ছবির নতুন ভাষার সন্ধানে
কাশফুলের মধ্যে দিয়ে ছুটে চলেছে দুই
ভাইবোন। তাদের চোখে অপার বিস্ময়। দূর থেকে ভেসে আসছে তাদের জীবনে না দেখা এমন এক যান
যা তাদের কল্পনাকে মোহিত করে রেখেছে বেশ কিছুদিন। যবে থেকে তারা শুনেছে বাবার কাছে
রেলগাড়ির গল্প। ক্রমে শব্দ দূর থেকে কাছে আসে। ছুটতে গিয়ে দিদি দূর্গা পড়ে যায়। ভাই
অপু দেখে বিশ্বের বিরলতম আবিষ্কার রেলগাড়ি। যা যান্ত্রব, গতিময়, নিদারুণ, পদে পদে এগিয়ে
যাওয়ার লোভ দেখায়। সত্যজিতের অপু ট্রিলজিতে এই রেল গাড়ি কি অমোঘ এক নিয়তির দিকে নিয়ে
যায় মূল প্রটাগোনিষ্ট অপুকে তা আমরা যারা ছবিগুলো দেখেছি তারা জানি।
সত্যজিতের দুর্গা রেলগাড়ি দেখতে পায়নি।
তার দেখার উপায় ছিল না। সে ছিল তার পিসি ইন্দিরঠাকরুনের ‘অবশেষ’। যাদের নিশ্চিন্দিপুরের
ওই গ্রামের বেড়াজালের মধ্যেই দম বন্ধ করে মরতে হয়েছে। কেউ মরার সময় জল পর্যন্ত পায়নি।
আবার কাউকে মরতে হয়েছে বিনা চিকিৎসায়, অপুষ্টিতে। তাদের রেলগাড়ি দেখার সৌভাগ্য হবে
কী করে? যা আসলেই আধুনিকতার প্রতিভূ। টেনে নিয়ে যায় গ্রাম থেকে শহরে। রুটি রুজির টানে।
বেঘর করে। এই উৎপাটনের কাহিনী আছে ছবিগুলোর পরতে পরতে। আমরা জানি ইন্দিরঠাকরুন এবং
দুর্গা তাও নিজের গ্রামে, ভিটেতে মরতে পেরেছিলেন। কিন্তু হরিহর আর সর্বজয়া? তাদের শেষ
পরিণতি কি নির্মম করুণ। তারাও কি ইন্দিরঠাকরুনের অবশেষ হয়ে দেখা দেন না সাদা পর্দায়?
খুব সুন্দর করে শতাব্দীর প্রাচীন চরিত্রদের অবশেষের চিত্রকল্প হিসেবে গড়ে তুলেছেন অধ্যাপক
প্রাবন্ধিক রুশতী সেন তাঁর ‘সত্যজিতের বিভূতিভূষণ’ বইটিতে। কিন্তু সেতো কোনো সাহিত্য
থেকে চলচ্চিত্রে পরিগ্রহণের হিসেব নিকেষ তার তাত্ত্বিক ব্যাখ্যা। আমাদের আলোচনা আসলেই
এইসব থেকে রস গ্রহণ করে ছবির ভাষার দিকে।
সেটা কেমন?
সাদা পর্দায় ইমেজ এবং সাউন্ডে যে জগত
তৈরী হচ্ছে সেটা একটা ভাষা। যা সাহিত্য, চিত্রকলা, নাটক, সঙ্গীত এইসবের থেকে সম্পূর্ণ
আলাদা। কিম্বা যা সবকিছুর সংমিশ্রণ। কারণ চলচ্চিত্র সবার থেকে পরিগ্রহণ করেছে এক নবীন
শিল্প হিসাবে। যে ভাষার দিকে আসলেই আমরা আসতে আসতে এগোতে চাইছি। দেখে নিতে চাইছি কিভাবে
এই ভাষাকে ব্যবহার করছেন সত্যজিৎ। নিজের মতো করে গড়ে তুলছেন। কিন্তু
সেটা তো একদিনে হয়নি। তাঁকে আসতে আসতে চর্চার মাধ্যমে শিখতে হয়েছে। ‘চলচ্চিত্র রচনাঃ আঙ্গিক, ভাষা ও ভঙ্গি’ নামের প্রবন্ধে
তিনি খুব সুন্দরভাবে ব্যাখ্যা করেছেন-
‘লেখকের হাতে যেমন কথা, চলচ্চিত্র রচয়িতার হাতে তেমনি ছবি (image) ও শব্দ
(sound)। এই দুইয়ে মিলে যে ভাষা, তার প্রয়োগে যদি মুন্সিয়ানার অভাব হয়, তার ব্যাকরণ
যদি রচয়িতার আয়ত্তে না থাকে এবং সব মিলিয়ে ছবির বক্তব্যে যদি জোর না থাকে, তাহলে ভালো
ছবি হবে কী করে? এতো যে লেখা হয়, তার কতটুকুই বা সাহিত্য হয়ে ওঠে? শিল্পী আগে তারপর
তো শিল্প। যেখানে শিল্পী নেই, সেখানে শিল্পের উপকরণ থাকলেও শিল্পের উদ্ভব সম্ভব নয়।
চলচ্চিত্রে যে অন্য শিল্প সাহিত্যের লক্ষণ আছে তাতে কোনো সন্দেহ নেই। নাটকের দ্বন্দ্ব,
উপন্যাসের কাহিনি ও পরিবেশ বর্ণনা, সংগীতের গতি ও ছন্দ, পেইন্টিং সুলভ আলোছায়ার ব্যাঞ্জনা
এইসবই চলচ্চিত্রে স্থান পেয়েছে। কিন্তু ইমেজ ও ধ্বনির যে ভাষা, দেখানো শোনানোর বাইরে
যার প্রকাশ নেই, সে একবারে স্বতন্ত্র ভাষা। ফলে বক্তব্য এক হলেও ভঙ্গির তফাত হতে বাধ্য।
এভঙ্গি চলচ্চিত্রের বিশেষ ভঙ্গি। তাই অন্য শিল্প সাহিত্যের লক্ষণ থাকা সত্ত্বেও চলচ্চিত্র
অনন্য।‘
এই অনন্য চলচ্চিত্রের ভাষা তার আঙ্গিক
সময়ের সাথে সাথে একটু একটু করে বদলেছে সত্যজিতের ছবিতে। আমাদের সময় এবং পরিসর কম। বিস্তৃত
ব্যাখ্যার সুযোগ নেই। কিন্তু এই স্বল্প পরিসরে আমরা দেখে নেওয়ার চেষ্টা করবো তাঁর প্রথম
দিকের ছবিতে নিজস্ব ভাষার দিকে কিভাবে এগিয়ে যাচ্ছেন সত্যজিৎ। তার নিজস্ব
এক ঘারানা তৈরী হচ্ছে। গোটা পৃথিবী অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকছে তাঁর ছবির দিকে। সেই সলতে
পাকানো সময়ের দিকে আমরা একটু ফিরে তাকাতে চাই।
আমরা জানি সত্যজিৎ বিভূতিভূষণের কাহিনীর সিনেমাটিক রিপ্রেজেন্টেশান এর কথা ভাবতে
শুরু করেছিলেন সিগনেট প্রেস থেকে যখন আম আঁটি ভেপুর সচিত্র সংস্করণ নির্মাণ করছেন তখনই।
আর এই ছবির ভাষা? তার দৃশ্যময়তা? এই যে জলের ওপর ফড়িং এর নাচানাচি? ঘনঘোর বৃষ্টির মধ্যে
অপু দুর্গার ভিজতে থাকা? এগুলো সব কিছুই কি এমনভাবে নতুন করে দেখা দিল সাদা পর্দায়?
এর আগে কেউ কি এইভাবে গল্প বলেনি? গ্রামকে দেখায়নি? আমাদের দেশকে? একটা সংস্কৃতিকে?
সত্যজিৎ যখন ছবি করতে এসেছেন তার আগেও তো অনেকটা
পথ পেরিয়ে এসেছে ভারতীয় চলচ্চিত্র। তাহলে কি এমন হলো যার জন্য এই ছবিটা একটা মাইলস্টোন
হয়ে থেকে গেল? কোনো কিছু আলোচনা হলে, পড়ানোর সময়, ইতিহাসকে ফিরে দেখতে হলে, নানা সময়
আমাদের এই ছবিটার কাছে ফিরতে হয়। কেন? শুধুমাত্র বিদেশ থেকেই ভূয়সী প্রশংসা পাওয়ার
জন্য? আমার মনে হয় উত্তরটা এতো সহজ নয়। কিম্বা বলা যায় এতো সরলীকৃত নয়। একটা দীর্ঘ
পথ পেরোতে হয়েছে পথের পাঁচালীর ছবির ভাষায় পৌঁছতে। তার তৈরী হওয়ার সময়টা ছিল চর্চার।
অনুশীলনের। অনুধ্যানের।
সিনেমা নিয়ে সিরিয়াস পড়াশুনো করার
একটা পরিসর গড়ে উঠলো। যাঁরা সেই পরিবেশ তৈরী করতে চেষ্টা করলেন তাঁরা পরবর্তীতে বাংলা
তথা ভারতীয় ছবির মোড় ঘুরিয়ে দিয়েছিলেন। সেই কবে কতদিন আগে ভারতীয় ছবি হলিউডের প্রভাব
মুক্ত হয়ে নিজস্ব ভাষা গড়ে তুললো। আন্তর্জাতিক মহলে নিজস্ব একটা মর্যাদা তৈরী করলো।
স্টুডিও সিসেটেম, স্টার প্রথা এগুলোকে দূরে সরিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল একটা সিনেমা নির্মাণের
কৌশল। আসল লোকেশান ব্যবহার। যারা এর আগে কোনোদিন ছবিতে অভিনয় করেননি তাদের অভিনেতা
হিসেবে ভাবা। ইতালীয় বাস্তবধর্মী ছবিকে অনুকরণ নয় তাকে পাথেয় করে এক নতুন দৃষ্টিভঙ্গীতে
সমকালকে দেখা খুব সহজ ছিল না। সত্যজিতের ছবি তৈরী করার সেই গল্পগুলো এখন মিথের পর্যায়ে
পৌঁছে গেছে।
পথের পাঁচালীর আগে দুটো বিশ্বযুদ্ধ
দেখে ফেলেছে পরাধীন দেশ। দাঙ্গা, মন্বন্তর এবং দেশভাগ। তার মধ্যেই দেশ যখন স্বাধীন
হচ্ছে ঠিক সেই বছরেই কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির জন্ম। যেখানে ছবি নিয়ে চর্চা হবে। বিভিন্ন
দেশের ছবি দেখানো হবে। শিক্ষিত হতে হবে নিজেদেরকে। ছবি সেখানে শুধু বিনোদন নয়। ছবি
সেখানে একটা টেক্সট। পাঠ্য। যদিও যে সময়ের কথা বলছি তখন সিনেমা আদৌ শিল্প কিনা সেই
নিয়ে বাক বিতন্ডা চলছে প্রচুর। ছবি নিয়ে গভীর অনুধ্যানের দিকে খুব যে তেমন নজর পড়েছে
তা নয়। কয়েকটি বিচ্ছিন্ন ব্যক্তিগত উদ্যোগ ছাড়া।
তিরিশের দশকের একদম গোড়ার দিকে গিরিজা
বসু, নরেন্দ্রদেব এঁদের প্রচেষ্টায় ‘সিনেমা লাইব্রেরী’ প্রতিষ্ঠিত হচ্ছে। উদ্বোধনী
ভাষণে অবনীন্দ্রনাথ ঠাকুর বলছেন, ‘সিনেমা আমাদের দেশে এসে গেছে। এসে যখন গেছে তখন সে
বিষয়ের জ্ঞান আমরা লাভ করবো না কেন? সে জ্ঞান সঞ্চয়ে আমাদের বাধা কোথায়?’ অনেক পরে
ফিল্ম সোসাইটির অন্যতম প্রতিষ্ঠাতা সত্যজিৎ রায় তাঁর ‘অপুর পাঁচালী’তে লিখবেন, ‘শান্তিনিকেতনে থাকতে প্রায়ই ভাবতাম যে,
দর্শকের মনে যাতে ছবির ভালো মন্দ সম্পর্কে একটা বোধ জন্মায় তারজন্য কিছু করতে হবে।
সেই লক্ষ্যেই এটা (ফিল্ম সোসাইটি) একটা প্রাথমিক পদক্ষেপ’।
মাত্র পঁচিশজন সদস্য নিয়ে ১৯৪৭ সালের
৫ অক্টোবর কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সূত্রপাত হয়। চলচ্চিত্র চর্চা, তার শিক্ষা এবং অনুশীলনের
এক নতুন অধ্যায় শুরু হয় সদ্য স্বাধীন হওয়া দেশের একটি শহরে হাতে গোনা কয়েকটি মানুষের
মধ্যে। এর ফল যে কত সুদূর প্রসারী হয়েছিল যাঁরা চলচ্চিত্র নিয়ে ভাবেন, কথা বলেন পড়াশুনো
করেন তাঁরা ঠিক অনুধাবন করতে পারবেন। আজ যে কলেজে, বিশ্ববিদ্যালয়ে ছবি নিয়ে পঠন পাঠন
হচ্ছে তার কৃতজ্ঞতা সেই সময়কে দিতে হয়। তাঁদেরও যাঁরা ভেবেছিলেন চলচ্চিত্র আসলেই শিক্ষার
একটি বিষয়। শুধু ছবি দেখা নয়। তাকে নিয়ে চর্চা, লেখালিখি এবং ছবি নির্মাণ। প্রথম দিকে
সত্যজিৎ রায়ের বৈঠকখানায় ষোলো মিলিমিটারে ছবি
দেখানোর ব্যবস্থা হয়েছিল। তারপরে সোসাইটির নিজস্ব ঘর হয়। এমনকি পত্রিকাও। ছবি যিনি
করতে আসবেন তাঁর ইনার আই তৈরী হচ্ছে অনেক আগে থেকেই একটু একটু করে।
যাঁরা এই সময়টা নিয়ে কথা বলেন তাঁরা
চারটি বিশেষ ঘটনার ওপর নজর দেন। যার প্রভাব পড়েছিল তাঁর সতীর্থদের মতো সত্যজিৎ রায়ের
ওপরেও। প্রথমত ১৯৪৭ সালে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সূত্রপাত। এই ক্লাবটা সেইসব
তরুণদের এক জায়গায় জড়ো করলো যারা আসলেই গড্ডালিকা প্রবাহে গা ভাসাতে রাজী নয়। চলচ্চিত্র
তাদের কাছে শিল্প। এবং নিজেদের বক্তব্য প্রকাশের হাতিয়ার। দ্বিতীয়ত ১৯৪৯
সালে রেনোয়ার ভারতে আসা। বিশেষ করে কলকাতার এক দঙ্গল তরুণ বিশেষ করে কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির
সদস্যদের সঙ্গে তাঁর আলাপ। শুধু তাই নয় তাঁদের মধ্যে বেশ কয়েকজনের রেনোয়ার ইউনিটে কাজ
করা। এদের মধ্যে অনেকেই পরবর্তীকালে চলচ্চিত্র শিল্পে তাদের নিজস্ব অবদান রাখবেন। রেনোয়ার
সঙ্গে কাজ করার সুবাদে দৃষ্টিভঙ্গির এক আমূল পরিবর্তন আসছিল। যিনি কাজ করছিলেন না অথচ
অন্তরঙ্গ আলাপ জমে উঠছিল সেই সত্যজিৎ রায়ও অফিসের ফাঁকে, ছুটির দিনে চলে যেতেন দ্য
রিভার ছবির শ্যুটিং দেখতে। ‘কলকাতায় রেনোয়া’ শীর্ষক প্রবন্ধে সত্যজিৎ সরাসরি স্বীকার করেছেন কিভাবে এক অন্য
দেখায় ভাবতে সাহায্য করছিলেন রেনোয়া। উদ্বুদ্ধ করছিলেন ছবির এক নতুন ভাষার সন্ধান করতে
যা হলিউড থেকে সম্পূর্ণ আলাদা। ভারতের মাটির সাথে সম্পৃক্ত। তার সংস্কৃতির সঙ্গে অঙ্গাঅঙ্গি
ভাবে যুক্ত।
‘ ফুলে আলো করা পলাশের একটা গাছ দেখিয়ে রেনোয়া বললেন, ‘দেখুন ওই ফুলগুলো।‘ ছবির
জন্য উপযুক্ত লোকেশান সন্ধানে সেই প্রথম আমি তার সঙ্গী হয়েছিলাম। ‘কি সুন্দর না? ফুল
কিন্তু আমেরিকাতেও আছে। যেমন পয়েনসেটিয়া-ক্যালিফোর্নিয়ায় অজস্র ফোটে। কিন্তু তাকিয়ে
দেখুন ওই কলাগাছের ঝাড়, তার নিচে ছোট্ট সবুজ ডোবাটি। এ জিনিস ক্যালিফর্নিয়ায় নেই। এই
হচ্ছে বাঙলাদেশ’। রেনোয়া যে উপযুক্ত লোকেশান সন্ধানেই ছিলেন তা নয়, সেই সঙ্গে তিনি
খুঁজছিলেন খাঁটি এদেশি সুরটি, প্রাকৃতিক দৃশ্যের সেই বিশেষ রূপটি-ফিল্মে যা ছবি হিসেবে
ছবি আবার বাঙলাদেশের রূপ হিসেবে রূপ। তাঁর কথায় ‘ছবিতে বেশি জিনিস ধরাতে নেই। ঠিক যা
প্রয়োজন তা যত্ন নিয়ে দেখাতে পারলেই হল’।
১৯৪৯ সালে রেনোয়া যখন কলকাতায় আসেন
তখন এদেশের অধিকাংশ চিত্রপরিচালক, সমালোচক, ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির সঙ্গে যুক্ত লোকজন
রেনোয়া এবং তাঁর কাজ সম্পর্কে তেমন কিছুই জানতেন না। বলা ভালো পরিচিত ছিলেন না। সে
জানার আগ্রহ কতটা ছিল সেটাও সন্দেহের উদ্রেক করে। শুধু তাই নয় তাঁর এদেশে ছবি নির্মাণ
করতে আসাটাও অনেকের কাছে আপত্তিকর ঠেকেছিল। ব্যবসায়িক লেনদেনের এই সম্পর্ককে তাঁরা
এক মামুলী বিদেশী পরিচালকের ছবি করতে আসার ঘটনা হিসেবে গ্রহণ করেছিলেন। কিন্তু ঠিক
উলটো দিকে রেনোয়ার কাজের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন কলকাতা ফিল্ম সোসাইটির সদস্যরা। এরফলে
রেনোয়ার সংস্পর্শে এসে তাদের সমঝদারি আরও প্রখর হল। একদিকে বিশ্বের ছবির সঙ্গে পরিচয়
অন্যদিকে এক বিখ্যাত বিদেশী পরিচালকের সঙ্গে কাজ করার সুযোগ, তার সান্নিধ্যে আসা। পালটে
দিয়েছিল সবকিছু। সত্যজিৎ রায়কেও। হ্যাঁ তাঁর
ছবির ভাষা সন্ধানেও সাহায্য করেছিল। অপুর পাঁচালীতে লিখলেন-
‘মাঠ ময়দান, মানুষজন, পাকাবাড়ি, কুঁড়েঘর, কচুরিপানায় ভর্তি ডোবার ধারে কলাগাছের
ঝাড়-এসব দৃশ্য এত খুঁটিয়ে তিনি দেখতেন যে আমার তাক লেগে যেত। …তাঁর এই প্রতিক্রিয়া
দেখে আমার চোখও খুলে যাচ্ছিল। ছবি তোলার ভাবনাটা যে তিনি আমার মাথায় প্রথম ঢুকিয়ে দেন,
তাও স্বীকার করবো’।
এই রেনোয়াই বলেছিলেন, ‘দেখুন হলিউডের
প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের দেশী রুচি কখনো যদি গড়ে তুলতে পারেন, আপনারা তাহলে একদিন
মহৎ ফিল্মের জন্ম দিতে পারবেন’। সাদা পর্দায় দেশীয় ভাষার সন্ধান করছিলেন সত্যজিৎ। যে
ভাষা কল্লোল যুগে যাঁরা ছবি করতে এসেছিলেন তাঁদের থেকে আলাদা। তাঁরা লেখক হওয়া সত্ত্বেও
আলাদা। মালিক কন্যা ও শ্রমিকের মধ্যে প্রেম হল বটে কিন্তু চিত্রভাষার আমুল পরিবর্তন
কিন্তু আনতে পারেননি তাঁরা। সত্যজিৎ চলচ্চিত্র বিষয়ে লেখা অনেক প্রবন্ধে সেই ভাষার
দিকে মনোযোগী পাঠকের দৃষ্টি আকর্ষণ করেছেন। যদিও এরমধ্যেই কল্পনা, উদয়ের পথে, বাঁশের
কেল্লা নির্মিত হয়েছে। চেষ্টা করেছেন নিমাই ঘোষ ছিন্নমূল ছবিতে উদ্বাস্তুদের দেখাবার।
আসল লোকেশান ব্যবহার করার। কিন্তু তার এক ক্রমান্বয়ের পূর্ণতা এনে দিতে পেরেছিলেন সত্যজিৎ তাঁর পথের পাঁচালীতে।
আলোচনা করছিলাম বিশেষ ঘটনাগুলো নিয়ে।
যারা প্রভাব ফেলছিল এক নতুন ভাষার সন্ধানে। তরুণ সত্যজিতকে ছবি নির্মাণের পথে এগিয়ে
দেওয়ার। তারমধ্যে তৃতীয়টি হলো ১৯৫০ সালে সিগনেট প্রেস থেকে প্রকাশিত একটি বই
‘চলচ্চিত্র-প্রথম পর্যায়’। এটি একটি সংকলন গ্রন্থ। সম্পাদক মন্ডলীতে ছিলেন কলকাতা ফিল্ম
সোসাইটির কর্মকর্তারা। যেমন- সত্যজিৎ রায়, কমলকুমার মজুমদার, কবি নরেশ গুহ, রাধাপ্রসাদ গুপ্ত, সুভাষ সেন, চিদানন্দ
দাশগুপ্ত। শুধু ছবি দেখলে হবে না। লেখালিখি করতে হবে। চর্চা আরও সুদূর প্রসারী হল।
এই সময়ের কাছাকাছি সত্যজিৎ ভারতীয় চলচ্চিত্রের
অবস্থা নিয়ে স্টেটসম্যান পত্রিকায় লিখলেন একটি গুরুত্ত্বপূর্ণ প্রবন্ধ ‘হোয়াট ইজ রং
উইথ দ্য ইন্ডিয়ান ফিল্মস’।
‘গড়পড়তা মার্কিন ফিল্ম যে মডেল হিসাবে খারাপ সেটা বোঝা দরকার। কথাটি এইজন্য
বলছি যে ওতে যে জীবন বিন্যাস দেখানো হয়, আমাদের জীবন বিন্যাসের সঙ্গে তার বিন্দুমাত্র
মিল নেই। … সুতরাং ওই চাকচিক্য নয়, ভারতীয় সিনেমার আজ যা চাই তা হল তার কল্পনা শক্তি,
আরও সততা এবং এই মাধ্যমের যা যা সীমাবদ্ধতা তার যথার্থ উপলব্ধি’।
এতোদিন ধরে চলচ্চিত্রের সমালোচনায়
যে দিকের প্রতি সরাসরি দৃষ্টি নিবদ্ধ করা হয়নি এই প্রবন্ধে তাকে সজোরে যেন ধাক্কা দেওয়া
হল। অভিনয় রীতি, সেট, পোষাক পরিচ্ছদ, প্রভৃতি বিষয়ে মোটাদাগের মার্কিন ফিল্মের চাকচিক্য
ঝেড়ে ফেলে ভারতীয় সিনেমায় ভারতকে খোঁজার যেন একটা সুর বাজতে থাকলো। এই প্রবন্ধের এক
জায়গায় তিনি লিখলেন, ‘সর্বোপরি আমাদের সিনেমায় যা চাই তা হল একটা নিজস্ব শৈলী, একটা
প্রকাশভঙ্গী, একটা নিজস্ব রূপ। যাতে কিনা দেখা মাত্র একেবারে নিঃসংশয় হওয়া যায় যে,
এটা ভারতীয় সিনেমাই বটে’। সত্যজিতের এই কথার সাথে রেনোয়ার কথার মিল খুঁজে পাওয়া যায়।
তিনি বলেছিলেন তরুণ সত্যজিৎকে, ‘হলিউডের প্রভাব ঝেড়ে ফেলে দিয়ে নিজেদের দেশী রুচি কখনো
যদি গড়ে তুলতে পারেন, আপনারা তাহলে একদিন মহৎ ফিল্মের জন্ম দিতে পারবেন’। পেরেছিলেন
সত্যজিৎ। দেখিয়ে ছিলেন পথের পাঁচালী্তে সেই ভাষার প্রয়োগ।
শেষ এবং চতুর্থ হল ১৯৫২ সালে
কলকাতায় অনুষ্ঠিত প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব। এই প্রথম দর্শকদের কাছে বিশ্ব চলচ্চিত্রের দিগন্ত উন্মোচিত হল। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর
পরিস্থিতিতে ইতালিতে নির্মিত নববাস্তধর্মী ছবিগুলি বেশি নাড়া দিয়েছিল। হলিউডের বাইরে
যে চলচ্চিত্র ভাষার বাস্তববাদী আর এক নির্দশন সম্ভব তা একটু বড় পরিসরে দর্শকদের মধ্যে
এবং বিশেষ করে যাঁরা ছবি নিয়ে চর্চা করছেন, লিখছেন, নির্মাণের সাথে যুক্ত তাদের মধ্যে
প্রভাব বিস্তার করলো। আমরা জানি এর আগেই কার্যসূত্রে লন্ডনে থাকার সময়ে সত্যজিৎ দেখে
ফেলেছিলেন এমন কয়েকটি ছবি। এই উৎসব নিয়ে ঋত্বিক ঘটক পরিচয় পত্রিকায় একটি প্রবন্ধ লিখলেন।
সেখানে তিনি বললেন এই চলচ্চিত্র উৎসব কলকাতার সাংস্কৃতিক জীবনে সবচেয়ে বড় উল্লেখযোগ্য
ঘটনা। এটি এতোবড় এবং অভূতপূর্ব যে তার পরিপূর্ণ তাৎপর্য তখনই উপলব্ধি করা সম্ভব নয়।
‘এই উৎসবের আগে ও পরে দুটোর মধ্যে যেন একটা বিরাট পার্থক্য বর্তমান। অনেকগুলি
চলতি ধারণা ছিল এদেশে, যেগুলো অগ্রসর দেশগুলোতে রূপকথা বলে গৃহীত হলেও আমাদের অত্যন্ত
গাম্ভীর্যের সঙ্গে শোনানো হতো। … এই সমস্ত মিথ্যার ঊর্ণাতন্তু প্রথম দরজা খোলার হাওয়াতেই
উড়ে গেছে। আজকের বলিষ্ঠ জীবনের ধারা চলে এসেছে ইতালীতে, রাশিয়ায়, চেকোশ্লোভাকিয়ায়।
এসব দেশের ছবি কোনদিনই দেখানো হতো নাই বলা চলে। আজ আমরা সাধারণ দর্শকরা প্রথম দেখার
সুযোগ পেলাম।… কলকাতার দর্শকের কাছে এই উৎসব শিক্ষার একটি উৎস হিসাবে দেখা দিয়েছে।
আমরা আগে যেমনটি ছিলাম তেমনটি আর থাকতে পারি না’।
ছবির ভাষার পরিবর্তন আসছিল। আসছিল
মূল ধারার ছবির সঙ্গে দৃষ্টিভঙ্গীর তফাতও। নাহলে এক ব্রাহ্মণ পরিবারের উদ্বাস্তু হওয়ার
ঘটানায় কেন গোটা বিশ্বের চোখে জল এল? কেন মন কেমন করলো একটা মেয়েকে ভাঙা আয়নায় কাজল
পরতে দেখে? চিনিবাস ময়রার ছায়া পড়লো যে জলে সেই রকম এক পুকুরে নয় বরং আধ শুকনো এক ডোবায়
ভেসে চললো বাঁশবনের মধ্যে মরতে থাকা ইন্দির ঠাকরুনের ঘটি। পরিত্যক্ত বাস্তু ভিটেয় আশ্রয়
নিল সাপ। কবেকার মরে যাওয়া দুর্গার চুরি করা পুঁথির মালা ঢেকে দিল পুকুরের শ্যাওলা।
অবাক বিস্ময়ে অপু শুধু দেখলো। আমরা তার অংশীদার হলাম।
ছবির ভাষার এই সন্ধান এখানেই থেমে
যায়নি। সত্যজিতের প্রতিটি ছবিতে আছে তার নিজস্ব ভঙ্গিমা। আছে সুদীর্ঘ চর্চা এবং অনুশীলনের
ছাপ। জানি না কতটা গুছিয়ে লিখতে পারলাম। কিন্তু শেষ করতে ইচ্ছে করছে ঋত্বিক ঘটককে দিয়ে।
‘একমাত্র সত্যজিৎ রায়’ শীর্ষক বিখ্যাত প্রবন্ধে তিনি জানিয়ে ছিলেন তাঁর উপলব্ধি-
‘আমি মনে করি ভারতবর্ষে ছবির মাধ্যমটাকে যদি কেউ বোঝে তিনি হচ্ছেন একমাত্র সত্যজিৎ রায়’।
সত্যজিৎ স্মারক গ্রন্থ। কল্যানী বিশ্ববিদ্যালয়। ২০২৪। প্রকাশিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন