ভগীরথ ঠাকুর
ভগীরথ ঠাকুরকে চিনতো না এমন কেউ ছিল
না আমাদের বাড়িতে। এমনকি পাড়ায়। সেই ছোট্ট জনপদে। মানুষটার ছোটখাটো দোহারা গড়ন। মাথার
চুল এক্কেবারে ছোট ছোট করে ছাঁটা। গলায় কণ্ঠি। কপালে চন্দনের তিলক। পরনে একটা হাতকাটা
স্যান্ডো গেঞ্জি আর গেরুয়া রঙের সুন্দর একটা পাড় দেওয়া উড়িষ্যার গামছা। মুখে সব সময়
থাকতো পান। ঠোঁটটা তাই লাল। দাঁতগুলো ছোপ ছোপ। হাসলে সেগুলো টুক করে সামনে বেরিয়ে আসতো।
গায়ের রঙ একেবারে বার্নিশ কালো। রাস্তা দিয়ে ভগীরথ ঠাকুর যখন হাঁটতো মনে হতো যেন তার
খুব তাড়া। হনহন করে হাঁটতে থাকা মানুষটার হাতে থাকতো লম্বা গাড়ু হাতা, বড় লোহার খুন্তি,
আর একটা পেল্লাই সাইজের ঝাঁঝরি। আর পাশ দিয়ে গেলেই মনে হতো হাওয়ায় যেন গন্ধ ভাসছে লুচি,
লম্বা লম্বা বেগুন ভাজা, ফিস ফ্রাই, মটন কষা আরও কত কি। টুপ করে জিভ দিয়ে যেন জল পড়ে
যায় আর কি! একবার যদি ডাকা যায়, ও ভগীরথ ঠাকুর কোথায় যাচ্ছো? সঙ্গে সঙ্গে অমন তাড়ার
মধ্যেও সে ঘাড় ঘুরিয়ে একটা মিষ্টি হাসি হাসবেই। কী খোকাবাবু কেমন আছো? উত্তরে হয়তো
বলবো আমি তো ভালোই। তুমি কেমন আছো? ভগীরথ ঘাড় নেড়ে দিব্য বলে চলে যাবে। পাপ্পু কানের
কাছে ফিসফিস করে বলবে আজ মনে হয় ভেটকি মাছের ফ্রাই করবে বুঝলি। কিম্বা দেশি হাঁসের
ডিমের ডেভিল। চোখের সামনে কেমন যেন গরম তেলের ইয়াবড় কড়াইটা দেখতে পাই। ট্রেতে সাজানো
থরে থরে ফিস ফ্রাই, ডিমের ডেভিল। তার কুসুমটা সূর্য ওঠা রঙের মতো গাঢ় কমলা। সঙ্গে একটু
গন্ধরাজ লেবুর রসে ভেজানো পেঁয়াজ, শসার টুকরো। চোখে জল আনা ঝাঁঝালো কাসুন্দি। ততক্ষণে
দূরে মিলিয়ে যেতে থাকে হন হন করে হাঁটতে থাকা ভগীরথ ঠাকুর।
পাড়ার যে বাড়িতে যার নেমনতন্ন হতো
না ভগীরথ ঠাকুরের রান্না খাবে বলে কত লোক যে যেচে নেমনতন্ন নিতো সেসব বলতে গেলে এখন
কেউ বিশ্বাসই করবে না। ভাববে বানিয়ে গল্প বলছি বুঝি। দাদা তো একবার চৌধুরী বাড়িতে গিয়ে
সটান বলে এসেছিল বাড়ির সবাইকে তো নেমনতন্ন করবেনই এমনকি আমাদের বাড়ির ছোট্ট মিনিটাকেও। ও ভগীরথ ঠাকুরের
হাতে মাছের ঝোল খেতে খুব ভালোবাসে। বাড়ি ফিরে বাবার কাছে অবশ্য উত্তম মধ্যম মার খেয়েছিল
খুব। শ্রাদ্ধ বাড়িতে কেউ নেমনতন্ন চাইতে যায়? দাদা বলেছিল বারে, ভগীরথ ঠাকুর রান্না
করবে না। ততক্ষণে পাড়ার সবার মুখে মুখে তো চৌধুরী দাদুর মায়ের নিয়ম ভঙ্গের মেনুর লিস্ট
ঘুরছে। বাবা আর কিছু বলতে পারেনি। কিম্বা কি বলবে বুঝতে পারেনি। শুধু আমরা কেন পাড়াশুদ্ধু সবাই চৌধুরী বাড়ির নিয়মভঙ্গের নেমনতন্ন খেয়ে এসেছিলাম। আর ভগীরথ ঠাকুরের নামে
ধন্যি ধন্যি করেছিলাম।
ভগীরথ ঠাকুরের বাড়ি কোথায় ছিল কেউ
জানতো না। কিন্তু আমাদের জানার আগ্রহ ছিল খুব। হাবু পুকুরে বল তুলতে গিয়ে বলেছিল সেখানে
নাকি নানা রকমের খাবার পাওয়া যায়। একদিন হাঁদার দোকানে চা খেতে আসলে জিজ্ঞেস করেছিলাম
কি গো ভগীরথ ঠাকুর তোমার বাড়ি কোথায়? ভগীরথ চোখ গোল গোল করে বলেছিল, কেন ওই যে পুলিশ
ব্যারাকের পাশে। আমি মাথা নাড়ি। আরে দূর। ওখানে তো তোমরা সবাই মিলে থাকো ভাড়া দিয়ে।
আমরা যেমন থাকি। আমি জানতে চাইছি তোমার আসল
বাড়ি। ভগীরথ লেড়ো বিস্কুট কামড়ে চায়ের ভাঁড়ে চুমুক দিয়ে বলেছিল তার দেশ উড়িষ্যার সেই
যেন কোন এক অজ গাঁয়ে। যেখানে রাতের আকাশ জুড়ে থাকে ফুটফুটে তারা। আর কান পাতলে শোনা
যায় সমুদ্রের ঢেউ। কিন্তু হাবু যে বললো তোমার দেশে নাকি মেলাই খাবার পাওয়া যায়। তা্র
জন্যে এতো ভালো ভালো রান্না করো তুমি। ভগীরথ হেসে ওঠে। গামছার কোচড় থেকে বার করে পান
আর জর্দা। মুখে পোরে। তারপর চিবোতে চিবোতে আয়েষ করে বলে তা খাবার পাওয়া যায় বই কি।
সে তোমার ভোজের বাড়ির থেকেও খুব ভালো খাবার। একটু বলো না ভগীরথ ঠাকুর কেমন সে খাবার?
ভগীরথ চোখ বন্ধ করে। যেন সে কোন এক স্বপ্নলোকে চলে গেছে। সে কি আর মুখে বলা যায় খোকাবাবু?
চেখে দেখতে হয়। কানের ওপর হাত চাপো দেখি। আমি বলি ওমা, কেন খামোকা কান ধরতে যাবো? সে
বলে আহা ধরো না। আমিও ধরি। হাতটাকে একটু নাড়াও চাড়াও। আমিও হাতটাকে এদিক ওদিক করি।
ভগীরথ বলে কি শুনতে পাচ্ছো? শোঁ শোঁ আওয়াজ। ঠিক ধরেছো ওটা আমাদের সমুদ্রের গর্জন গো।
চোখ বন্ধ করো এবার দেখতে পাবে সকালবেলা ছোট ছোট জেলে নৌকা সমুদ্রে মাছ ধরে ফিরে আসছে।
তাতে আছে কত রকমের যে মাছ। কুড়মুড়ে করে ভেজে ডাল দিয়ে মেখে খাওয়া।
তাহলে চলে এসেছিল কেন? নিজের সুন্দর গ্রাম ছেড়ে? দেশ ছেড়ে?
চিকচিক করে ওঠে কী ভগীরথ ঠাকুরের চোখ?
করছেই তো। বিড়বিড় করে বলে, ওই যে সেবার খুব খরা। গ্রামে ফসল হল না। লোকের কাছে কাজ
নেই। খাবার নেই। তাই একদিন ট্রেনে চেপে চলে এলুম। আর রান্না করতে লাগলুম। দাদু বলেছিল
ভগীরথ কখনো চুরী করিস না। মিথ্যে কথা বলিস না। খেটে খাস। সেই থেকে চলছে খোকাবাবু। বুঝলে
কিছু? যাও এবার পড়তে বসো গিয়ে। নাহলে কিন্তু আমার মতো সারাজীবন আগুনের তাপ পোহাতে হবে।
ভগীরথ উঠে চলে যায়। আমি ভাবি বেশ তো খারাপ কি তাতে? চারপাশের বাতাস ভরে থাকবে গাওয়া
ঘিয়ের লুচি লুচি গন্ধে। তার সাথে মাখো মাখো ছোলার ডাল। তারমধ্যে কুচি কুচি নারকেল ভাজা।
মোহনভোগ। মনে মনে ভাবি ইশ ভগীরথ ঠাকুরের মতো যদি আমরাও হতাম। কত কত ভালো ভালো খাবার
খেতে পারতাম। টিঙ্কু তো দুই শালিখ দেখে একবার দিব্যি কেটেই ফেলেছিলো। সে বড় হয়ে ককখোনো
অঙ্কের স্যার গোবিন্দ বাবু হবে না। সে হবে ভগীরথ ঠাকুর। কেউ তাকে রুখতে পারবে না। তারও
অনেক পরে সত্যি টিঙ্কু হোটেল ম্যানেজমেন্ট পড়ে কি যে ভালো শেফ হয়েছিল। শুনেছি এখন সাহেব
সুবোরা তার রান্না খেয়ে খুব প্রশংসা করে। টিঙ্কুর কি এখনও ভগীরথ ঠাকুরকে মনে আছে? কি
জানি!
যে সময়ের কথা বলছি সেই আশির দশকের
শুরুতে পাড়াতে একটা বাড়িতে একটাই মাত্র টেলিফোন ছিল। সেটাও প্রায় অর্ধেক সময় খারাপ
হয়ে পড়ে থাকতো। কারো বাড়িতে বাথরুমে শাওয়ার লাগিয়ে গেলে পাড়া শুদ্ধু লোক ঝরনায় স্নান
করার জন্য হাজির হতো। পাড়ার একটা মাত্র বাড়িতে টেলিভিশন এলে সবাই ছন্দা সেনের খবর শুনতে
যেতো। আর কারেন্ট অফ হলে ঘন্টার পর ঘন্টা অন্ধকারে ডুবে থাকতো পাড়া। টিম টিম করে জ্বলে
উঠতো সবার বাড়িতে লণ্ঠন। একটা গোটা জনপদ গরম আর মশার হাত থেকে বাঁচতে গঙ্গার ধারে চলে
যেত। আঁধার রাতে নদীর পাড়ে বসে সবাই গল্প করতো। সুখ দুঃখ ভাগ করে নিতো নিজেদের মতো
করে। কার বাড়িতে কি রান্না হচ্ছে। কার বাড়িতে কে অসুস্থ। আর কার বাড়িতে একদমই হাড়ি
চড়ছে না সবাই সবার খবর রাখতো। সবাই সবার দিকে নজর দিতো বলেই আর সি সি ক্যামেরার দরকার
হতো না। তাই বলে যে ঝগড়াঝাঁটি অশান্তি ছিল না এমনটা ভুল করেও ভেবো না। এই তো সারদাদির
কালো বেড়াল পেত্নি বিশালদের নতুন আনা এ্যালশেশিয়ান কুকুর জেমসকে এমন ভয় দেখিয়েছিল সে
বেচারা নাকি দু রাত্রি ঘরের মধ্যেই হিসি পটি করেছে। তাই নিয়ে কি কম কান্ড হয়েছে। ঘোষ
বাড়ির নারকেল চুরী নিয়ে তো পাড়ার নাগরিক কমিটি পর্যন্ত ছুটোছুটি পড়ে গিয়েছিল। যাইহোক
এইসবের মধ্যেই এক শীতের মরশুমে আমরা যখন পরীক্ষার পড়া নিয়ে নাস্তা নাবুদ ঠিক সেই সময়ে
মৌঝলা গুড়ের সুবাস নিয়ে এলো রিম্পিদির বিয়ের খবর।
রিম্পিদি কে?
সেকি তোমরা রিম্পিদিকে চেনো
না? পঁচিশে বৈশাখে রিম্পিদি চিত্রাঙ্গদা নৃত্য নাট্যে গান গায়। খুব ভালো ছাত্রী। দেখতে
সুন্দর। সবার সাথে হেসে হেসে কথা বলে। আমাদের মতো ছোটদের ভালোবাসে। মাঝে মাঝে ওদের
বড় বাড়িটার বাগানে ক্রিকেটের বল পড়লে কিচ্ছুটি বলে না। রিম্পিদির মা সবাইকে
ডেকে ডেকে এটা ওটা খাওয়ান। ওদের বাড়িতে সবাই মিলে টিভি দেখতে যাওয়া হয়। ওখানেই চৌকো
বাক্সটার মধ্যে উত্তমকুমার থেকে শুরু করে কত কত সব বিখ্যাত লোক যে আসে। আমরা ঘেঁষাঘেষি
করে ওখানেই প্রথম ফেলুদাকে দেখেছি। অপুকেও। তা সেই বাড়ির রিম্পিদির বিয়ে বলে কথা। সেকি
যে সে ব্যাপার। পাত্র থাকে নাকি সেই সুদূর আমেরিকায়। সাত সমুদ্র তেরো নদীর পাড়ে। আর
রিম্পিদি থাকে কিনা বালির গঙ্গার ধারের একটা বাড়িতে। এমন কান্ডও হয়? পাড়ার চায়ের দোকানে।
রেশনের লাইনে। কেরোসিন তেলের ড্রাম জমা দিতে গিয়ে। গঙ্গায় নাইতে নাইতে সে গল্প যেন
আর থামে না। পাড়ার নাগরিক কমিটিতে ভাঁড়ের পর ভাঁড় চা আর সিগারেটের ধোঁওয়া ওড়ে। লেলিনের
ভুরু আরও যেন কুঁচকে ওঠে ফটো ফ্রেমে। আলোচনা তবু থামে না। কেন বিল্টু রাশিয়াতে চাকরী
করে না? সন্তু কানাডাতে যায়নি? স্বদেশ নিউইয়র্কে থাকে না? সেখানে সে বেঙ্গলি ক্লাবের
প্রেসিডেন্ট নয়? তাহলে আমেরিকা থেকে ছেলে বিয়ে করতে আসবে এ আর এমন কী? টিভি দেখে দেখে
তোমাদের মাথাটাই খারাপ হয়ে গেছে। ঠিক এমনই একটা সময়ে রোববার সকালে পাড়ার লাইব্রেরীতে
বেতালের খুলি গুহা পড়তে পড়তে বাবাই একটা মারাত্মক খবর দেয়। রিম্পিদির দাদু
নাকি বাড়ির মধ্যে ঘোষণা করেছেন তাঁর একমাত্র নাতনির বিয়ে মনে রাখবে পাড়ার লোক চিরকাল।
কিন্তু কিভাবে?
সেটা নিয়েই পরের দিন রাসবাড়ির গঙ্গার
ঘাটে একটা আস্ত এ্যটোম বোম ফাটালো বুড়ো। এই প্রথম পাড়াতে আসবে কলকাতার ক্যাটারার। সবার
গালে হাত। মুখ গুলো তাড়িনীবাবুর দোকানের ঠিক চুপসে যাওয়া বেগুনীর মতো। ক্যাটারার? সেটা
আবার কী? বুড়ো চোখ গোল গোল করে বললো, তার মামা নাকি তাকে বলেছে সে নাকি এলাহি এক কান্ড।
যেখানে কাউকে গামছা জড়িয়ে পরিবেশন করতে হবে না। টেবিলে কলাপাতা থাকবে না। নো মাটির
ভাঁড়। সেখানে সাহেব সুবোদের মতো প্লেট, গ্লাস। ঠিক হোটেলে খাওয়ার মতো। অবাক হয়ে জানতে
চাই আর ভগীরথ ঠাকুর? তার সেই বিখ্যাত মটন কষা? দই কাতলা? কড়াই শুটির কচুরী। বুড়ো বললো
সে এতো কিছু জানে না। তবে ভগীরথ ঠাকুর নাকি এবার নট এলাউ। চারিদিকে ফিসফিস শুরু হলো।
ভগীরথ ঠাকুর রান্না করবে না তাও কী করে হয়? এদিকে পাড়ায় এর আগে কোনোদিন ক্যাটারার হয়নি।
মানুষজন পাত পেড়ে প্লেটে চামচে খায়নি। ঘনির ঠাকুমার কাছে গঙ্গার কুচো চিংড়ি নিতে গিয়ে
শুনলাম ছেলের নাকি অনেক সাহেব সুবো বন্ধুরা আসবে। তারা কি আর কলাপাতায় খেতে পারে? নাকি
মাটির গ্লাসে?
পাপ্পু গুলি খেলতে খেলতে বললো কেন
পারবে না? খুলি গুহায় বেতাল যদি বাংলায় কথা বলে। টিনিটিনের কুকুরের নাম যদি কুট্টুস
হতে পারে। ফেলুদা যদি অতোবড় গোয়েন্দা হয়ে দেশ বিদেশ ঘুরে এতো মারাত্মক সব অপরাধী ধরেও
হাতে করে হাপুস হুপুস খেতে পারে তাহলে বরযাত্রীরা নয় কেন? ম্যারাপ বাঁধা শুরু হতেই
পাড়ার লোকজন একটা নতুন কিছু দেখার জন্য কেমন যেন হন্যে হয়ে উঠলো। ঘিয়ে রঙের বেনারসীতে
মোড়া লাল প্রজাপতি আটকানো বিয়ের কার্ড পৌঁছে গেল সবার বাড়ি। কার্ডের কোনে হলুদ আর সিঁদুরের
টিপ। আইবুড়ো ভাত থেকেই সবার নেমনতন্ন। পাড়ার
লোকজনের আনন্দ আর দ্যাখে কে? শুধু আমারই মনটা খচখচ। আর ভগীরথ ঠাকুর? বাবাই ঘুড়ি ওড়াতে
ওড়াতে একেবারে বাঘের মুখের খবর দিলো। বিয়ের সন্ধ্যেবেলা ছাড়া আর সব কটা দিন রান্না
করবে ভগীরথ ঠাকুর। যাক একটু প্রান পেলাম যেন। মেনুও জানা হয়ে গেল। মাছের মাথা দিয়ে
ডাল আমার খুব প্রিয় সেটা হচ্ছে ভেবেই ক্যালেন্ডারে দাগ দিতে শুরু করলাম। বিয়ের দিন
এগিয়ে গেল। এই প্রথম পাড়াতে বেনারস থেকে সানাই বাজিয়েরা এলেন। তারকেশ্বর থেকে এলো ছানা।
ভিয়েনের কারিগররা এলেন খোদ পর্তুগীজদের দেশ চন্দননগর থেকে। শুনলাম জলভরা তাল শাঁস হবে।
নলেন গুড়ের রসগোল্লা। ছানার পায়েস। আর এই কয়েক দিনে খাওয়ার মিষ্টির লিস্টে থাকবে খোওয়া
ক্ষীর বাদাম কিসমিসে মাখা বোঁদে, লেডিকেনি, কালোজাম আরও কতকি। ও ভুলেই গিয়েছিলাম মোল্লারচকের
দইও। কুয়াশা ভরা পাড়ায় একদিন সকালে বেজে উঠলো বিয়ের সানাই। আর ভগীরথ ঠাকুর অগ্নিদেবকে
প্রনাম করে বসালো তার বিরাট কড়াই খানা। সে বিয়ে মনে রেখেছিল পাড়ার লোকজন। আর ভগীরথ
ঠাকুরকেও। কেন? বলছি সেটাই।
ভগীরথ ঠাকুরের রান্নার কথা সেতো আর
কাউকে বলতে হতো না। লা জবাব ছিল। বিয়ের দিন সকালে দুই লরি ভর্তি করে সেই প্রথম পাড়াতে
ক্যাটারারের দল এলো। তাদের সব বাসন কোসন। লোক লস্কর। খান একশো তো হবেই। সে যে কি বিষম
রান্না শুরু হলো। এমন কেউ নেই যারা উঁকি দিয়ে দেখলো না। বুড়ি পিসিও তার বাতের ব্যাথা
নিয়ে উঠে এলো কলকাতার ক্যাটারারের রান্না দেখতে। খান চারেক উনুনে রান্না বলে কথা। বিরিয়ানী
হবে। মাখনে ভাজা রুটি থাকবে। উলের মতো সুতো সুতো কিসব, বুড়ো পাশ থেকে বলে দিল নুডলস
সেও থাকবে (তখনও বাঙালি মধ্যবিত্ত ঘরে ম্যাগি নামক বস্তুটির আবির্ভাব হয়নি)। আরও কিসব
সাহেবী খাবার। ঠুং ঠাং ঝুন ঝাং সব আওয়াজ হতে থাকলো। বিকেল থেকে নো এন্ট্রি করে দেওয়া
হলো প্যান্ডেল। সাজানো হবে বলে। ঠিক যেন যাত্রার আসর বসেছে। এক্ষুনি তরুণ অপেরার শান্তিগোপাল
মঞ্চে উঠবেন।
গোটা পাড়া সন্ধ্যে থেকে নেমে পড়লো
বিয়ে বাড়ির সামনে। যেন ঠিক চ্যাপলিনের ছবি। এপড়ে ওর ঘাড়ে। এদিকে বর চলে এলো সাদা ধপধপে
এ্যাম্বাসাডারে। লাল গোলাপে গাড়ি সাজানো। বরযাত্রী এলো একটা বিশাল বাসে। সেসব আর কে
দেখে? ততক্ষণে তো খাবার জায়গা জুড়ে মারামারি শুরু হয়ে গেছে প্রায়। হবে নাই বা কেন?
সাদা ধপধপে টেবিলে প্লেট, কাঁচের গ্লাস। উর্দিধারী পরিবেশনের লোকজন। সাহেবদের মতো কাঁটা
চামচ, স্যুপ। আর প্যান্ডলে ঢুকতে গেলেই ফুসফুস করে গোলাপ জল। তার ওপরে আবার প্লেটের
পাশে রাখা রুমাল। একটু করে খাবে আর মুখ মুছবে। বুড়ো তার মামার কাছ থেকে সব জেনে নিয়েছে।
এইসব দেখে সবাই খেতে চলে এসেছে। নেমনতন্ন হয়েছিল হয়তো সাড়ে সাতশো। সেখানে হাজার দেড়েক
লোক। প্যান্ডেল ভেঙে পড়ো পড়ো। আর সন্ধ্যে আটটার মধ্যে ক্যাটারিং এর খাবার সব শেষ। তখনো
গুচ্ছের লোক বাঁকি। মালিককে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। রিম্পিদির বাবা কথা বলতে পারছেন
না। গলা বসে গেছে। দাদু পায়চারীর জায়গা পাচ্ছেন না এতো ভিড় বারান্দায়। রিম্পিদির ঠাকুমা
যাকে আমরা বড় দিদা বলতাম তিনিই দেখলাম খুব শান্ত। এমনিতেই তিনি কম কথা বলেন। পাড়ায়
দুর্গা পুজোয় ভোগ রাঁধেন। কালী পুজোয় বলির পাঁঠার মাংসের ঝোল তাঁর হাতে যে খেয়েছে সে
কোনোদিন ভুলতে পারবে না। তো সেই তিনি বর বরণ করে, নাতনিকে বিয়েতে বসিয়ে এসে হাল ধরলেন।
প্রথমেই হাঁক দিলেন ভগীরথ। সে ভেতরেই ছিল। পরের দিনের কুটনো কুটতে ব্যস্ত ছিল তার লোকজনের
সাথে। সামনে এসে হাত জোড় করে দাঁড়ালো। বড় দিদা বললেন এখন কি হবে ভগীরথ? রিম্পিদির দাদু
কি একটা বলতে আসছিলেন তিনি কড়া চোখে তাকাতেই চুপ করে গেলেন। দিদার বরাবরের আপত্তি ছিল
ক্যাটারারে। দাদু শোনেনি। এখন তাঁর মুখ লোকাবার জায়গা নেই। এদিকে মাঠে হুলস্থূল অবস্থা।
এগিয়ে এলেন বড় দিদা ভগীরথের দিকে। আমার বাড়ি থেকে আজ পর্যন্ত কেউ না খেয়ে যায়নি। ভগীরথ
বললো হুকুম করন মা ঠাকরুন। দিদা ভাঁড়ারের চাবিখানি দিয়ে বললেন যা ব্যবস্থা হয় করো।
শীতের রাতের দশটা নাগাদ গোবিন্দ ভোগ চালের গন্ধে আকাশ বাতাস মো মো করে উঠলো। আগের রাতের
ভিয়েনের ছানা ছিল পর্যাপ্ত। বড়া ভাজা হলো। ডালনা হলো। সঙ্গে সকালের কাতলা দই দিয়ে মাখো
মাখো হল। বরের সাহেব বন্ধুরা টু গুড…টু গুড করতে করতে হাত চাটলো। আর ভগীরথ ঠাকুর এক
খিলি পান মুখে পুরে ক্যটারারের উনুনেই সারা রাত ধরে রেঁধে গেল। সেদিন ভগীরথের জয় হয়েছিল।
মনে রেখেছিল সবাই। কত কত দিন যে এই গল্পটা সবার মুখে মুখে ঘুরে চলেছিল তার হিসেব কেউ
রাখেনি। গঙ্গার ঘাটও না।
কিন্তু দিন যত এগোতে থাকলো। পাড়া যত
ভাঙতে থাকলো। গাছ যত কাটা পড়লো। মা গঙ্গা যত ছোট হতে থাকলো খাটার লোক তত কমতে লাগলো।
আরও কমে গেল গল্প করার মানুষ। কুশল কামনার হিসেব নিকেষ। ঠিক সেই সুযোগেই এদিক ওদিক
থেকে ক্যাটারিং এর লোকজন ঢুকে পড়তে থাকলো পাড়াতে। সেই ক্যাটারার যাদের একদিন মুখ চুন করে পাড়া
থেকে চলে যেতে হয়েছিল।
মনে আছে ভগীরথ ঠাকুরকে শেষ দেখেছিলাম
বসন্তের কোন এক সকালে। হাঁদার চায়ের দোকানটা তখন আর নেই। হাঁদাও নেই। উপেন্দরের চায়ের
দোকানে বসে চা খাচ্ছিল। কোথায় থাকো তুমি এখন? দেখাই পাওয়া যায় না। ভগীরথ হাসি মুখে
জবাব দিয়েছিল কলকাতা। কোনো এক বড় ক্যাটারারের দলে রান্না করে। মাসিক বেতন পায়। কলকাতার
মান্যগন্যরা ভগীরথের রান্না খেয়ে ধন্য ধন্য করে। যদিও তখনও তার পরনে গেরুয়া গামছা,
স্যান্ডো গেঞ্জি আর মুখে পান খাওয়া মিটিমিটি হাসি। কিন্তু হাতে সেই গাড়ু হাতাটা নেই। ঝাঁঝরি নেই। এমনকি খুন্তিটাও না। মনে হয়েছিল কেউ যেন কেড়ে নিয়েছে। তারপর কতবার যে কত নেমনতন্ন বাড়িতে
একটু ভালো খাবার খেলেই প্যান্ডেলের রান্নাঘরে উঁকি দিয়েছি ভগীরথ ঠাকুরকে দেখতে পাবার
আশায়। কিন্তু পাইনি। অথচ দেখেছি সেই গেরুয়া গামছা, স্যান্ডো গেঞ্জি, গলায় কন্ঠি, পান খাওয়া সারি
সারি মুখ।
না তাদের সাথে আর গল্প করা হয়নি। জানতে চাওয়া হয়নি দেশের কথাও। কারণ জানতাম তারা কেউ আমার ভগীরথ ঠাকুর নয়। তারা সবাই ক্যাটারিং এর রন্ধন শিল্পী। যাদের নিজস্ব গাড়ু হাতা, লম্বা খুন্তি এমনকি ঝাঁঝরিটাও নেই। সবটাই ক্যাটারারের। সবটাই মালিকের। হয়তো তাদেরও একটা গ্রাম আছে। দুহাতে কান চাপা দিয়ে হয়তো এখনও কেউ শোনে তাদের গ্রামের সমুদ্রের আওয়াজ হাঁদার দোকানে লেড়ো বিক্সুট আর চা খেতে খেতে। এখনও কেউ হয়তো নাক উঁচু করে গাওয়া ঘিয়ে লুচি ভাজার গন্ধ শুকে বেড়ায় বাতাসে। বিয়ের নেমনতন্নের কার্ড বাড়িতে এলে দিন গোনে ক্যালেন্ডারের পাতায়। হয়তো কেউ...
ছবি সৌজন্য- গুগুল। যদিও কলা পাতায় বেড়ে দেওয়া সেই আদ্যন্ত বাঙালি পরিবেশনা কোথাও খুঁজে পেলাম না। বুঝলাম পুরোটাই বিলুপ্ত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন