পথের কবি
নাড়া, লবটুলিয়া, বইহারের অরণ্যে এক নিঃসঙ্গ তরুণ এসে দাঁড়ান। না, তিনি মোটেই প্রকৃতির মোহছন্নতায় আসিক্ত হবার জন্য এমন মালভূমির রুক্ষ শুকনো অথচ কী ভীষণ সুন্দর এক অরণ্যে এসে গা ভাসিয়ে দেননি। নিজ দেশে নিতান্ত না খেতে পেয়ে, না চাকরী পেয়ে নিরুপায় হয়ে এসেছেন। না হলে সরস্বতী পুজোর দিন পকেটে একটা নয়া পয়সা পর্যন্ত যার নেই তাকে কিনা মেস থেকে লুকিয়ে পালাতে হয় এক পেট ক্ষিদে নিয়ে। পাছে কিনা লোকজন চাঁদা চেয়ে বসে? ওদিকে তো ঠাকুর বসিয়েছে উনুনে কড়া। ময়ান দেওয়া লুচির সুঘ্রাণ ছড়িয়ে পড়েছে উত্তর কলকাতার এঁদো স্যাঁতসেঁতে গলিতে। সত্যচরণকে পালাতে হয়েছিল এক বেকার যুবকের ভয়ঙ্কর অভিশাপ মাথায় নিয়ে আরও এক অভিসম্পাতের তীরে। তাঁর হাতে ধ্বংস হয়েছিল বিস্তৃত অরণ্যপ্রান্তর। বিঘের পর বিঘে উপড়ে ফেলা হয়েছিল আদিম মহা দ্রুমদের। তাই নিজেকে ভেতরে ভেতরে ভাঙার, প্রশ্ন করার, ছিন্ন বিচ্ছিন্ন রক্তাক্ত করার এক আখ্যান কি নয় আরণ্যক? আমার কাছে তাই। হ্যাঁ প্রকৃতির রূপ, রস, গন্ধ, স্পর্শ মেখেও।
বারবার যখন বইটার দিকে ফিরে চাই তখনই একটা খাটো ধুতি, ক্যাম্বিসের জুতো, মলিন জামা পরা কাঁধে ব্যাগ ঝোলানো একজন মানুষ আমার দিকে চেয়ে থাকেন। যিনি বনের পথে পথে চিহড় ফল কুড়িয়ে খেতেন। আর ছুটি পেলেই তাঁর সব শহুরে, এলিট কল্লোল যুগের বন্ধুদের সঙ্গে সিনেমা দেখতেন, ইম্পিরিয়াল লাইব্রেরীতে গিয়ে বই পড়তেন। গোটা শহরটা হাঁটতেন পায়ে পায়ে। অনেক দিন পরে অনেক রাতে গ্রামের ভাঙা বাড়িতে ফিরে মায়ের কথা মনে পড়লে বর্ষার ভরা ইচ্ছামতীতে ডুব দিতেন। মাথার ওপর সাক্ষী থাকতো উড়ন্ত তারাদের সব ছায়া। শরীর জুড়ালে, মন শীতল হলে কলমী ফুলের রঙের রেখায় লেখা হতো ‘দিনের পর দিন’। তাঁর অপ্রকাশিত ডায়েরীর পাতায় ভরে উঠতো প্রচন্ড সজীব আড্ডাপ্রিয় অথচ একাকী এক মানুষের ধারাভাষ্য।
দেশ স্বাধীন হবার মাত্র তিন বছরের মাথায় তিনি মারা যান। তার পাঁচ বছর পরে লেখকের প্রথম উপন্যাস নিয়ে ছবি করেন ডি জে কিমারের অফিসে কাজ করা এক তরুণ শিল্পী। তাঁরও সেটি প্রথম কাজ। আবারও এক গভীর রাতের বিদেশী ফিল্ম ফেস্টিভালের শোতে, এমনকি সাব টাইটেল বিহীন মিউজিয়াম অব মর্ডান আর্টের প্রদর্শনীতে একটা পথের রেখা সূচিত হয়। হ্যাঁ সেটাও নতুন পথ। নতুন করে দেখা। রাতারাতি চিনে ফেলে তাঁকে পৃথিবী। যে পৃথিবীকে নিজের সত্তায় বহন করে বেড়াতেন তিনি। যা তাঁর বন্ধুরাও মেনে নিত অনায়াসে। খ্যাতির মধ্য গগনে থাকা এমন এক সাহিত্যিকের আটপৌরে জীবন না দেখার, তাঁর সান্নিধ্য না পাওয়ার আক্ষেপ করেছিলেন সুনীল তাঁর কোনো এক লেখায়। কিন্তু তাঁরই সম সময়ের আরেক বন্ধু জীবনের উপান্তে এসে তাঁর শেষ উপন্যাসে বুনে দিয়েছিলেন এই জীবন দেবতাকে। লেখকের স্বনামেই।
অবাক হয়ে দেখবো কীভাবে বিভূতিভূষণ লোকাল ট্রেনে যাতায়াত করতে করতে চাষীদের সঙ্গে কথা বলছেন ধানের দামের ওঠা পড়া নিয়ে একদম ট্রেনের দরজার সামনের পা দানিতে বসে। হাতে ধরা আছে টাইম ম্যাগাজিনের কোনো এক নতুন সংখ্যা। যে ছেলেটা তাকে দেখছে সেও তো চেনে না মানুষটাকে। কোন এক অখ্যাত গ্রাম থেকে আসছে শহরে। পড়াশুনো করার ইচ্ছে তার। ভেবেছে কুড়িয়ে পেয়েছে কোথাও এই চাষা। কিন্তু চেয়ে নিয়ে খুলে দেখে প্রথম পাতায় লেখা বিভূতিভূষণ বন্দ্যোপাধ্যায়। প্রথমে কথা সরে না মুখে। তারপর যখন কথা হয় তখন তো মাথার ওপর এক বিশাল ছায়া। গ্রামের সেই পুরনো বটগাছটা যেন।
স্বাধীনতার পটভূমির সেই ক্রান্তিলগ্নে এই ছেলেটা ফিরে দেখে অনেক মানুষকে। কিন্তু ততক্ষণে 'আলো নেই'। চারপাশটা ভীষণ অন্ধকার। যে মহাজাগতিক অন্ধকারের মধ্যে মৃদু আলোয় নক্ষত্রের মতো ফুটে উঠছেন কেউ কেউ। শ্যামলবাবুর এই উপন্যাস আমরা কজনই বা পড়েছি?
প্রকৃতি ছেয়ে ফেলেছিল সত্যচরণকে। তার মানুষরাও। প্রচন্ড কঠোর, কঠিন বাস্তবতা নিয়ে। অরণ্য এক বিষাদ সিন্ধু নির্মাণ করেছিল ঘরে ফেরার। যান্ত্রিক সভ্যতা অপুকে করেছিল শিকড় ছিন্ন। কিন্তু তাঁদের স্রষ্টা থেকে গিয়েছিলেন অমলিন এক পাঁচালীর ধারাভাষ্যকার। সারাদিন কাজ করার পর গোটা শহরটা পায়ে হেঁটে ঘুরে এসে লিখতে বসতেন। কত কত মানুষ, তাদের কত মায়া ভরা গল্প। কিন্তু কেমনভাবে লিখতেন তিনি?
চোখ বন্ধ করলাম। দেখতে পাচ্ছি কি পথের কবিকে? আমার চারপাশে তখন তো পৃথিবী পুড়ছে। পোড়া মাংসের গন্ধের ভেতর থেকে কী করে উদ্ধার করবো তোমাকে? সেই দোবরুপান্নাকে? ভানুমতীকে? দুর্গাকে? সর্বজয়া? ইন্দিরঠাকরুণ? যাদের কারো কাছে কোনো নালিশ ছিল না। শুধুমাত্র হারিয়ে যাওয়া ছাড়া।
তাই হে পথের কবি তোমার লেখা এখনও বাঙালির চিত্তশুদ্ধি। তার প্রাণের আরাম, মনের আনন্দ, আত্মার শান্তি।
জন্মদিনে এক নগন্য পাঠকের এইটুকু শ্রদ্ধা গ্রহণ করুন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন