ঝর্ণা মন্ডল


 গাড়ি চালাতে আমার খুব ভালো লাগে স্যার। সকাল আটটা থেকে রাত এগারোটা পর্যন্ত চালাই। রবিবার ছুটি থাকে। সেদিন বাড়ি থাকি। নানা কাজ থাকে। কোভিডের সময় আজাদ ফাউন্ডেশান ওই যে ফিল্ম স্টার আমির খানের ছেলের নামে ওদের একটা সংস্থা আছে না ওখানেই গাড়ি চালানো শিখি। খুব যত্ন করে শিখিয়েছিলেন স্যাররা। শুধু তাই না গুগুল ম্যাপ দেখে রাস্তা কিভাবে চিনবো। কিভাবে যাবো। সব কিছু। অনেক ড্রাইভারের চাকরী এসেছিল স্যার। একটাও করিনি। চাকরী করা মানে আটকে যাওয়া। আর এই যে গাড়ি চালাচ্ছি। নিজের না তবুও তো কত মানুষের সঙ্গে রোজ দেখা হয়। কত মানুষ কত গল্প করেন। ভালো লাগে। প্রথমে অনেক কিছু ভুল হতো। পার্ক সার্কাস সেভেন্ট পয়েন্টে গিয়ে মনে হতো কোন দিকে যাবো। কোন দিকে বেরোবো। পার্ক স্ট্রিটে গেলে ওয়ান ওয়ে। ভুল হয়ে যেত। কিন্তু সার্জেন্ট স্যাররা চিনিয়ে দিতেন। একদিনের জন্যও কেস দেননি। একদিন হয়েছে কি আমার গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে গেছে এই বাইপাসের ওপরেই। চাকাটা লাগাচ্ছি। দেখি একজন বড় পুলিশ স্যারের গাড়ি এসে দাঁড়ালো। আমি তো ভয়েই মরি। কী হলো। এবার যদি কেস দেয়। উনি গাড়ি থেকে নেমে ওনার ড্রাইভারকে দিয়ে গাড়ির চাকা ঠিক করে দিতে বললেন। আমি বারণ করেছিলাম। কিন্তু উনি বললেন দেখতে যখন পেয়েছি এটা করতে দিন। পরের বারেরটা নিজে লাগাবেন। বাড়িতে দুই ছেলে আছে স্যার। বড় জনের বিয়ে হয়ে গেছে। নাতি আছে। ছোট ছেলেটা এখনও বিয়ে করেনি। মেয়েটারও বিয়ে হয়েছে। জামাই মেয়ে সবাই খুব কাছাকাছি থাকে। নাতি নাতনি বউমা, জামাই সবাইকে নিয়ে আমার সংসার স্যার। সাত বছর আগে স্বামী মারা যান। কিন্তু তারপর থেকে বসে থাকিনি। লড়ে গেছি স্যার। এক দিনের জন্যও থামিনি। আমরা সবাই মিলে কাজ করি স্যার। কেউ বসা না।


একটানে কথা গুলো বলে যাচ্ছিলেন ঝর্ণা মন্ডল। আমার মাত্র তিরিশ মিনিটের রাস্তায় ঝর্ণাদি। কত আপন করে যে নিয়েছিলেন। আর কি দক্ষতায় যে গাড়ি চালাচ্ছিলেন তা হয়তো যাঁরাই ঝর্ণাদির গাড়িতে চড়েছেন তাঁরাই জানেন। সকালে ভাত কিম্বা পান্তা খেয়ে বেরোন। কিম্বা ছাতুর সরবত। দুপুরে মুড়ি বাতাসা। গাড়ি যখন ফোর্টিস হস্পিটালের কাছে। একদম আমার অফিসের সামনে তখন বাড়ি থেকে বউমার ফোন আসে, আজ ভাত পর্যন্ত খেয়ে যাওনি মা। গেরস্থালির টুকিটাকি কথা হয়। সিগনাল ছাড়ে। ঝর্ণাদি এগিয়ে যায়।

এতোদিনে কোনো খারাপ অভিজ্ঞতা?

একটাও না স্যার। এখনও পর্যন্ত না। অনেক রাত হলে কোনো কোনো পুলিশ স্যার বলে এবার বাড়ি যান। আমি বলি কেন? আপনারা কি বাড়ি যাচ্ছেন? ডিউটিই তো করছেন। আমিও আমার ডিউটি করছি। আমার কারও সাথে কোনো শত্রুতা নেই স্যার। সেই যবে স্বামীর সঙ্গে এসেছিলাম তবে থেকে খারাপ ব্যবহার পেলে আর খারাপ কেউ বললে দূরে সরে গেছি। ভালোটা মনে থাকলে কত ভালো লাগে তাই না স্যার? জানেন শুধু একটাই স্বপ্ন আমার। নিজের গাড়ি হবে একদিন। তখন আরও অনেক মনের সুখে গাড়ি চালাবো। একটু একটু করে পয়সা জমাচ্ছি স্যার। মনে ভাববেন না আমি একা। এই শহরে আমার মতো এমন আরও খান পঞ্চাশেক মেয়ে ড্রাইভারি করছেন। মনে মনে বলি সবার যেন নিজের গাড়ি হয়।

ঝর্নাদির গাড়ি থেকে যখন নামলাম চারিদিকে ভেসে যাচ্ছে শরতের ঝকঝকে রোদ। সামনেই দেবীপক্ষ।

ফেসবুক পোস্ট-২৮ সেপ্টেম্বর

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি