ঝাঁপ - এক (নীল রঙের ফাউন্টেন পেন)
এক
নীল রঙের ফাউন্টেন পেন
ঝিরঝির করে বৃষ্টি পড়ছিল। অনেকক্ষণ ধরে। তার সাথে জোলো
বাতাস। হাওয়ায় উড়ছিল ঘরের পর্দাগুলো। অর্চিত ভেবেছিল জানলাগুলো সব বন্ধ করে দেবে।
কিন্তু করা হয়নি। আসলে ইচ্ছে করেনি। টেবিল ল্যাম্প থেকে চুঁয়ে পড়ছিল আলো। সেটুকু
আলোতেই যেটুকু দেখা যায় একবার ঘরখানা। তাকিয়ে দেখেছিল
অর্চিত। তার এই আঠেরো বছরের জীবনে তিনতলার ঘরটা জড়িয়ে আছে
নানাভাবে। ঠিক কিভাবে সেটা এখন তার একটুও ভাবতে ভালো লাগলো
না আর। সারা ঘরটায় আস্তে আস্তে ছড়িয়ে পড়ছে নীচের বাগানের
হাসনাহানার গন্ধ। বৃষ্টিতে ভিজে ফুলগুলো নিঝুম হয়ে আছে মনে হয়। একবার দেখবে কি গাছটাকে? কেমন সারা গায়ে জ্যোৎস্নার মতো আলো জড়িয়ে নুয়ে
আছে। দক্ষিণ দিকের জানলার ঠিক নীচেই তো। কিন্তু চেয়ার ছেড়ে
উঠলো না অর্চিত। ল্যাপটপটাকে শাটডাউন করে লেখার ছোট্ট প্যাডটাকে টেনে নিল নিজের
দিকে।
সামনেই রয়েছে লাল, কালো, নীল এই তিন রঙের জেল পেন। এই পেনগুলো দিয়েই লেখে
অর্চিত। ইউজ এ্যান্ড থ্রো। ব্যবহার হয়ে গেলেই নিঃশেষ হয়ে যায় এদের জীবন। কিন্তু
সত্যিই কি তাই? কাজ ফুরিয়ে গেলেই কি সব কিছু শেষ হয়ে যায়? বিশ্বাস করে না অর্চিত।
বাড়তে থাকে তাই মৃত পেনের সংখ্যা। যদিও অর্চিত বেশিরভাগ
সময়ে লেখে ল্যাপটপে। খুব সম্প্রতি ফাউন্টেন পেনে। তার বাবা অনির্বাণ কলকাতার কোন এক পুরনো দোকান থেকে পেয়েছিল পেনটা। সেখানে নাকি পড়েছিল অনেক দিন ধরে।
দোকানি বলেছিল, নিয়ে যান। খানদানি পেন। এইসব কি আজকাল আর
পাওয়া যায়? অনির্বাণ একটুও না ভেবে নিয়ে এসেছিল বাড়িতে। পেনটা দেখে
তার হয়তো মনে পড়ে গিয়েছিল অনেক কিছুই। অনির্বাণের দাদা মানে
অর্চিতের জেঠু ঠিক এইরকম একটা কালি
পেনে লিখতো। ঝরঝরে হাতের লেখায় ভর্তি হয়ে যেত খাতা। তার পাতা উড়ে বেড়াতো সারা বাড়ি
জুড়ে। দোতলার ঘরে। সিঁড়িতে। বারান্দায়।
মুক্তোর মতো হাতের লেখায় জড়ানো কাগজগুলো তুলে রাখতো ছোট্ট অনির্বাণ। কম কথা বলা দাদাকে মনে মনে ভয় পেতো সে। ভালোও
বাসতো হয়তো। কাজেই ছেলে যদি আবার তেমন ভাবে লেখে কোনোদিন।
ঠিক দাদার মতো। কাগজগুলো যদি আবার সত্যি উড়ে বেড়ায় সারা বাড়ি জুড়ে। ঘরময়। কুড়িয়ে বাড়িয়ে রাখে যদি সেই কবেকার ফেলে আসা
দিনের মতো। তাহলে আবার এই কতকালের পুরনো বাড়িটা একটুর জন্য হলেও
হয়তো সতেজ হয়। যারা ছিল একসময় কিম্বা যারা এখন আর নেই- যাদের বর্ণ, গন্ধ, স্পর্শ ছেয়ে
আছে গোটা বাড়ি জুড়ে তারা আবার এসে যদি ভিড় করে। তাহলে একটা অন্য আবহ তৈরি হয়। যাতে
একটুর জন্য হলেও মনে হয় বদলে গেছে চারপাশটা। হয়তো বা নিজের জীবনটা। ঠিক সেই ছোট্টবেলার
মতো।
তাই অনেক দিন পরে হঠাৎই শহরের এক পুরনো এ্যান্টিক দোকানে নীল রঙের ফাউন্টেন পেনটাকে খুঁজে পেয়ে ভালো লেগেছিল অনির্বাণের। পেনটা হাতে নিয়ে অন্যরকম অনুভূতি হয়েছিল তার। চকিতে মনে পড়েছিল দাদার টানা টানা গভীর চোখ দুটো। এমনকি হাসলে গালে টোল পড়াটাও। পেনটা নাকের কাছে আনলে দাদার গায়ের কবেকার চন্দন সাবানের গন্ধটা যেন নিমেষে অবশ করে দিয়েছিল তাকে। ঠিক তখনই ওই অতো পুরনো দোকানটা যেন চোখের সামনে পালটে গিয়েছিল শ্যাওলা ধরা নোনা বাথরুমের দেওয়ালে। খুব স্পষ্টভাবে শুনতে পেয়েছিল অনির্বাণ চৌবাচ্চায় পাইপ দিয়ে জল ভরার শব্দ। বুদবুদগুলো নীচ থেকে উঠে আসছে ওপরে। কলবল করে কথা বলছে জলের ধারা। হালকা হালকা সাবানের ফেনা লেপটে আছে কার যেন গোটা শরীরে। ভাঙা জানলা থেকে আসা অল্প আলোয় দেখা যাচ্ছে তার বুক, পেট, পা দিয়ে গড়িয়ে নামা সাবানের ফেনা। বাথরুমের নোনা ধরা দেওয়াল ঘেঁষে মগের পর মগ জল তুলে স্নান করছে নিরাবরণ সেই দেহ। দরজায় লুকোনো ছিদ্র দিয়ে সেই জান্তব গোটা পরিবেশটা গিলছে রক্ত মাংসের একজোড়া চোখ। খুব কাছের মানুষের না দেখা আকৃতি, প্রকৃতি হাড় মজ্জা যেন চিনে নিতে চাইছে সে।
গভীর আত্মপোলব্ধির জায়গা থেকে।
কাউকে জানতে না দিয়ে।
অনেকটা লুকিয়ে পাপ করার মতো।
চারপাশটা আস্তে আস্তে ছেয়ে
যাচ্ছে সকালের সবে ধরানো উনুনের ধোঁওয়ায়। ঘিরে ফেলছে বাড়িটাকে। তেরচা রোদ এসে পড়েছে
ভেজা বারান্দায়। গ্রিল বেয়ে ওঠা মানিপ্ল্যান্টের পাতায়।
পুরনো দোকানের দেওয়াল থেকে টিকটিকিটা ঠিক ঠিক বলে ডেকে উঠলে সম্বিত ফিরেছিল অনির্বাণের। কেমন যেন এক নেশার মতো ঝিম ধরেছিল তার। চারদিকটা মনে হচ্ছিল ঘোলাটে। ঝাপসা। দেহটা তার ভরশূণ্যে দাঁড়িয়ে ছিল। মেঝে থেকে একটু ওপরে অনেকটা হাওয়ায় ভাসার মতো। কেউ একটু টোকা মারলেই টুক করে খসে পড়বে। অনেক দিন পরে ভালো লাগছিল এই ঘোরটা। একটা কালি পেন এতো কিছু মনে করিয়ে দিতে পারে? বিশ্বাস হচ্ছিল না যেন তার। তাই আর সাত-পাঁচ না ভেবে হুট করে একটু বেশি দামেই কিনে ফেলেছিল পেনটা এক্কেবারে ঝোঁকের মাথায়। নাকি পেনটাই কিনে নিয়েছিল অনির্বাণের ভেতরের চিন্তা ভাবনা সমেত প্রায় সব কিছুকেই?
না হলে যেদিন সে প্রথম অর্চিতের হাতে তারই উপহার দেওয়া পেনটা দেখলো অমনভাবে
চমকে উঠেছিল কেন? সেই মুহূর্তে কেন মনে হয়েছিল যে মানুষটা সামনে দাঁড়িয়ে আছে সে তার
সন্তান নয়। অন্য কেউ। অনেক দিনের ওপার থেকে ঝাঁকড়া চুলে গভীর দুটো টানা চোখ নিয়ে দাঁড়িয়েছিল
সদ্য আঠেরোয় পড়া দাদা অরুণেশ। কিছু যেন বলতে চাইছিল সে। অনির্বাণের
তখন কোন সাড় ছিল না শরীরে। খুব চেষ্টা করেও এক পা পিছিয়ে আসার উপায় ছিল না তার। এমনকি
পালিয়ে যাওয়ারও নয়। কেউ যেন তার পা দুটোকে গেঁথে রেখেছিল সিমেন্টের শক্ত মেঝের ওপর।
ঠান্ডা একটা স্রোত যেন বয়ে গিয়েছিল গোটা দেহে। কপালের ওপর জমেছিল টিপ টিপ ঘাম। ঠিক
উলটো দিকে তখন একটু একটু করে এগিয়ে আসছিল একটা পুরনো সময় অবিকল দাদার রূপ ধরে হাতে
নীল রঙের ফাউন্টেন পেন নিয়ে।
কেন এলে তুমি এতোদিন পরে? কিসের জন্যে?
ফিসফিস করে হয়তো বলতে চেয়েছিল অনির্বাণ। কিন্তু পারেনি। ততক্ষণে তার শরীরের
একদম কাছ ঘেঁষে দাঁড়িয়ে হাত স্পর্শ করেছিল সেই অবয়ব। বরফ শীতল অনুভূতির সাড়া পেয়ে কোনোরকমে
তাকিয়ে দেখেছিল সাবানের ফেনার মতো ফ্যাকাসে একটা হাত খামচে ধরেছে তাকে। সারা ঘর ভরে
যাচ্ছে বিন্দু বিন্দু জলকণায়। এই ঘোর লাগাটা ঠিক কতক্ষণ ছিল সেটা আর মনে নেই তার। শুধু
মনে আছে জানলার একটা পাল্লার আস্তে আস্তে খুলে যাওয়ার শব্দ। আলসে থেকে উড়ে যাওয়া কাকটার
কা কা ডাক। যেন সে এতক্ষণ গঙ্গার ঘাটে পড়ে থাকা অচেনা মানুষটার নামে উৎসর্গ করা পিন্ডটা
ঠোকরাচ্ছিল। ছড়িয়ে পড়ছিল কালো তিল মাখা আধ সেদ্ধ আতপ চালের ভাতগুলো। তার ডানার শোঁ
শোঁ আওয়াজে ভেসে আসছিল কবেকার একটা স্বর।
চিনতে পারলি তাহলে আমায়?
সত্যিই চিনতে চাইছিল না
অনির্বাণ তাকে। একটুও না। হাঁকপাক করে চেষ্টা করছিল অদ্ভুত ঝিমুনিটা থেকে বেরিয়ে
আসার। মনে হচ্ছিল যেন ঘুমচোখে মশারির মধ্যে আটকে পড়েছে সে। চারিদিক থেকে ঘিরে
ধরেছে মশারির জাল ফাঁসের মতোই। দম বন্ধ হয়ে গভীর অন্ধকারের মধ্যে তলিয়ে যেতে যেতে
হঠাৎই একটা হাত ধরে ফেলেছিল তাকে। এক ঝটকায়। ভয়ঙ্কর একটা ঝাঁকুনিতে গোটা শরীর নাড়া
দিয়ে গেলে অবাক হয়ে দেখেছিল সামনে দাঁড়িয়ে আছে তারই ছেলে। খুব শক্ত করে ধরা বাবার
হাত। যেন লম্বা একটা গেরো। কোন রকমে টাল সামলে উঠে দাঁড়িয়ে খুব কাছ থেকে অনির্বাণ
সেদিন দেখেছিল অর্চিতকে। যেন অনেক দিন পর। বহু যুগের ওপার থেকে। পিতা-পুত্রের ঘন
নিঃশ্বাসে ভারী হয়ে উঠেছিল চারপাশ। নিরীক্ষণের অছিলায় দুজোড়া চোখ একে অপরের মধ্যে
গেঁথে ছিল ঠিক মাছ ধরা বড়শির মত। কে কাকে কিভাবে চিনতে চাইছিল কে জানে? তবে এমন পরিবেশ আগে কখনো আসেনি। ভবিষ্যতে আসবে
কিনা নিশ্চিত বলা যায় না।
অর্চিতের কাছেও গোটা
ব্যাপারটা আকস্মিক। কিছু একটা বলতে এসে ঘরের চৌকাঠ পেরিয়ে থমকে দাঁড়িয়ে পড়েছিল
বাবা। তারপর আর এগোতে পারেনি। অপলক দৃষ্টিতে স্থিরভাবে চেয়ে দরদর করে ঘামছিল।
ডাকলেও সাড়া দিচ্ছিল না। একটু এগিয়ে গিয়ে দেখতে পেয়েছিল অর্চিত বাবার কাঁধ, পিঠের অংশটা ঘামে ভিজে সপসপ করছে। হালকা
কাঁপছিল কি দেহটা? হতে পারে। হাতটা ধরতেই শরীরটা কেমন যেন ছেড়ে দিয়েছিল বাবা। আর একটু হলেই পড়ে
যেতে পারতো। কিন্তু সতর্ক অর্চিত ধরে ফেলেছিল তাকে। খাটে বসিয়েছিল। জলের বোতলটা
এনে ধরেছিল সামনে। খায়নি অনির্বাণ। মুখ ঘুরিয়ে নিয়েছিল। এমন বয়সে স্ট্রোকের একটা
সম্ভাবনা থাকে। যদিও তার বাবার শরীর সুঠাম। এখনও পর্যন্ত নিরোগ। তবু ভয় লাগে ছেলের।
তোমার কি শরীর খারাপ লাগছে বাবা? স্বপ্রশ্নে তাকিয়ে থাকতে চাইছিলো অর্চিত
বাবার দিকেই।
প্রশ্নের উত্তর দেয়নি অনির্বাণ। শুধু ছেলের হাত থেকে পেনটা কেড়ে নিতে চেয়েছিল
সে।
দিয়ে দাও। ওটার কোনো দরকার নেই আর।
ছিটকে সরে এসেছিল অর্চিত।
মা যে বললো পেনটা তুমি আমার জন্য এনেছো। লিখতে বলেছো।
ওর চেয়ে ভালো পেন এনে দেব তোমাকে। ওটা খারাপ।
কি করে জানলে? এখনও তো লিখলামই না কিছু। কালিই তো নেই।
বলছি তো এনে দেবো আর একটা। এখন দিয়ে দাও।
একটু ধমকের সুরেই বলেছিল অনির্বাণ।
শোনেনি অর্চিত।
হাতের মুঠোর মধ্যে শক্ত করে ধরা ছিল পেনটা। যেন ওর সঙ্গে তার জন্মজন্মান্তরের
সম্পর্ক।
শান্ত ছেলের অদ্ভুত জেদি চোখের দিকে তাকিয়ে পেনটা আর ফেরত নিতে পারেনি বাবা।
বলা যায় সাহস পায়নি। ইচ্ছেও করেনি চিৎকার চেঁচামেচি করার। মাথার চুলটা ধরে ঝাঁকিয়ে
দেওয়ার। যদিও অনির্বাণ কোনোদিন হাত তোলেনি নিজের সন্তানের গায়ে। প্রয়োজনও পড়েনি। সোজা
একতলায় নেমে এসেছিল সে। ঘুম দরকার ছিল তার। অনেক দিন পরে অসময়ে দুচোখ জুড়ে ঘুম নামছিল।
মনে হচ্ছিল কতক্ষণে সে নিজের ঘরে পৌঁছবে। শরীরটাকে এলিয়ে দিতে পারবে বিছানায়। তার আগে
অবশ্য সিঁড়ি দিয়ে তরতর করে নামার সময় ছেলের আবদার কানে এসেছিল।
আমাকে একটু কালি এনে দেবে বাবা? কালি ছাড়া এই পেনটা দিয়ে তো লেখাই যাবে না।
শব্দগুলো অনির্বাণের খুব চেনা। বলার ভঙ্গিটাও। তবুও পেছন ফিরে তাকায়নি সে।
ইচ্ছে করলেও না। মনে হয়েছিল তাকালে যদি এক প্রলম্বিত ছায়াকে দেখতে হয় ছেলের ওপর দিয়ে।
নিজের ঘরে ঢুকে দরজা জানলা সব বন্ধ করে অবেলায় ঘুমিয়ে পড়েছিল সে। অর্চিতের কথাগুলো
যেন কেটে কেটে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হয়ে বেড়াচ্ছিল মনের গভীরে। তাই একটু তাড়াতড়ি কালি
আনতে ছুটেছিল অনির্বাণ তার সেই কবেকার ফেলে আসা ছোট্টবেলায়।
দিনটা ছিল রবিবার। কয়েকদিন বৃষ্টি হবার পর রোদে ঝলমল করছিল যেন চারপাশটা।
মনে আছে ভাজা পেঁয়াজের ওপর কালো জিরের ফোড়ন দিয়ে মা মুসুরির ডাল সাঁতলেছিলেন। সারা
বাড়ি ঘিরে ছিল গরম ভাত দিয়ে ডাল মেখে খাওয়ার ক্ষিদে ক্ষিদে গন্ধে। বন্ধুদের সাথে খেলতে
যাবে অনির্বাণ। যাওয়ার আগে রান্নাঘরের মেঝেতে বসে হাপুস হুপুস করে গরম ডাল দিয়ে ভাত
মেখে খাচ্ছিলো সে। একটা কাক পাঁচিলের ওপর ঠায় বসে দেখছিল তার খাওয়া। অদ্ভুত ভাবে ঘাড়
ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে। নিকষ কালো। লম্বা ঠোঁট। চোখগুলো পুঁতির মতো লাল। এরকম কাক আগে কখনও
দেখেনি সে।
দাঁড়কাক। উনুনের পড়ন্ত আঁচে কয়লা দিতে গিয়ে বলেছিল মা। এ তল্লাটে তো কোথাও দেখা যায় না। কোত্থেকে এলো কে জানে! তুই খেয়ে নে। দেরী করিস না।
দেরী হচ্ছিল অনির্বাণের। মুখের গ্রাস যেন আটকে গিয়েছিল। অস্বস্তি হচ্ছিল তার। কাকটার উপস্থিতি মন থেকে যেন মেনে নিতে পারছিল না সে। কেউ যদি কারো দিকে অপলক দৃষ্টিতে চেয়ে থাকে? ঠিক মৃত মানুষের ঠান্ডা চোখের মতো? পলকহীন? যদিও তখনও পর্যন্ত কোনো মরা মানুষকে দেখেনি অনির্বাণ। তার চাহনিও না। কিন্তু বাজারে মরা মাছ দেখেছে। মরা মুরগির চোখ। চক্কোত্তি বাড়ির পুজোয় বলি দেওয়া পাঁঠার মুন্ডুকাটা শীতল চাহনি। সেভাবেই কি দেখছে না কাকটা তাকে আর মাকে? বিজ্ঞের মতো ঘাড় ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে?
নাকি সে দেখছে এই বাড়িটাকে? একটা সময়কে?
যা ঘটেছিল।
যা ঘটছে।
কিম্বা ভবিষ্যতে ঘটে চলবে তার পরিক্রমাকে?
সেই সময় এতো গভীর ভাবনার বয়স ছিল না অনির্বাণের। অস্বস্তিটা কাটানোর জন্য শুধু মনে হয়েছিল হাতের কাছে গুলতিটা থাকলে ব্যাটা পালাবার পথ পেতো না। দুবার মুখ দিয়ে হুশ হুশ আওয়াজ করলেও কাকটা পালিয়ে যায়নি। একটুও নড়ে বসেনি। ঠিক সেইসময় বারান্দার কলিংবেলটা কর্কশ স্বরে বেজে উঠলে মা হাতের কাজ সারতে সারতে মুখ তুলেছিল। দ্যাখ তো কি চাইছে দাদা। ক্ষিদে পেয়েছে মনে হয়। বলিস একটু পরেই ভাত নিয়ে যাচ্ছি ওপরে।
কোনোরকমে পাতের ভাত শেষ করে উঠে পড়েছিল অনির্বাণ। তখনও বারান্দায় কলিংবেলটা
কর্কশ স্বরে বেজে চলেছিল। তার মাথার ওপরে বাল্বটা দপদপ করে জ্বলছিল আর নিভছিল। এইসব
ব্যবস্থা করেছিলেন অনির্বাণের বাবা। দাদাকে যাতে ওপর থেকে নীচে নামতে না হয় পড়ার সময়
নষ্ট করে। দাদা ডাকলেই যাতে বুঝতে পারে একতলার মানুষ। তার খিদমত খাটার জন্য হাজিরা
দিতে যেতে হয় ওপরে। কিন্তু সেদিনের বেল বাজার ধরণটা একটু অন্যরকমের ছিল। এক নাগাড়ে
বেজেই চলছিল যেন। মনে হতে পারে ইচ্ছে করে কেউ সুইচের ওপর আঙুল টিপে আছে। কিম্বা খারাপ
হয়েছে মেশিন। গোটা বাড়ি জুড়ে কেমন যেন এক সতর্কবার্তা।
থাকতে না পেরে মা চিৎকার করে রান্নাঘর থেকে বলেছিল শুনতে পেয়েছি। যাচ্ছি।
যাচ্ছি…। মাছের ঝোলের গরম কড়াই নামিয়ে ভাত বাড়তে শুরু করেছিল মা। আর ছোট্ট অনির্বাণ
সিঁড়ি টপকিয়ে টপকিয়ে দোতলায় উঠছিল। ধড়াম করে খুলে দিয়েছিল দাদার ঘরের বন্ধ দরজাটা।
চন্দন সাবানের গন্ধ গুমোট হাওয়ার মতো ধাক্কা দিয়েছিল নাকে।
কালি শেষ। এনে দিতে পারবি তো এক্ষুনি? অঙ্ক করতে করতে ছোট্ট ভাইয়ের দিকে
চোখ তুলে তাকিয়েছিল অরুণেশ।
খুব পারবো। ঘাড় নেড়েছিল অনির্বাণ। তাকিয়ে দেখেছিল এই ঝলমলে সকালেও ঘরের
সব জানলা বন্ধ। শুধু টেবিল ল্যাম্পের আলো জ্বালা।
জানলা গুলো খুলে দিই দাদা? কি সুন্দর ফুল এসেছে হাসনাহানা গাছটায় দেখবি
না?
খুলিস না। চোখ জ্বালা করে। সারারাত ঘুমায়নি তো।
অনির্বাণ জানে দাদা সারারাত পড়ে। সামনে উচ্চমাধ্যমিক পরীক্ষা। তারপর জয়েন্ট
এন্ট্রান্স। বাবা বলেছে দাদা নাকি একদিন খুব বড় একজন ডাক্তার হবে। বংশের মুখ উজ্জ্বল
করবে। তাই তো চোখ লাল করে সারা রাত ধরে পড়ে। তাই তো কাজ ছাড়া দোতলায় ওঠা মানা তাদের।
জোরে কথা বলাও যায় না। চিৎকারও না। এই বাড়িতে সবাই তাই হাওয়ায় ভেসে যাওয়ার মতো ফিসফিস
করে কথা বলে।
চলে যাচ্ছিল অনির্বাণ। দাদা পিছু ডাকে।
ভাই শোন।
ফিরে তাকায় ছোট্ট অনির্বাণ।
এগিয়ে আসে দাদা। ঠোঁটের পাশে লেগে থাকা শুকিয়ে যাওয়া ডালের দাগটা মুছিয়ে দেয়। খেলতে যেতে দেরী হয়ে যাবে না তো তোর?
জোরে দুবার মাথা নেড়ে ছুটেছিল অনির্বাণ। বাবার সাইকেলের সিটে বসে তখনও তার
পা যায় না প্যাডেলে। কাজেই হাফ প্যাডেলের দিনে তার সাইকেলের সেই ধীর গতি স্বপ্নে আরও
আস্তে চলে। প্যাডেলে চাপ দিতে হয় আরও অনেক বেশি। কসরত করে করে একটু এগোলে, বাঁক ঘুরলেই
তো চৌমাথার মোড়। সেখানে বাজার। হাতে গোনা মোটে কয়েকটা দোকান। তাদের প্রত্যেকটাতে পাওয়া
যায় পেনের কালি। দশ টাকায় এক শিশি। হলুদ রঙের কাগজের ছোট্ট বাক্স নিয়ে হাঁপাতে হাঁপাতে
দোতলার ঘরটার সামনে এসে দাঁড়ায় অনির্বাণ। দরজা বন্ধ। তাতে কি? এই দরজা তো সবসময় বন্ধই
থাকে। ধাক্কা মারার জন্য হাত বাড়ায় অনির্বাণ। কিন্তু পারে না। ভেতরে কার সাথে যেন কথা
বলছে দাদা। দরজায় কান পাতে। কিন্তু কিছু বুঝতে পারে না। কোনো বন্ধু আসে না দাদার কাছে।
স্কুলের না। কোচিং এর না। যারা একসময় এই বাড়িতে হইচই করতো তারা কেমন যেন আসা যাওয়া
ছেড়ে দিয়েছে। আর একটু ভালোভাবে শোনার চেষ্টা করে। পড়া মুখস্থ করছে না তো? তাও কি করে
হয়? দাদা তো তার মতো চিৎকার করে জোরে জোরে পড়ে না। ফিসফিসে ভেসে আসা কথার মাঝে দাঁড়িয়ে
থাকে অনির্বাণ। হঠাৎ চোখ পড়ে বারান্দার রেলিং এর ওপর সকালের সেই কালো কাকটা। এবার খুব
কাছে। স্থির চোখে দেখছে তাকে। ব্যাপারটা ভালো লাগে না অনির্বাণের। কেমন যেন একটা ভয়
ঘিরে ধরতে থাকে তাকে।
দাদা…। অস্ফুট স্বরে ডাকে ভয় পেয়ে যাওয়া ভাই।
ঘরের কথাগুলো
যেন থেমে যায়। কিন্তু দরজা খোলে না।
এদিকে কাকটা আস্তে আস্তে গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে আসছে তারই দিকে। মনে হচ্ছে
যেন উড়ে এসে খুবলে নেবে চোখটা। কাকটা ডানা ঝাপটালে প্রচন্ড ভয়ে দরজার ওপরে ধাক্কা মেরেছিল
অনির্বাণ। খুলে গিয়েছিল দরজাটা আপনা আপনি। সামনে দাঁড়িয়ে ছিল দাদা অরুণেশ। এক্ষুনি
যেন কাঁচা ঘুম ভেঙেছে তার। বাইরের আলোয় ভালো করে চোখ মেলে তাকাতে পারছে না সে।
কি রে হাঁপাচ্ছিস কেন? ছুটে গিয়েছিলি বুঝি? আধডুবন্ত চোখ নিয়ে জানতে চায়
দাদা।
অনির্বাণ মাথা নাড়ে। না। একটা কাক। ওই যে ওখান। হাত তুলে দেখাতে গেলে কোথাও
কিছু খুঁজে পায় না সে। রেলিঙের ওপর মেলে দেওয়া মায়ের সকালের শাড়ি, ভেজা জামা কাপড়।
উনুনের ধোঁওয়া ছেঁড়া ছেঁড়া সাদা কুয়াশার মতো।
দাদার মুখে হাসি ফুটে ওঠে। দিন দিন তুই একটা ভিতুর ডিম হচ্ছিস।
দরজার সামনে থেকে যতটুকু দেখা যায়। ঘরের মধ্যে কেউ নেই নিকষ অন্ধকার ছাড়া।
দে। দাদা হাত বাড়ায়।
অনির্বাণ এগিয়ে দেয় কালি। প্যাকেটটা নিয়েই দাদার মুখে টোল পড়া খুশির হাসির ঢেউ
খেলে যায়। হাতছানি দিয়ে ঘরের মধ্যে ডাকলে ধীর পায়ে এগিয়ে গেলেই দাদার গায়ে চন্দন সাবানের
গন্ধ। খুব কাছ ঘেঁষে দাঁড়ালে সেই গন্ধমাখা হাত বাড়িয়ে দেয় শিশিতে রাখা নকুলদানা। হাত ভর্তি নকুলদানা নিয়ে ফিরে
আসার পথে ছোট্ট অনির্বাণ শুনতে পায় ফড়ফড় করে কাগজ ওড়ার শব্দ।
সে জানে দোতলার ওই বন্ধ ঘরে ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকবে অঙ্কের পাতা। ওগুলো কুড়িয়ে বাড়িয়ে বাবার
কাছে নিয়ে গেলে পাওয়া যাবে দশ পয়সা। বাবা অঙ্কগুলো দেখলে সন্তুষ্ট হবেন। বড় ছেলের ভবিষ্যৎ
নিয়ে তখন তিনি স্বপ্ন দেখবেন। ঠিক এখন যেমন অনির্বাণ দেখছে অর্চিতের
জন্য।
চন্দন সাবানের গন্ধটা যখন বন্ধ ঘরে আরও গভীর ঘুমের মধ্যে ডুব দেওয়াচ্ছিল
তাকে ঠিক তখনি শ্রাবনীর চিৎকারে ধড়মড় করে উঠে বসেছিল সে। হাঁপাচ্ছিল শ্রাবনী তার হাই
প্রেশারের ভারী শরীর নিয়ে। সাপের ফোঁস ফোঁস করার মতো নিশ্বাসের আওয়াজে বলেছিল
এই অবেলায় ঘুমোচ্ছো কেন তুমি?
কেন? কী হয়েছে? বিরক্তির সঙ্গে জিজ্ঞেস করেছিল অনির্বাণ।
এগিয়ে এসে শ্রাবণী বলেছিল কী হয়েছে বুঝতে পারছো না?
সত্যিই প্রথমে বুঝতে পারছিল না সে কিছুই। এটা দিন না রাত। সকাল না বিকেল।
দাদার দোতলার ঘর না একতলা? প্রচন্ড ভয় পেয়ে দড়াম করে একটা জানলা খুলে দিয়েছিল শ্রাবনী।
শেষ বিকেলের ক্ষয়ে যাওয়া আলো এসে পড়েছিল ঘরে। ঘুম চোখে অনির্বাণ দেখেছিল
মেঝেতে উলটে আছে নকুল দানার কৌটোটা। ঢাকনিটা খুলে বেরিয়ে গেছে হাত চারেক দূরে। ছড়িয়ে
ছিটিয়ে থাকা সাদা সাদা দানাগুলোকে আর চোখে দেখা যাচ্ছে না। কারণ তাদের ঘিরে ধরেছে অসংখ্য
ডেউ পিঁপড়ে। লাল রঙের মোমপালিশ মেঝে ঢেকে ফেলেছে তারা কালো রঙের থকথকে জমায়েতে। শ্রাবণী
বেগন স্প্রে নিয়ে আসতে গেলে বারণ করেছিল অনির্বাণ।
থাক না। খেতেই তো এসেছে। ক্ষতি তো কিছু করেনি।
ঝাঁঝিয়ে উঠেছিল অর্চিতের মা। কি বলছো তুমি? ছেলেটাকে কামড়ালে তখন কী হবে?
পোকামাকড়, মাকড়সা, টিকটিকিতে শ্রাবণীর বরাবরের ভয়। সারাক্ষণ দরজা জানলা
বন্ধ করে রাখে। পাছে কেউ ঢুকে পড়ে। ছেলের যদি কোনো ক্ষতি হয়। থম মেরে বিছানায় অনির্বাণকে
বসে থাকতে দেখে শ্রাবনীর রাগ বেড়েছিল পারদের মতো।
কিগো উঠবে না?
কী করবো উঠে?
আমাকেই সব কিছু বলে দিতে হবে?
অনির্বাণ চুপ।
নকুলদানার কৌটোটা এখানে এলো কী করে শুনি? ঠাকুরঘরের তাকে ছিল না?
জানি না।
আবার চুরি করে মিষ্টি খেতে শুরু করেছো?
আমি খাইনি।
মিথ্যে কথা।
আমরা তিনজন ছাড়া এই বাড়িতে আর কে আছে শুনি?
উত্তর দেয়নি অনির্বাণ। চেষ্টা করছিল সবকিছু এড়িয়ে যাওরার। ঠিকমতো উত্তর না দেওয়ার। কিম্বা সত্যি জবাব দেওয়ার মতো কিছু ছিল না তার কাছে। শুধুমাত্র পিঁপড়ের লম্বা সারিটার দিকে চেয়ে থাকা ছাড়া। অনির্বাণ দেখেছিল ওদের প্রত্যেকের মুখে নকুলদানার টুকরো অংশ। ওরা খাট বেয়ে ওঠার চেষ্টা করছিল। হয়তো ঘিরে ফেলতে চাইছিল অনির্বাণকে চক্রব্যুহের মতো। আর ঠিক তখনই শ্রাবণী স্প্রে করতে শুরু করলে পিঁপড়েগুলো টুপ টুপ করে খসে পড়েছিল লাল রঙের মোমপালিশ মেঝেতে। ঠ্যাঙগুলো আকাশের দিকে তুলে যন্ত্রনায় দুমড়ে মুচড়ে মরে কাঠ হয়ে গিয়েছিল তারা বিষাক্ত রাসায়নিকে। ঘর থেকে আস্তে আস্তে হারিয়ে গিয়েছিল সাবানের মিষ্টি সুবাসটা। গোটা বাড়িটা ঢেকে গিয়েছিল বেগন স্প্রের কড়া গন্ধে।
না, সেদিন কোন ঝিঁঝিঁ পোকা ডাকেনি। এমনকি রাতজাগা পাখিটাও না।
সেদিন অনেক রাতে বাগানের কোলাপসিবল গেটটা বন্ধ করতে গিয়ে অনির্বাণ অবাক হয়ে দেখেছিল হাসনাহানা ফুলের গাছে অসময়ে কুঁড়ি এসেছে। ছ্যাঁত করে উঠেছিল গাটা। সেবারও তো এমনই হয়েছিল। অসময়ের ফুলের গন্ধে উথাল পাথাল হয়েছিল বাড়ি। ভেবেছিল ফোন করে জানাবে বাবাকে। কিন্তু করেনি সে। পাছে বাবা যদি আরও দুশ্চিন্তা করেন। তাঁর যদি শরীর আরও খারাপ হয়। সবটাই চেপে গিয়েছিল সে। এইসব কিছু দূর থেকে দেখেছিল অর্চিত। তাকে দেখতেই হতো। কেউ যেন চোখে আঙুল দিয়ে আড়ালে আবডালে ঘটে যাওয়া ঘটনার সামনে বসিয়ে দিচ্ছিল তাকে। সেদিন অনেক রাতে বাবার জেগে থাকাটাও চোখ এড়ায়নি তার। এমনকি হাসনাহানা গাছটাও।
বেশ কয়েক দিন হন্যে হয়ে ঘুরেও দোয়াতে ভরা পেনের কালি পেলো না অনির্বাণ। এমনকি একটু দূরের বড় বাজারটাতেও না। ফাউন্টেন পেনের কালি
বললেই দোকানি দেখাচ্ছিল রিফিলে ভরা কালি। অনেকটা ডট পেনের মতো।
এগুলোই এখন পাওয়া যায় আঙ্কল। ওসব বোতল ফোতল উঠে গেছে কবে।
ডাঁই করা খাতা আর পেনের র্যাকের মধ্যে বসা ছোকরা ছেলেটা অনেকটা তাচ্ছিল্যের
সঙ্গেই বলেছিল কথাগুলো। আরও কিসব বলতে চাইছিল শোনেনি অনির্বাণ। ইদানিং তার ধৈর্য্যটা
কমে আসছিল যেন হু হু করে। স্থির হয়ে বসে বা দাঁড়িয়ে থাকা যাচ্ছিল না। সারাক্ষণ অস্থির
অস্থির ভাব। ভেতরে বাড়তে থাকা সেই এক গোপন অশান্তি নিয়েই অনির্বাণ এগিয়ে গিয়েছিল অন্য
এক রাস্তায়।
এদিকের বাজারটা নতুন। ফ্ল্যাটের নীচে খুপরি খুপরি দোকান। মুখগুলোও অচেনা। গত দশ বছরে কেমন যেন পালটে গিয়েছে জায়গাটা। এখন এখানে আর কোথাও কিলো দরে খাতা বিক্রি হয় না। কিম্বা ডজন হিসেবে পেন। সব কেমন যেন এখন একই রকমের দেখতে সব। একই ছাঁচে ঢালা। কাছে পিঠে, দূরে, বহুদূরের বাজার ঘুরে কোথাও পাওয়া গেল না কালি। পেল না অনির্বাণ।
চিন্তায় ঘুম চলে গিয়েছিল তার।
চুপ করে উঠে বসে থাকতে হতো মাঝরাতে।
বারান্দায় পায়চারী করতে হতো এপ্রান্ত থেকে ও প্রান্ত। কেমন যেন শান্তি শূণ্য
হয়ে গিয়েছিল জীবন।
ছেলে কথা প্রায় বন্ধ করে দিয়েছিল। খেতো না ঠিক করে। এমনকি পড়াশুনোটাও না।
একটা পেনের জন্য এতো কিছু? বাড়াবাড়ি মনে হয়েছিল অনির্বাণের। আশকারা
দিয়ে মাথায় তুলতে চায়নি ছেলেকে আর। একটু জোরের সঙ্গেই এবার ফেরত নিতে চেয়েছিলো।
কালি যখন পাওয়া যাচ্ছে না তখন আর দরকার নেই পেনটার। ফেরত দিয়ে দাও আমাকে।
তুলে রেখে দিই। কালি পেলে তখন লিখো।
হাত বাড়িয়েছিল অনির্বাণ। ভেবেছিল ছেলে ফেরত দেবে। কিন্তু অর্চিত পেনটা ফেরত
দেয়নি। টানাটানা দুটো চোখ নিয়ে তাকিয়ে ছিল বাবার দিকে। ইচ্ছে করছিল অনির্বাণের জেদি
ছেলেটার গালে তার বাড়িয়ে দেওয়া হাতটায় একটা থাপ্পড় কষাবার। কিন্তু পারেনি সে। একটা
জীর্ণ পুরাতন সময়ের গায়ে কি হাত দেওয়া যায়?
না। যায় না।
তাকে বরং উপলব্ধি করতে হয়। জারিয়ে নিতে হয় নিজের সঙ্গে।
অশান্তির ঘনঘটা রাতে খাবার টেবিলেই শুরু হয়েছিল। একটা কালি পেন নিয়ে বাবা আর ছেলের মধ্যে এমন চূড়ান্ত কথা কাটাকাটি ভালো লাগেনি শ্রাবণীর। ছেলের পক্ষই নিয়েছিল সে।
তাহলে কিনে এনেছিলে কেন পেনটা? আর ওকেই বা দিতে গিয়েছিলে কেন?
অনির্বাণ কোনো যুক্তি খাড়া করতে পারেনি। দরদর করে ঘামছিল সে। যে ছেলে বড়দের
মুখের ওপর একটা রা পর্যন্ত কাটে না সেও কেমন বেপরোয়া হয়ে বাবার মুখে মুখে তর্ক করছিল।
গোটা পরিবেশটা আরও দুর্বিসহ হয়ে ওঠার আগেই খাবার টেবিল থেকে আর কিচ্ছুটি মুখে না দিয়ে
উঠে গিয়েছিল অর্চিত। হতভম্ব হয়ে গিয়েছিল শ্রাবনী আর অনির্বাণ ছেলের এই আমূল পরিবর্তন
দেখে। এই নিয়ে তিন দিন খাবার মাঝ থেকে উঠে গেল অর্চিত।
মুখের ভাত কেউ এমনভাবে ফেলে যায়? অকল্যাণ হয় যে সংসারের। এরপর যখন আর ভাত
জুটবে না তখন দেখো।
মায়ের চিৎকারে কান দেয়নি অর্চিত। বাবার কথাতেও না। তখন কে কি বলছে যেন শুনতেই ইচ্ছে করছিল না তার। শুধু মনে হচ্ছিল একটা নির্জিব বস্তু যেন হাতছানি দিচ্ছে। লোভ দেখাচ্ছে অনেক কিছু লেখার। যেগুলো সে কোনোদিন লেখেনি অথবা লিখতে চায়নি। শুকনো একটা পেনের নিব হা পিত্যেশ করে তাকিয়ে ছিল তার দিকে। এবার কালির জন্য হন্যে হয়ে উঠলো অর্চিত। তার বাবা যেগুলো চেষ্টা করেনি কিম্বা করতে পারেনি সেইগুলোই করতে চাইলো সে। গুগুলে সার্চ করলো। বিভিন্ন বাজারি এ্যাপ ঘেঁটে অবশেষে খুঁজে বার করলো কালি। ছিমছাম দেখতে একটা হলুদ বাক্স। তারমধ্যে কাঁচের বোতলে ভরা কালি। যাঁরা বানাচ্ছেন তাঁরাও নাকি অনেক দিন পরে ফিরিয়ে আনছেন এমন এক পুরনো জিনিস যা নতুনের আধার হবে। বিজ্ঞাপন দেখে প্রায় সঙ্গে সঙ্গে অন লাইনে অর্ডার করেছিল অর্চিত। সেদিন তার আনন্দ বলে বোঝাতে পারেনি কাউকে। চায়ওনি। শুধু ধড় থেকে মুন্ডুটাকে খুলে পেনটাকে ভিজিয়ে রেখেছিলো জলভর্তি কাঁচের গ্লাসে। জানলার ধারে ওরা দুটো দেহে আলাদা হয়ে কেমন যেন ডুব দিয়েছিল গ্লাসের নীচে। ডুবুরির মতো সাঁতার কেটেছিল সারাদিন। ফিসফিস করে কথা বলেছিল। অপেক্ষা করেছিল কখন কালি আসে। ড্রপারে করে তার পেটের মধ্যে ভরা হয়। সাদা পাতায় স্পষ্ট অক্ষরে লিখে ফেলে সে তার নিজের কথা।
অথবা যা নিজের নয়।
কোনদিনই ছিল না।
অন্যের।
গুমোট মেঘলা এক রবিবারের দুপুরে অনির্বাণের হাতে যখন এসে পড়লো রঙচঙে পার্সেলটা তখনও সে বুঝতে পারেনি কি মারাত্মক ভুল করে ফেলেছে পেনটা বাড়িতে এনে। কিম্বা এই ভুলটাই হয়তো তার ভবিতব্য ছিল।
(ক্রমশ...)
ছবি সৌজন্য-গুগুল ইমেজ।
টানটান উত্তেজনা। অপেক্ষায় থাকলাম।
উত্তরমুছুনঅসাধারণ। ছোটবেলার অনেক স্মৃতি ফিরে এল। পরের পর্বের অপেক্ষায় রইলাম।
মুছুনস্যার,মনের মধ্যে থাকা আবছা আধচেনা কাহিনীর ছায়া ধীরে ধীরে কায়া নিচ্ছে।অপেক্ষায় রইলাম।
উত্তরমুছুন