েও তিনি অভিভূত হয়ে যান এর বিরাটত্বে দৃষ্টিপ্রদীপ কিম্বা আরণ্যকের মতো উপন্যাস, অসংখ্য প্রথম সারির ছোট গল্প নির্মাণ হতে থাকে এই গোটা তিনের দশক জুড়ে বিচিত্র এই জগতের রূপ-রঙ-গন্ধ-স্পর্শ যে তিনি উপভোগ করছিলেন তার বহিঃপ্রকাশ ঘটে ১৯৩৪ সালের ১৬ মার্চের দিনলিপির পাতায়, “মহলে গেলুম-আমি, শৈলজা, প্রেমেন, নৃপেন, সজনী সেখানে সুধীর চৌধুরীর সাথে দেখা সে বললে বেশ উপন্যাস হচ্ছে সবাই ভালো বলেচে, নৃপেণও বললে বসে বসে ভাবছিলুম দেখতে দেখতে, এই আলোকোজ্জ্বল কক্ষে বায়োস্কোপ দেখছি বন্ধুদের সাথে-আমিই কিছুকাল আগে সিদ্ধেশ্বর ডুংরির মাথায় ঘন বনের মধ্যে বসে পাহাড়ী চিহড় ফল কুড়িয়ে খেয়েছিলুম জীবনের এই প্রসারতা ও বিস্তৃতিই আমি চাই


দিনলিপিতে ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে আরও ছবি দেখার খবর কিন্তু সময়ের সাথে সাথে ছবি দেখার সংখ্যাও কমে গেছে গ্রিফিথ, রিচার্ড বলেসলস্কি,সিসিল-বি-ডিমিল, রুবেন মামোলিন, কিং ভিডর চলচ্চিত্রের এইসব বিখ্যাত ব্যক্তিদের ছবি দেখেছিলেন বিভূতিভূষণ সেকালের নামকরা ছবি রূপলেখাও দেখেন, দেখান খুকুকে এই ছবিটি দেখার সঙ্গী ছিলেন সস্ত্রীক নীরদচন্দ্র চৌধুরী বিভূতিভূষণের আত্মীয় চন্ডীদাস চট্টোপাধ্যায় তাঁর পথের পাঁচালীর নেপথ্য কাহিনীতে লিখেছেন, “মাঝে মাঝে তাঁর সঙ্গে বেশ কয়েকবার ব্যারাকপুর ও কলকাতায় সিনেমা দেখতে গিয়েছি, দেখেছি চলচ্চিত্র তিনি খুব ভালো বুঝতেন এ বিষয়ে তাঁর পড়াশুনোও যথেষ্ট ছিল” এইসব উল্লেখের সূত্রে চলচ্চিত্রের একজন অনুরাগী হিসেবে তাঁকে চিনতে অসুবিধে হয় না অতীত ও ভবিষ্যতের মধ্যবর্তী পর্যায়ে দোদুল্যমান অবস্থায় আমরা সেই ‘জীবনের প্রসারতা ও বিস্তৃতি’র অন্বেষণে সচেষ্ট হই যার মধ্যে প্রচ্ছন্ন অবস্থায় থেকে যায় এক নবাঙ্কুরিত শিল্প মাধ্যমকে ভালোবাসার প্রচেষ্টা ক্রমে ক্রমে জানতে পারা যাবে এই নতুন শিল্প মাধ্যমকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার পিছনে তাঁর প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষ সহযোগিতার কথা



দুই
“সে তো কলকাতায় আসিয়াছে-মিউজিয়াম, গড়ের মাঠ দেখিতে পাইবে তো? বায়োস্কোপ দেখিবে-এখানে খুব বড় বায়োস্কোপ আছে সে জানে তাহাদের দেওয়ানপুরের স্কুলে একবার একটা ভ্রমণকারী বায়োস্কোপের দল গিয়েছিল, তাহাতেই সে জানে বায়োস্কোপ কি অদ্ভুত দেখিতে তবে এখানে নাকি বায়োস্কোপে গল্পের বই দেখায় সেখানে তাহা ছিল না-রেলগাড়ি দৌড়াইতেছে, একটা লোক হাত পা নাড়িয়া মুখভঙ্গী করিয়া লোক হাসাইতেছে, এইসব এখানে বায়োস্কোপে গল্পের বই দেখিতে চায় অনিলবাবুকে জিজ্ঞাসা করিল, বায়োস্কোপ যেখানে হয়, এখান থেকে কত দূর?”
অপারিজত (Aporajito)


এক অপরিচিত শহরে পা রাখবার পরেই অপু এই সমস্ত কথা ভাবতে পেরেছিলো বিভূতিভূষণ অপুকে এইসব ভাবিয়ে ছিলেন তিনি নিজে প্রথম সিনেমা দেখেন ১৯১২ সালে সে সময়ে তিনি স্কুলের ছাত্র “জীবনে প্রথম বায়োস্কোপ দেখলুম” এইভাবে উল্লেখ করেছেন দিনলিপিতে ছবি দেখার এইরকম উল্লেখ হয়তো আরও কয়েকটি গল্প বা উপন্যাসে পাওয়া যেতে পারে বিশেষ করে তাঁর প্রবন্ধেও এরকম উল্লেখ পাওয়া গেছে ‘সাহিত্যের কথা’ শীর্ষক প্রবন্ধটিতে তিনি আলোচনা করেছিলেন-সাহিত্য কেন, সাহিত্য কাদের জন্য, কেমন হবে সাহিত্যের বুনোট, সে কোন কথা বলবে ইত্যাদি এইভাবে ধাপে ধাপে এগোতে গিয়ে তিনি পৌঁছে গেছেন স্থায়িত্বের সংকটে লিখেছেন, “ কেউ বাঁচেনি, বড় বড় নাম ওয়ালা কথা সাহিত্যিক তলিয়ে গেছেন কালের ঘূর্ণিপাকের তলায়...সেই যুগের প্রয়োজন শেষ হয়ে গেলে পরবর্তী যুগের লোকেরা ধুলো ঝেড়ে ছেঁড়া পাতা গুলো উদ্ধার করবার কষ্টও স্বীকার করবেন না...ফিল্ম না উঠলে অনেকের উপন্যাস কি নিয়ে লেখা তাই লোকে জানতো না নামটাই থেকে যায় লেখকের, তাঁর রচনা আধমরা অবস্থায় থাকে অনেক ক্ষেত্রে মরে ভূত হয়ে যায়


উদ্ধৃতিটি সংশয়ের সৃষ্টি করে
কয়েকটি প্রশ্ন উঠে আসে মনে-

একঃ- ভাষার সীমাবদ্ধতা যদি মেনে নিই, তাহলে সাহিত্যের যতই সার্বজনীন আবেদন থাকুক না কেন তা বিশ্বের দরবারে সর্বগ্রাহ্য হতে পারে না

দুইঃ- কাহিনীর দৃশ্যগ্রাহ্যতা চলচ্চিত্রে এই সীমারেখা বা ভেদ রেখা মুছে দেয় ফলে বহু মানুষের মধ্যে পরিচিতি ঘটায় এই চলচ্চিত্র

তিনঃ- আবার তিনি শেষে যে মন্তব্যটি জুড়ে দিয়েছেন, রচনার ‘আধমরা অবস্থার’ কথা বলেছেন-এই ধ্বংস চিত্র কি তাঁর চলচ্চিত্র ভাবনারই অন্তর্গত নয়? যেখানে চলচ্চিত্রও শেষ পর্যন্ত মহত সাহিত্যকে বাঁচাতে পারেনা! বরং অন্য এক পন্থায় তাকে ঠেলে দেয় চরম অবলুপ্তির দিকে


মনে ক্রমশ সন্দেহের বীজ দানা বাঁধতে থাকে
এত স্বচ্ছ ধারনার বশবর্তী হয়েও বিভূতিভূষণের কি কোনো দিনও মনে হয়নি যে তাঁর উপন্যাস বা গল্প নিয়ে ছবি হতে পারে একথা ভাবলে অবাক হতে হয় যে দম্পতি উপন্যাসটি চলচ্চিত্রায়ণের জন্য রচিত হয়েছিল ১৯৪০ সালে অনুসন্ধান নামের ছোট গল্পটাও সেই উদ্দেশ্যেই রচিত হয়েছিল দম্পতি উপন্যাসটি পড়লে বোঝা যায় যে বাংলা ছবির জগতের অনেক অজানা খবর জানা ছিল তাঁর বিশেষ করে রূপালী জগতের মোহ যার ফঁদে পড়েছিলো দম্পতির পাড়াগাঁয়ের নায়ক পাটের আড়তদার গদাধর কাহিনী হিসেবে হয়তো অসামান্য কিছু নয়, কিন্তু ডিটেলের গুণে তা হয়ে উঠেছে লেখকের অভিজ্ঞতার সারতসার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে হলেও সত্যজিত রায় বলেছিলেন, “বাংলা ছবির উপাদান কি হওয়া উচিত সে সম্বন্ধে তখনকার সাহিত্যিকদের ধারণার স্পষ্ট ইঙ্গিত এই উপন্যাসে পাওয়া যায়


১৯৪৭ সালে চিত্ররূপা লিমিটেডের কাছ থেকে খবর আসে তারা অনুবর্তন উপন্যাসের ছবি বানাতে চায়
দেবকী বসু তাই বিভূতিভূষণকে সপ্তাহ দুয়েক কলকাতায় থাকার প্রস্তুতি নিয়ে আসতে বলেছেন অনুবর্তন অবশ্য শেষ পর্যন্ত ছবি হয়নি এরপরেও ১৯৫০ সালের মে মাসে কেদার রাজা উপন্যাসের ছবি করার প্রস্তাব এসেছিল কিন্তু শেষ পর্যন্ত তা হয়নি তবুও “তাঁর গল্পের ছবি হোক-এমন ইচ্ছে তিনি কোনোদিন মুখ ফুটে বন্ধুদের কাছেও বলতে পারতেন না...আত্মীয় বান্ধবদের মধ্যে যদি কখোনো কেউ বলতেন, এই যে বিভূতিবাবু অমুকের ছবি হলো, কই আপনার তো ছবি হোল না? বিভূতিভূষণ বিরক্ত হতেন স্পষ্ট বোঝা যেত ...বলতে শুনেছি, দেখুন আমার দ্বারা বই কোলে করে টালিগঞ্জের স্টুডিওতে স্টুডিওতে ঘোরা সম্ভব নয়” স্মৃতিচারণ করেছেন চন্ডীদাস চট্টোপাধ্যায় স্ত্রী সুপ্রভাকে মাঝে মাঝে আক্ষেপ করে বলতেন, “আমি যে সিনেমা হবে ভেবে কিছু লিখতে পারি নে, আর পথের পাঁচালী তো কেউ আর ছবি করবে না” এই আক্ষেপের সুরে হয়তো কিছুটা নিহিত ছিল দুঃখ আর অভিমান কিন্তু ১৯৪৪ সালে আম আটির ভেঁপু’র সচিত্র সংস্করণ করতে গিয়ে ডি জে কীমার কোম্পানীর তরুণ কমার্শিয়াল আর্টিস্ট সত্যজিত রায়ের (Satyajit Roy) মনে পথের পাঁচালী (Pather Panchali) সম্বন্ধে যে আগ্রহ, যে প্রেরণা সৃষ্টি হয়েছিলো তার হদিস বিভূতিভূষণের কাছে ছিলো না সে আগ্রহের পরিণাম যে বিশ্বজোড়া খ্যাতি এনেছিল, বিভূতিভূষণ তা দেখে যাননি (চলবে)

মন্তব্যসমূহ

  1. Ei artcle er bishoybostu onyo swader. bhalo laglo pore. porer kistir opekkhay roilam.

    Banglay lekhar chesta korechilam, kintu kichu shobdo thikthak type hochche na. ogotya English font!!

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি