ঠিকানা লেখা নেই_৮
শীতের আলোর মধ্যে এক ধরণের মায়া আছে। হারিয়ে যাওয়া আছে। হাতে বোনা মাফলার আছে। ব্যাগের সামনের পকেটে রাখা ইনহেলার আছে। আদর করে দেওয়া একটু টোকো কমলালেবু আছে। আর...আর যেটা আছে সেটা এক ধরণের বিপন্নতা। সেটা যে ঠিক কি হয়তো নিজেও জানা যায় না। মেট্রোতে উঠলে আমার থেকে যাঁরা আরও অনেক দূরে দূরে থাকেন তাদের গায়ে লেগে থাকে বারাসাত, নবদ্বীপ, বনগাঁর শীতের কুয়াশা। কেউ কেউ তখনও গায়ে জড়িয়ে রেখেছেন চাদর। সবুজ রঙের সোয়েটার। বাচ্চাটার চোখে ঠান্ডা লাগা ফুলো ফুলো ভাব। শরীরের ভাষায় স্কুলে যাওয়ার তীব্র অনিচ্ছা ঠিক অনেকটা আমার অফিস যাওয়ার মতোই।
রুবি থেকে চিনে কালি বাড়ি পর্যন্ত অটোতে উঠলে বেলা বেড়ে যায়। শীতের আলো তখন উত্তরপাড়ার খেয়া ঘাট ছেড়ে উঁকি মারে শহর কলকাতায়। ফুটপাতে দাঁড়িয়ে বারুইপুরের ডাঁসা পেয়ারা খায়। কতবেলে আরও লঙ্কা দিয়ে ঝাল দিতে বলে। পেটাই পরোটার গন্ধে পাসপোর্ট অফিসের আকাশ বাতাস ভারী হয়। ঠিক সেই সময় মাঝে মাঝে আমার সঙ্গে বিপ্লবের দেখা হয়।
বিপ্লব তুখোড় অটো চালায়। ডান হাতে আঁকা একটা ছোট্ট উড়ো জাহাজ। বছর তিনেক আগে কোভিডের সময় ওর বন্ধু এঁকে দিয়েছিল। কিন্তু উড়ো জাহাজের উল্কি কেন?
ওই যে ঘরে শুয়ে শুয়ে জানলা দিয়ে প্লেন ওড়া দেখতুম। আর ও ব্যাটা হেঁটে হেঁটে, কখনও কারো সাইকেলে, ভাড়ার গাড়িতে অনেক কষ্ট করে চলে এসেছিল মুম্বাই থেকে। কাজ চলে গিয়েছিল যে। খাওয়া ছিল না। বাড়ি ফেরার টাকাটুকুও না।
এখন কি করে?
পালিয়েছে ব্যাটা। দুবাই। কলের মিস্ত্রি যে। আমাকেও নিয়ে যাবে। গাড়ি চালাবো।
আর এই অটোটা?
নিজের নয় তো মালিকের।
বাড়ির লোকজন?
কি আর বলবে? নোট দিলে সবাই খুশি।
আমার অফিস আসে। দশ টাকা ধরিয়ে নেমে যাই। বিপ্লব গলা বাড়িয়ে জানতে চায় এই যে এতো কথা আমার শুনলে তুমি কি করো এই এত্তো বড় বাড়িটায়?
ওই যে সবার গল্প শুনি।
বিপ্লব কয়েক সেকেন্ড আমার দিকে অবাক হয়ে তাকিয়ে থাকে। তারপর ধুস বলে মিষ্টি হেসে হাওয়ায় উড়িয়ে নিয়ে যায় অটো। ও বিশ্বাস করতে পারেনা আমাকে। আমিও না। শীতের বিপন্ন আলো বিশ্ব বঙ্গ শিল্প সম্মেলনের বিরাট হোডিং এর ওপর এসে পড়ে।
আরও একটা দিন শুরু থেকে শেষের পথে যায়।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন