তেইশে জানুয়ারী
ঠিক এই মুহূর্তে, জন্মদিনের সকালে নেতাজী যদি দেশে ফিরে আসতেন কী দেখতেন তাহলে? আদৌ তিনি যে দেশটাকে স্বাধীন করতে চেয়েছিলেন সেই দেশটাকে চিনতে পারতেন? ১২৮ তম জন্মদিনেও তিনি অমর। ভারতের স্বাধীনতার ইতিহাসে তিনি মিথ। সব চাইতে বিতর্কিত। সবাইকে পেছনে ফেলে তিনি এখনও অগ্রনী। তবুও প্রত্যেকবার তেইশে জানুয়ারী এলে আমাকে এই প্রশ্নটা ভাবায়। কয়েকজনের কথা মনে করিয়ে দেয়।
আমাদের স্কুলে ইতিহাস পড়াতেন মণিবাবু। চোখে ভালো দেখতে পেতেন না। বইটা একদম নাকের ডগায় ধরে তাঁকে পড়তে হত। প্রায় ক্ষীণকায়, একটা চোখ ছানিতে নষ্ট হওয়া সেই স্যারের কাছে আমার প্রথম স্বাধীনতা সংগ্রামীদের সঙ্গে পরিচয়। বিশেষ করে অগ্নিযুগের সেইসব আগুনে ঝাঁপ দেওয়া বিপ্লবীদের সঙ্গে। আজাদ হিন্দ ফৌজ, চট্টগ্রাম অভ্যুত্থান, আরও নানান ঘটনা তিনি যেভাবে পড়াতেন স্কুল ছুটির ঘন্টা বেজে গেলেও লাস্ট বেঞ্চ পর্যন্ত চুপটি করে শুনতো। সেদিন আর হুড়মুড়িয়ে চিৎকার করতে করতে কেউ সিঁড়ি দিয়ে নামতো না। মাথায় ঘুরতো এক পার্বত্য উপত্যকা, বন জঙ্গলে ঘেরা পথ, রেডিও সামনে নিয়ে অধীর আগ্রহে অপেক্ষা, ফাঁসীর মঞ্চে বীরদের জয়গাথা।
আমার বিধবা পিসি আমরণ বিশ্বাস করে গেছেন সুভাষ থাকলে দেশভাগ হতো না। 'সোনার ছেলে কোনোদিন সোনার বাংলা ভাগ করতে দিতো? তোমাদের থোঁতা মুখ কেমন ভোঁতা হত দেখতে তখন'। তরুণ অপেরার শান্তিগোপাল 'আমি সুভাষ বলছি' যাত্রায় নেতাজী সেজে স্টেজে এসে দাঁড়ালে মণি হাতজোড় করে প্রনাম করতো। তারপাশে চাদরে আদ্যপান্ত ঢাকা বছর পাঁচেকের ভাইপোকে পর্যন্ত প্রনাম করিয়ে ছাড়তো। 'দেখিস একদিন ঠিক আসবে আমাদের সুভাষ। তখন বুঝবে হারামজাদারা'। মণিকে মাদারের নির্মল হৃদয়ে মরতে হয়েছিল। শেষবেলায় মুখে কেউ জল দিয়েছিল কিনা আমাদের পরিবারের কেউ জানে না। মণির সুভাষ আজও ঘরে ফেরেনি। তার জন্মদিনে বিরাট বিরাট বিজ্ঞাপন ছাপানো হয়েছে বিভিন্ন নেতা মন্ত্রীদের ছবি দিয়ে। দিল্লীতে বসানো হয়েছে মূর্তি। সকাল থেকে পাড়ার মাইকে চলছে দেশাত্মবোধক গান। হিন্দিতে। একটু পরেই নিশ্চই বক্তৃতা শুরু হবে।
১৯৮৯ সাল। ক্লাস নাইন। শীতের সন্ধ্যে। আমি আর আমার বন্ধু ফিরছি প্রায় অন্ধকার এক গলি দিয়ে। সেই পথ দিয়ে ওই সময়ে আসা উচিত নয়। কারণ পাশেই রেল ইয়ার্ড। সেখানে নানা রকম কাজ হয়। যার ফলে মাঝে মাঝেই বোমা পড়ে। লাশ পড়ে। পুলিশ টহল দেয়। দেওয়ালে লেখা থাকে বিশাল বড় হাতের চিহ্ন দিয়ে মেরা ভারত মহান। কিম্বা উলটো দিকে লেনিনের ছবির পাশে সাম্রাজ্যবাদ নিপাত যাক। এগিয়ে যাচ্ছিলাম আমরা একটু তাড়াতড়ি। হনহনিয়ে বলা যায়। পেছন থেকে কেউ একজন ডাকে অন্ধকার ফুড়ে, বেটা। দাঁড়িয়ে পড়েছিলাম আমরা। রাস্তার পাশে ছেঁড়া খোড়া জামা পড়া এক পাগোল ভিখারী চেয়েছিল এক ভাঁড় চায়ের পয়সা। আর আমাদের সে শুনিয়েছিল যুদ্ধ থেকে হেরে ফিরে আসা এক সৈনিকের গল্প। বলেছিল ভাঙা ভাঙা হিন্দি আর বাংলা মিশিয়ে, তৈরি থেকো ফিরছেন নেতাজী। পাশে ক্লাসে ফাস্ট হওয়া বন্ধু তাচ্ছিল্য করে বলেছিল, কোথায়? চিকচিক করে উঠেছিল বুড়োর চোখ। খবর আছে। তারজন্য চোখ কান খোলা রাখতে হবে।
কত বছর হয়ে গেছে। মমির মতো হয়ে উঠেছি আমি। চোখ কান সব বন্ধ। তবুও প্রত্যেক বছর তিনি ফিরে আসেন। তেইশে জানুয়ারী। বাঙালি ছুটি পায়। সকালে ঘুম থেকে উঠে কচুরী জিলিপি খেয়ে বাজারে যায়। আমার মতোই আড়মোড়া ভেঙে কেউ হয়তো ভাবে এমন একটা যুদ্ধ করেছিল বটে কেউ। অনেক ভেবে চিন্তে কবিগুরু হয়তো সেইজন্যই তাঁকে উৎসর্গ করেছিলেন 'তাসের দেশ'। যাকে সত্যিই বাঙালির গন্ডির মধ্যে আটকে রাখতে পারেনি কেউ। তাই তিনি অমর। তিনি মিথ। এখনও যাঁর ঘরে ফিরে আসার স্বপ্ন দেখেন কেউ কেউ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন