ঠিকানা লেখা নেই_৩


 টুকনুদের চিলেকোঠাতে সেই কবেকার আমলের একটা দূরবীন ছিল। তার ছোটকাকে তার দাদু নাকি এনে দিয়েছিলেন কোনো এক মাদারির কাছ থেকে। ছোটকা যখন বাড়ি থেকে একদিন ভ্যানিশ হয়ে গেল তার আগের রাতে টুকনুকে দিয়ে গিয়েছিল চুপিচুপি ওই দূরবীনটা। বলেছিল, এটা আজ থেকে তোর টুকনু। তোকেই দিয়ে গেলাম। মন খারাপ করলেই দূরবীনে চোখ রাখবি আর ঠিক দেখতে পাবি ভাস্কো দাগামার জাহাজটাকে।

এরপর থেকে টুকনু অনেকবার চোখ রেখেছে দূরবীনে। মন খারাপ হলে। মন ভালো থাকলে। খুব বৃষ্টি পড়লে। কিম্বা এমনি এমনি। কিন্তু একবারও সে জাহাজটাকে দেখতে পায়নি। এরপর পড়ার বইতে সে ভাস্কোদাগামাকে খুঁজে পেয়েছে। আরও বড় হলে জানতে পেরেছে ঔপনিবেশিক শক্তি কি মারাত্মক হতে পারে। দেশ দেখা আর দেশ জয় করা ঠিক এক জিনিস নয় কখনোই। শ্যামল গঙ্গোপাধ্যায় কান ধরে শিখিয়েছেন কিভাবে বাঙালির রান্নাঘরে ওলন্দাজ সব খাবার মিশে গেল। মশলা থেকে আনাজপাতি সমেত। তবুও টুকনু তার সেই দূরবীনটার কথা আজও ভোলেনি। তার ছোটকাকেও নয়। যে একদিন সত্যি সত্যি ভাস্কোদাগামার জাহাজ দেখতে পেয়েছিল সেই কবেকার এক দূরবীনে চোখ রেখে।

এই প্রথম হয়তো বিজয়াতে বাড়িতে নেই। পুষ্পপাত্রে হলুদ গোলা জলে প্রতিমা নিরঞ্জন নেই। ছোট্ট লাল ডায়েরি খুলে লাল জেল পেনে শুভ বিজয়া লেখা নেই। আমার চারপাশে কোথাও পুজো নেই। শুধু পুজোর গন্ধ মেখে গায়ে জড়ানো ছুটিটা ছাড়া।
যে রাজ্যে এসেছি তার চারপাশে ইতিহাসের ভাস্কর্য। তার ছায়াবীথি অনেক প্রাচীন গাছ। তার মানচিত্র তৈরি হয়েছে আরব সাগরের নোনা জলে, মান্ডভি নদীর পলিতে। আরও তার শাখা প্রশাখায়।
এখানে একজন ইশ্বরপ্রতিম ফাদার শুয়ে আছেন সেই কবে পনেরো শতক থেকে। পাইন কাঠের সেই কফিন। কাঁচ, রূপো, সোনার সেই নিরূপিত চোখ ধাঁধানো আলো। তারই মধ্যে কত কত জনশ্রুতি। কত গল্প। কত মিথ। এখনও করজোড়ে সবাই প্রার্থনা করে ফাদার থাকুন আমাদের সাথে। ফাদার নিরাময় করুন।
গোটা শহরটা এখনও ঘুম থেকে জেগে ওঠে গির্জার ঘড়ির শব্দে। কাজে যায়। ফিরে আসে ঘরে। মান্ডভি নদীর তীরে, আরব সাগরের জলে সূর্য পাটে যায়। সমুদ্রের ধারে, পুরোনো শহরের গলিতে বার গুলো জেগে ওঠে। ঢিমে তালে গান হয়। গল্প ঘোরে। উদাস হয়। হারিয়ে যায় পুরোনো শহরের বাতাসে।
মা ফোন করে মনে করিয়ে দেয় আজ বিজয়া দশমী।


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি