গোস্ট রাইটার
হারুকি মুরাকামির নরওয়েজিয়ান উড পড়তে খুব ইচ্ছে করছিল। দীপঙ্করদাকে বলতেই বই পাঠানোর ব্যবস্থা করে দিয়েছিলেন। মনে একটু সংশয় নিয়ে পড়তে শুরু করেছিলাম। জানি না কেমন লাগবে! অনুবাদ কেমন হবে! অনেক দিন ধরে বইটা পড়ার খুব ইচ্ছে। অথচ ইংরাজী জ্ঞান আমার খুব টনটনে বলে দাঁত ভাঙে। ডিকশনারি নিয়ে বসতে হয়। মেজাজ যায় খাট্টা হয়ে। বাবার বকুনিটা ছোটবেলার মতো ফ্ল্যাশব্যাকে ভেসে ওঠে। ‘ভাষাজ্ঞানের এই অশিক্ষাই তোমাকে ডোবাবে’। অনুবাদের জন্য তাই হাঁ করে বসে থাকতে হয়। একটু ভালো লাগলেই চেটেপুটে খেতে ইচ্ছে করে। হাজার বছরের নিঃসঙ্গতার মধ্যে একটা বই যেন মাথা উঁচু করে দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তায় যেতে যেতে, অটোর লাইনে, মেট্রোর ভিড়ে, কিম্বা খুব একান্তে সময় কাটানোর অছিলায় তারা ফিসফিস করে কথা বলে। কাছের বন্ধুদের বললে তারা একটু অবাক হয়। ওহ এতোদিন পরে পড়ছিস? বোঝাতে পারি না অনুবাদের জন্য পথ চেয়েছিলাম। আমার অপেক্ষাটা দীর্ঘ প্রতীক্ষার। হয়তো আমার মতো এমন অনেকেরই।
নরওয়েজিয়ান উড পড়ে ভীষণ ভালো লাগলো। মুরাকামির লেখা এর আগে পড়িনি। তাঁর লেখায় ডুব দেওয়া আমাকে এক অন্য ঘোরের মধ্যে যেন নিয়ে গেল। চারপাশের চরিত্র, সময়, আমাকে বেশ কয়েকদিন আর অন্য কিছু করতে দিল না। টানা শেষ করে ফেললাম বইটা এক নিঃশ্বাসে। আর তখনই নজর কাড়লেন অনুবাদক আলভী আহমেদ। এমন ঝরঝরে গদ্যে সাবলীল অনুবাদ ইদানিং কালে খুব কম পড়েছি। ইচ্ছে করলো তাঁর নিজের লেখা পড়ার। ল্যাপটপের ব্যাগে ঘুরতে থাকলো গোস্ট রাইটার।
মাইন একজন লেখক এবং সম্পাদক। সদ্য কাজ হারিয়েছে সে। চাকরীটা গেছে। তাই বেশ কিছুটা ঘাঁটা এখন জীবন। অনিয়মিত এবং অনিয়ন্ত্রিত তার সেই উঁচুতে থাকা ভাড়া নেওয়া ছোট্ট এপার্টমেন্টের মতো। অনেক রাতে কেরুর নেশায় নিজেকে শতছিন্ন করতে করতে সমস্ত রাগ গিয়ে উঠলিয়ে ওঠে ফেসবুকে। একটা লম্বা স্ট্যাটাস লিখে নেশায় বুঁদ হওয়া মাইন ঘুমিয়ে পড়ে। ব্যাঙ্ক একাউন্টে তখন মোটে কয়েকটা টাকাই পড়ে আছে। খুব কাছের একজন সবচেয়ে অপছন্দের বন্ধুর কাছ থেকে একটা কাজ পায় মাইন। একজন তাবড় অবসর নেওয়া আমলার লেখা ঠিক করে দিতে হবে। প্রায় পুরোটাই নতুন করে লেখা। কিন্তু সেই লেখায় মাইনের কোনো নাম যাবে না। সে থাকবে সাইলেন্ট। পর্দার পেছনে। নীরবে। সম্পূর্ণ গোস্ট রাইটার। অনেক শর্ত এদিক ওদিক করে মাইন রাজী হয়ে যায়। কারণ তার কাছে তখন যে টাকাটা তাকে অফার করা হয়েছে তা খুব দরকার।
মূল ম্যানুস্ক্রিপ্ট পড়ে ভালো লাগে না মাইনের। ভদ্রলোক আর যাইহোক ফিকশান লিখতে পারেন না। যদিও পলিটিকাল আর্টিকেল লেখার কলমে, নন ফিকশানে তিনি বেশ জনপ্রিয়। ইদানিং শখ হয়েছে উপন্যাসের। একটা লেখা বেরিয়েছে। কিন্তু তেমন কাটতি নেই। লেখার কনসেপ্টটা ভালো লাগে মাইনের। এক কাল্পনিক দ্বীপ যা হয়তো প্রতিফলিত করছে তার নিজের দেশকে। সম সময়ের অবস্থাকে। এই সম্পূর্ণ কাল্পনিক দ্বীপে বাজারে জিনিসপত্র কেনা হয় দেহের রক্ত আর ব্যক্তিগত স্মৃতির বিনিময়ে। মজাটা হয় যে চরিত্রগুলো মাইন সৃষ্টি করতে থাকে বাস্তবে তারা মাইনের চারপাশে ঘুরে বেড়ায়। আর সেই উপন্যাস লিখতে গিয়ে মাইনের কী হয় তা নিয়েই আলভী আহমেদের এক পলিটিক্যাল স্যাটায়ার থ্রিলার গোস্ট রাইটার।
বইটি একবার পড়া শুরু করলে থামা যায় না। আলভীর নিজস্ব লেখার স্টাইলের গোলক ধাঁধায় হারিয়ে যেতে হয়। তিনি লেখেন সিনেম্যাটিক ল্যাঙ্গুয়েজে। তাঁর বাক্য গঠন, শব্দের ব্যবহার, চরিত্রের খুব নিখুঁত ডিটেল, তাদের পেছনের গল্পের বর্ণনা সবাইকে কেমন যেন চোখের সামনে জ্যান্ত করে তোলে। কাজেই মাইনের হারানো শৈশব, একটা ধূষর মফস্বল শহর, তার ভালোবাসার জটিলতা, ঢাকার মতো শহরে তার দৈনন্দিন অস্তিত্ত্বের টিকিয়ে রাখা তার সঙ্গে পাশাপাশি এক কাল্পনিক দ্বীপ তার চরিত্র সব কিছু নিয়ে এক বা একাধিক দ্বন্দ্ব নির্মাণ হয়। যে কনফ্লিক্ট গুলোকে খুব মুন্সিয়ানায় সামলান লেখক। পাঠকের মনে প্রত্যাশা তৈরী করেন। আস্তে আস্তে মাইন তার ছায়াটাও হারিয়ে ফেলে। কী করে তারপরে মাইন? জানতে হলে পড়তে হবে গোস্ট রাইটার। অনেকগুলো চেনা ছায়ার অনুবৃত্ত হয়তো জড়িয়ে ধরবে পাঠককে। তবুও এর রুদ্ধশ্বাস গতি এগিয়ে যাবে একটা পাতা থেকে পরের পাতায়। এই মুন্সিয়ানা আয়ত্ত করা সহজ নয়। আলভীর লেখায় সেই অপার ক্ষমতা আছে।
অনেক শুভেচ্ছা লেখককে। তাঁর আরও লেখা পড়ার অপেক্ষায়।
গোস্ট রাইটার
আলভী আহমেদ
প্রচ্ছদ সব্যসাচী হাজরা
প্রকাশক বাতিঘর
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন