খলসী ফুলের গন্ধ
আজ সকালে ঘুম ভাঙলো কোকিলের কুহু কুহু ডাকে। বুঝতে পারলাম বসন্ত এসে গেছে। সকালের শির-শিরানি ঠান্ডা বাতাসটা কোথায় যেন ভ্যানিশ হয়ে গেল। হাড় কাঁপানো শীতের বুড়ি আমার দেশ ছাড়তেই কোথা থেকে একঝাঁক মিষ্টি তাজা আনন্দের হাওয়া আমার বাড়ির চারপাশে, গঙ্গার ঘাটে, রক্তকরবীর ডালে, নিমগাছের কচি পাতায় আর পাশের বাড়ির সিরাজুলের পরীক্ষার টেবিলে ঘুরপাক খেতে লাগলো।
আমার জানলার ধারে লাইট পোষ্টের তারের ওপর দুটো কাক বেশ কিছুদিন ধরে বাসা বাঁধছিলো। এবার দেখলাম তারা ডিম পেড়েছে আর মনের আনন্দে বসে বসে তা দিচ্ছে। পাঁচটা ডিম, অবশ্য তার মধ্যে কটা কোকিলের সেটা আমি জানি না। বেশি বলতেও চাইনা। ফস করে কাক গুলো যদি শুনে ফেলে।
স্নেহার অবশ্য এদিকে কোনো খেয়াল নেই। সে শুধু জানে অনেক দিন বন্ধ থাকার পর এবার তাদের সুইমিং ক্লাস আবার শুরু হবে। সকালবেলা ঘুম থেকে উঠে সাঁতার কাটতে তার বেশ ভালো লাগে।
কিন্তু পাখিরালা গ্রামের আনন্দির বেশ মন খারাপ। নৌকার ওপর চুপ করে বসে আছে। (ছবি)
কাল রাতেও তো বাঘের ডাক শুনেছে আনন্দি। জলে কুমীর ডাঙায় বাঘ,আরো কত বিপদ আছে জঙ্গলে সেসব জানে আনন্দি। বাবার মধু আনতে যাওয়া মানে মায়ের মুখভার, ঠাকুমার কান্নাকাটি। আর বাবা যতদিন না বাড়ি ফিরে আসছে ততদিন তার মা সূর্য ওঠার আগে রান্না করবে। সেই রান্না তারা সারাদিন ধরে খাবে। চুলে তেল দেবে না। মাছ-মাংস ছোঁবে না। আর সবসময় মনে মনে জঙ্গলের দেবী মা বনবিবি আর বাঘের দেবতা দক্ষিণ রায়কে স্মরণ করবে। বারবার প্রার্থনা করে বলবে তার বাবা আর গ্রামের সবাই যেন ভালোভাবে ফিরে আসতে পারে।
এই সময় সুন্দর বনের জঙ্গল আলো করে ফুটে থাকে হরেক রকমের ফুল। তার মধ্যে খলসী ফুলকেই সবচেয়ে ভালো লাগে আনন্দির।
এই ফুলের মধুর রঙ যেন গলানো সোনা। আর খেতে? এই মনখারাপের সময়েও যেন জিভে জল এলো আনন্দির। চটপট উঠে পড়লো বাড়ি ফিরে পড়তে বসতে হবে। কারণ বিকেলে সে বাবার সাথে হাটে যাবে পুজোর বাজার করতে।
আর সেটাই বিপত্তি ও ভয়ের কারণ। পালে পালে হাতি এই সময় গ্রামে ঢুকে পড়ে ভুট্টা খাওয়ার লোভে। তাদেরকে ভয় দেখিয়ে আবার জঙ্গলে পাঠেতে হয়। সেই কাজটা খুব একটা সুবিধের নয়। ক্ষেতের লাগোয়া জায়গায় বাঁশ দিয়ে উঁচু করে একটা ছাওনি করা হয়। যাকে বলা হয় মাঁচা। সেখান থেকে ক্ষেতের ওপর নজর রাখতে হয়।
ঠিক এরকমই এক বসন্তের সকালে পরিচয় হয়েছিলো অন্ধ গায়ক, তেরো বছরের বেচয়ানের সাথে। বিহারের সমস্তিপুরের নাম শুনেছো কি? সেই সমস্তিপুরের এক প্রত্যন্ত অঞ্চল মাইসট। সেই মাইসটের এক অনেক দূরের গ্রাম ঝারোলাটোলা। এই গ্রামেই বেচয়ান থাকে। গোটা গ্রামকে সে গান শোনায়। আর সবাই খুশি হয়ে যা দেয় তাই দিয়ে তার মা সংসার চালান। এই গ্রামের সবাই খুব গরীব। এতো গরীব গ্রাম আমি এর আগে দেখিনি। গ্রামের বেশির ভাগ পুরুষ কাজের সূত্রে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে থাকেন। আর হোলির সময় গ্রামে ফেরার চেষ্টা করেন। খুব মজা আর আনন্দে কাটে কয়েকদিন।
গ্রামের মধ্যে বেচয়ান এখনো পর্যন্ত বাইরে কাজ করতে যায় নি। তার বন্ধুরা সবাই চলে গেছে কেউ কলকাতায়, কেউ দিল্লী, কেউ মুম্বাই। তাদের সবার কাছে গল্প শুনে বেচয়ান ঠিক করলো সেও এবার কিছু একটা কাজ করবে। বন্ধুদের মতো রোজগার করবে। বোনের বিয়ে দেবে। ছট পুজোয় মাকে দেবে নতুন শাড়ি। গ্রামে তার ইজ্জত বেড়ে যাবে। বেচয়ান যখন আমাকে তার এই স্বপ্নের কথা বলছিলো তখন আমি মজা করে তার গল্প শুনছিলাম। আর ভুলেও গিয়েছিলাম। কাজের সুত্রে সেবার কয়েকদিন বেচয়ানদের গ্রামে থাকতেও হয়েছিলো। একদিন সকালে আমার ঘুম ভাঙলো কান্নাকাটির শব্দে। গ্রামের রাস্তায় একটা ছোটখাটো মিছিল। সেই মিছিলের
আমার শুধু অবাক হওয়ার পালা। কখোনো ভাবতে পারিনি যে বিহারের সেই ছোট্ট গ্রামের একরত্তি ছেলে মুখে যা বলে কাজেও সেটা করে দেখানোর সাহস রাখে। এই বেচয়ান সত্যি একদিন অনেক টাকা নিয়ে ফিরে আসবে। তার বোনকে বিয়ে দেবে। মাকে কিনে দেবে ছট পুজোয় শাড়ি। আর কখোনো কোনো বড় শহরের রাস্তায় যদি তোমার সাথে বেচয়ানের দেখা হয়ে যায় তাহলে সে তোমাকে শোনাবে তার গ্রামের কথা, সূর্যমুখী ক্ষেতের কথা। আর মন ভালো থাকলে হয়তো গাইবে কমলা নদীর সেই গানটা যেটা সে গুনগুন করে সব সময় গাইতো।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন