দুঃসময়ের দর্শন
বাড়িতে যখন বড়রা যুদ্ধ করে তখন সবচেয়ে ক্ষতিগ্রস্ত হয় কারা? সেই বাড়ির সবচেয়ে ছোট ছোট সদস্যরা। কেমন ক্ষতিগ্রস্ত হয় আর তাদের জীবনে কি কি সমস্যা নেমে আসে একটু খোঁজ খবর রাখলেই তার হদিশ পাওয়া যায়। আমরা সেগুলো জানিও। আর যখন একটা দেশ আর একটা দেশের সঙ্গে যুদ্ধ করে? কিম্বা একাধিক দেশ একসঙ্গে? সমস্ত শহরটা যখন ধ্বংস স্তুপে পরিণত হয়ে যায়। তখন সেই ছোট্ট ছোট্ট ছেলে মেয়েদের কি অবস্থা হয়? এটাও হাতের কাছে একটু নেট ঘাঁটলেই পাওয়া যায়। হয়তো একটু বেশি করেই পাওয়া যায়। যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশগুলোর থেকে পালিয়ে আসা, বেঁচে থাকা পৃথিবীর সেই ক্ষুদে সদস্যদের সত্যিকারের গল্প এখানে ওখানে প্রকাশ পায়। ওয়ার চাইল্ড হ্যাশট্যাগের সংখ্যাটাও কেমন যেন অস্বস্তি জাগায়। বাকিটা পৃথিবীর ইতিহাসের নিয়ম মেনেই হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশে চলে যায়। তাদের মধ্যেও আবার কেউ কেউ মনে রাখেন। কেউ রাখে্ন না। আবার কেউ পরবর্তী প্রজন্মকে মনে করিয়ে দেওয়ার জন্য সযত্নে তুলে রাখেন। বাচ্চা বাচ্চা বলে মাথা না খেয়ে আসন পেতে সেই কাহিনী বলতে বসেন একজোড়া ছোট্ট বেলার চোখ দিয়ে।
সেইরকমই একটা গল্প এবার এ্যাপেল টিভিতে #AppleTVPlus শুনিয়েছেন স্টিভ ম্যাককুইন #stevemcqueen। তাঁর ব্লিটজ #BlitzFilm দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধের পটভূমিকায় লন্ডন। যেখানে হিটলারের বোমারু বিমান একের পর এক বোম ফেলে শহরটা তছনছ করে দিচ্ছে। সেই শহরে ছোট্ট ছেলে জর্জ থাকে তার মা আর দাদুর সঙ্গে। কিন্তু প্রতিদিন রাতে সাইরেন শুনে পালাতে পালাতে এখন তার আর ভয় করে না। বরং আদরের বেড়ালটাকে সে ভয় কাটানোর সাহস জোগায়। ভয় পেয়ো না, এই দেখো না আমরা কেমন সবাই একসঙ্গে আছি। একটু পরেই বাড়ি চলে যাবো। সবাই সকাল হলে আবার যে যার মতো বাড়ি ফেরে কিন্তু সরকার ফরমান জারি করে ছোটদের নিরাপদে রাখার জন্য শহর নয় গ্রামের এক প্রত্যন্ত জায়গায় পাঠিয়ে দিতে হবে। সেখানে তারা সরকারের দেখভালে সুরক্ষিত থাকবে। প্রচন্ড অনিচ্ছা সত্ত্বেও জর্জকে যেতে হয় তার মা, দাদু আর আদরের বেড়ালকে ছেড়ে। যাওয়ার সময় জর্জ তার মায়ের সঙ্গে একটুও কথা বলে না রাগে, দুঃখে, অভিমানে। এমনিতেই তার বন্ধুরা তাকে ব্ল্যাক বলে খেপায়। তার গায়ের রঙ কালো। কিন্তু দাদু আর মায়ের গায়ের রঙ সাদা। বাবাকে কোনোদিন সে চোখেই দেখেনি। কোথায় চলে গেছে কে জানে? তাই কি মা তাকে পাঠিয়ে দিল? বাচ্চা ভর্তি এক ট্রেন গাড়িতে উঠে পড়ে জর্জ। ফিরেও তাকায় না কান্নাকাটি করা পৃথিবীর সবচেয়ে ভালোবাসা মায়ের দিকে। কিন্তু সে কি সত্যি নির্বাসনে যাবে? দাদুর সঙ্গে সেকি আর কোনোদিন পিয়ানো বাজিয়ে গান গাইবে না? মা কি তাকে ঘুমোনোর সময় আর কোনোদিন গল্প শোনাবে না? পাড়ার রাস্তায় ক্রিকেট খেলে চ্যাম্পিয়ন হয় জর্জ। সে কি এতো সহজে সিস্টেমের কাছে হার মানবে? মোটেই না। কক্ষোনো না। কোনোদিনও না। লুকিয়ে ঝপাং করে সে চলন্ত ট্রেন থেকে লাফ মারে। পালায়। তার এই পালানোই ব্লিটজ ছবির বিষয়। এই ছবির প্রাণ ভোমরা। কেন?
কারণ পালাতে না পারলে একটা জ্বলন্ত সময়কে কেমন করে দেখতো জর্জ? কেমন করে বুঝতো না সত্যি তার মা ভালোবাসে তাকে। যুদ্ধ ভূমির এক ব্ল্যাক সৈন্যের সঙ্গে বন্ধুত্ত্ব না হলে বুঝতো কি করে আসলেই গায়ের রঙ দিয়ে, চামড়া দিয়ে, ধর্ম দিয়ে মানুষকে আলাদা করা যায় না। যারা করে তারাই গোটা পৃথিবীতে যুদ্ধ বাধায়। নিরাপরাধ মানুষকে মেরে ফেলে। পৃথিবী ধ্বংস করে। লেখক এবং পরিচালক স্টিভ ম্যাককুইন এক বাচ্চার চোখ দিয়ে দেখান যুদ্ধ বিধ্বস্ত লন্ডনকে। সময়কে। তার চারপাশের মানুষদেরকেও। আর একটা রূপকথাকেও যা বুনে চলেন ছবির ভাষায় একজন লেখক এবং পরিচালক সর্বোপরি তার টিম অত্যন্ত নিষ্ঠার সঙ্গে এবং যত্ন নিয়ে।
একটা ছবি দেখলে সেটা কি আপনাকে তাড়া করে নিয়ে বেড়ায়? মন কেমন করায়? অটোর লাইনে, মেট্রোর ভিড়ে, ঘুমিয়ে পড়ার আগে কিম্বা না ঘুম আসার রাতে আপনাকে সজাগ করে? কেউ কেউ হয়তো করে। এই ছবিটা আমার সেইসব ছবির তালিকায় থাকবে হয়তো বেশ কিছুদিন।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন