ঘুড়ি ওড়ানোর গল্প
আমাদের বড় হয়ে ওঠার দিন গুলোতে একটা আস্ত নদী ছিল। বেশ কয়েকটা পুকুর ছিল। ভোলাদার একটা বিশাল বড় গোয়াল ঘরসমেত এক গুচ্ছ গরু ছিল। চাঁপির খাটালে কালো কালো খুবই নিরীহ চেহারার মহিষ ছিল। ঝুলিদির বাড়িতে পোষা গোটা কয়েক বিচ্চু ছাগল ছিল। এছাড়াও গঙ্গার ধারে গুরুদ্বার, কাকেশ্বর তলার মা, দেড়শো বছরের পুরনো দাঁদের রাধারমণ জিউ, একটু দূরে বাদামতলায় মসজিদ, আরও একটু এগোলে দয়ার ঠাকুর, জীবে প্রেমের বানী শেখানো ঈশ্বর চুপটি করে বসে ছিলেন আর সবার দিকে মিটিমিটি চোখ দিয়ে নজর রাখছিলেন। এইসবের সঙ্গে ছিল লিলুয়ার বহু প্রাচীন রেল কলোনীর ঝিলের পাশে একটা ছোট্ট গির্জা। বহুপ্রাচীন কল্যানেশ্বর মন্দিরের লাগোয়া দেওয়ান গাজীর মাজার। কোন সাহেবের কোন কালে ফেলে যাওয়া এক বাগান বাড়ি। একটু হাঁটলেই বালী সাধারণ গ্রন্থাগার। বেশ গোটা কয়েক চটকল। অসংখ্য ছোট ছোট কলকারখানা। বিহারী, পাঞ্জাবী, তামিল, তেলেগু, ওড়িয়া, বাঙালির এক আশ্চর্য সমাহার। আর এইসবের সঙ্গে এক ম্যাজিক পাড়া।
যে পাড়ার আকাশে বছরে মাত্র দুবার ঘুড়ি দেখা যেত। একবার বিশ্বকর্মা পুজোয়। আর একবার শীতে সরস্বতী পুজোয়। একদল ঘুড়ি ওড়াতো। একদল ঘুড়ি ধরতো। আর একদল ঘুড়ির নানা রকমের পরিচর্যা করতো। একদম সুতো থেকে মাঞ্জা দেওয়া, ঘুড়ি কেনা, কল খাটানো। এদের সিদ্ধ পুরুষ হিসেবে ধরা হতো। সিজনে এঁদের চাহিদা বাড়তো। মাথায় করে রাখতে হতো এঁদের বছরের পর বছর। এখনও আমার কোনো কোনো বন্ধু ঘুড়ির সময়ে নাওয়া খাওয়া ভোলেন। ফুটবল টিমের মতো একটা সংসার সামলিয়েও ছাদ কাঁপান। তাঁদের ক্যারিশমার গল্প না হয় অন্য কোনোদিন। অন্য কোনোখানে।
কিন্তু এতোসব কিছু থাকার পরেও আমার জীবনে কোনো ছাদ ছিল না। বেড়ে ওঠার বয়সে তো নয়ই। যে বাড়িতে ভাড়া থাকতাম সেই বাড়ির ছাদে ওঠা নিষেধ ছিল। কাজেই আমার বন্ধুরা যখন ‘হাওয়ায় হাওয়ায় ভেসে বেড়ায়’ তখন আমি তাদের থেকে একটু দূরে, বেশ পেছনে বাড়ির জানলায় শিকের গরাদ দিয়ে আকাশ দেখছি। খুব একটু কেউ দয়া দাক্ষিন্য করলে লাটাই ধরতে দিয়েছে। ঘুড়ি কাটলে ভোকাট্টা বলে কাঁসর বাজাতে দিয়েছে। হাড় হিম করা শীতের ভোরে ফুল তুলতে গিয়ে মাঞ্জা দেখতে দিয়েছে। ঘুড়ি উড়িয়ে নতুন সুতোর ধারে আঙুল কেটে ব্যান্ডেজ বেঁধে স্কুলে এলে ভূগোল দিদিমনির ক্লাসে ফিসফিস করে শুনিয়েছে তার আকাশ পথের দিগ্বিজয়ের গল্প। দেড়তেকে পেছনে ফেলে একতের মাথার ওপর দিয়ে হাঁড়িকাঠকে ভোকাট্টা করা। যেন বোমারু বিমান চালাচ্ছে সে। এমনকি নিঝুম দুপুরে ঘুড়ি ধরতে গিয়ে প্রথম প্রেমের চিঠি পাওয়া। মাঝ আকাশে ময়ূরকণ্ঠির গায়ে তখন ‘আই লাভ ইউ’। সেসব তখন অশোকের রাজ্য জয়ের চেয়েও রোমাঞ্চকর। পালটে যেতে থাকা শরীর আর মনের বিভৎস ত্রিকোণমিতি।
এতোদিন পরেও সেইসব জায়গাগুলো একই রকম আর নেই। থাকার কথাও নয়। কারখানা গুলো যেন ভ্যানিশ। মাত্র দু একটা জুটমিল এখনও টিম টিম করে চলছে। ব্লেড ফ্যাক্টরির রাজকীয় প্যাকেট এখনও আছে কিনা জানি না। ইণ্ডালের খাওয়া দাওয়া বিদেশী মালিক চলে যাওয়ার পরে কবেই উঠে গেছে। আর ঠাকুর দেখতে যাওয়া? বিশ্বকর্মাকে নিয়ে প্রচলিত গল্পগুলো? কি জানি! এই তো নিজের কাছে নেই বলে ঘুড়ির ছবি গুগুলে খুঁজতে গিয়ে দেখলাম সেখানের অবস্থাও লক ডাউনের মতোই।
তবে প্রত্যেক বছর এখনও নিয়ম করে বিশ্বকর্মা আসেন। মা দুর্গার বাপের বাড়ির রাস্তাঘাট খুব যত্ন নিয়ে সারান। কলকব্জা ঠিক আছে কিনা দেখেন। তারপর দধিকর্মা খেয়ে আবার গঙ্গায় ভেসে যান। তবে এখনও জানি না লাস্ট বেঞ্চে বসে কেউ ঘুড়ির গল্প বলে কিনা। কিউটি সেন্ট মাখা প্রথম প্রেমের চিঠি হাতে ধরিয়ে বলে কিনা একটা উত্তর লিখে দিবি?
জানি না।
তিন শালিখের দিব্যি।
ছবি সৌজন্য-গুগুল ইমেজ
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন