Kannathil Muthamittal
কান্নাথিল মু্থামিত্তল (A peck on the cheek)
গত কয়েক দিন ধরে খবরের কাগজে যতবার শ্রীলঙ্কায় সেনা অভিযানের কথা পড়ছি...দেখছি শরণার্থী শিবির গুলোর অবস্থা ততই আমার মনে পড়ে যাচ্ছে কয়েক বছর আগে দেখা একটা তামিল ছবির কথা। বারবার মনে পড়ছে ছবিটা এই কয়েক দিনে। বার বার ফিরে তাকিয়েছি ছবিটির দিকে তারপর পূর্বাশার কাছ থেকে পেয়েছি ছবিটা এবং আরো একবার দেখেছি এই পরিস্থিতিতে বসে Kannathil Muthamittal কে।
ভারতীয় পরিচালক মনি রত্নম(Mani Ratnam)এই ছবিটি নির্মাণ করেন ২০০২ সালে।
শ্রীলঙ্কার গ্রামে এই গল্পের শুরু। সেখানে গ্রামের মেয়ে শ্যামার সাথে বিয়ে হয় দিলীপানের। দিলীপান শ্রীলঙ্কায় তামিল টাইগার বাহিনীর সাথে যুক্ত। বিয়ের কিছু দিন পরেই দিলীপানকে চলে যেতে হয় কারণ ততক্ষণে গ্রামে ঢুকে পড়েছে শ্রীলঙ্কার মিলিটারী বাহিনী। কিছুদিনের মধ্যে শ্যামাকেও তার এই গ্রাম ছাড়তে হয়। উদ্বাস্তু হতে হয় তাকে। অন্তস্বত্ত্বা শ্যামা তখন কোথায় যাবে? ভারতের রামেশ্বরমের সমুদ্র উপকূলবর্তী এক উদ্বাস্তু শিবিরে শ্যামা তার কন্যা সন্তান প্রসব করে। এবং কিছুদিনের মধ্যে সে সেখান থেকে চলে যায়। থেকে যায় তার নাম, পরিচয় আর বাচ্চা মেয়েটা।
ঠিক এর ন বছর পরে চেন্নাইয়ের একটা দুরন্ত মেয়ে আমুদাকে দেখি সে তার বাড়ির সবার সাথে দর্শকদের পরিচয় করাচ্ছে। সে চিনিয়ে দিচ্ছে আমাদের তার খুব ট্যালেন্টেড, অল্পেতে রেগে যাওয়া পেশায় ইঞ্জিনিয়ার কিন্তু নেশায় সফল সাহিত্যিক এক বাবার সাথে। টিভির ঘোষিকা মায়ের সাথে...তার দুই ভাই... দাদু...আর পিসির সাথে। তার প্রচন্ড দুষ্টুমিতে আর নানা কার্যকলাপে যখন সবাই খুবই নাস্তানাবুদ...এ আর রহমানের নিজের মাতৃভাষার সুর যখন দর্শককে মোহিত করে দিচ্ছে ঠিক সেই সময় এসে পড়ে আমুদার ন বছরের জন্ম দিন। আমুদার মা তার বাবাকে মনে করিয়ে দেয় সে কথা দিয়েছিলো যে আমুদাকে সত্যি বলবে। কি সেই সত্যি?
আমুদা তাদের মেয়ে নয়। তার দুই ভাইয়ের মতো সে তার মায়ের পেটে জন্ম নেয়নি। আমুদা তাদের পালিত কন্যা। ছবিটার মোড় এর পর থেকে ঘোরে। যে মেয়েটার দাপটে বাড়ির সবাই অতিষ্ঠ...স্কুলের সবাই পাগল...সেই মেয়েটা কেমন যেন হয়ে যায়...চুপ। দু বার বাড়ি থেকে পালাতে যায়। সে খুঁজবে তার আসল মাকে। বাড়ি থেকে পালিয়ে রামেশ্বরমের সেই সমুদ্র উপকূলে আমুদাকে খুঁজে পাবার পর তার বাবা-মা কথা দেয় আমুদার জন্মদাত্রী মা শ্যামাকে তারা খুঁজে বের করবে।
এরপর শুরু হয় একটা জার্নি। মনিরত্নমের ছবির যা এক অত্যাশ্চর্য বৈশিষ্ট্য। ভারত থেকে শ্রীলঙ্কা। আপাত শান্তির চেন্নাইয়ের সি-বিচ ছেড়ে এক হাড় হিম করা রক্তাক্ত পরিবেশে গিয়ে পড়া। সেখানে তো তখন যুদ্ধ পরিস্থিতি। এলটিটি দের সাথে সংঘর্ষ চলছে সেনা বাহিনীর। আমুদা গিয়ে সেখানে কি দেখে? আমুদা দেখে গ্রাম থেকে লোকেরা দল বেঁধে পালাচ্ছে শরণার্থী শিবিরের দিকে। মুহুর্মুহু এসে পড়ছে বোমা...ছিন্ন ভিন্ন মানুষের দেহ। কোথায় তার মা শ্যামা? একজনকে পাওয়া যায়। কিন্তু সে তো কোনোদিন এই গ্রাম ছেড়ে বেরোয়নি...সে তো ন বছর আগে ভারতের কোনো উদ্বাস্তু শিবিরে কন্যা সন্তানের জন্ম দেয়নি। সে তো এই মাত্র তার নিজের মেয়ের মৃতদেহ ওই গাছটার তলায় কবর দিয়ে জীবনের শেষ বারের মতো এই গ্রামটা ছেড়ে চলে যাচ্ছে। আর কোনো দিন হয়তো তার এই ভিটেয় ফেরা হবে না।
এই দৃশ্যের রূপায়ণের চমতকারিত্ত্বে মনিরত্নম ছুঁয়ে যান সবার মন। বৃষ্টি নামে পর্দার ভিতরে আর বাইরে দর্শকের চোখে। শেষ পর্যন্ত আমুদার সাথে তার মার দেখা হয়। কিভাবে হয়, কেমন করে হয় সেটা জানতে ছবিটা দেখতে হবে। ছবিটা দেখা দরকার অন্তত এই সময়ে দাঁড়িয়ে।
এখন আমাদের দেশে ভোটের দামামা। খবরের কাগজের বেশিরভাগ পাতা গুলো ভরে আছে নির্বাচনী সংবাদে। কিন্তু তার মধ্যেও ছোট্ট করে সংবাদটা চোখ এড়ালো না। “এক লক্ষ শরণার্থীর অন্ন বস্ত্রের ব্যবস্থা করাটা এখন আর এক মাথা ব্যাথা হয়ে দাঁড়িয়েছে শ্রীলঙ্কা সরকারের। সেনা সূত্রে পাওয়া ছবিতে দেখা গিয়েছে, শরনার্থী শিবিরের ঘেঁষাঘেষি ত্রিপল ঢাকা কুঁড়ে ঘরের চারপাশে শুধু কালো মাথার ভিড়। কেউ খাবারের আশায় ঠায় দাঁড়িয়ে, কেউ আবার কোমরজল ঠেলে ডাঙায় উঠতে ব্যস্ত। এরই মাঝে জন্ম নিচ্ছে শিশু। এ দিকে রেড ক্রস অভিযোগ করছে, যুদ্ধ বন্ধ না হওয়ায় তাদের পক্ষে উদ্ধার কাজ চালানো দুষ্কর হয়ে পড়েছে। নৌকা করে শরণার্থীদের সরিয়ে আনা যাচ্ছে না, প্রয়োজনীয় ত্রাণও পাঠানো যাচ্ছে না।”(আনন্দবাজার পত্রিকা,২৪ এপ্রিল, ২০০৯)
আমার মনে পড়ে এক শীতের সন্ধ্যা। কলকাতা চলচ্চিত্র উতসবের মঞ্চে দাঁড়িয়ে তার সদ্য শেষ হওয়া এই ছবিটা নিয়ে বলছিলেন মনিরত্নম। বলছিলেন একদিন সকালে খবরের কাগজে ছোট্ট একটা খবর দেখে তাঁর এই ছবির গল্পটা মাথায় আসে। তিনি ভাবনা চিন্তা শুরু করেন। তার ফলে আমরা পাই এমন সুন্দর ছিমছাম এক ছবি। মনিরত্নম এমন এক পরিচালক যাঁর ছবিতে সম সময় উঠে আসে প্রখর ভাবে। তা সে কাশ্মীর সমস্যার প্রেক্ষাপটে রোজা-ই হোক কিম্বা বাবরি মসজিদ ভাঙার বিরুদ্ধে তাঁর সোচ্চার ছবি বোম্বে। সহজ সরল গল্প বলার ভঙ্গি আর বিষয় চয়ণ তাঁকে ভারতীয় চলচ্চিত্রের অগ্রগণ্য পরিচালকদের মধ্যে স্থান দিয়েছে। আজ এই মুহুর্তে শ্রীলঙ্কা অশান্ত। শরণার্থী শিবির গুলোর অবস্থা ভয়াবহ। সেখানে অর্ধাহারে অনাহারে জন্ম নিচ্ছে অসংখ্য আমুদা। কিন্তু তারা সবাইকি চেন্নাইয়ের সেই বিলাসবহুল ফ্ল্যাটে থাকার সু্যোগ পাবে? এর উত্তর পরিচালক নিজেই দিয়েছেন এক অসাধারণ দৃশ্য ভাবনায়। আমুদা শ্রীলঙ্কায় নিজেই বাড়ি থেকে বেড়িয়ে পড়ে। নিজের মনে। মায়ের সাথে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছে। আসল মাকে খোঁজাটাই তার কাছে মুখ্য উদ্দেশ্য। বাড়ির পাশেই জঙ্গল...সেখানে আমুদা আপন মনে ঘুরে বেড়ায় আর হঠাতই সেই বন জঙ্গলের...গাছপালার ভেতর থেকে বেরিয়ে আসে তারই বয়সী অনেক ছেলে মেয়ে...যাদের হাতে উন্নত মানের আগ্নেয় অস্ত্র। যারা আমুদার বয়সী হলেও আমুদার মতো নয়। আমুদা এদের দেখে ভয় পায়। ছুটে চলে যায় বাড়ি। মায়ের কোলে মুখ গুঁজে কাঁদে...তখন তার মনে থাকে না কয়েকদিন রাগ করে মার সাথে কথা না বলার ঘটনা। তার জানা থাকে না যাদের সাথে গাছের অন্তরালে দেখা হল তাদের বেশিরভাগেরই বাবা মা নেই...তারা ওই বয়সেই সমাজের চোখে, রাষ্ট্রের চোখে জঙ্গী। যাদের বারবার থেকে যেতে হবে লোক চক্ষুর আড়ালে...জঙ্গলের গভীরে...যাদের শৈশবটা নষ্ট হওয়া শৈশব। যাদের কথা বলতে বসে আমুদাকে আনতে হয়...শরণার্থী শিবির দেখাতে হয়...। আর নৈরাশ্যের মধ্যে না ডুবে তাই হয়তো আমুদা তার মাকে খুঁজে পায়। তার ঠোঁটের কোণে হাসি ফোটে। তার গালটা বাড়িয়ে দেয় মায়ের গালের দিকে। একটা মিষ্টি ভালোবাসার রেশ থেকে যায় গোটা ছবিটা জুড়ে। এই ভালোবাসা নেমে আসুক পৃথিবীর সব শরণার্থী শিবির গুলোতে...নেমে আসুক মানবতা...সব আমুদা ফিরে পাক তার নিজের মাকে। বিশ্বের সবাই অন্তত পাক অন্ন-বস্ত্র-বাসস্থানের প্রাথমিক অধিকারটুকু।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন