বড় দিন

 

সিনেমার জন্মের মাত্র চার বছর পরে জন্মে ছিলেন তিনি। লন্ডনের একটা স্যাঁতসেঁতে গলিতে বড় হচ্ছিলেন অভিনেত্রী মা হান্না, দাদা সিডনি আর গভীর দারিদ্রতার সঙ্গে। যে দারিদ্রতার কথা সেই সময়ে আমরা যারা ইংরেজদের গোলামী করছিলাম তারা হয়তো ততটাও জানতাম না। রানীর সাম্রাজ্যের এমন চেহারা আমাদের সামনে উন্মোচন করা হত। শিল্প বিপ্লবের এমন রমনীয় গাথা গাওয়া হতো তা যেন স্বর্গের পরের স্টেশনকে স্মরণ করাতো আমাদের মতো নেটিভদের। আর যারা তাদের দেশেই নিজের মায়ের ভাষায় কথা বললেও নেটিভদের মতো হয়ে থাকতো? দিনের সামান্যতম আহার পর্যন্ত জোগাড় করতে যাদের হিমশিম খেতে হত? একটা ছোট্ট ছেলেকে দেখতে হতো কিভাবে মিউজিক হলে মাকে অপমান করছে যুদ্ধ ফেরত সৈনিকের দল। অনেক পরে ফিরে দেখছেন চ্যাপলিন তাঁর সেই লন্ডনের গলিকে। তাঁর সেই ভুবন ভোলানো মাকে যাঁকে তিনি বা সিডনি অত প্রাচুর্যের মধ্যেও নিজেদের কাছে কোনো দিন রাখতে পারেননি। বারবার সেই ছোট্ট বেলার সেইদিনের কথাটাই মা বলে গেছেন ছেলেদের 'সেদিন যদি একটু গরম চা পেতাম'।

হান্না ভুলে গিয়েছলেন সব। কিন্তু ছেলে ভোলেনি কিছুই। সেসব কিছু লিখে রেখে গেছে তার ছবিতে, বইতে। কিন্তু দুঃখের সারণী হিসেবে নয়। বরং হাসির বোমা ফাটিয়ে। গোটা পৃথিবী তুলকালাম করে। বলা ভালো হুলস্থুল করে। এমনকি হিটলারের দিকে আঙুল তুলে চিৎকার করে বলে, 'ব্যাটা আমার গোঁফ চুরী করেছে'। অমন সাহস না থাকলে ওই সময় দাঁড়িয়ে গ্রেট ডিক্টেটর হয়? আর হবে নাই বা কেন? তিনি যে বিখ্যাত অভিনেত্রীর ছেলে। যাকে ছোট্ট থেকে মা ওই অভাবের মধ্যেও শিখিয়েছেন অনেক কিছু। তার দুচোখ ভরা যে স্বপ্ন। একদিন নিজের কথা শোনাতে, যুদ্ধ নয়, বোমারু বিমান নয়, অভিনয় আর ছবিতে গল্প বলে তাঁকে যে বিশ্বজয় করতে হবে। সেই সুযোগও এসেছিল হঠাৎই। অতর্কিতে। তাই থিয়েটারে চ্যাপলিন যখন দিকপাল মাত্র কুড়ি বছর যার বয়েস নাম লেখালেন ফিল্মে। তাও নিজে থেকে নয় মোটেই। আমেরিকায় থিয়েটারে অভিনয় দেখে নিমন্ত্রণ করলেন কিস্টোন কোম্পানির মালিক ম্যাক সেনেট। তাঁর স্টুডিওতে শুধু হাসির ছবি তৈরি হয় যে।

থিয়েটার ছেড়ে সম্পূর্ণ এক নতুন মাধ্যমে গিয়ে কাজ করার বিষয়ে দ্বিধায় ছিলেন চ্যাপলিন। ভাষা নিয়েও একটা সমস্যা ছিল। দাদা সিডনিকে লেখা চিঠিগুলোতে তার সব ছড়িয়ে ছিটিয়ে জমাট বদ্ধ হয়ে আছে। তখন তো সবে স্টুডিও গুলো তৈরী হচ্ছে। আস্তে আস্তে গড়ে উঠছে হলিউড। থিয়েটারের যে নিয়মানুবর্তিতা, শৃংখলা, নীতিবোধ আদি সিনেমার ঝুলিতে তার ছিটেফোটাও যে নেই তখন। কেমন যেন খোলামেলা এলোমেলো ভাব। তাই পছন্দ হয়নি পরিবেশ। এমনও হয়েছে দু এক দিন কিস্টোন স্টুডিওর বাইরে থেকে ফিরে এসেছেন চ্যাপলিন। ভেতরে ঢোকেননি। তারও অনেক পরে যখন ফিরে দেখবেন সব, আমরা জানতে পারবো অনেক কিছু। আমরা জানতে পারবো আসলেই যা উন্নয়ন বলে দেখানো হয়। যাকে স্বপ্নের মতো প্রজেক্ট করা হয় সেগুলো এই পৃথিবীর মানুষের কাছে সত্যিই কি উন্নয়ন? সত্যিই কি স্বপ্ন? আর সেই প্রশ্নগুলো আমেরিকার গ্রাম গঞ্জ থেকে শহরের কারখানায় খাটতে আসা, নিরুপায় গরীব মানুষরা, হাঁ করা দারিদ্রতায় বাস করা যন্ত্রনায় কাতর হওয়া শ্রমিকদের হয়ে প্রশ্ন করেন এক ভবঘুরে। যাকে সবাই আদর করে ডাকে চার্লি। যে সিনেমার সেই আদি যুগ থেকে এখনও সমান তালে অর্থবহ। যিনি আজও সাদাকালো ছবির মধ্যে থেকেও নতুন। প্রতিদিন। প্রতিনিয়ত।

কেন চ্যাপলিন এখনও মারাত্মক প্রাসঙ্গিক? দর্শকের কাছে। পড়ুয়ার কাছে। চিন্তকদের কাছে। এই পৃথিবীর কাছে? কেন তাঁর ছবি পুরনো হয়েও হয় না। কেন তিনি মিথ তাঁর সব কিছু নিয়ে? আমার মনে হয় এই একটা মানুষ যিনি সারাক্ষণ নিজের সৃষ্টিকর্মে, নিজের জীবনে নিরন্তর প্রশ্ন করে গেছেন। নিজেকে ভেঙেছেন আপাদমস্তক। যিনি নিজে অভিবাসী, উদ্বাস্তু তাঁর কাছে পৃথিবীটাই তো ঘর। তাঁর তো হারিয়ে যাওয়া, ফুরিয়ে যাওয়া, ক্ষমতার রক্তচক্ষুকে ভয় পাওয়ার কিছু নেই। আজ তাঁর পৃথিবী থেকে চলে যাওয়ার দিন। কিন্তু তিনি কেমন যেন আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে আছেন আমাদের সঙ্গে। সিনেমার মতোই। প্রচন্ড বাস্তব হয়ে। অনেক ভালোবাসা, শ্রদ্ধা প্রিয় কমরেড চার্লস স্পেনসর চ্যাপলিন। আপনি ভালো থাকবেন। এই পৃথিবীতে এখনও আপনার প্রয়োজন ফুরিয়ে যায়নি। যাবেও না কোনোদিন।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি