উইম ওয়েন্ডার্স

 

স্বাধীনতার মাত্র দু বছর পরে কলকাতায় এসেছিলেন বিখ্যাত ফরাসী পরিচালক জঁ রেনোয়া। সেটা নিতান্ত তাঁর ব্যক্তিগত কাজের সফর ছিল। তিনি শ্যুটিং করছিলেন ‘দ্য রিভার’ ছবিটির। সেই সময়ে বাংলা তথা কলকাতা ফিল্ম ইন্ড্রাস্ট্রির লোকজন তেমন তাঁকে পাত্তা না দিলেও, তাঁর কাজ সম্পর্কে সম্যক জ্ঞান না থাকলেও বেশ কয়েকজন তরুণের ছিল। কারণ স্বাধীনতার বছরেই তাঁরা খুলেছিলেন একটা ফিল্ম ক্লাব। ক্যালকাটা ফিল্ম সোসাইটি। যেখানে ছবি শুধু দেখানো হবে না। তা নিয়ে পড়াশুনো হবে, নিয়মিত চলবে চর্চা। সেইসব ছবিই প্রাধান্য পাবে যাদের সচারচর দেখা যায় না। যারা অপ্রতুল। এই তরুণদের মধ্যে কারা ছিলেন? এখন নাম শুনলে আঁতকে উঠতে হয়, তখন তাঁদের কেউ চিনতো না। সত্যিজৎ রায়, চিদানন্দ দাশগুপ্ত, ঋত্ত্বিক ঘটক, হরিসাধন দাশগুপ্ত, কমলকুমার মজুমদার, মৃণাল সেন, বংশী চন্দ্রগুপ্ত, সুব্রত মিত্র এমন আরও অনেকে। এঁদের মধ্যে কেউ কেউ সরাসরি যুক্ত ছিলেন রেনোয়ার ছবির সঙ্গে। পরবর্তীকালে এই সময়টাকে ফিরে দেখতে গিয়ে অনেকে একটা ক্রান্তিলগ্নের কথা বলেছেন। বাংলা ছবির এক আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্রের ভাষার অনুসন্ধানের আঁতুর ঘর। রেনোয়ার সঙ্গে শীর্ষক প্রবন্ধে সত্যজিৎ সরাসরি স্বীকার করেছেন যে মুগ্ধতায় একজন বিদেশী পরিচালক তাঁর স্বদেশকে দেখছিলেন তেমনটা তিনি এর আগে এমন ভাবে দেখেননি। রেনোয়া বারবার বলেছিলেন ছবির নিজস্ব দেশীয় ভাষার কথা। যে ভাষায় পরিচিতি পাবে আন্তর্জাতিক মহলে বাংলা তথা ভারতীয় সিনেমা। এই ভাষা কিন্তু কথ্য ভাষা নয়। এই ভাষা আসলেই ছবির একান্ত নিজস্ব ‘ভাষা’। যা শিখতে হয়। চর্চা করতে হয়। প্রয়োজন হয় সাধনার। আমরা জানি তার বেশ কয়েক বছরের মধ্যে একটা সিনেমা পত্রিকা প্রকাশ হয়েছিল সিগনেট থেকে-চলচ্চিত্র প্রথম পর্যায়। প্রথম আন্তর্জাতিক চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছিল। ঋত্বিক লিখেছিলেন, ‘আমরা যেমনটা ছিলাম তেমনটা আর থাকতে পারি না’। কোথাও একটা বিস্ফোরণ ঘটেছিল সাদা পর্দার ছবির ভাষায়। তার ফল কী হয়েছিল যথেষ্ট ভালভাবে আমরা জানি। বাংলা তথা ভারতীয় ছবিকে আন্তর্জাতিক মহলে স্বীকৃতির কোন শিখরে নিয়ে গিয়েছিল তা এখন ইতিহাসে পাঠ্য।
মনে পড়লো এই কথাগুলো অনেক কারণে। অনেক দিন পরে এই শহরে আমার মনে হয় বাংলা ছবির আরও একটা ক্রান্তিলগ্নে কলকাতায় আসছেন আর একজন বিখ্যাত পরিচালক উইম ওয়েণ্ডার্স। তাঁর কোনো ব্যক্তিগত সফরে নয়। ঝুলি ভর্তি করে তাঁর ছবি নিয়ে। অভিজ্ঞতাকে সঙ্গী করে। এটা কলকাতার কাছে যেমন গর্বের তেমনই শ্লাঘার বিষয়। কারণ এই শহরেই দেশের প্রথম সিনেমা হলটি ছিল। দেশ স্বাধীন হবার পর প্রথম ফিল্ম ক্লাব। ম্যাডানদের ওই অতোবড় স্টুডিও। যা এখনও কয়েকটা ফ্লোর নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বাকিটা ধ্বংস স্তুপ। নিউ থিয়েটার্সে অখন্ড ভারতের নানা ভাষাভাষির ছবি হতো এক সময়ে। তাঁর সঙ্গে ছিলেন এক ঝাঁক উজ্জ্বল শিল্পী ক্যামেরার সামনে এবং পেছনে। দেশের প্রথম মাল্টিপ্লেক্স নন্দন। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে দেশে প্রথম চলচ্চিত্রবিদ্যা নিয়ে পড়াশুনো। সিনেমা নিয়ে বাঙালির দাপাদাপি হই হুল্লোড় চিৎকার কম ছিল না। তাও আমাদের এমন ভাঁড়ে মা ভবানীর দশা হলো কেন? এই শহর শুধুই জেনেছিল তার প্রথম সবকিছু এমন বলছি কেন? কুড়িয়ে বাড়িয়ে এমন ইতিহাসের সামনে দাঁড় করাচ্ছি কেন যা একটা ভাঙা সময়কে জোড়া লাগাবার ব্যর্থ প্রচেষ্টা? এক, দুই তিন করে সেই কারণগুলো কি সত্যিই আমরা লিখতে পারবো কোনোদিন সাহস করে বুকের পাটা নিয়ে? যা কয়েক দশক ধরে আমাদের নিয়ে গেছে আমাদেরই অন্তর্জলি যাত্রার দিকে। জানা নেই। ইচ্ছেও কি নেই? নাকি হাত কাঁপবে?
তবুও আবারও এমন এক সময়ে আসছেন পরিচালক উইম ওয়েন্ডার্স এই ছবির শহরে, এই কবিতার শহরে সেটা আমার মতো বুড়োদের হাড়ে দুব্বো ঘাস গজানোর জন্য যথেষ্ট কিনা জানি না। কিন্তু তরুণদের যাদের দিকে তাকিয়ে আছে নতুন ছবির আঙ্গিক এবং ভাষা তারা নিশ্চই উপকৃত হবেন। অনেক দিন পরে শহরে হয়তো বইবে চলচ্চিত্র চর্চার এক অন্য আবহ। যা এই সময়ে একান্ত প্রয়োজন। একটা প্রশ্ন থেকে ঘনিয়ে উঠবে আরও অনেক প্রশ্ন যা যুগের ধর্ম। বয়সের সংঘাত। খুব মারাত্মক ঝোড়ো হাওয়া বইবে না জানি। তবুও বদ্ধ জলাশয়ে যদি দু একটা তরঙ্গ ওঠে ক্ষতি কী?
উইম ওয়েন্ডার্স ঘুরছেন ভারত। হাতে তাঁর সেই ক্যামেরা, অনুরাগীদের কাছে তাঁর সেই চিরপরিচিত পোজ। শুনেছি আদূরের সাথে দেখা করেছেন। কলকাতায় কার সঙ্গে দেখা করবেন তিনি? জানতে চাইবেন রে’র শহরে, ঘটকের শহরে, সেনের শহরে বাংলা ছবির হাল হকিকৎ? এটা না হয় একটা ধাঁধার উত্তর খোঁজার মতোই আশ্চর্যজনক কিছু থেকে যাক আমাদের সবার কাছে। হ্যাঁ বাংলা ছবির এই ক্রান্তি লগ্নে।

ছবি সৌজন্য- গুগুল ইমেজ

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি