বহুরূপী


 এই ছবি এমন মারাত্মক গল্প বলে না যা আপনি আগে কোনোদিন শোনেননি বা জানেন না। সেই ছোট্টবেলায় যখন কাগজের ছোট ছোট হোমিওপ্যাথির পুরিয়ার মতো টুকরোয় চোর দারোগার খেলা জমানো থাকতো পেন্সিল বক্সে তখন থেকেই তো গল্প ঘুরছে মাথায়। খবরের কাগজে। চায়ের দোকানে। বর্ষার রাতে কারেন্ট অফে তাড়িনী বাবুর গরম গরম ফুলুড়ি খেতে খেতে। আমাদের বাড়িতে প্রায়ই একটা গল্প ঘুরে ফিরে বেড়াতো সেই আশির দশকের শুরুতে কেমন করে চুপটি করে পুলিশ কখনও ভ্যানওয়ালা সেজে, ঠেলা গাড়ির চালক হয়ে, ভিক্ষে করতে করতে একটা পুরো ডাকাত দলকে ধরে ফেলেছিল। সামনে ভাতের থালা নিয়ে আমরা হাঁ করে শুনতাম সেই গল্প। তারমধ্যে যে কখন মায়ের খাওয়ানো শেষ হয়ে যেত সেটা ধরতেই পারতাম না আমি বা দাদা কেউই।


অনেকদিন পরে আমার মায়ের সেই মুখের গল্পটা কেমন করে জানি সাদা পর্দায় হাজির করে দিয়েছেন শিবপ্রসাদ এবং নন্দিতা। শুধু হাজির করেছেন তাই নয় গোটা বাঙালির অন্তত হাজার বার শোনা গল্পকে এক অসাধারণ দক্ষতায় এবং আত্মিক সৃজনে বুনে দিয়েছেন বাংলার রূপ রস গন্ধ স্পর্শ মেখে। তাই এইছবি বাঙালির অত্যন্ত কাছের। এর ধারে পাশে তাই মুম্বাই বা সাউথ কেউই নেই। শুধু অনন্ত পর্দা জুড়ে আছে বাংলার মাঠ, ঘাট, নদী, কুয়াশা, আর সেই মানুষগুলো যাদের ছবিতে এখন দেখা যায় না। আবার যারা হল ভর্তি করে ছবি না দেখলে বাজারে আকাল হয়। একটার পর একটা সিনেমা হল ভেঙে বহুতল ওঠে। গজায় শপিং মল।

ঋত্বিক ঘটক পথের পাঁচালী দেখে ইন্দির ঠাকরুনকে বলেছিলেন বাংলার আত্মা। এক বিখ্যাত ইউরোপিয়ান পরিচালক জঁ রেনোয়া সেই সময়ের ডি জে কিমারের তরুণ আর্টিস্ট সত্যজিৎ রায়কে বলেছিলেন যতদিন তোমরা নিজের দেশের ভাষা না খুঁজে পাচ্ছো ততদিন হলিউডের অন্ধ অনুকরণ করে যাবে। তারও প্রায় বছর পনেরো আগে সম্পূর্ণ বেনামে এক সিনেমা পত্রিকা সম্পাদনা করতে গিয়ে প্রচন্ড সিনেমা দেখা আরণ্যকের কথাকার বিভূতিভূষণ লিখেছিলেন তাঁর দুঃখের কথা। স্টুডিওর মধ্যে আটকে থেকে দম বন্ধ হবার কথা। তিনি চাইছিলেন বাংলার মুখ। চাইছিলেন পর্দায় তেপান্তরের পার।

বাংলা সিনেমা সেইসব অনেকদিন আগে পেরিয়ে এসেছে। করেও দেখিয়েছে তার সব অসাধারণ কাজ। মাথা উঁচু করে। যার নিদর্শন ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে অজস্র। আজ তার নদীতে খরা। জল নেই। তবুও এই আকালে জয় মা বলে একটা নৌকা ভাসিয়েছেন শিবপ্রসাদ এবং নন্দিতা রায়। বিশ্বাস করুন এমন তরণী বাওয়া আমি অনেকদিন দেখিনি। আমি দেখিনি পলাশ রাঙা হয়ে কোনো কনেকে কোনোদিন এর আগে বাংলা সিনেমার পর্দায়।

আপনাদের জয়যাত্রা অব্যাহত থাকুক। অনেক শুভেচ্ছা।

পুনশ্চ- পারলে হলে গিয়ে ছবিটা দেখুন। সেটাও একটা অভিজ্ঞতা।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি