মন কেমন করা ছবি

মন কেমন করা ছবি

কোনো একটা ছবি দেখে কি আপনার কোনো দিন মন কেমন করেছে?

বারবার ফিরে ফিরে এসেছে মনে...সারাদিন...কাজের মাঝে...শুতে যাবার সময়...কিম্বা হঠাতই ভোররাতে ঘুম ভেঙে গিয়ে...

উত্তর হতে পারে হ্যাঁ কিম্বা না

অথবা শুধুই তাকিয়ে থাকতে পারেন নিজের দিকে...

কিম্বা অসীম শূন্যতায় হাতড়াতে পারেন কিছু স্মৃতি...

কিছু ভুলে যাওয়া মুহূর্ত...

মন কেমন করা অনুষঙ্গ...

ঠিক যেমন এখন আমার হচ্ছে

আমি মনে করার চেষ্টা করছি ঠিক কতদিন আগে আমি একটা গোটা বই পড়েছি... ঠিক কতদিন আগে কোনো একটা ছবি দেখে বাইরে এসে চুপ করে বসে থেকেছি শাদা পর্দা থেকে ছুটে আসা বৃষ্টি এসে ভিজিয়ে দিয়েছে আমায়...

ঠিক কত দিন আগে...?
জনে জনে জানিয়েছি বন্ধুদের ছবিটার কথা...তর্কে মেতেছি...আবার বছর কয়েক পর ছবিটা ফিরে দেখতে গিয়ে মন কেমন করে উঠেছে... যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচিত্র বিদ্যাবিভাগের ক্লাস থেকে ছুটে চলে যেতে ইচ্ছে করেছে মায়ের কাছে...

ঠিক কত দিন আগে?



আমি দেখছি সর্বজয়া ক্রমে দূরে, দূরে সরে যাচ্ছেন অপুর থেকে...আমি দেখছি তাঁর একাকিত্ত্ব...তাঁর ভেঙে পড়া...অনুষঙ্গ গুলোকে নিয়ে বাঁচার তীব্র আর্তি...তাঁর মৃত্যু এক অজানা পথে পাড়ি দিচ্ছে অপু...ফেলে আসছে তার শৈশব...কৈশোর...তার শেষ স্মৃতিটুকু শেষ হচ্ছে অপরাজিত


ঠিক এরও আগে... অনেক অনেক আগে...কোনো এক সন্ধ্যেবেলা বাড়ির সবাই সেজে গুজে ট্যালকম পাওডার মেখে কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতিতে...

কোথায় যাচ্ছ মা?

বই দেখতে

আমি যাবো না?

নিশ্চই যাবে

মাঠে বড় শাদা পর্দা টাঙানো প্রজেক্টার মেশিনের কাকু বিড়িতে টান মেরে রিল গোটানোতে ব্যস্ত...চারিদিকে ফিসফিস গুঞ্জন... কি বই হবে রে?

এমা তাও জানো না...পথের পাঁচালী...


বাড়িতে তো মা লক্ষ্মীর পাঁচালী পড়ে ধুর বোকা চুপ করে যা...দাদা চিমটি কাটে তার জ্বালায় আমি চিতকার জুড়ে দিই কিন্তু হঠাতই আমাকে থামতে হয় কারণ ততক্ষণে শুরু হয়ে গেছে এক বাচ্চা মেয়ের দৌরাত্মি...তার পিসির সঙ্গ...তার মায়ের দুঃখের সংসার...তার বাবার স্বপ্ন...তার ভাইয়ের অবাক বিস্ময়ে তাকিয়ে থাকা...


গোটা পাড়ার সাথে আমি গিলতে থাকি একটা গোটা ছবিকে...নিশ্চিন্দিপুরকে...অপুকে...দুর্গাকে...ইন্দিরঠাকরুনকে...সর্বজয়াকে... হরিহরকে...তাদের বেঁচে থাকার নিদারুন আকাঙ্খাকে

ভালো লেগে যায় অপুকে...তার দিদি দুর্গাকে... লেবু পাতায় করমচা...যা বৃষ্টি থেমে যা...

পুজোর সময় বাবা কিনে দেন আম আঁটির ভেঁপু

আমি আর দাদা দারুন খুশি

সপ্তমী...অষ্টমী...নবমী...দশমী...শুধু ঘিরে থাকে আমাদের নিশ্চিন্দিপুর...


জন্মাষ্টমীর যাত্রায় কিম্বা মামার বাড়ির চন্ডীমন্ডপে আমি সেই বীর কর্ণ...যার রথের চাকা মাটিতে ঢুকে গেছে...চাইছে সামান্য সময় আর মৃত্যু এসে গ্রাস করছে আঁধার ধরণীকে অপু ভাবছে...আমি ভাবছি...দাদা ভাবছে...আর সময় চলে যাচ্ছে হু হু করে সেই ট্র্যাজিক নায়ক দেখছে একের পর এক মৃত্যু ইন্দির ঠাকরুনের তোবড়ানো ঘটি উলটে পড়ছে ঘোলা জ্বলে...এই প্রথম খুব কাছ থেকে লক্ষ্য করছে অপু এক বড় কঠিন নির্মম সত্যকে

আমিও দেখছি আমার পিসিকে...খুলনার কলাপোতার গল্প করতে করতে কাসুন্দি রোদে দিচ্ছে আমাদের বাসার দশ ফুট বাই দশ ফুটের উঠোনে...পিসির দুগাল বেয়ে নামছে করুণা ধারা...ওপার বাংলার গল্প ঘিরে ধরছে আমাকে...দাদাকে...

বাবা ছাতা নিয়ে স্কুলে বেরোচ্ছে আর বাড়ি ফিরছে রোজ জ্বর নিয়ে

ডাক্তারকাকু বলছে...একটু সাবধানে রাখুন...টিবি হয়েছে...একটু দুধ, ফল

ফল ছিলো আমাদের কলাপোতায়, বুঝলি...গাছে গাছে আম...গোয়াল ভরা গাই...হ্যারিকেনটা একটু বাড়িয়ে দিবি টুকনু... ঠাম্মার কথা মাঝ পথে থেমে যায়... ঝিমিয়ে পড়ে...চোখে ছানি রিলিফ ক্যাম্পে কাল নিয়ে যাবে দাদা

বাবা কাশছে লুকিয়ে...কাশির সাথে রক্ত...কাউকে দেখতে দেবে না...

আর আমি তখন শাদা পর্দায় দেখছি নীতাকে... তার রক্তমাখা রুমালকে...

আমি শুনছি যে রাতে মোর দুয়ার গুলি...

আমি এগিয়ে যাচ্ছি হসপিটালে বাবার বিছানার দিকে...

আমি দেখছি শাদা চাদর ঢাকা দেওয়া একটা দেহ...

আর শুনতে পাচ্ছি কেউ যেন বাবার কথাটা...পিসির কথাটা...ওভারল্যাপ করে বলে চলেছে... ঠিক ওইখানে...ওইখানে আমাদের দেশটা ভেঙে দু-টুকরো হয়ে গেছে... কোমলগান্ধার শেষ হচ্ছে এক মন কেমন করা বিকেলে

হরিহর যে স্বপ্নটা দেখতেন অপু সেটা কিছুটা বয়ে নিয়ে বেড়ায়...কিন্তু তার সাধ সে পূর্ণ করতে পারে কিনা সেটা সত্যজিত দেখান না এক অন্তহীন পথে বাবা আর ছেলের চলার দৃশ্যে শেষ হয় অপুর সংসার নীতা কিন্তু ফিরে আসতে পারে না তার সাধের সংসারে তাকে আমরা হারিয়ে ফেলি ৩৬০ ডিগ্রির এক পৃথিবী ব্যাপী প্যানে

আমিও হারাই আমার পিসিকে...বাবাকে...ঠাম্মাকে...খুলনার কলাপোতার কথা বলা লোক গুলোকে দেশের কথা বলতে গেলে যাদের চোখ চকচক করে উঠতো...পিসির গাল বেয়ে নামতো করুণাধারা...

এখন আমরা কাসুন্দি কিনে খাই

এখন আমরা চারতলার ওপরে সাড়ে নশো স্কয়ার ফিটের এক ফ্ল্যাটে থাকি

এখন আমি আমার কম্পিউটারে পথের পাঁচালী দেখি...

আর ঠিক তখনই কোথা থেকে ঝুপ করে আমার সামনে নেমে আসে সেদিনের সেই সন্ধ্যা...ট্যালকম পাওডারের গন্ধ...কাশ ফুলের মধ্যে দিয়ে ছুটতে ছুটতে রেল গাড়ি দেখা...জ্বরে কাঁপতে কাঁপতে একটা মেয়ের মরে যাওয়ার দৃশ্য


আমার ফ্ল্যাটে এবার সত্যি সত্যি সন্ধ্যা নামে আমি হাতড়ে হাতড়ে বাবার মুখটা মনে করার চেষ্টা করি...পিসির পান খাওয়া...ঠাম্মার আমসত্ত্ব...কাউকে খুঁজে পাইনা...আমি দিশাহারা...আমি কষ্টে

আর ঠিক তখনি আমার না খুঁজে পাওয়া পরিশ্রান্ত চোখ দুটোকে পিছন থেকে জড়িয়ে ধরে আমার চার বছরের ভাইঝি...

কাকা তুমি কিচ্ছু বোঝো না...কাকা তুমি ভারি ছেলে মানুষ...












মন্তব্যসমূহ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি