চার্লি

বালীর বাসার নোনা ধরা দেওয়ালে এমন একটা মানুষের ছবি সাঁটা থাকতো যার ছবি তখনও আমার দেখা হয়ে ওঠেনি। দেখার কোন সুযোগ ছিল না বলেই। আশির দশকের শুরুর সেই দিন গুলোতে শীতের রোদ ঝুপ করে একটুস খানি উঠোনে পড়লেই লিকার চা আর রুটি ডুবিয়ে খাওয়ার সময় লোকটার গল্প উঠে আসতো অবধারিত ভাবেই। ইচ্ছে করে না যে ওই খাবারটা খেতে একদমই আমার। তখন কান্ডটা ঘটাতো আমাদের সবার থেকে বড় দাদা। সে যে তখন কলেজে পড়ছে। কোথায় কোথায় ঘুরে বেড়াচ্ছে। লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেটও খাচ্ছে রাস্তায় বেরিয়ে ঠিক দেখেছি। সেইতো এনে টাঙিয়েছে দেওয়ালে ওই অত্তো বড় একটা ছবি। ইঁট গুলোও ঢাকা পড়ে গেছে কেমন।

বুঝলি ওই যে ঢোলা প্যান্ট, ছোট্ট কোট, বিবর্ণ পোষাক পরা লোকটা দাঁড়িয়ে আছে সে কিন্তু যে সে মানুষ ছিল না। লোকটা তার ওই ছেঁড়া টুপি, পুরনো ছড়ি, প্রজাপতি গোঁফ নিয়ে তার চারপাশের মানুষকে কি চরকি পাক খাওয়াচ্ছে যদি দেখতিস তাহলে বুঝতে পারতিস এই একটুখানি লিকার চা আর রুটিও খেতে কত ভালো। গোল গোল চোখ করে সেও লিকার চা রুটি খেতে খেতে গল্প বলে। ততক্ষণে আমার খাওয়া শেষ।

একটা লোক ক্ষিদের জ্বালায় যে এতো কিছু করতে পারে। রাস্তায় ঠান্ডায় ঘুমোতে পারবে না বলে একটু শোওয়ার জন্য এতো বুদ্ধি আঁটতে পারে তাকে পর্দায় দেখার জন্য ছটফট করতাম আমরা। ততদিনে সিনে ক্লাব করা আমাদের সবচেয়ে বড় জ্যাঠতুতো দাদার কাছ থেকে শুনে শুনে মুখস্থ হয়ে গেছে গল্প গুলো। লোকটার দেশ বলে কিছু তো ছিল না। লোকটার ঘর বলে কিছু নেই। লোকটা একা। নিঃসঙ্গ। দুঃখ তার চিরসঙ্গী। শুধু বেঁচে থাকবে বলে তার এই নানা রকমের বিচিত্র কর্মকান্ড। যা কিছুই করতে যায় তাই হয়ে যায় একটা বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন। সমাজের কাছে। রাষ্টের কাছে। সব চোখ রাঙানো নেতা, নেত্রী, চুল ছিঁড়ে টাক গজানো বুদ্ধিবাজদের কাছেও। এমনকি হিটলারও!

সেবার মাধ্যমিক। টেস্ট পরীক্ষা হয়ে গেছে। লাইন দিয়ে টেস্ট পেপার কিনে এনেছে বাবা কলেজস্ট্রিট থেকে। আমার চারপাশে পড়ে আছে সেভেন টিচার্স, টেন টিচার্স, অধ্যাপক পি আচার্য গুচ্ছ গুচ্ছ মানে বই। ওই শীতে মাথায় জবজবে নারকেল তেল, গাল ভর্তি ব্রণ নিয়ে পরীক্ষার দুঃস্বপ্নে দিন কাটাচ্ছি। আর সিনে গিল্ড বালী সেই বছর আমাদের অঞ্চলে উদ্বোধন হওয়া নতুন রবীন্দ্র ভবনে দেখাচ্ছে সেই লোকটার ছবি যাকে নোনা ধরা দেওয়ালে আমি আর দাদা চিরটাকাল দেখে এসেছি লিকার চায়ে রুটি ডুবিয়ে খেতে খেতে। অনেক হুড়ুমতাল কান্না কাটির পর একটা ছবি দেখিয়েছিল বাবা।

হলভর্তি লোকের মাঝে লোকটা যে হাসির বোমা গুলো টুপ টুপ করে ফেলছে তাতেই ফেটে যাচ্ছে মানুষগুলো। কবে কোন এক প্রথম মহাবিশ্বের আস্তাকুড়ে বড় হওয়া চার্লির কথা কত যুগ পরে বালীর নোনা ধরা দেওয়ালে আঁকিবুকি কাটছে। অনেক পরে তারও অনেক অনেক পরে যখন পড়ছি তাঁর নিজের কথা। তখন কোথাও সেই ছোট্ট চার্লি, তার মা, তার দাদা আমাদের পাতকো তলায়, গঙ্গার ধারে, অনেক কিছু চাওয়া এবং পাওয়ার বেড়াজালে প্রশ্ন তুলছে। তখন তো আমি অনেক বড় লুকিয়ে লুকিয়ে সিগারেট খাচ্ছি। নন্দনের ছোট্ট ঘরে শুনে এসেছি মৃণাল সেনের চ্যাপলিনকে নিয়ে ভালোবাসাও।

২৫ ডিসেম্বর চ্যাপলিনের চলে যাওয়ার দিন। কিন্তু আমরা সবাই জানি চার্লির মৃত্যু নেই। থাকবে কী করে? সে যে এখনও যুদ্ধ বিধ্বস্ত দেশে, হুমকির চোখ রাঙানিতে, নিরন্ন সমাজে একের পর এক কান্ড ঘটিয়ে যাচ্ছে। এক বিরাট প্রশ্ন চিহ্ন হয়ে দেখা দিচ্ছে সাদা পর্দায়। ভালো থেকো চার্লি। আমাদের শীতের সকালে লিকার চায়ে ডুবন্ড রুটি হয়ে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি