খবর পড়ছি ছন্দা সেন

 

গঙ্গার ওপারে পুবদিকের আকাশে ফুলের আগুন লাগলে গুরুদ্বারে গ্রন্থসাহেব পড়া শুরু হতো। মৃদু দুলে দুলে বিড়বিড় করে গ্রন্থসাহেব পড়তেন এক সত্তরোর্ধ মানুষ। রাধারমণের মন্দিরে তখন কাঁসর ঘন্টা পিটিয়ে ভোর বেলার আরতি। ঘুম ভেঙেই একদা মহাভারতের কান্ডারি খাবেন মিছরি আর মাখন। ওদিকে বড় কাঠবাদাম গাছের তলায় দেওয়ান গাজীর মাজারের পাশে মসজিদে শুরু হয়েছে ফজরের নামাজ। জুটমিলের পাশে হনুমান মন্দিরে সুখেন্দর গুনগুন করে গাইছে রামচরিত মানস। তার সারা গা দিয়ে টপটপ করে গড়াচ্ছেন মা গঙ্গা।  হাতের ঘটির জলটুকু গিয়ে পড়ছে ঝাঁকড়া হয়ে ওঠা তুলসী গাছটার ওপর। গঙ্গার ধারের বড় মাঠে তখন জড়ো হয়েছে কচি কাঁচারা। তাদের বাড়ির লোকেরা। আরও অনেকে। সবাই যে এমন রোজ সক্কালবেলা বাড়ি ছেড়ে, ভোরের ঘুম নিঙড়ে নদীর ধারে চলে আসে তেমনটা নয়। কিন্তু হয়েছে কি মাঝরাত থেকে কারেন্ট অফ। প্যাচপ্যাচে গরমে সে এক নাজেহাল অবস্থা। ঘেমে নেয়ে একসা হয়ে তিতবিরক্ত সবাই তাই এসে জড়ো হয়েছে গঙ্গার ধারের মাঠে।

বামফ্রন্ট তো নয়। গরীবফ্রন্টের সরকার। নুন আনতে যাদের পান্তা ফুরোয় তারা আবার কারেন্ট দেবে কী? কোথাকার কোন সর্বহারার দল এসেছে রাজ্য শাসন করতে।’ গজগজ করতে করতে গায়ে তেল ঘষে এক সময়ের দাপুটে কংগ্রেস করা নিমাই চাটুজ্জ্যে। ভাবটা এমন হাতের সামনে নতুন মুখ্যমন্ত্রী জ্যোতি বসুকে পেলে এক্ষুনি লাশ ফেলে দেয় আর কি! যেমন দিয়েছিল সে নকশাল করা কয়েকটা ছেলেকে। ভাসিয়ে দিয়েছিল এই গঙ্গায়। অনেকেই জানে ব্যাপারটা। এখন বেশ কয়েক বছর কেটে গেলেও ঘটনাটা নিয়ে কানাকানি হয়। ফিসফিসানি। গেলবার পুরসভার ভোটে হেরেছে। মুখে চুন কালি পড়েছে। পাড়ার লোকজন বলেছে হবে না? হাতে লেগে রয়েছে যে তাজা প্রান গুলোর রক্ত। নিয়তি আর যাবে কোথায়? পাড়ার বখাটে গুলোও আর তেমন পাত্তা দেয় না। আড়ালে আবডালে ভ্যাঙায়। ছ্যাবলামি করে। যাদের পেছনে এক সময়ে কাঁড়ি কাঁড়ি টাকা উড়িয়েছিল তারাই দুয়ো দেয়। এই সকালে গলা পর্যন্ত জলে চুবেও তাই নিমাই খুড়োর গা চিড়বিড় করে ওঠে। সেটা শরীরের জ্বালা না মনের ঠিক বোঝা যায় না। ঝুপ ঝুপ করে ডুব দেয় জলে। মা গঙ্গা। ওপারের দক্ষিণেশ্বরের জাগ্রত কালি। উলটো দিকে কাঁচের মন্দিরে বসে থাকা রামকৃষ্ণদেব। চোখের সামনে সকালের সূর্য। আর তেত্রিশ কোটিরও বেশি দেব দেবীকে প্রনাম করতে করতে নিমাই খুড়ো হাউ হাউ করে কাঁদে। আবার ডুব দেয়। তার পাপের নিবৃত্তি করতে বলে।

নিমাই চাটুজ্জের এতোবার ডুব দেওয়াতে মা গঙ্গা বিরক্ত হন কিনা বোঝা যায় না। কিন্তু নদী থেকে পয়সা কুড়োতে গিয়ে পল্টুর মন সংযোগে ব্যাঘাত ঘটে। একে মানুষ দিন দিন কেমন যেন কিপটে হয়ে যাচ্ছে। দু হাত ঢেলে মা গঙ্গাকে আর পয়সা দিচ্ছে না। কাজেই খাটনি হচ্ছে প্রচুর। হাতের মালসা ভাঙা দিয়ে জল আছড়ে ফেলছে সে গঙ্গার ঘাটে। সেই জল সরে গেলে আগে কেমন চট করে এ্যালুমিনিয়ামের দশ পয়সা, পাঁচ পয়সা মাটির ওপরে ফুটে উঠতো। ছোঁ মেরে কুড়োতে পারলেই চলে যেত মুখের মধ্যে। পয়সার ভারে দুই গাল ফুলে টইটম্বুর হতো। মাসির দোকানে ঘুগনি, পাউরুটি, হজমিওয়ালার কাছে কুলের আচার, বিলাতি আমড়ায় কারেন্ট নুন মাখা দিব্যি হয়ে যেত। কিন্তু আজ একটা গাল ফুলোতেই পুবের সূর্য মাথায় উঠতে শুরু করেছে। আর একটু দেরী হলেই চার্চের সাতটার ঘন্টা পড়বে। ক্লাসে বই খাতা নিয়ে উপস্থিত দিতে না পারলে আজ আশ্রমে দুপুরের খাওয়া বন্ধ। হড়বড় করে পল্টু। যে করেই হোক মাসির দোকানের ঘুগনি পাউরুটির দাম তাকে তুলতেই হবে। ভাঙা মালসার জল ছিটোতে থাকে ভাঁটা পড়া গঙ্গার ভাঙা সিঁড়িতে। স্নান সেরে নিজের পাপের বোঝা অর্ধেক মা গঙ্গার ঘাড়ে দিয়ে ঘাটে উঠতে গিয়ে সেই ভাঙা মালসার জল গায়ে লাগে নিমাই খুড়োর। খিটমিট করে ওঠে লোকটা। আজন্মা গুলোর মুখ দেখাও পাপ। জোটে কোথা থেকে ছেলে গুলো? নিমাই খুড়ো খুব ভালো করেই জানে ছেলে গুলো কোথা থেকে জোটে। কোথায় থাকে। কারা তাদের হেনরি কিসকুর আশ্রমের সামনে ফেলে যায়। পল্টুর সেদিকে নজর নেই। ঢোকেও না কথা কানে। গরম ঘুগনির সুবাস ততক্ষণে তার নাক কান ঝালাপালা করে দিচ্ছে। পেটের মধ্যে ছুঁচোটা বলছে অনেকক্ষণ খাসনি পল্টু।

মা গঙ্গাকে সাক্ষী রেখে নদীর ধারের এই পাড়াটার বিস্তৃতি বেশ অনেকটাই। শোনা যায় বিদ্যাসাগর বিধবা বিবাহ প্রচলনের সময় এই পাড়ার বারেন্দ্র ব্রাহ্মণদের দ্বারস্থ হয়েছিলেন। তাঁদের মুখের একটা হ্যাঁ নাকি অনেক কিছু পালটে দিতে পারতো। সেবারের গ্রীষ্মে এই পাড়ায় নাকি তাই বসেছিল বিরাট ভোজের আসর। দুধ, আম, কাঁচা সন্দেশ মাখামাখি হয়েছিল ফলারের মালসায়। হুতোমও নাকি তাঁর নক্সাতে লিখেছেন এসবের কিছু কিছু? তাতে অবশ্য এপাড়ার বিধবাদের কপালে কি জুটেছিল তা নিয়ে কারও কোন গবেষণা ছিল না। এখনও নেই। অম্বুবাচি একাদশীতে গঙ্গার ঘাটে তাদের স্নান দেখলেই বোঝা যায় বিয়ে তো দূরের কথা বাড়ির মাছ মাংস আমিষ রান্নায় তারা থাকে সহস্র দূরে। বাড়ির কাজের লোকের থেকেও অবস্থা খারাপ হয় তাদের। একগোছা দড়ি কিম্বা একটা ঘড়াও জোটে না কপালে। জীবন তরনী পার করতে অপেক্ষা করতে হয় শেষ নিশ্বাস পর্যন্ত।

নদীর ধারে বড় বট গাছটা নাকি অনেক পুরনো। তার লম্বা ঝুড়ি যেন সন্যাসীর জটার মতো জাল বিস্তার করে ছড়িয়ে পড়েছে। কবে থেকে যে এই গাছটা দাঁড়িয়ে আছে আর কত কত গল্প তার জানা তা ঠিক ঠাহর করা যায় না। শোনা যায় ওর তলায় নাকি একবার সতীদাহ হয়েছিল। বউটা জ্বলতে জ্বলতে গড়িয়ে পড়েছিল নদীর জলে। তারপর আর তাকে পাওয়া যায়নি। এখনও সে নাকি রোজ রাতে ওই গাছের ডালে চুপ করে বসে থাকে। তার হাওয়া গায়ে লাগলে ছুটতে হয় দেওয়ান গাজীর মাজারে। জল পোড়া, তেল পোড়া, কালো চামড়ের বাতাস কত কি যে চলে তার হিসাব করা মুশকিল হয়ে যায়। এই বট গাছের গায়ে অনেক কোটর। সেই কয়েকটা কোটরে থাকে দু তিনটে ভুতুম প্যাঁচা তাদের পরিবার নিয়ে। আর গাছের মাথায় থাকে এক ঝাঁক শকুন। তাদের তীক্ষ্ণ দৃষ্টি থাকে নদীর জলের দিকে। পচা গরু, শুয়োর এমনকি মানুষের লাশের ওপর তারা চড়ে বসে। বাঁকানো ঠোঁট দিয়ে খুঁটে খুঁটে মাংস খায়। ভর দুপুরে ডানা উঁচু করে রোদে শোকায়। ঝিমোতে থাকে। ঠিক সেই সময়ে পল্টু গঙ্গায় কুড়োনো পয়সা গুনে গুনে সেই গাছের কোটরে লুকিয়ে রাখে। গেরস্থের বাড়ির কার্তিক, মনসা, পুরনো লক্ষ্মীর মূর্তি, গাধার পিঠে হাতে ঝাঁটা নেওয়া মা শেতলা আরও যার যা কিছু মা গঙ্গায় বিসর্জন হয় না তারা এখানে এই গাছের তলায় সবাই জড়ো হয়। প্রবল বৃষ্টিতে ধুয়ে কেউ বা কাঠামো নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকে। কেউ বা গলে গলে গঙ্গার জলে মেশে। পলি হয়ে মিলিয়ে যায়। এই বটগাছটাকে নিশানা ধরলে তার বাঁ দিকে মুসলিম আর ডানদিকে হিন্দু পাড়া প্রায় সমান ভাগে ভাগ হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। তারমধ্যে কিছুটা আবার জুড়ে আছে জেলে পাড়া। বাগদি পাড়া। সেই সবের মধ্যে আবার কুড়ি পঁচিশ ঘর পাঞ্জাবি। দশ বারো ঘর খ্রীষ্টান। এক বিরাট চত্ত্বর নিয়ে রাজবাড়ি অঞ্চল। সবার যেন সহাবস্থান করে দিয়েছেন মা গঙ্গা তাঁর পশ্চিমকূলে।

কথায় বলে গঙ্গার পশ্চিম কূল বারাণসি সমতুল। সেই পশ্চিমকূলের এই পাড়াতে মা দুগগা বেনারসি পড়ে আগে ভটচাজদের চন্ডীমন্ডপে পুজো পেতেন। তাঁর ছানা পোনারা নাকি গা ভর্তি সোনার গয়না পড়তো। পুজোর পাঁচদিন চলতো এলাহি খাওয়া দাওয়া। সাহেব সুবোরা ফিটন গাড়ি চেপে সেই কলকাতা থেকে এখানে নেমনতন্ন রক্ষা করতে আসতেন। হুইস্কি সোডার বন্যা বইতো। সেবারে যখন স্বাধীনতা সংগ্রামে জ্বলে পুড়ে খাক হচ্ছে ভারত তখন সেই অগ্নিযুগের কোনো এক তরুণ সংগ্রামীকে ধরিয়ে দিয়ে এই বাড়ির কেউ পেয়েছিল সাহেবদের কাছ থেকে রায়বাহাদুর খেতাব। রবীন্দ্রনাথ সেই বছর নাকি গীতাঞ্জলীর কবিতা লিখছিলেন। জীবন যখন শুকায়ে যায় করুণা ধারায় এসো...। নেমনতন্ন করা হয়েছিল নাকি তাঁকেও। নিজেদের ঠাঁটবাট দেখানোর জন্য। আসেননি কবি। পা পড়েনি তাঁর এই পাড়ায়। আসলে আর রক্ষে থাকতো নাকি? তাঁকে নিয়েও গল্প গুজবের পারদ উঠতো চড়বড় করে। এই ভটচাজ বাড়ির ঠাটবাট লক্ষ্য করেই তাদের পরের প্রজন্ম হয়তো এই অঞ্চলের নাম রেখেছিলেন রাজবাড়ি পাড়া। সেই হাতি শালে হাতির গল্প আর হাওয়ায় গাওয়া ঘিয়ের লুচির গন্ধ কোথায় উবে গিয়ে এখন ভটচাজ বাড়ির চন্ডীমন্ডপে বাদুড়ের বাসা। এমন অবস্থা হয়েছে কোনদিন যে কার মাথায় একটা চাঙড় ভেঙে পড়বে তা বলা মুশকিল। এই বাড়ি রাখা হবে কি হবে না এইসব বেত্তান্ত নিয়ে একবার এক বড় মিটিং বসেছিল পাড়ায়। নিমাই খুড়ো নিদান দিয়েছিলেন ভেঙে ফেলা হোক এই চন্ডীমন্ডপ। কী হবে জঞ্জাল বাড়িয়ে? পাড়ার অনেকেই তা মানতে চায়নি। বলেছে যতদিন আছে থাকুক। বাঙালির সংস্কৃতি-ঐতিহ্য বলে কথা। স্থান মহিমারও তো একটা ব্যাপার আছে। তবে এই জায়গাটার ওপর নজর আছে অনেকের। বিশাল আমবাগান। একটা পোড়ো বাড়ি। আর চন্ডীমন্ডপের প্রকৃত উত্তরসূরী এই মূহূর্তে কেউ নেই। থাকবে কী করে? তারা যে নিব্বংশ হয়েছে। ওই যে বট গাছের তলায় সতীদাহ হয়েছিল না। সেই বউয়ের নাকি অভিশাপ। যাবে কোথায়!

বড় গঙ্গার ঘাটে নাইতে হলে এই ভটচাজ বাড়ির ওপর দিয়েই এপাড়ার সবাইকে যেতে হয়। পাড়ার বিচ্চু ছেলেদের খেলার আখড়া এখন। তারা সেই কবেকার ভাঙা বাড়িটা ঘিরে লুকোচুরি খেলে। পিট্টু, গুলি, ডাঙ্গুলি হাঁকায়। আগে তেমন কেউ এদিকটা আসতো না। খারাপ হয়েছিল জায়গাটা। সত্তরের দশকে কারা যেন বোমা বানাতো। তারা মরে খুন হয়ে হেজে গেলে জরুরী অবস্থার সময় নেশার আড্ডা চলতো তুখোড়। আরও কত কি হতো কে জানে? ঊনআশিতে যেবার গরীবের সরকার এলো রাজ্যে সেবার নাকি পাড়ায় একটা নতুন দল তৈরী হল। ওই যে প্রাইমারি ইস্কুলে পড়ায় সুকান্ত স্যার তার ভাই, পাড়ার আরও কয়েকজন ছেলে এইসব জঙ্গাল সাফ করলো সব। নেশারুদের বিদেয় করলো। ভাঙা দেওয়ালের গায়ে লিখলো সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক গান বাজনার আসর বসালো। চিল্লে চিল্লে, কোরাসে, রিহার্সালে, ফাংশানে গাইলো “ওরা আমাদের গান গাইতে দেয় না...ভিয়েত সংগ্রামী পল রোবসন...।” হাওয়ায় ফড়ফড় করে লাল পতাকা ওড়ালোমাঝখানে ঠিক চাঁদের মতো কাস্তে হাতুড়ি তারা। ওরা ঠিক করলো একটা ঘর সারিয়ে এখানে লাইব্রেরি করবে। নতুন ল্যাম্প পোষ্ট বসলো রাস্তায়। ঘুটঘুটে অন্ধকার জায়গাটায় এবার যেন একটু আলো হলো। তবুও পাড়ার বয়স্ক লোকেরা এই পথ দিয়ে যাওয়ার সময় এদিক পানে একটি বারও তাকায় না। গটমট করে সোজা গঙ্গার দিকে তাকিয়ে রাধারমণের নাম করতে করতে এগিয়ে যায়। আজ নিমাই খুড়োও ঠিক তেমনটা করছিল। যদি না সত্যিই সেই অবাক করা মিছিলটা সে দেখতে পেতো। ভটচাজ বাড়ির সামনেই সব কিছু ভুলে ভিজে গামছায় দাঁড়িয়ে পড়লো সে। হাতে রইলো পিতলের ঘট। তার ওপর খান চারেক তুলসী আর বেলপাতা। বিড়বিড় করা নবগ্রহের মন্ত্র ভুলে গেল সে। এই মিছিল কোন রাজনৈতিক দলের মিছিল ছিল না। নকশাল আমলে যে কয়েকজনকে নিমাই খুড়ো পুলিশ দিয়ে খুন করেছে তাদের মৃতদেহের সারিও না। ভোরের দূঃস্বপ্নে যারা ভিড় করে চোখের সামনে উজাড় হয়ে থাকে তারাও না। এই মিছিল ছিল অন্যরকমের। পাড়াটা পালটে দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট

ফাদার হেনরি কিসকু হনহনিয়ে তার সাইকেল নিয়ে চলেছিলেন চার্চের দিকে। আজ বড্ড দেরী হয়ে গেছে তাঁর। গতকাল রাতে গঙ্গার ফ্যাসা মাছ ভাজা দিয়ে বোতলের শেষ রামটুকু খেতেই এই বিপত্তি। ঘুম থেকে উঠতে এতো দেরী। এমনিতে হেনরি কিসকু অন্ধকার থাকতে থাকতে উঠে পড়েন। জপে বসেন। জেলে পাড়া থেকে কয়েকজন আসে মাছ ধরার আগে। তাদের সাথে প্রার্থনা করেন। সুরেন টোপ্পো, খগেন গোমস কয়েক ঘর খ্রিষ্টান পরিবারের বাস আছে হিন্দু পাড়ায়। তাদের মধ্যেই টিম টিম করে জ্বলে খ্রীষ্ট চর্চা। ঠিক যেমন পাঞ্জাবিদের কয়েক ঘর নিয়ে একটা ছোট্ট গুরুদ্বার। ঘুম থেকে উঠে ইচ্ছে হলে গঙ্গা স্নানে যান হেনরি কিসকু। আবার কখনও আলস্য জমাট বাঁধলে কুয়োর জলে স্নান করেন। বয়েস অল্প। কয়েক বছর হল এসেছেন এইদিকে। দুমকার ছেলে। এখনও চোখে মুখে লেগে থাকে সরল গ্রাম্যতা। ভাঙা ভাঙা বাংলা আর হিন্দিতে কথা বলেন। ইট খোলার সাঁওতাল কুলিদের সাথে দেখা হলে ফাদারকে তখন আর পায় কে। কত কত গল্প যে তার মনে পড়ে। ঘন্টার পর ঘন্টা কথা বলতেও তখন অসুবিধে হয় না। গতকাল রাতে একে লোড শেডিং। তার ওপরে ওল্ড মঙ্কের বোতলের শেষ রাম। সব মিলিয়ে জগা খিচুড়ি পাকিয়ে এপাশ ওপাশ ফিরিয়ে ছিল বিছানায় হেনরিকে। ভোরবেলায় নদীর ঠান্ডা বাতাসে কখন যে ছাদের ওপরে ঘুমিয়ে পড়েছেন সকাল ভেঙেছে সূর্যের আলো চোখে পড়লে। এদিকে পাড়ার মোড়ে কদম গাছটা পেরোতেই সাইকেলের প্রথম চাকাটা গেছে পাঞ্চার হয়ে। হেনরি কিসকুকে তাই সাইকেলটাকে টেনে নিয়ে হাঁটতে হচ্ছে। তাঁর সাদা ফুলশার্ট জামা ভিজে গেছে গায়ের ঘামে। মাথার ছোট ছোট করে ছাঁটা চুল গুলোতে এমন ভাবে ঘামের কণা জমেছে যেন মনে হচ্ছে আশ্বিনের শারদপ্রাতে ঘাসের আগায় শিশির বিন্দু। গলা থেকে খ্রীষ্টের কাঠের লকেকটা উঁকি দিয়ে বেরিয়ে আসছে বারবার। বার্নিশে কালো মুখটাতে সকালের রোদ পড়ে চকচক করছে ঈস্পাতের মতো। হরভজন সিং তাঁর গুরুদ্বারের প্রার্থনা শেষ করে এগিয়ে যাচ্ছিলেন বাজারের দিকে। রহমত আলি ফজরের নামাজ শেষ করে দোকান খুলছিলেন। রাধারমণের মন্দিরে সকালের পুজো শেষ করে হরবল্লভ চক্কোত্তি সত্যনারায়ণের সিন্নি দিতে চলেছিলেন কোন এক ভক্তের বাড়ি। আর গঙ্গাস্নান ফেরত নিমাই খুড়ো তো ভাঙা ভটচাজ বাড়ির সামনে নবগ্রহের মন্ত্র ভুলে ভন্ডুল। সবাই খানিকটা যে যার জায়গায় স্ট্যাচু হবার মতো অবস্থা।

কিন্তু কেন?

কিসের জন্য এতোসব মানুষের যাওয়া আসা, কাজ কর্ম ছেদ পড়লো?

সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো সেই আশ্চর্য অবাক করে দেওয়া একঘেয়ে সকালে?

গো স্ট্যাচু খেলার সময় স্টপ বললে যেমন নিশ্বাস বন্ধ করে দাঁড়াতে হয় ঠিক তেমন?

কেন? কেন? কেন? আর আজকেই বা কেন?

কারণ তাদের সামনে দিয়ে যে মিছিলটা চলেছিল সেখানে কোন ব্যান্ডপার্টি ছিল না। বাজছিল না কোন হিন্দি গান। দিচ্ছিল না কেউ রাজনৈতিক স্লোগান। একে খেয়ে নেবো। তাকে দেখে নেবোর মতো মারাত্মক দম্ভের উল্লাস। বরং সেদিন সকালের সোনা রাঙা রোদ এসে পড়েছিল রাস্তায়। সেই রোদের ওপর দিয়ে হেঁটে যাওয়া ভঙ্গিমায় বলা ছিল রাজবাড়ি পাড়া আগে যেমনটা ছিল তেমনটা আর থাকবে না। পালটে যাবে অনেক কিছু। সেই পালটে যাওয়া সময়ের হাওয়া কি অনেক দিন আগে থেকেই বইছিল না? তার দেওয়াল লেখা কেউ যে তেমন পড়তে পারেনি এই পাড়ায়। আর যারা পেরেছিল তারা চুপ করে গিয়েছিল অনেক দিন আগে। কিম্বা চুপ করিয়ে দেওয়া হয়েছিল। চাঁদে মানুষের পা রাখাতে যে অভিঘাত হয়েছিল আজ যেন এই পাড়াতে তেমনটাই হলো। এক যুগ সন্ধিক্ষণের সাক্ষী হয়ে থাকলো এই সকাল।

মিছিলের সামনে ছিল একটা রিক্সা। সেই রিক্সার ওপরে বড় পিচবোর্ডের বাক্স আর নানান কিছু সব অদ্ভুত সরঞ্জাম নিয়ে বিজয় ঢোল হাসি হাসি মুখ করে সারা রাত তার না ঘুমোনো চোখে এগিয়ে যাচ্ছিল। পেছনে ছিল গোটা পাড়ার বখাটে ছেলে পিলেদের দল। সেখানে অনেকক্ষণ গঙ্গায় স্নান করে পয়সা তুলে চোখ লাল করা পল্টুকেও দেখা গেল। বিজয় ঢোল একটা মস্ত কিছু চমক দিচ্ছে বলে ধারণা করতে শুরু করলো সকলে। মাসির দোকানে জোর গুজব শুরু হলো। কি থাকতে পারে ওই বাক্সে? কেউ যে এগিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করবে তার আর অবকাশ থাকলো না। ডবল ডিমের পোচ আর ঘুগনি পাউরুটি খেতে খেতে আলোচনা শুরু করলো সবাই। হরিণঘাটার দুধ বিক্রি করতে এসে সরকারি জাব্দা খাতা নিয়ে কানাই বাবুও দাঁড়িয়ে পড়লো। যাকে তাকে নিয়ে তো আর কথা হচ্ছে না। বিজয় ঢোল বলে কথা। তার বড় পিচবোর্ডের বাক্সে যে বড় বড় করে লেখা আছে ইংরাজিতে টেলিভিশন। সবার চোখ গোল্লায় উঠলো। সাধে কি এমন স্ট্যাচু হয়ে গেল পাড়াটা?

আঠারোশ পঁচানব্বই সালের ডিসেম্বর মাসে প্যারিসে ল্যুমিয়ের ভাইয়েরা যখন প্রথম চলচ্চিত্র নামের এক শিল্প প্রদর্শন করছিলেন গ্রান্ড কাফেতে তখন এই পাড়া কী করছিল তার ইতিহাস কোন সাহেব ঐতিহাসিক লিখে যাননি। কাজেই এখনকার পাঠ্য পুস্তকে তার কিছুই পাওয়া যায় না। বাঙালির বিক্ষিপ্ত কিছু নমুনার অতি বিক্ষিপ্ত কিছু ধারা বিবরণীতে যেসব ছোট ছোট অঞ্চলের কথা উঠে আসে তাতে এই পাড়ার কথা পাওয়া যায় না। যেটুকু শোনা যায় তার সব টুকুই ওই মুখে মুখে। শ্রুতির মতো। অনেকটা যেন আউলে যাওয়া গল্প। সেই গল্পের রেশ ধরে মা গঙ্গার বুকে জোয়ার ভাঁটা খেলিয়ে এই পাড়াতে ঢুকে পড়ে কত কত চরিত্র। তাদের মধ্যে একজন হল বিজয় ঢোল। ইনি কোন মহাত্ম্যা নন। যুগপুরুষ হিসেবে পুজিত হবেন না। এই মানুষটাই গোটা পাড়াকে মুক্ত কন্ঠে জানিয়েছিল এতাবদ অঞ্চলে এতো পুকুরের দরকার নেই। জলের অভাব হলে মা গঙ্গাই তো আছেন। কত জমি নষ্ট হচ্ছে এইসব ছোট ছোট পুকুরে। মানুষ থাকতে পারছে না। কাজেই ভরাট করো সব। জমি বেচো। বাড়ি তোলো। কাঁচা পয়সা পকেটে ঢোকাও। ঠাকুরের বেদ বাক্য টাকা মাটি আর মাটি টাকার অর্ন্তনিহিত অর্থ যেন একমাত্র বিজয় ঢোলই চর্ম চোক্ষে দেখতে পেয়েছিল। তারপরে তাকে অনুসরণ করেছে অনেকেই। সেইসব ধারা বিবরণী না হয় ঐতিহাসিকেরাই দেবেনখুব যত্নে কিম্বা অযত্নে লিপিবব্ধ করবেন। আমরা তো নিছকই পাটি পেড়ে গল্প শুনতে বসেছি।

ইতিমধ্যে পাড়ার একটা বড় পুকুর বুঁজিয়ে বিজয় ঢোল নিজে তিন তলার এক বাড়ি তুলেছে। কলকাতা থেকে এসেছে দামী আসবাব। পাড়ার এবং চারপাশের অনেক পুকুরের ওপর আছে তার কড়া নজর। এর সাথে আছে ভটচাজ বাড়ির জায়গাটাও। সেটা যে পাড়ার লোকেরা বোঝে না তা নয়। চুপচাপ ঘাপটি মেরে থাকে। বিজয় ঢোল তার আঁচ বুঝে দুর্গা পুজোয় বড় চাঁদা দেয়। ঈদে করে দান খয়রাত। গুরুদ্বারে বিলোয় হালুয়া রুটি। বড়দিনে বাড়ি বাড়ি পাঠায় কেক। সামনের সোনা বাঁধানো একটা দাঁত নিয়ে হাসি হাসি মুখে বলে, “সবই আপনাদের জন্য...ফর গড শেক...”।  তখন সবে মাত্র প্রাথমিক শিক্ষায় ইংরাজী বাতিল হয়েছে। মাতৃভাষাতে দুগ্ধ পান করাতে উঠে পড়ে লেগেছে নতুন সরকার। তখনও চারিদিকে ছাতার মতো ইংরাজী মিডিয়াম স্কুল গুলো গজিয়ে ওঠেনি। পাড়াতে একটাই লোকের বাড়িতে তখন ফোন। মাঝে মাঝেই যা ক্রিং ক্রিং করে বাজে। বেশির ভাগ দিন ডেথ বা মৃত অবস্থায় থাকে। পাড়ায় একটা লোকের বাড়িতেই তখন ফ্রিজ। জমাট বাঁধা বরফ দেখতে লোকেরা ভিড় করে। কলের তলায় দাঁড়ালে যে ঝরনার মতো জল পড়ে তা বিজয় ঢোলই দেখিয়েছিল এই পাড়াকে প্রথম। আরও অনেক কিছু। আড়ালে আবডালে লোকে তাকে বাটপাড় বলে। তবুও টেরিকাটা চুলে মুখের হাসিটা মিলিয়ে যায় না তার। প্রসন্ন মনে এগুলোকে পশ্রয় দেয়বুঝতে পারে একটু একটু করে বিখ্যাত হয়ে উঠছে সে। অপপ্রচার তারই অঙ্গ। এইসবে একদম সময় না দিয়ে সে বরং পাড়ার ইয়ং জেনারেশকে হাতে রাখার জন্য এবং ক্লাবকে চাঙ্গা করার জন্য রাসের মেলায় কলকাতা থেকে যাত্রা আনায়সেখানে গঙ্গার ধারের বড় মাঠে তিল ধারনের আর জায়গা থাকে না। ‘আমি লেনিন বলছি’ যাত্রা শুরু হলে দেখতে আসে পাশের পাড়া এমনকি জেলার লোকজনও। ভিড় ঠেকাতে জি টি রোডের ওপর পুলিশ পিকেট বসাতে হয়। শুধু পল্টু দেখে লেনিনেরর মাথায় বিশাল টাক। ঠিক হারুদের পাঁচিলে আঁকা ছবিটার মতো। জগঝম্প কনর্সাটের সঙ্গে লেনিন যখন স্টেজে এসে দাঁড়ালো কানে তালা লেগে গিয়েছিল হাত তালির চোটে। ভগবান দর্শন হয়েছিল যেন গোটা অঞ্চলের। কেউ কেউ চাদরের খুটোয় চোখ মুছে ছিলেন দেওয়ালে আঁকা লোকটাকে সত্যি দেখতে পেয়ে।  সেদিন রাজবাড়ি পাড়ায় বরফ পড়েছিল কিনা জানা যায় না। তবে বিজয় ঢোলের বিশাল ফ্রিজ থেকে ভদকার বোতল বেরিয়েছিল। ঠান্ডা জলে ভদকা গুলে গলায় ঢেলেছিল বিজয়। লেলিনকে চিনতে তার তখনও কিছুটা বাঁকি ছিল। এমনকি সাম্যবাদের নতুন কান্ডারী হয়ে ওঠারও।      

পাড়ার এইসব নানারকম আজব কান্ড কারখানা যে ছোটকু তার চিলেকোঠা থেকে দেখতে পেত তেমনটা নয়। তবে যেগুলো দেখা যায় না সেগুলো ছোটকু কল্পনা করে নিতো। মনে মনে গল্প বানানোর বড় শখ তার। গেলবার যখন কাকা তাকে রাসের মেলা থেকে একটা টেলিস্কোপ কিনে দিয়েছিল তখনই সে ঠিক করে রেখেছিল এটাকে জানলায় বসাবে। ভাস্কোদাগামার মতো চোখ রাখবে ঘষা কাঁচের ওপরে। কি দেখতে পাবে সে? কাকা বলেছিল ওয়েট করো। আগে বাড়ি তো যাই। পেল্লাই সাইজের জাহাজ বলে কথা। আকাশ কালো করা সমুদ্রের ঝড়। উত্তাল জলরাশির মাঝে কাঠের জাহাজ টলোমলো। সেই জাহাজের পেটের মধ্যে আছে বাঙালীর রান্নাঘরের কত কিছু। আলু, টমাটো, কাঁচা লঙ্কা, ছানা তৈরীর ইতিহাস আর কৃতদাসদের করুণ কান্না’। ছোটকু ঘুরে তাকায় তার কাকার দিকে। ক্রিতদাস তারা যাদের জোর করে ইচ্ছের বিরুদ্ধে ধরে নিয়ে যাওয়া হতো। তাই না কাকা?’ জানলায় টেলিস্কোপ ফিট করতে করতে কাকা বলেছিল একদম ঠিক। সাম্রাজ্যবাদের ইতিহাসটা মারাত্মক বুঝলি?’ ছোটকু তখন এইসব বুঝতে চাইছে না। তার সামনে বিরাট একটা টেলিস্কোপ। ভাস্কো দাগামা বলে কথা! পৃথিবী জয় করা কি চাড্ডিখানি কথা? ভাস্কো দাগামা কি খেতে ভালোবাসতো কাকা? ছোটকুর কাকা টেলিস্কোপের ঘষা কাচ ঠিক করতে করতে বলে ‘ কি খেতে ভালোবাসতো জানা যায় না। তবে বাঙালীর রান্নাঘরের অনেক কিছু ওরা এনে দিল। ভেবেছিল ওরা নতুন একটা দেশ আবিষ্কার করেছে। কিন্তু কোথায় নতুন দেশ? এ যে সুজলা সুফলা শস্য শ্যামলা বঙ্গভূমি। এখানে কত রকমের কত কি পাওয়া যায়। টুপটাপ তারা নিজের ঝুলিতে থুড়ি জাহাজে ভরলো আর কোথাও কোথাও বানিজ্য করার জন্য থেকে গেল। মৌরুসি পাট্টা চলতে শুরু করলো তাদের। ‘মৌরুসিপাট্টা’? কি কঠিন শব্দ। ছোটকুর মাথায় ঢোকে না। কাকা বলে এই যে তুই আমার চিলে কোঠার ঘরটা দখল করে নিজের মতো যখন পারছিস আসছিস। যাচ্ছিস। কোন পারমিশানের বালাই নেই ঠিক তেমন

এখন কাকা বেশ কিছুদিন নেই। কোথায় যে মাঝে মাঝে চলে যায় কে জানে? বাবা বলে কাকা তো বড় হয়েছে। তাই বড়দের মতো বাইরে গেছে। কাজে’। টেলিস্কোপ নিয়ে তাই চিলেকোঠায় ছোটকুর মৌরুসিপাট্টা বেড়েছে। এটাকে ঘিরেই তার ভাস্কোদাগামার রাজত্ত্ব। কাকা যদিও লোকটাকে একদম পছন্দ করে না। কিছু বলতে এলেই বলে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। পর্তুগিজ, ইংরেজ, এক নায়কতন্ত্র কারো প্রভুত্ত্বই আমরা মেনে নেবো না কমরেড...। শ্রেনী শত্রুহীন সাম্যবাদের সমাজই আমাদের একমাত্র পথ’

আর এইটা?

ছোটকু তার টেলিস্কোপটা দেখায় কাকাকে। কাকা হাসে। ফেলুদা হলে বলতো মগজাস্ত্র। আমি বলি কি এটা তোর তৃতীয় নয়ন। যেটা নেই...সেটাও দেখাবে এই বস্তুটা। এতো কঠিন কঠিন কথা বোঝে না ছোটকু। তার শুধু মনে পড়ে সেদিনের কথা। একটা চিমসে মতো লোক মেলায় অনেক রকম জিনিসের পশরা সাজিয়ে বসেছিল। কাকার কেন যে সেই লোকটাই পছন্দ হলো কে জানে? তার পাশেই তো তারের ওপর দিয়ে হাঁটা জোকার ছিল। বুড়ির চুলের কাঠি ছিল। ড্রাম বাজানো শিম্পাঞ্জি ছিল। কৃষ্ণনগরের পুতুল ছিল। সেগুলোর দিকে একটুও না তাকিয়ে কাকা লোকটাকে জিজ্ঞেস করেছিল কিগো তোমার এই রঙচঙে তাপ্পি মারা ব্যাগে কি আছে? লোকটা মিটমিট করে হেসেছিল। তার পান খাওয়া দাঁত গুলো ছোটকু দেখতে পেয়েছিল স্পষ্ট। চোখ বড় বড় করে বলেছিল লোকটা ভেলকি আছে। কাকা হেসে ফেলেছিল। বেশ দেখাও তোমার ভেলকি। লোকটা তার তাপ্পি মারা ব্যাগটা খুলতে গিয়ে আবার তাকালো একবার ছোটকু আর তার কাকার দিকে। কে ভেলকি দেখবে বাবু? তুমি না খোকাবাবু? লোকটা ছোটকুকে খোকাবাবু বলাতে বিরক্ত হয়েছি্ল সে বেশ। কাকা তাকে থামিয়ে বলেছিল আমার কি আর সেই বয়েস আছে ভেলকি দেখার? তুমি আমার এই ছোটকুর জন্যে কিছু দেখাও দেখি। লোকটা ফিসফিস করে বললো। ভেলকি দেখার কি আর বয়েস আছে বাবু? এই এক জীবনে কত কি দেখলাম। ট্রামে টানা ঘোড়ার গাড়ি থেকে মাথার ওপর উড়ো জাহাজ  কাকা থামিয়ে দেয় লোকটাকে হয়েছে। থামো এবার দেখি। অতোদিন কোন মানুষ বাঁচে নাকি? বয়সের গাছ পাথড় নেই নাকি তোমার? এখন বার করো দেখি কি আছে ঝোলায়? যত আন তাবড়ি গল্প। কিন্তু ছোটকুর লোকটাকে বেশ ভালো লেগে গেল। সত্যি যদি লোকটা ঘোড়ায় টানা ট্রাম দেখে থাকে তাহলে কি ও ভাস্কোদাগামাকেও দেখেছে? জিজ্ঞেস করতে যাবে আর ঠিক সেই সময় লোকটা একটা টিনের পৃথিবী বার করেছিল। এই দ্যাখেন...আমাদের পৃথিবী। ঠিক এইভাবে ঘোরালে বনবন করে পৃথিবী ঘোরে। তখন দিন রাত হয়। আর সূর্যকে মাঝখানে রেখে এইভাবে এক চক্কর ঘুরে এলে হয় এক বছর। ঠিক এখানটায় চিন...এই দেখুন পৃথিবীর গায়ে। আর এটা হল সোভিয়েত ইউনিয়ন...। যেখানে কমরেড লেনিন থাকতেন’। কাকা ঠোঁট উলটে বলেছিল ওইসব আমার পড়ার টেবিলে থাকে। কলেজে ফাস্ট ইয়ার জানো? ছোটকুর ক্লাস থ্রি। তুমি অন্য কিছু দেখাও। লোকটা ফোঁস করে উঠেছিল অন্য কিছু দেখাও বললেই কি দেখানো যায়? তারজন্য খরচা করতে হয়। ছোটকুর কাকারও রাগ আছে। ফ্রিতে তো আর চাইছি না কিছু তোমার কাছে। লোকটা বিড় বিড় করে অন্য কিছু দেখবে? দেখো তাহলে। হুড়মুড় করে তার ঝোলা থেকে বের করেছিল মস্ত বড় পেতলের একটা টেলিসস্কোপ। ছোটকু আর তার কাকা দুজনেই হাঁ হয়ে গিয়েছিল। কত দাম এর? লোকটা এক হাতের সব আঙুল মেলে  বলেছিল পাঁচ টাকা। ছোটকুর কাকা শুনে লাফিয়ে উঠেছিল এতো টাকা আমার কাছে নেই। সিগারেটের পয়সা বাঁচিয়ে ঠিক করেছিলাম ওর জন্য কিছু কিনে দেবো। চিমড়ে লোকটা হেসে বলেছিল তা কি করে হয়? যোগ্য জিনিস যোগ্য হাতে না পড়লে কি তার মান থাকে? বাড়িতে যাও বাবারা পয়সা নিয়ে এসো। পাঁচটা টাকার কমে এজিনিস পাবে না

পাঁচ টাকা? ইয়ার্কি নাকি? আট আনায় কলকাতায় যাওয়া যায়। হরি ময়রার দোকানে ইয়া বড় চারটে রসগোল্লা খেতে খরচ হয় চার আনা। একটা লেড়ো বিস্কুট দশ পয়সা। চালের সের কত টাকা কিলো খেয়াল আছে? ছোটকুর কাকার হম্বি তম্বির মাঝখানে হঠাৎ লোকটা মেলে দিল টেলিস্কোপের পা। চোখ রাখতে বললো তার ছোট্ট নলটার কাচের ওপরে। কাকা চোখ লাগিয়ে চুপ করে গেল। এতোক্ষণ যে হম্বি তম্বি করছিল সে কেমন যেন পাথরের মতো হয়ে গিয়ে এদিক সেদিক ঘোরাতে লাগলো যন্ত্রটা। বিড়বিড় করে বলে উঠলো ইউরেকা। ইউরেকা...। হঠাত তার চোখ পড়লো ছোটকুর দিকে। দ্যাখ ছোটকু। এখানে চোখ দিয়ে দ্যাখ। ছোটকু চোখ রাখলো কাঁচের ওপরে। সামনের ঘুরন্ত ইলেকট্রিক নাগোরদোলা মনে হল এক্ষুনি তার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়বে। দূরে বেলুন ওয়ালার বেলুন গুলো যেন তারই হাতের সামনে। গঙ্গার ওপারে গানশেল ফ্যাক্টরির চিমনি গুলো এক্কেবারে নাকের ডগায়। আর মাথার ওপরে আকাশটা চকমকে তারায় ভরা। এটাকে বাড়ি নিয়ে যাই কাকাই? ছোটকু আনন্দে প্রশ্ন করেছিল তার কাকাকে। শেষ পর্যন্ত পাঁচ টাকার কিছু কমে রফা হয়েছিল। কিন্তু অতো টাকা ঠিক কি ভাবে ছোটকুর কাকা যোগাড় করেছিল তা জানে না ছোটকু। বাবার কাছে চেয়েছিল? হাঁদার কাছে? মা, পিসি সক্কলে দিয়েছিল তাকে? নাকি নিজেই নিজের ভাড় ভেঙে টাকা জোগাড় করেছিল কাকাই? এখন তো সে এখানে থাকে না। কলেজে পড়ার নাম করে সেই যে বাড়ি থেকে বেরিয়েছে আসার নামও নেই। তার সেই টেলিস্কোপ এখন ছোটকুর জিম্মায়। তার চিলেকোঠার ঘর এখন ছোটকুর মৌরুসিপাট্টা। সেই জানলা থেকে ছোটকু গোটা পাড়াটা দেখতে পায়। গঙ্গার ঘাট। গুরুদ্বার। দেওয়ান গাজীর মাজার। রাধারমণের মন্দির। পাড়ার কদম তলার মোড়। এইসব কিছু সে পল্টুকে দেখিয়েছে। বিশুকে দেখিয়েছে। হারুকে দেখিয়েছে। ওপাড়া থেকে সন্ধ্যা এসে দেখেছে। ফাদার হেনরি বাবার সাথে মিটিং করতে এসে দেখেছে। কত লোক দেখে কত কি বলেছে। সব শুনেছে ছোটকু। আর মনে মনে কত কি যে গল্প তৈরী করেছে সেগুলো লিখে রাখলে একটা বই হয়ে যেত বুঝলে?

এইঘর থেকে, বাড়ি থেকে ছোটকু খুব একটা বেরোতে পারে না। যদিও তার খুব ইচ্ছে করে পাড়ায় টো টো করে ঘুরে বেড়াতে। হুটোপাটি করতে। গঙ্গায় ঝাঁপাতে। কিন্তু এসবের কিছুই করতে পারে না সে। কারণ একটা জায়গা থেকে আর একটা জায়গায় যেতে ছোটকুর সময় লাগে অনেক। তার একটা পা যে লোহার খাঁচায় মোড়া। সেই খাঁচাটা না থাকলে বাঁ পায়ে কোন জোর পায় না সে। ছোট্ট ক্রাচে ভর দিয়ে হাঁটতে তার লজ্জা লাগে। সবাই কেমন করে যেন তার দিকে তাকায়। তাও স্কুলে যাওয়ার সময় বংশীদা পিঠে করে নিয়ে যায়। কখনও খুব বায়না করলে হাঁটায়। খেলার পিরিয়ডে চুপ করে বসে থাকে মাঠের ধারে। বাবা দূর থেকে দেখে। ছেলের মন খারাপে চুপ করে ঢুকে যায় টিচার্স রুমে। এপাড়ায় সবাই ছোটকুর বাবাকে মান্যগণ্য করে। সুকান্ত মাষ্টারের কাছে এসে অনেকে শলা পরামর্শ করে। স্কুলের পরেও সুকান্ত ব্যস্ত থাকে তাই অনেকটা সময়। বাড়িতে অনেক লোকজন আসে। কথাবার্তা হয়। দিনকাল যে পালটে যাচ্ছে তা নিয়ে স্বরগরম তর্ক হয়। ছোটকু সব বুঝতে পারে ওপরের চিলেকোঠার ঘর থেকে। অনেকটা সময় এই কাকার ঘরেই থাকে সে। গল্পের বই পড়ে। যাত্রায় দেখা লেনিনের সংলাপ বলে। মিছিমিছি যুদ্ধ করে। কাকার জন্য মন কেমন হলে টেলিস্কোপে চোখ দিয়ে বসে। আর অমনি যেন কাকাকে দেখতে পায় সে। তোর সবচেয়ে কাছের বন্ধু কে ছোটকু? ছোটকু কাকার দিকে তাকিয়ে বলে তুমি...তুমি...তুমি...। কাকা চুপ করে যায়। আর আমি চলে গেলে? ছোটকুর চোখ ছলছল করে ওঠে। কাকা টেলিস্কোপটা দেখায়, এটা তো শুধু যন্ত্র নয়। বলতো কী? ছোটকু মুখ গোমড়া করে বলে ওঠে তৃতীয় নয়ন? কাকাও হেসে ওঠে। ছোটকুকে দু হাতে তুলে চরকির মতো ঘোরায় আর আবৃত্তি করে ,

কত অজানারে জানাইলে তুমি

কত ঘরে দিলে ঠাঁই-

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু

পরকে করিলে ভাই।

পুরনো আবাস ছেড়ে যাই তবে

মনে ভেবে মরি কী জানি কী হবে

নতুনের মাঝে তুমি পুরাতন

 সে কথা যে ভুলে যাই।

দূরকে করিলে নিকট বন্ধু

পরকে করিলে ভাই’।

ঘরের মধ্যে কোথাও যেন কবিতাটা গমগম করে। আর ঠিক তখনি ঠুক ঠুক আওয়াজ হয় দরজায়। কোনমতে হাতড়াতে হাতড়াতে পা টেনে টেনে এগিয়ে যায় ছোটকু দরজার দিকে। এই ভর দুপুরে আবার কে এলো? ওদিক থেকে উত্তর আসে একটা বিশাল খবর আছে দরজা খোল তাড়াতাড়ি। ছোটকু দরজা খুলে দেখে চিলেকোঠার বাইরে দাঁড়িয়ে পল্টু। চুল গুলো উসকো খুসকো। চোখ লাল। বিজয় ঢোল বাড়িতে টেলিভিশন এনেছে। ছাদে ইয়া বড় এ্যান্টেনা লাগাচ্ছে। কত লোক ত্যানা ব্যনা করে জড়ো হয়েছে তুই না দেখলে বিশ্বাস করতে পারবি না ছোটকু। টেলিভিশন? সেই যে চৌকো বাক্সের মধ্যে সব কিছু দেখা যায়? কলকাতায় বাবার এক বন্ধুর বাড়িতে দেখেছিল প্রথম ছোটকু। বড় আজব মনে হয়েছিল তার। আরও অনেকক্ষণ বসে থাকতে ইচ্ছে করছিল। কিন্তু অনেক রাত হয়ে যাবে ভেবে তারা বাড়ি চলে এসেছিল এল থার্টি ওয়ান নম্বরের এক লাল বাসে চড়ে। সেই টেলিভিশন এবার তাদের পাড়ায়? যাবি নাকি? চোখ চকচক করে ওঠে পল্টুর।

এর আগে রাজবাড়ি পাড়ার সবার সাথে ছোটকু মাঠে বসে সিনেমা দেখেছে। পশ্চিমবঙ্গের নতুন সরকার তাদের নতুন গাড়িতে করে সিনেমা পাঠিয়েছে। গঙ্গার ধারের মাঠে সাদা পর্দা টাঙিয়ে প্রজেক্টারের ঘড় ঘড় আওয়াজে সবাই মিলে সেই ছবি দেখেছে। গঙ্গার হাওয়ায় সাদা পর্দা উড়েছে পতপত করে। তার সাথে অপু দুর্গার মুখও। তখন থেকেই তো তাদের সাথে ছোটকুর ভাব। গুপী গায়েন আর বাঘা বায়েনের আজব কান্ডখানা দেখে তার কত দুপুরে যে মনে হয়েছে ইশ অমন যদি ভূতের বর সে পেতো? তারপর একদিন সেই নতুন গাড়ি করে সিনেমা আসা বন্ধ হয়ে গেছে। বাড়ির সামনে শ্রীকৃষ্ণ হলের পোষ্টার কাকু রঙচঙে কত পোষ্টার মেরেছে তবুও বাড়ির কেউ সিনেমা দেখতে যায়নি। ছোটকুকেও যেতে দেয়নি। হিন্দি ছবি দেখে পাকা তাল গাছটি হবে তুমি তাই না? বকুনি দিয়েছে মা। গৌরীতে এসেছে বাবা তারকনাথ। পাড়া শুদ্ধু লোক ছুটেছে। আজ তোমার পরীক্ষা ভগবান...লোকজন গুনগুন করতে করতে গান গেয়েছে। পাড়ার মোড়ে মোড়ে জটলা করে সিনেমার গল্প করেছে। কিন্তু ছোটকুরা যায়নি। স্কুলের পরীক্ষা বলে বাড়ি থেকেছে। বাবাকে বললে বাবা বলেছে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাবো। ছোটকু চিলে কোঠায় খিল দিয়েছে। অনেক রাতে কাকা শুনিয়েছে চাঁদের পাহাড়ের গল্প। তারপর চুপি চুপি নিয়ে গেছে ঘনির নৌকায়। মাঝ রাতে গঙ্গার মাঝে নৌকায় চড়ে সব সিনেমা টিনেমা ভুলে গিয়েছে ছোটকু। মাথার ওপরে আকাশ জোড়া কালপুরুষ।

এই কয়েক মাস টেলিস্কোপটা নিয়ে কেমন যেন একটু সন্যাসীর মতো হয়ে গিয়েছিল সে। আজ পল্টু এসে আবার তার সব কিছু যেন মনে করিয়ে দিল। এখন যে তার খুব টেলিভিশন দেখতে ইচ্ছে করছে। আজ একটা বই আছে জানিস? সন্যাসী রাজা। গুরুর গুরু… উত্তমকুমার। পল্টু চোখ গোল্লা পালিয়ে বলে। ছোটকুর কান্না পায়। ‘মিথ্যে কথা কেন বলছিস পল্টু? মা গঙ্গার দিব্যি। পল্টু গলায় হাত দিয়ে দিব্যি গালে। তার নিজের মা নেই। বাবা নেই। তাই মা গঙ্গাকে দিব্যি লাগায়। পল্টু মিথ্যে বলে না। ছোটকুও জানে। বিজয় ঢোল কাকে যেন একটা বলছিল। শুনে তোর কাছে ছুট্টে এলুম। যাবি নাকি ছোটকু?    

কিন্তু ছোটকু কী করে যাবে? বাড়িতে মা শুনলে বকবে। বাবার কাছে পারমিশান লাগবে। পল্টু বুদ্ধি দেয় কাঁধে করে নিয়ে যাবে সে। বাড়ির কাউকে বলতে হবে না। দেখেই চলে আসবে। সন্ধ্যে হয়ে যাবে। তাই হয় নাকি? বাড়ির লোকে খুঁজবে। পল্টু বুদ্ধি দেয় তখন না হয় বলবি ভটচাজ বাড়িতে আমরা লুকোচুরি খেলছিলাম। ছোটকু লোভ সামলাতে পারে না। পল্টু বন্ধু হলেও তার থেকে বছর তিনেকের বড়। লম্বা। স্বাস্থ্য ভালো। পল্টুর কাঁধে চেপে সেই প্রথম ছোটকু সেই চিলেকোঠা থেকে নীচে নামে। কাউকে না জানিয়ে দুপুরে মায়ের ঘুমের সুযোগ নিয়ে পল্টুর দুপায়ে ভর দিয়ে ছোটে। পল্টুর শরীরটা যেন আজ তার শরীর। পল্টুর পা দুটো আজ যেন তার পা। দুপুরের বাতাস ছোটকুর চোখে মুখে লাগে। দেওয়ান গাজীর মাজার...গুরুদ্বার...রাধারমণের মন্দির...সবাই ফিসফিস করে বলতে থাকে পালটে যাচ্ছিস ছোটকু তুই, পালটে যাচ্ছিস

বিজয় ঢোলের বাড়ির সামনে যেন তখন ঠিক একটা ছোট খাটো মেলা। বাড়ির ছাদে কয়েক জন মিলে একটা লোহার বড় লম্বা রডের ওপর লোহার শিক দেওয়া একটা খাঁচার মতো কি একটা জিনিস টাঙানোর ব্যবস্থা করছে। ফিসফিস করে আলোচনা ঘুরছে মুখে মুখে।  চায়ের দোকানের মাসি বলে এটা তো পায়রা বসার চাতাল হচ্ছে গো। ধমক দিয়ে জেলে পাড়ার ঘনা থামিয়ে দেয় মাসিকে। তোমার মাথা। দেখছো না ইলেকট্রিকের তার জুড়ছে। আকাশ প্রদীপ জ্বালাবে মনে হয়’। ঘনার মাথায় গাঁট্টা মারে বাগদি পাড়ার তানা। পড়াশুনো না করলে এই হয়। ওখান থেকে গোটা গোটা মানুষ আকাশ থেকে হুশ হুশ করে এসে ঢুকে পড়বে চৌকো বাক্সে। পচা এতোক্ষণ দাঁড়িয়ে শুনছিল সব কিছু। বেঁটে খাটো বলে লোকজন তাকে এমনিতেই কম পাত্তা দেয়। মানুষ কি পাখি? যে আকাশ থেকে উড়ে এসে ঝুপ করে লোহার খাঁচায় ঢুকবে? হাসির হুল্লোড় পড়ে যায় ভিড়টার মধ্যে। পল্টু গম্ভীর হয়ে বলে তোমরা কিছুই জানো না। আমাদের স্যার বলেছে ওটা হল এ্যান্টেনা। হাতির যেমন শুড়। টিভির তেমন এ্যান্টেনা। ঘনা বলে আরশোলার শুড়টা তাহলে কি রে পল্টু? স্বান্ত্বনা? হেসে ওঠে আবার সবাই। রঙ্গ রসিকতা চলতে থাকে। ছোটকু আসায় বেজায় খুশি হারু আর বিশু। টিভি চললেই কিভাবে তারা সামনের সারিতে গিয়ে বসবে সেই প্ল্যান করতে থাকে।

এইসব দূর থেকে দাঁড়িয়ে দেখে নিমাই খুড়ো। খুব একটা কাছে যায় না সে। ছোট লোক গুলোর গায়ের ছোঁওয়া লাগলে স্নান করতে হবে এই অবেলায়। তখন আবার বুকে কফ বসবে। কর্পূর দেওয়া গরম তেলে মালিশ করার জন্য খ্রীষ্টান পাড়া থেকে মেয়ে ধরে নিয়ে আসতে হবে রাত বিরেতে। জানাজানি হলে ঢি ঢি পড়বে। এমন যে হয়নি তা নয়। হয়েছে। তবু মালিশ কোন ব্যাটা ছেলের হাতে নিতে এখনও এই বুড়ো চামড়া সায় দেয় না। তারপরের এক সপ্তাহ হবিষ্যি খেয়ে পাপ নিবারণ করতে হবে নিমাই খুড়োকে। তবুও এখনও জেলে পাড়ার কেউ কেউ অনেক রাত বিরেতে কড়া নাড়ে। পেতলের হাড়িটা, কড়াটা, নাক ছাবি যারা বন্ধক রাখে খুড়োর কাছে তারাই আবার এসে মালিশ করে দিয়ে যায়। অনেক রাতে তখন নতুন বরের মতো সোহাগ জাগে নিমাই খুড়োর। রাস্তায় দাঁড়িয়ে থাকতে থাকতে ঘাম হয়। হিসি পেলে এখন আর চেপে রাখা যায় না। সেই আগের দিন কাল থাকলে এখন তার ঘরে টেলিভিশন আসতো। রাধারমণ যে এটা ভালো করলো না তার গাল পাড়তে পাড়তে খুড়ো ঝোপের দিকে ছোটে। বামফ্রন্টের দেওয়ালে মুততে পারলে তবে মনে সুখ আসবে। ভোটে হারিয়ে শালারা রাজ্যপাট দখল করে নিলো গো।

একটু দূরে ভিড়ের মধ্যে সুকান্ত মাষ্টারের ছেলেকে চিনতে অসুবিধে হলো না বিজয় ঢোলের। ছেলেটা ছোট থেকে বিকলাঙ্গ। একটা পা ভালো করে ফেলতে পারে না। সরু। এখন পাড়ার সবচেয়ে বিচ্চু ছেলেটার কাঁধে চড়ে আছে। বিজয় ঢোল বুঝতে পারলো না সুকান্ত মাষ্টার এখানে ছেলেকে আসার পারমিশান দিল কী করে? এর আগে তার বাড়িতে কত অনুষ্ঠানে মাষ্টারকে সে নেমনতন্ন করেছে। তার ভাই বিষাণকে করেছে। কেউ আসেনি। বলা যায় এক কথায় পছন্দ করে না বিজয় ঢোলকে মাষ্টার। আজ একটা মোক্ষম সুযোগ পেয়েছে সে। সুকান্ত মাষ্টারের ছেলে আজ তার বাড়ির দরজার সামনে। এতোক্ষণ বিজয় ঢোলের বাড়ির কাজের লোক হারু, বিশু এদের দূর ছাই করছিল। মওকা বুঝে তাকে সরিয়ে বিজয় এগিয়ে আসে এক্কেবারে পল্টুর কাঁধের ওপর বসা ছোটকুর সামনে। ভেতরে এসো বাবা। এই রোদে কেউ কি দাঁড়িয়ে থাকে। শরীর খারাপ করবে যে। এসো আমার কোলে এসো’। বিজয় ঢোল তার সোনার দাঁত বের করা হাসিতে কেমন যেন দু হাত বাড়িয়ে দেয়। পল্টুই দু পা সরে আসে পেছনে। ওর গায়ে হাত লাগাতে যেও না ঢোল কাকু। মাষ্টার হেবি কিন্তু কড়কে দেবে। বিজয় ঢোল জিভ করে বলে ছি ছি। বামুনের ছেলেকে হাত লাগাই সাধ্য কী? একটু ঘরে গিয়ে বসলে ঠান্ডা জলটা দিতে পারতাম। গরীবের ঘরে একটু মিষ্টিমুখ করলে পুণ্যি হতো। ছোটকুর কেমন যেন ভালো লাগে না ব্যাপারটা। সে বুঝতে পারছে চরম একটা গন্ডগোলের মধ্যে পড়তে চলেছে সে। ভাস্কোদাগামা কালিকট বন্দর দখল করতে চাইছে। তার বাড়িতে বামুন কায়েত ছোঁয়াছুঁয়ি এইসব কেউ মানে না। জাত পাতও না। কাকা বলে ওগুলো হলো সামন্ত্রতান্ত্রিক প্রথা। সব জ্বালিয়ে দাও পুড়িয়ে দাও। নিজের পৈতেও তাই পুড়িয়ে ফেলেছে কাকা। বাবা বারণ করেনি। কিন্তু খারাপ লোকদের তার বাবা একদম দু চোখে দেখতে পারে না। কাকাও না। বিজয় ঢোল যে খারাপ লোক। দুনম্বরি টাকা তার ঘরে এই পাড়ার সবাই জানে। তার বাড়িতে সুকান্ত মাষ্টারের ছেলে যাবে? কক্ষোনো না। এসেই ভুল করেছে সে। সন্ন্যাসী রাজার লোভটা সে সামলে নিতে পারতো। সিনেমা দেখার এতো লোভ তার মনে? ছি ছি ছি। সবে পল্টুকে বলতে যাবে ‘চল পল্টু পালাই’কিন্তু তার আগেই তার বন্ধু দাও কষে। ছোটকুকে ঢুকতে দিলে আমাকে বিশুকে হারুকেও ঢুকতে দিতে হবে। ঠান্ডা জল খাওয়াতে হবে। তার সাথে চারটে করে রসগোল্লা। আর টেলিভিশন চললে সামনের সিট আমাদের। বিজয় ঢোল যেন হাতে স্বর্গ পায়। এতো কম খরচে শত্রু শিবিরের দুর্বলতা তার কব্জায়। এই বুঝি ইষ্ট ইন্ডিয়া কোম্পানি দখ করে নিল গোটা ভারতবর্ষটাকে। চোখ গুলো চকচক করে ওঠে বিজয়ের। তা আর বলতে? এই সব তো তোমাদেরই জন্য’। খুব আদর আপ্যায়ণ করে বাড়ির মধ্যে বসায় বিজয় ঢোল। তার বউয়ের চোখ রাঙানিকে উপেক্ষা করে পল্টু, বিশু, হারুর মতো বেজন্মা ছেলেকে সোফায় বসায়। ফ্রিজের ঠান্ডা জল দেয়। রসগোল্লা খাওয়ায়। ছোটকু জীবনে সেই প্রথম ঠান্ডা জল খেল। নরম সোফায় বসলো। কলকাতার স্পঞ্জ রসগোল্লা মুখের মধ্যে মিলিয়ে গেল। কিন্তু এইসব গুলো তার একটুও ভালো লাগছিল না। কাকা যদি কোন দিনও জানতে পারে তাহলে তার সাথে আর কথা বলবে না। ভীষণ ভয় করতে শুরু করেছিল ছোটকুর। মায়ের মারের থেকেও। কিন্তু তাদের তখন আর বেরিয়ে যাওয়ার মতো উপায় ছিল না। এতোটাই ভিড় বেড়ে গিয়েছিল যে লোকজন উপচে পড়েছিল যেমন ঘরের মধ্যে ঠিক তেমনি বাইরেও। পাড়ায় প্রথম টেলিভিশন বলে কথা। এইটুকু ভিড় হবে না? মাসির দোকানের খদ্দেরের দল রসগোল্লার রস চাটতে চাটতে বলেছিল। এদের মধ্যে দিয়ে ছোটকুর বেরিয়ে যাওয়ার মতো অবস্থা ছিল না। পল্টুও জেদ ধরেছিল চূড়ান্ত।

হাঁ করে চৌকো বাক্সটার দিকে তাকিয়ে ছিল যেন গোটা পাড়া। টিভি যখন চলতে শুরু করলো কেউ একটা কথাও বললো না। গমগম করে চাঁদটা ঘুরতে শুরু করলো সুতীব্র মিউজিকে। হাততালি দিয়ে উঠলো সবাই। মাসির সেদিন সন্ধ্যেয় চায়ের দোকান খোলা হলো না। নিতাই খুড়ো সবার ছোওয়া ছুয়ির মধ্যে ঢুকে পড়তে বাধ্য হল। লোভ বড় বিষম বস্তু ভায়া। সন্ন্যাসী রাজা বলে কথা। সবাই থামিয়ে দিলো খুড়োকে। ততক্ষণে টিভিতে মহানায়ক, পল্টুর গুরুর গুরু উত্তমকুমার বলতে শুরু করেছে, ‘তোমরা সবাই জয়ধ্বনি দিচ্ছো কিন্তু আমি রাজা হতে আসিনি। মাসি চোখের জল মুচছে কাপড়ে। ঠিক সেই সময়ে টেলিভিশনের গোটা পর্দা জুড়ে এলো সংবাদ। এতোদিন সবাই রেডিওতে সংবাদ শুনেছে। এবার চোখে দেখবে। এতোক্ষণে কেমন যেন হাঁপ ছাড়লো ছোটকু। এখানে আসার পর থেকে সব কিছু তার কাছে কেমন যেন বিস্বাদ লাগছে। ঠান্ডা জল, রসগোল্লা, টেলিভিশন, তার মধ্যে উত্তমকুমার সবকিছু। বাড়ি চলে আসবে বলে খুব করে বলছিল পল্টুকে। চল না এবার যাই আর ঠিক সেই সময়ে গোটা টিভির পর্দা জুড়ে একজন মহিলাকে দেখলো ছোটকু। এতো পর্দার নায়িকার মতো নয়। একটুও রঙচঙ মাখা নয়। ঠিক যেন তার মায়ের মতো করে শাড়ি পড়া। খোপা করা। চোখে চশমা। যেন ঠিক এক্ষুনি পড়াতে বসবেন। একটু গম্ভীর হাসি হেসে বললেন নমস্কার। সঙ্গে সঙ্গে ঘরের অনেকেই প্রতি নমস্কার জানালো তাকে। সেটা সেই মহিলা টিভির মধ্যে থেকে দেখতে পেলেন কিনা বোঝা গেল না। সরাসরি সবার দিকে তাকিয়ে বললেন খবর পড়ছি ছন্দা সেন। ঠিক সেই সময় দপ করে কারেন্ট চলে গেল। চারিদিকের ঘুটঘুট্টি অন্ধকারে হায় হায় করে উঠলো পাড়ার লোক। বাগদি পাড়ার হরির মা মুখ ঝামটা দিল। মাইয়াটারে একটু বসতেও দিল না। হাসি মুখে নমস্কার করলো...একটু পান যে দেবো...তার সময় দিলি না মুখপোড়াগুলো’। কারেন্ট অফকে গালি দিতে দিতে বার হয়ে যায় সে। সবাই জানে একবার যখন কারেন্ট গেছে তখন আর সহজে আসবে না। ভিড় পাতলা হয়ে গঙ্গার ধারে গিয়ে ভিড়তে থাকলো। নিমাই খুড়ো ওই রাতে গঙ্গায় ডুব দিল কম করে বার কুড়ি। অস্পৃশ্যের ছোঁওয়া বলে কথা। আজ রাতে তার কর্পূর তেলে মালিশ লাগবেই।

খুব ভয়ে ভয়ে এবার বাড়ি ফিরলো ছোটকু। ভেবেছিল বাড়ির লোকজন তাকে চাবকে রেখে দেবে। কিন্তু বাবা কিছুই জানতে চাইলো না। মাও না। এমনকি তার সাথে ঘুর ঘুর করা হুলোটা পর্যন্ত মুখ তুলে তাকালো না। সবাই কেমন যেন শুধু একটু গম্ভীর হয়ে থাকলো। কাকা থাকলে সেও কি এইরকম করতো। কান্না পেল ছোটকুর খুব। বেজায় কান্না। খেতে বসে সে ভ্যাঁ করে কেঁদে ফেললো। মা তবুও কিছু বললো না। বাবা শুধু মাথায় হাত বুলিয়ে বললো এরপর কোথাও কারও সঙ্গে বাড়ির বাইরে গেলে বলে যেও ছোটকু’। শোওয়ার সময় মা পিঠে সুরসুড়ি দিয়ে দিল না। তালপাতার পাখায় হাওয়া করলো না। কেউ জানতেই চাইলো না কোথায় গিয়েছিল সে। কি দেখলো? বড় অভিমান হলো তার। নিজের মনে মনে দিব্যি গাললো ছোটকু কোনদিন আর না বলে কোথাও যাবে না। টিভি তো দেখবেই না। কোনদিন না। তাহলে তার মা তাকে আদর করবে তো? সুড়সুড়ি দেবে তো? গভীর রাতে কাঁপুনি দিয়ে জ্বর এলে ছোটকুর মাথায় জলপট্টি পড়েছিল। আর ছোটকু দেখেছিল তার টেলিস্কোপের কাঁচে চোখ লাগিয়ে, কারেন্ট আবার এসেছে। রাজবাড়ি পাড়ার লোকজন জড়ো হয়েছে মাসির চায়ের দোকানের সামনে। সেখানে ভাঙা বেঞ্চিতে বসে গম্ভীর হাসি মাখা মুখে সত্যি সত্যি খবর পড়ছেন ছন্দা সেন।

প্রথম প্রকাশ শারদীয় নির্মুখোশ। ২০২১।

ছবি সৌজন্য-গুগুল ইমেজ

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি