তিতুন ও টারজান
লীলা মজুমদারের জ্যাঠামশাই উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর ময়মনসিংহের বাড়িতে দুটো হাতি ছিল। একটার নাম যাত্রামঙ্গল আরেকটার নাম কুসুমকলি। যাত্রামঙ্গল মেজাজে ছিল খুব রাশভারি। রাগিও। পান থেকে চুন খসলে তার মেজাজ যেত সপ্তমে চড়ে। নোংরা জিনিস সে মোটেই দেখতে পারতো না, এমনকি পছন্দও করতো না। সবাই যাত্রামঙ্গলকে একটু সমঝে চলতো। কুসুমকলি ছিল ঠিক তার উলটো। মেজাজেও যেমন শান্ত। তার মুখটাও ছিল খুব মিষ্টি। চোখ দিয়ে মিটিমিটি হাসতো আর মাথার ওপর শুঁড় তুলে প্রনাম করতো। কমলালেবু পেলে খুশি হতো সে।
এগুলো সব তিতুন পড়েছিল বইতে। সেই থেকে তার হাতি দেখার খুব শখ। শীতকালে যখন সিঁথির মাঠে সার্কাস এসেছিল তখন দূরে গ্যালারি থেকে সে হাতির ফুটবল খেলা দেখেছিল। কিন্তু বাবা বলেছিল, এগুলো ভালো নয়। পৃথিবীর আদিমতম প্রানীদের এইভাবে আটকে রেখে, জোর করে ট্রেনিং দিয়ে খেলা শেখালে পৃথিবীর ভালো হয় না। বরং ঢেড় ক্ষতি হয়। ঠিক কি যে ক্ষতি হয় সেটা সেদিন তিতুন বুঝতে পারেনি। আগেকার দিনের রাজা মহারাজারা তো হাতি পুষতো। যুদ্ধের জন্য ট্রেনিং দেওয়া হতো হাতিকে। তাহলে এখন সার্কাসে দেখালে ক্ষতি কী? বাবা বলেছিল সেগুলোও যে খুব ভালো ছিল তা কিন্তু মোটেই নয়। তুমি একটা প্রাকৃতিক শৃঙ্খলকে ভাঙছো। আরও একটু বড় হলে সব আস্তে আস্তে বুঝতে পারবে।
তিতুনের অবশ্য ভালোই লাগছিল যখন তিন চারটে বড় হাতি আর একটা বাচ্চা হাতি মিলে পা দিয়ে বল মারছিল। শুঁড় দিয়ে লোফালুফি করছিল। কিন্তু খেলা দেখাতে দেখাতে ওদের মধ্যে কেউ একজন একটু ভুল করলেই পাশে দাঁড়িয়ে থাকা সাদা পোষাকের টুপি পড়া ট্রেনার হাতে ধরা লাঠি দিয়ে মারছিল। সেটা তিতুনের খুব খারাপ লেগেছিল। মন খারাপ হয়ে গিয়েছিল তার। ভুল করলে অমন করে মারবে কেন? ব্যাথা লাগেনা বুঝি? ছোট্ট বাচ্চা হাতিটা কেমন ভয়ে ভয়ে থাকছিল সেটাও লক্ষ্য করেছিল তিতুন। ওদের হয়তো খেলা দেখাতে তখন ইচ্ছেই করছিল না। মনের ওপর এক আকাশ মেঘ চাপিয়ে মুখ ব্যাজার করে সার্কাসের তাঁবু থেকে বেরিয়ে এসেছিল। ঠিক করেছিল এমন সার্কাস সে আর কোনোদিন দেখবে না।
তিতুনের মন খারাপ দেখে সেবার বাড়ির সবাই মিলে তাকে নিয়ে চিড়িয়াখানায় গিয়েছিল। শীতটাও তখন বেশ জাঁকিয়ে পড়েছে। সবাই ভেবেছিল কড়াইশুটির কচুরী, জয়নগরের মোয়া খেতে খেতে দারুন হই হুল্লোড় করা যাবে আর সেই সঙ্গে পিকনিকও। কিন্তু সেখানেও ভালো লাগেনি তিতুনের। এতো ভিড় দেখে তার মনে হয়েছিল সবাই মিলে যেন ঠাকুর দেখতে এসেছে। কেউ কারো ঘাড়ে পড়ে যাচ্ছে। পা মাড়িয়ে ঠেলে ঠুলে চলে যাচ্ছে কেউ। আর সব পশু পাখিরা খাঁচার মধ্যে আটকানো। ওদের দেখে মনে হচ্ছে সবাই কেমন যেন জেলের মধ্যে বন্দি। কারও মনে কোনো আনন্দ নেই। এতো লোকজনকে সামনে হামলে পড়তে দেখে তারাও যেন বেশ খানিকটা ঘাবড়ে গেছে। খাঁচার সামনে দাঁড়ালে বাঘটা ঘুরেও দেখলো না। আর দেখবেই বা কেন? বেশ কিছু লোক তাকে নানারকম নামে ডেকে, ভেঙিয়ে বিরক্ত করছিল। সেই যে সে ঘরের মধ্যে ঢুকলো আর বেরোলো না। কুমীরটা হাঁ করে রোদের দিকে মুখ করে শুয়ে আছে তার আর নড়াচড়ার কোনো লক্ষণ নেই। দূর থেকে দেখে মনে হচ্ছে ধ্যান করছে যেন। এই চিৎকার চেঁচামেচিতে তার কিচ্ছু এসে যায় না। এখানেও সেই হাতির পায়ে শিকল দিয়ে বাঁধা। সে বেচারা একই জায়গায় দাঁড়িয়ে কেমন যেন দুলে যাচ্ছে। মনে হচ্ছে কেউ যেন মিউজিক চালিয়ে দিয়েছে আর সে তালে তালে দুলে চলেছে। কলা, ভিজে ছোলা এইসব দিলে চটপট শুঁড় দিয়ে তুলে নিয়ে মুখে পুরে দিচ্ছে।
দাদা কানে কানে বলেছিল এটা হচ্ছে ওদের
একটা সাংকেতিক ভাষা।
তিতুন জানতে চেয়েছিল কোনটা?
দাদা দেখিয়েছিল, এই যে একই জায়গায় দাঁড়িয়ে বিশাল শরীরটাকে নিয়ে সামনে আর পেছনে ক্রমাগত দুলে যাচ্ছে। কানদুটো পাখার মতো সামনে পেছনে করছে। লক্ষ্য করে দেখেছিস কি শুঁড়টা কেমন একবার মাটিতে ছোঁওয়াচ্ছে আবার তুলে নিচ্ছে। এগুলো দেখে মাহুত হাতিদের মুড বুঝতে পারে। মেজাজ ভালো আছে নাকি খারাপ। তোকে যেমন অঙ্ক করতে দিলে বোঝা যায় ঠিক তেমন। তিতুনের রাগ হয়। দাদাটা না সত্যি সারাক্ষণ তিতুনের পেছনে পড়ে থাকে। তার অঙ্ক করতে ভালো লাগে না। ব্যাস। আর অঙ্ক করতে বসলেই সে ধৈর্য্য হারিয়ে ফেলে। মেজাজটাও যায় তার খারাপ হয়ে। তাই বলে পৃথিবীর সবচেয়ে আদিমতম প্রানীর সঙ্গে তুলনা? ছোটকা বলেছিল, খারাপ কী? হাতির মতো গায়ের শক্তি আর বুদ্ধি কজনের আছে?
হাতির বুদ্ধিও আছে? অবাক হয় তিতুন।
দাদা বলে সেকি? থাকবে না কেন? পিঁপড়ের যদি বুদ্ধি থাকে ওই টুকুনি মাথাতে তাহলে হাতির মাথাটা একবার ভাব। কতবড়! স্মৃতিশক্তিও ভীষণ। যা একবার দেখে সবকিছু মনে রাখে।
এই যে আমাকে দেখলো সেটা মনে রাখবে? জানতে চেয়েছিল তিতুন।
দাদা বলেছিল নিশ্চই রাখবে। এই যে তুই ওকে একটা কলা খাওয়ালি সেটাও। ব্রেনখানা যেন একটা বড় হার্ড ডিস্কের মতো। সব ডেটা ফাইল জমা হচ্ছে সেখানে। কত হাজার হাজার বছরের স্মৃতি ওরা বয়ে নিয়ে বেড়াচ্ছে এক জেনারেশন থেকে আর এক জেনারেশন। তার একটুও যদি মানুষ বুঝতে পারতো রে তাহলে পৃথিবীটা অন্যরকম চেহারা নিতো।
তিতুনের তখন এতোসব কিছু ভাবতে ভালো লাগছিল না। চিড়িয়াখানায় একটা প্রাচীন গাছের নীচে বসে সে পরিযায়ী পাখিদের দেখতে দেখতে ডিম সেদ্ধ খাচ্ছিল। তারপর কড়াইশুটির কচুরী খেল। আমসত্ত্ব, খেজুরের চাটনি খেল। গোটা তিনেক নলেনগুড়ের সন্দেশ খেল। আর সারাক্ষণ ঘ্যান ঘ্যান করতে থাকলো তাকে সব কিছু আসল দেখাতে হবে। আসল জঙ্গল। আসল হাতি। আসল বাঘ। তাদের খাঁচার মধ্যে থাকলে চলবে না। সার্কাসেও না। বনের মধ্যে ঘুরে ঘুরে বেড়াতে হবে। দাদা অমনি মুখ ভেঙিয়ে বললো, গো এজ ইউ লাইক হবে না? সবাই তোমার নির্দেশ মতো তোমারই সামনে ঘুরে ঘুরে বেড়াবে আর তুমি হবে কিনা টিচার? যা ওখানে কর্কটা পড়ে গেছে নিয়ে আয়। তিতুন রেগে মেগে কর্ক তো আনলোই না। উঁচু স্লিপটার ওপরে গিয়ে মুখ ব্যাজার করে বসে থাকলো। যদিও কেউ তকে খুব একটা পাত্তা দিলো না তখন। বাবা, বাছা করে তুই কত ভালো বলে সেই স্লিপ থেকে নামিয়েও আনলো না। বরং সবাই মিলে শীতের রোদে ব্যাটমিন্টন খেলতে শুরু করে দিল। আর খেলতে খেলতেই চুপি চুপি তারা প্ল্যান করলো তিতুন যা চাইছে তা অবশ্যই তাকে একদিন দেখাতে হবে। কিন্তু কবে? কী করে? সেটা তারা তখনই চিড়িয়াখানায় বসে ঠিক করতে পারেনি। তবে সেই সুযোগ এসে গেল খুব তাড়াতাড়ি।
সেবার শীতের শেষে, ভরা বসন্তে স্কুলের পরীক্ষা শেষ হবার পরদিনই তিতুন বড় মামার চিঠি পেলো চিলাপাতার জঙ্গল থেকে।
স্নেহের তিতুন,
আশা করি পরীক্ষা দিয়ে ভালোই আছিস তুই। টেনশানে পেট খারাপ হয়নি তো এবার? আর মাঝে মাঝেই তোর সেই রেগে যাওয়া? ধরে নিলাম হয়নি। দিব্যি পরীক্ষা দিয়েছিস আর স্কুলের বাসে হইচই করতে করতে বাড়ি ফিরেছিস। এবার আসি তাহলে এক্কেবারে কাজের কথায়। আমি এখন চিলাপাতায় পোষ্টিং হয়েছি। রোজ আপিসে যাওয়ার পথে হাতি দেখি। সেগুলো সবই অবশ্য বন দপ্তরের ট্রেনিং প্রাপ্ত কর্মচারী। আমার মতোই ওদের ঠিক নিয়ম মেনে অফিসের কাজ করতে হয়। সরকার তাদের মাসের শেষে মাইনেও দেয়। এমনকি পেনশনও আছে ওদের। না হলে বুড়ো বয়সে খাবে কী? জঙ্গলে ঘুরে ঘুরে খাবার অভ্যেস যে নষ্ট হয়ে গেছে। আমরাই অবশ্য তার জন্য দায়ী। তবে জঙ্গলের হাতিকেও সংরক্ষণ করা হচ্ছে খুব কঠোর কঠিন নিয়ম কানুন মেনে। সেসব না হয় তুই যখন আসবি তখন বিস্তারিত ভাবে বলবো। তার আগে তোকে একটা মজার ঘটনার কথা বলি।
সেদিন হয়েছে কি, রাত তখন কটা বাজে ঠিক জানি না। হাতের কাছে ঘড়িখানা নেই। ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছে। জানলার একটা পাল্লা হয়তো হাওয়াতেই খুলে গিয়েছিল। সেটা খুট খুট করে নড়ছে। জল ঢুকে যাওয়ার ভয়ে বন্ধ করতে গিয়ে দেখি, আমার বাংলোর বাইরে যে চালতে গাছটা আছে সেখানে দুটো হাতি চুপচাপ মুখোমুখি দাঁড়িয়ে বৃষ্টিতে ভিজছে। ওদের ভালোভাবে দেখবো বলে বাইরে বেরিয়ে এলাম। কতরাত পর্যন্ত বারান্দায় বসে বসে ওদের দেখলাম। ওরা একটুও নড়লো না। চড়লো না। আওয়াজ করলো না। হয়তো ওদের বৃষ্টিতে ভিজতে ভালো লাগছিল জানিস। ছবি তুলতে ইচ্ছে করলেও তুলিনি। পাছে ওদের ডিসটার্ব হয়। সেই সময় তোর কথা বারবার মনে পড়ছিল। ইশ তিতুন যদি থাকতো এখানে তাহলে কি ভালোটাই না হতো। কত হাতি দেখতে পেত। আসবি নাকি একবার চিলাপাতায় হাতি দেখতে? সেরকম যদি ইচ্ছের জোর রাখতে পারিস মনে তাহলে হয়তো চিতা বাঘের পরিবারের সঙ্গেও দেখা হয়ে যেতে পারে তোর। আর কার কার সঙ্গে দেখা হবে সেই লিস্ট না হয় এখানে ঘোরাঘুরি করেই তৈরি করিস। চলে আয় চটপট আমার কাছে। ভালো থাকিস।
ইতি
মামা।
সারাদিন ধরে কত কত বার যে তিতুন চিঠিখানা পড়লো তার কোন ঠিক ঠিকানা রইলো না। চোখ বন্ধ করলেই যেন সে দেখতে পেল একটা জঙ্গল। সেখানে ঘুরে বেড়াচ্ছে হাতি, চিতাবাঘ, ময়ূর, খরগোশ সবাই। ডালে ডালে কত পাখি। ওই বুঝি ছুট্টে চলে গেল হরিণ। মনে হল চিঠিখানা যেন জঙ্গলের নিমন্ত্রণ বয়ে নিয়ে এসেছে তার কাছে। আর সবাই মিলে ডাকছে চলে আয় তিতুন, খুব তাড়াতাড়ি আমাদের কাছে চলে আয়। কিন্তু যাওয়া বললেই কি আর যাওয়া? সামনে দাদার পরীক্ষা আছে। বাবার আপিসে প্রচুর কাজ। ছুটি পাবে না মোটেই। বাবা, দাদা না গেলে মায়েরও যাওয়া হবে না। বাড়িতে ওদের দেখবে কে? তাহলে তিতুন কী করবে এবার? তার যে একটা নেমনতন্নের চিঠি এসেছে জঙ্গল থেকে তারবেলা? মেঝেতে বসে পা ছড়িয়ে কান্না পেল তার। বায়না বেড়ে গেল চতুর্গুণ। খিটখিটে হয়ে গেল তিতুন। পরীক্ষা শেষের আনন্দটাই কেমন যেন মাটি হয়ে গেল।
দাদা বললো, চিলাপাতা কোথায় তুই কি জানিস? কেন জানবে না তিতুন? অতো বোকা ভাবো নাকি তোমরা তাকে? ডুয়ার্সের জঙ্গল সে কি জানে না? একবার চিলাপাতা যদি সে যেতে পারে তাহলে অবশ্যই ঘুরে আসবে ওখান থেকে বক্সার জঙ্গলে। ওই রাস্তার ওপরেই পড়বে জলদাপাড়া। আরও খানিকটা এগিয়ে গেলে গরুমারা। সেবার ঝিমলিরা সবাই বেড়াতে গেল না। কত কত ছবি তুলে নিয়ে এসেছিল। দেখিয়েছিল তিতুনকে সব। হাতির পিঠে চেপে ভোরবেলায় ওরা সবাই মিলে জঙ্গল দেখতে বেরিয়েছিল। সেখানে গন্ডার দেখেছিল। হরিণ দেখেছিল। এমনকি একটা সাপ এঁকেবেঁকে চলে গিয়েছিল শুকনো ঘাসের ঝোপে।
দাদা বললো সেসব তো পরেও থাকবে। জঙ্গল তো আর উবে যাবে না রাতারাতি। সবাই মিলে তখন না হয় যাওয়া যাবে।
ছোটকা শুধু একমাত্র তিতুনের পক্ষ নিলো। কড়া ধমক দিলো দাদাকে। উবেই তো যাচ্ছে জঙ্গলগুলো রাতারাতি। সবাই সব জায়গায় শুধু বড় বড় বাড়ি করবে, রাস্তা বানাবে আর কল কারখানা গড়বে। দেখতে পাচ্ছিস না কি হারে সব প্রাকৃতিক জিনিস নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তুই কোনো চিন্তা করিস না তিতুন। আমি তোকে বড়মামার কাছে দিয়ে আসবো তোর বাবা আর মায়ের যদি কোনো আপত্তি না থাকে তবেই।বাবা, মা কোন আপত্তি তো করলোই না বরং যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলো। যাক তাহলে তিতুন অন্তত জঙ্গলটা দেখতে পাবে এবং তারসঙ্গে ছেলেটার পরীক্ষার পর হাওয়া বদল ঘটবে ভেবে। কিন্তু মুশকিলটা হলো ছোটকার নতুন চাকরি। সেখান থেকে তার ছুটি পাওয়া ভীষণ মুশকিলের। তাও সবাইকে বলে কয়ে একদিনের ছুটি ম্যানেজ করেছে সে। কাজেই তার তিতুনের সঙ্গে মোটেই জঙ্গলে থাকা হবে না। তিতুনকে দিয়েই চলে আসতে হবে। সেইসব দেখে শুনে মা বললো এতো কষ্ট করে যাবে কাকা, কোন মানেই হয় না। তিতুন তুই অমন মিছে মিছে বায়না করিস নাতো। পরেই না হয় সবার সঙ্গে যাস। কিন্তু তিতুন এক নাছোড় জেদ ধরেছে। তাকে জঙ্গলে যেতেই হবে। ছোটকা কিন্তু তার সেই বিখ্যাত মিষ্টি মিষ্টি হাসি হাসি মুখ নিয়ে বললো, তুমি খামোকা ওকে বকছো বৌদি। আমার কোনো কষ্টই হবে না। কিন্তু তিতুনের কাছে আমার একটা শর্ত থাকবে।
শর্ত? মানে কন্ডিশন? তিতুন চোখ গোল
গোল করে জানতে চায়।
কাকা বলে ইয়েস।
এই খাতাটায় প্রত্যেকদিন লিখতে হবে
তুই সারাদিন ধরে কী দেখলি, কী করলি সবটা গল্পের মতো করে। আমি যেতে পারবো নাতো তাই তুই
যখন বাড়ি আসবি তখন সেটা পড়বো। ছোটকা এগিয়ে দেয় সুন্দর দেখতে নোটখাতা আর একটা নীল রঙের
কালি পেন। যে পেনে এর আগে কোনোদিন লেখেনি তিতুন।
কালী ভরে তবেই লেখা যায়। শিখিয়ে দেবো তোকে। লিখবি তো? জানতে চেয়েছিল কাকা খুব সিরিয়াস ভাবেই।
তারমানে তুমি আমাকে পরীক্ষার পরেও, বেড়াতে গিয়েও সেই পড়াশুনোটাই করতে বলছো তো? তিতুন ভুরু কুঁচকে জানতে চায়।
ছোটকা ঘাড় নেড়ে বলে মোটেই না। এটা পড়াশুনো কোথায়? এটা তো গল্প লেখা। আসলে তোর চোখ দিয়ে আমরা পুরো জঙ্গলটা দেখবো। আর শুধু আমিই বা কেন? দাদা দেখবে, মা দেখবে, বাবা আপিস যেতে যেতে দেখবে। স্কুলের টিফিনে বন্ধুদের সেই খাতা থেকে পড়ে শোনালে তারাও দেখতে পাবে। তখন তোর দেখাটা আর একার থাকবে না সবার দেখা হয়ে যাবে। কি বলেছিলাম, আনন্দ ভাগ করে নিলে কী হয়?
অনেক অনেক বেড়ে যায়। এই এত্তো? তিতুন
দুই হাত তুলে পরিমানটা দেখায়।
তখন মজা লাগে না? ছোটকা জানতে চায়।
খুব মজা। ঠিক যেমন গল্পের বই পড়লে
হয় তেমন।
তাহলে?
লিখবো ছোটকা। নিশ্চই লিখবো। সবার জন্য। তিতুন প্রমিস করে।
এমন ভাবে আগে কোনোদিন সে ভাবেনি। সত্যিই তো তার গল্প বলতে ভালোলাগে। গল্প করতেও। এমন কতদিন হয়েছে গল্প বলার ক্লাসে শুধু তিতুনই গল্প বলে গেছে দিনের পর দিন। তিতুনের গল্প শুনতে পারলে বন্ধুরাও খুশি হয়। ব্যাগ গোছানোর সময় তিতুন তার অনেক কিছু প্রয়োজনীয় জিনিসের সঙ্গে ছোটকার দেওয়া সুন্দর খাতাটা আর নীলরঙের কালি পেনটা নিতে ভুললো না। তারসঙ্গে হলুদ রঙের ছোট্ট চৌকো প্যাকেটে ভরা কালির দোয়াত। সেটা দেখে ঝিমলি খুব বায়না ধরেছিল। ছোটকা তাকেও একটা কিনে দেবে বলেছে। খুশি হয়ে ঝিমলি বলেছে তিতুনের ছোটকার মতো ভালো মানুষ আর হয় না। সেটা শুনে ছোটকাও খুব খুশি হয়েছে।
আস্তে আস্তে তিতুনের চিলাপাতায় যাওয়ার দিন এগিয়ে এলো। এর আগে তিতুন কোনোদিন এইভাবে হুট করে বেড়াতে যায়নি। তাদের বেড়াতে যাওয়ার প্ল্যান হতো সারা বছর ধরে। কোথায় যাওয়া হবে? কে কে যাবে? কোথায় কোথায় থাকা হবে? কি কি খাওয়া হবে সব কিছু নিয়ে আগে থেকে চলতো আলাপ-আলোচনা, মিটিং আর তারসঙ্গে ফাউ হিসেবে ইটিং তো থাকতোই। বাবা, মা, দাদা, ছোটকা, পিসি, মাসিরা সবাই মিলে একটা বড় ফুটবল টিমের মতো হতো। ট্রেনে উঠলে প্রায় একটা গোটা কামরা ভর্তি করে দিত তিতুনরা সবাই মিলে। ক্যালোর ব্যালোর, চিৎকার চেঁচামেচিতে কান পাতা যেত না। কার সুটকেস পাওয়া যাচ্ছে না। কার ব্যাগ সিটের তলায় ঢুকে গিয়েছে। কে জানলার ধারে সিট পায়নি, কার আবার ট্রেনে উঠলে বমি পায় সেসব কত কি বলে শেষ করা যাবে না। কিন্তু এবার সেসব হওয়ার নয়।
রাতের দার্জিলিং মেল যখন শিয়ালদহ স্টেশন ছাড়লো তখন এই প্রথম কেমন যেন মনটা হুহু করে উঠলো তিতুনের। চোখটা একটু ছলছল করে উঠলো। সত্যি কি সে একটু বেশি বায়না করে ফেললো? কিন্তু ট্রেন যত স্পিড নিল, রাতে যখন ছোটকা মায়ের গুছিয়ে দেওয়া টিফিন কৌটো খুলে তার থেকে লুচি, আলুরদম, ফিসফ্রাই বের করতে লাগলো তিতুনের মন খারাপটাও আস্তে আস্তে কোথায় যেন হারিয়ে গেল। পেটপুরে লুচি, আলুরদম, ফিসফ্রাই খেয়ে শেষপাতে পেল্লাই সাইজের একটা জলভরা সন্দেশ চোখ বন্ধ করে চিবোতে চিবোতে তিতুনের ঘুম পেল। তাকে ছোটকা মাঝের বাঙ্কে শুতে বলেছিল বাইচান্স যদি তিতুন পড়ে যায়। কিন্তু তিতুন কি আর অতো ছোট আছে? দেখছো না সে কেমন নিজেই একা একা বেড়াতে যাচ্ছে। এক সপ্তাহ একা একা থেকে আবার ফিরে আসবে। তাই সে সবচেয়ে ওপরের বাঙ্কেই উঠলো। ছোটকা কোলে করে ঠেলে তুলে দিতে চেয়েছিল কিন্তু তিতুন নিজেই বাঙ্কের পাশের সিঁড়ির মতো মই দিয়ে তরতর করে উঠে গেল। তাই না দেখে ছোটকা মজা করে বললো এই তো তুই কেমন জঙ্গলে যাওয়ার আগে এক্কেবারে শিম্পাঞ্জী হয়ে যাচ্ছিস। তাহলে আমাদের আর কোনো চিন্তাই রইলো না কি বল তিতুন? তিতুন কাকার কথার কোনো উত্তর না দিয়ে শুধু মুচকি হাসলো। মাথার ওপর রিডিং ল্যাম্পটা জ্বালিয়ে দিয়ে, পায়ের ওপর সাদা চাদরটা টেনে নিয়ে প্রমদারঞ্জন রায়ের লেখা বনের খবর পড়তে শুরু করলো। এটা তার বরাবরের অভ্যেস। খানিকটা পড়ার পর ট্রেনের দুলুনিতে ঘুম আসতে মোটেই দেরী হলো না তার।
ঘুমের মধ্যে তিতুন একটা স্বপ্ন দেখলো। চিলাপাতার গভীর জঙ্গলে সে হারিয়ে গেছে। কিছুতেই সে হোটেলে ফিরে যেতে পারছে না। চারিদিক থেকে ঘিরে ধরছে তাকে অসংখ্য জোনাকি। তাদের টিমটিম করা জ্বলা আলোয় তিতুন দেখলো সামনে দাঁড়িয়ে আছে একটা বিশাল হাতি। যার দুটো দাঁত চাঁদের আলোয় ঝকমক করছে। হাতিটা শুড় বাড়িয়ে তাকে ছুঁতে গেলেই তিতুনের ঘুম ভেঙে গেল। আর সে দেখলো ছোটকা কখন উঠে পড়েছে। ট্রেন নিউ জলপাইগুড়ি স্টেশনে ঢুকছে।বড়মামা বেশ কিছুক্ষণ আগেই স্টেশনে এসে অপেক্ষা করছিল। ছোটকা ওই সকালবেলা বড় মামার কাছে তিতুনকে দিয়ে চলে গেল শিলিগুড়ির দেশবন্ধু পাড়ায় তার এক বন্ধুর বাড়ি। সেখান থেকে রাতের ট্রেন ধরে বাড়ি ফিরবে। এবার সত্যি কেমন যেন ঝপ করে মন খারাপ হয়ে গেল তিতুনের। এই বেড়ানোটাই কি সে চাইছিল? মোটেই না। একা একা কার ভালো লাগে? যাইহোক একবার যখন সে জঙ্গলের মধ্যে হাতি দেখবে বলে বায়না করেছে তখন আর কি করা যাবে? তিতুনের শুকনো মুখ দেখে মামা জানতে চাইলো কী রে মন খারাপ করছে বুঝি? তিতুন বললো একটু একটু। মামা বললো চল তাহলে তোর মন ভালো করে দিচ্ছি। জিপে একদম সামনের সিটে বসলো তিতুন। মামা নিজেই ড্রাইভ করছে। তার ছোটবেলা থেকে খুব ইচ্ছে ছিল জঙ্গলের মধ্যে থাকবে। জীবজন্তুদের নিয়ে কাজ করবে। তারপর সেইমতো কত কত পড়াশুনো করে, কত কত পরীক্ষা দিয়ে পাশ করে এখন ফরেস্ট অফিসার হয়েছে। একাই থাকে। শিলিগুড়িতে অফিসের কি কাজ ছিল তাই আগের দিন রাতে এসেছে। তিতুনদেরও সেই কারণেই নিউজলপাইগুড়ি স্টেশনে নামতে বলেছিল। না হলে কাঞ্চনকন্যায় আসলে তারা এখানে মোটেই নামতো না আরও খানিকটা এগিয়ে যেতে পারতো। তবে এন জি পি থেকে যাওয়াটাও মজার। একবার ট্রেন থেকে নেমে ফ্লাইওভার দিয়ে বাইরে আসলেই হলো। ড্রাইভাররা ঘিরে ধরবে। দার্জিলিং যাবে? কালিম্পং? মিরিক? সিকিম? কত কত জায়গার যে নাম বলবে তারা। মনে হবে সেই সব জায়গায় যদি যাওয়া যেত কি মজাটাই না হতো তাহলে। তবে এইসব ভাবনা দূরে সরিয়ে দিয়ে তারা এখন যাবে চিলাপাতা। সেটাও তো অনেকটা রাস্তা। কিন্তু একটু পরেই গাড়ির জানলার ধারের দৃশ্যগুলো পালটে যেতে থাকলো। নদী, চা বাগান দেখতে দেখতে তিতুনের মন ভালো হয়ে গেল। আরও ভালো হলো যখন বড় মামা রাস্তার পাশের দোকান থেকে তিতুনকে স্টিম মোমো খাওয়ালো।
রাস্তার চারপাশে ধানক্ষেত, গ্রাম, নদী দেখতে দেখতে কখন যে ঘুমিয়ে পড়েছিল তিতুন সে নিজেও জানে না। হঠাৎ গালের ওপরে নরম নরম কিসের ছোঁওয়া, আর ফোঁস ফোঁস আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তার। চোখ খুলতেই সে দেখলো একটা লম্বা শুঁড় তার গালের ওপরে, মাথার ওপরে হাত বোলানোর মতো করে আদর করছে। তিড়িং করে লাফিয়ে উঠে বসলো তিতুন, দেখলো গাড়ির জানলার বাইরে একটা বড় হাতি। তার ইয়াবড় দুটো দাঁত। মিটিমিটি চোখে তার দিকে তাকিয়ে আছে। আর অন্য কোনো কিছুই সে করছে না। আসেপাশে বড়মামাকে দেখতে পেলো না তিতুন। একটু একটু ভয় করতে লাগলো তার। সার্কাসে সে হাতি দেখেছে, চিড়িয়ানাখানায় কলা খাইয়েছে হাতিকে। কিন্তু তারসঙ্গে তখন লোকজন ছিল। আর এমন ভাবে তারা শুঁড় বুলিয়েও দেয়নি তাকে। কিছু কি বলতে চাইছে হাতিটা? তেড়ে আসবে না তো? তেড়ে আসার হলে আগেই সেটা করতো। এইভাবে শুঁড় বুলিয়ে ঘুম থেকে ডাকতো না। যখন সে ভাবছে এইবার বড়মামাকে ডাকবে কিনা তখনই সেই হাতির পাশ থেকে বেরিয়ে বললো, কীরে? ভয় পেয়ে গেলি নাকি তিতুন? টারজান তোকে দেখতে এসেছে। কালই বলে রেখেছিলাম ওকে। তুই আসছিস সেই কলকাতা থেকে। আয় আয় গাড়ি থেকে নাম। বন্ধুত্ত্ব কর টারজানের সঙ্গে।
গাড়ি থেকে নামবে কি সেই দশাসই চেহারার হাতি, যার নাম টারজান সেই তো পথ আটকে আছে। কোথা থেকে বেঁটে খাটো ফর্সা একটা লোক টারজানের গায়ে হাত দিয়ে বললো, পিছে পিছে। অমনি টারজান একটু পেছন দিকে সরে এসে তিতুনকে গাড়ি থেকে নামার জায়গা করে দিলো। পরে তিতুন জেনেছিল এই লোকটার নাম রামদাস রাভা। টারজানের মাহুত। যে আসলে টারজানের দেখাশুনো করে। তাকে যত্ন নেয়। খাওয়ায়। আর তার একজন সহকারী আছে চিরু। যে টারজানের জন্য কলাগাছ, ঘাস এইসব নিয়ে আসে। জঙ্গলে তাকে বলা হয় পাতাওয়ালা। একটু ভয়ে ভয়েই গাড়ি থেকে নামলো তিতুন। আর যেই না গাড়ি থেকে নামা অমনি আবার তিতুনের মাথায় শুঁড় বুলিয়ে দিল টারজান। যেন কতদিন আগে থেকে চেনে। তিতুনকে দেখে যেন তার ভারী ভালো লেগেছে।বড়মামা তিতুনের কাছে এসে বললো, এমনি এমনি বন্ধুত্ত্ব করলে হবে না কিন্তু তিতুন। টারজান কলা খেতে ভালোবাসে। তারসঙ্গে সোনপাঁপড়িও। গাড়ি থেকে সোনপাঁপড়ির প্যাকেটটা বের কর। তিতুনের ততক্ষণে ভয় কেটে গেছে। তিতুন গাড়ি থেকে সোনপাপড়ি বের করে যেই টারজানকে দিলো সে অমনি কপাত করে শুঁড় দিয়ে ধরে মুখে চালান করলো। আরও খাওয়ার জন্য শুঁড় বাড়িয়ে বায়না করতে লাগলো। মামা বললো, আজ আর নয় টারজান। কাল যখন তিতুন তোমার পিঠে করে কোদাল বস্তি, সিসি লাইন, রাভা বস্তি ঘুরে দেখবে তখন খেয়ো। টারজানও কেমন বাধ্য ছেলের মতো শুঁড় উঁচিয়ে সেলাম ঠুকে মাথা দোলাতে দোলাতে গলায় বাঁধা ঘন্টা টুং, টাং করে বাজাতে বাজাতে চলে গেল নিজের আস্তানায়। ততক্ষণে তিতুন জেনে নিয়েছে হাতিদের থাকার জায়গাকে পিলখানা বলে।
সেদিন রাতে ঝেঁপে বৃষ্টি এলো। এর আগে শহরের বৃষ্টি দেখেছে তিতুন। পাহাড়ে বেড়াতে গিয়ে সেখানকার বৃষ্টি। এমনকি গত বছরে সমুদ্রে বেড়াতে গিয়ে সেই বৃষ্টিও দেখেছে। কিন্তু জঙ্গলের বৃষ্টি এই প্রথম। তারসঙ্গে কড় কড় করে বাজ পড়ার আওয়াজ। মামার কাঠের বাংলোর চারপাশে ঘন জঙ্গলে ঘেরা। সেই জঙ্গলে নানা রকম গাছের পাতায় বৃষ্টির আওয়াজ শুনতে শুনতে তিতুন দেশী মুরগীর ঝোল দিয়ে রুটি খেলো। মামার পাশে শুয়ে শুনলো টারজানের গল্প। এই টারজান সেই বইয়ের টারজান নয়। যে আসলে তার বাবা-মায়ের থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে বনের মধ্যে মানুষ হয়েছিল পশু পাখিদের মধ্যে। অনেকটা ঠিক মোগলির মতোই। মামা আসলে যে টারজানের গল্প শোনাতে শুরু করলো তারসঙ্গে কয়েক ঘন্টা আগেই বন্ধুত্ত্ব হয়েছে তিতুনের।
তাও সে প্রায় সাত-আট বছর আগেরকার কথা বুঝলি তিতুন। বলতে শুরু করলো মামা। সেবার খুব বর্ষা। উত্তরবঙ্গের প্রায় সব নদী ফুলে ফেঁপে উঠেছে। বন্যার অবস্থা প্রায়। আর এইরকম অবস্থায় জঙ্গলের ওপর আরও বেশি করে নজর রাখতে হয় আমাদের। কারণ বন্যা হলে মানুষের মতোই পশু পাখিদের দুর্গতির আর শেষ থাকে না। বাড়ি-ঘরের মতো ভেসে যায় জঙ্গলও। সারা রাত ওয়াচ টাওয়ারে বসে নজর রাখতে হয়। কোনো পশু পাখির অসুবিধে হচ্ছে কিনা। কেউ বিপদে পড়লো কিনা। হাতিরা তো একজায়গায় বেশি দিন থাকে না। একটা জায়গার খাবার ফুরিয়ে গেলেই ওরা আবার অন্য একটা জায়গায় চলে যায়। এইভাবে ঘুরে ঘুরে বেড়ায়। সেই কতদিন আগে থেকে মানুষের জন্মানোর বহু বহু আগে। আর মজার কথা কি জানিস তিতুন হাতিদের এই খাবার জোগাড় করার যে স্মৃতি তারা কিন্তু তাদের প্রজন্মের পর প্রজন্ম বয়ে নিয়ে চলেছে। তারা ঠিক জানে কোথায় তাদের খাবার জল, স্নান করার জল, উপযুক্ত খাবার পাওয়া যায়। কিন্তু মুশকিল হলো আমরা তাদের সেইসব জায়গাগুলো নষ্ট করে ফেলছি। তাদের যাওয়ার রাস্তায় আমরা রেল লাইন বসিয়েছি। রাস্তা তৈরী করে দিয়েছি। কোথাও চা বাগান হয়েছে। বড় বড় বাড়ি তৈরি করে ফেলেছি। আকাশচুম্বী ইলেকট্রিক টাওয়ার বসিয়েছি। এর ফলে ওরা দিন দিন বিপন্ন হয়েছে। ওদের খাবার গেছে কমে। ওদের থাকার জায়গাও বিলুপ্ত। নেই বললেই চলে। অত বড় প্রানী। জায়গাও তো কম লাগে না। একটু নিজেদের মতো করে থাকবে সেই উপায়ও কি রেখেছি আমরা?তিতুনের কেমন যেন মন খারাপ হয়ে যায় আবার। এবার তাহলে কী করবে ওরা?
মামা বললো, কষ্ট পাচ্ছে। অথচ ভেবে দেখ ওরা কিন্তু খুব সুশৃঙ্খলিত। পরিবার নিয়ে বসবাস করে ঠিক আমাদেরই মতো। আর সেই পরিবারের যিনি প্রধান তিনি হন একজন মহিলা হাতি। মাতৃতান্ত্রিক সমাজ ওদের। সেই বিচক্ষণ প্রাজ্ঞ মহিলা হাতির দায়িত্ত্বেই সবাই থাকে। তিনিই নির্দেশ দেন কোথায় যাওয়া হবে। কারা কারা দলে থাকবে। সেইরকমই খাবারের সন্ধানে যখন তারা একটা জায়গা থেকে আর এক জায়গায় যাচ্ছিল তখনই তিস্তার খরস্রোতায় রাতের অন্ধকারে একটা বাচ্চা হাতি ভেসে যায়। অনেক ভোরে ওয়াচ টাওয়ারে যে ফরেস্ট গার্ডরা ডিউটি দিচ্ছিলেন তাঁরা দেখেন দূরে নদী দিয়ে কালো মতো কি ভেসে যাচ্ছে। চটপট দূরবীন চোখে লাগিয়ে তাঁরা বুঝতে পারেন আসলেই ওটা হাতির শুড়। জলের ওপরে ওঠানো। তার পিঠটা শুধু দেখা যাচ্ছে। সঙ্গে সঙ্গে তিন চার জন মিলে বড় দড়ি নিয়ে ঝাঁপিয়ে পড়ে সেই খরস্রোতা নদীতে। কোনো রকমে উদ্ধার করা হয় একটা হাতির বাচ্চাকে। তার তো তখন সারা রাত বৃষ্টিতে ভিজে, জলে চুবে, ভয়ে কাহিল অবস্থা। শীতে ঠক ঠক করে কাঁপছে।
তখন তাকে কী করা হলো? ঘুম-টুম উবে গিয়ে গোল গোল চোখ করে তিতুন জানতে চায়।
কী আবার করা হবে? ভালো করে মোছা হলো তার গা। কম্বল দিয়ে ঢেকে দেওয়া হলো। আর একটা লম্বা পাইপে করে এক বালতি দুধ খাওয়ানো হলো তাকে। তারপর সে রয়ে গেল আমাদের কাছে। আদর করে নাম দেওয়া হলো টারজান। কেন বলতো টারজান?
কেন? আমার মতোই খুব ছটফট করতো বলে? তিতুনের কথায় মামা হেসে ফেলে।
ঠিক বলেছিস। তোর মতো ছটফটে ছিল টারজান। সেবারে জলদাপাড়ার পিলখানায় এক বিদেশী পর্যটক এলেন ফটো তুলতে। খুব নাম করা তিনি। হাতিদের নিয়ে কাজও করেছেন পৃথিবী ঘুরে ঘুরে। বেশ কয়েকটা বই আছে তাঁর। আমরা আগে থেকেই সাবধান করে দিয়েছিলাম যে পিলখানায় কয়েকটা বাচ্চা আছে তারা কিন্তু ভীষণ দুষ্টু। তা ভদ্রলোক তো ছবি তুলতে শুরু করলেন। আর বেশি ছবি তুলতে লাগলেন বাচ্চা হাতিগুলোর। প্রথমে তারা কিছুই বলছিল না। কিন্তু একটা সময় হলো কি উনি একটু আদর করতে গেলেন তাদের। আর যায় কোথায়। ব্যাস ওরাও মজা পেয়ে গেল। তারমধ্যে একজন অতি উৎসাহে তার পায়ের ওপর একটা পা তুলে দিলো। কোলে উঠতে চায় যেন। এবার হাতির পা বলে কথা। কোথায় হাতির পা বলে কথা। গেল একটা আঙুল ভেঙে সাহেবের। ওরা যে ইচ্ছে করে এটা করেছিল তা নয়। মজা করতে করতে লেগে গিয়েছিল। সেই দুষ্টু বাচ্চা হাতিটা কে বলতো?
তিতুন চটপট জবাব দিলো- কেন টারজান।
মামা বললো ঠিক বলেছিস।
কিন্তু তোমরা টারজানকে ওর মায়ের কাছে ফেরত দিয়ে এলে না কেন? তিতুন জানতে চায়। ওকে তো মায়ের কাছে দিয়ে এলেই আর কোনো কষ্ট হতো না। খুব ভালো ভাবে থাকতে পারতো।
তিতুনের প্রশ্নের জবাবে বড়মামা বললো, তার মা ঠিক কে সেটা খুঁজে বের করা মুশকিল ছিল। তবে আমরা খোঁজার চেষ্টা করেছিলাম। বেশ কিছুদিন। কিন্তু পাওয়া যায়নি। এমন অনেকবার আগেও হয়েছে। ভেসে আসা বাচ্চা হাতির দলকে ট্রেস করা যায়নি। আর যাদের গেছে, খুঁজে পেতে সেই হাতির দলের কাছে বাচ্চা রেখে এলেও দল যে তাকে ফিরিয়ে নেবে এমন কোনো নিশ্চয়তা নেই। বেশিরভাগ ক্ষেত্রেই সেই দল তাকে আর ফেরত নেয়নি। কারণ ততদিনে তার গায়ে মানুষের গন্ধ লেগেছে। সে এক অন্য জীবন যাত্রায় অভ্যস্ত হয়ে পড়েছে। এইরকম কত কত হাতি যে ফরেস্ট ডিপার্টমেন্ট উদ্ধার করেছে তার কোনো ঠিক ঠিকানা নেই। এইসব হাতিরাই বনের মধ্যে বন দপ্তরের হয়ে কাজ করে। পর্যটকদের ঘোরায়। রাতে ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে বন পাহাড়া দেয়। তাছাড়া কারোর ক্ষেতে বনের হাতি ঢুকে পড়লে তাদের তাড়ায়। অনেক অনেক কাজ করে। মাথায় রাখিস আমরা কিন্তু কোনো হাতি ধরিনা। সেটা আইনত দন্ডনীয় অপরাধ। নে এবার শুয়ে পড়। কাল ভোর বেলায় টারজান আসবে। তোকে ঘোরাতে নিয়ে যাবে। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রানীটির সঙ্গে তোর যদি খুব ভালো বন্ধু হয়ে যায় তিতুন, তাহলে দেখবি কি আনন্দ লাগছে। আর কত কি জানতে পারছিস। মামা ঘরের লাইট নিভিয়ে দিয়ে পাশ ফিরে শুলো। কিন্তু তিতুনের ঘুম আসতে চাইলো না। এই প্রথম সে হাতির পিঠে চড়বে। সেটা কম কথা নাকি? বৃষ্টিটা একটু থেমে যেতেই কানে তালা দেওয়ার মতো ঝিঁঝি ডাকতে শুরু করলো। সেই ঝিম ধরা ঝিঁঝির আওয়াজে কখন যে ঘুমিয়ে পড়লো তিতুন নিজেই বুঝতে পারলো না।ভোর বেলায় টুং টুং ঘন্টার আওয়াজে ঘুম ভেঙে গেল তিতুনের। টারজান এসে পড়েছে। তারসঙ্গে মাহুত রামদাসও। তিতুনও তাড়াতাড়ি একটা জ্যাকেট পরে বেরিয়ে এলো। কারণ ভোরবেলায় বেশ শীত ছিল। টারজান তিতুনকে দেখেই শুঁড় বাড়িয়ে দিলো।
কি বলছে বল তো টারজান তোকে? মামা মুচকি হেসে জানতে চাইলো।
তিতুন বললো সোনপাপড়ি। কিন্তু সক্কালবেলা উঠে সোনপাপড়ি খাওয়া ভালো নয় টারজান। তুমি কলা খাও। তিতুন এক ছড়া পাকা কাঁঠালি কলা খাওয়ালো টারজানকে। সেই কলা খেয়ে কি খুশি টারজান। আবার তিতুনের মাথায় শুঁড় বুলিয়ে আদর করে দিল।
টারজানের পিঠে উঠতে তিতুনের মোটেই কষ্ট হল না। বসার জায়গাটা পিঠের ওপরে বস্তা দিয়ে গদি করা। সেই গদিটা আবার টারজানের পিঠ বরাবর এসে পেটের তলা দিয়ে বাঁধা। ওই দড়িটা ধরেই তিতুন ট্রেনের কামরায় যেমন ওপরের বাঙ্কারে উঠেছিল তেমন উঠে পড়লো। সামনে মাহুত রামদাস। আর পেছনে তিতুন।
টারজানের পিঠে চড়ে তিতুন গভীর জঙ্গল দেখলো। কত কত পাখি, কত রকমের গাছ, খরগোশ, ময়ূর, হরিণ এমনকি চিতাবাঘও। চুপটি করে বাঘটা গাছের ডালে বসেছিল। তিতুনদের দেখে ঝাঁপ মেরে পালালো। মাহুত রামদাস তাকে নিয়ে গিয়েছিল কোদাল বস্তি, রাভা পাড়া, মেচ পাড়া। যেখানেই টারজান যাচ্ছিল সেখানেই সবাই তাকে খেতে দিচ্ছিল। আদর করছিল। যেন মনে হচ্ছিল টারজান তাদের ঘরের ছেলে। এরপর তিতুন একদিন সারা রাত টঙেও কাটিয়েছিল। ও টঙ মানে জানো কী? গাছের ওপরে বানানো একটা ঝোলানো চালা বা পাটাতন। যেখান থেকে ক্ষেতের ফসল পাহাড়া দেওয়া যায়। সেই টঙে বসেই রাত জেগেছিল তিতুন। বুনো হাতিরা ফসলের ক্ষেতে ঢুকে পড়লে টিন বাজিয়েছিল গ্রামের মানুষের সঙ্গে। এমনকি টারজানের পিঠে চেপে ফরেস্ট গার্ডদের সঙ্গে সেই বুনো হাতির দলকে জঙ্গলের অনেক ভেতরে রেখে এসেছিল। আসেপাশের সবাই চিনে গিয়েছিল তিতুনকে। বিশেষ করে টারজান তো চিনে ছিলই। কারণ তিতুনের মতো টারজানও খেতে খুব ভালোবাসে। তিতুনের সঙ্গে থাকলে বেশ এটা ওটা খাওয়া যায়।এরপর যতদিন তিতুন চিলাপাতায় ছিল ততদিন তিতুনের কাছে আসতে ভুলতো না টারজান। রোজ তিতুন টারজানের পিঠে চড়ে বেড়াতে বেরোতো। তার ছোটকার দেওয়া খাতা ভরে যাচ্ছিল টারজানের নানা রকম গল্পে। সেইসব গল্প স্কুলে, বাবার অফিসে, দাদার কোচিং-এ, ছোটকার কাজের জায়গায় ঘুরে বেড়াতে লাগলো। আর সবার ইচ্ছে করলো টারজানকে একবার দেখে আসতে। তারসঙ্গে বন্ধুত্ত্ব করতে। তিতুন সবাইকে শুধু হাতির গল্পই বললো না। সে জঙ্গল থেকে শিখে এসেছিল অনেক কিছু। তার গল্পে সে বলেছিল গাছ কেটো না। জঙ্গল ধ্বংস করো না। তাহলে আমাদের ক্ষতি হবে। পৃথিবীর প্রাচীনতম প্রানীদের আর বাঁচানো যাবে না। ওদের বিপদ মানে আমাদের বিপদ। পৃথিবী কিন্তু এইসব কিছু সহ্য করবে না। সে তার শোধ তুলবেই। কাজেই এখন থেকে সচেতন হও।
এরপর প্রত্যেক বছর তিতুন টারজানের সঙ্গে দেখা করতে যেত। ওরা খুব ভালো বন্ধু হয়েছিল। এখনও তিতুনের সঙ্গে আমার দেখা হলে আমি শুধু টারজানের গল্প শুনতে চাই। আর মনে মনে ভাবি কবে যেতে পারবো জঙ্গলে। চুপটি করে বসে থাকবো তিস্তা কিম্বা তোর্সা নদীর পাড়ে। আস্তে আস্তে সন্ধ্যে নামবে আর জোনাকিরা ঘিরে ধরবে আমাকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন