ঠিকানা লেখা নেই_৭


 ছোটবেলা থেকে তাঁর শখ ছিল ভোজবাজি শেখার। ম্যাজিক তাঁকে টানতো। ভূতপ্রেত ব্রহ্মদত্যির গল্প ভালো লাগতো। যখন কৈশোর, একদিন খবরের কাগজে দেখলেন কোনো এক সাহেব যিনি ভূত নামান তিনি সহকারী খুঁজছেন। কি মনে হলো গেলেন সেই সাহেবের কাছে। তখন চারিদিক তো জ্বলছে। ইংরেজ যাতে ভারত ছাড়ে তারজন্য অগ্নিযুগের বিপ্লবীরা উঠে পড়ে লেগেছে। বোমা বানাতে গিয়ে খুব কাছের এক বন্ধুর হাত উড়ে গেল। একজন মারাও গেলেন। ছোট ছোট গুপ্ত সমিতিতে যাতায়াত শুরু হলো ছেলেটার। কিন্তু সাহেব টানছে। তার ভূত নামানোর ক্রিয়া কৌশল তাক লাগিয়ে দিচ্ছে মনে। তিনি ঢুকে পড়লেন সাহেবের দলে। সাহেব বড়লোকের বাড়িতে। জমিদার বাড়িতে। পার্ক্সট্রিটে এ্যাংলো পাড়ায় ভূত নামায়। লোকজন তাজ্জব বনে যায়। বেশ কিছুদিন এমন চললো। তারপর সাহেব যে কোথায় চলে গেল কেউ জানতে পারলো না। ছেলেটার মনেও পরিবর্তন আসছিল। থাকতে ইচ্ছে করছিল না বাড়িতে আর। কোনো এক সাধু মাঝ রাতে মাঝ গঙ্গায় নৌকার মধ্যে নিয়তির কথা বললেন ছেলেটিকে। যে পথে গিয়েছিস। যাদের নামানোর জন্য সাহায্য করেছিস তারা থাকতে দেবে না বাড়িতে। ঘর ছাড়া হতে হবে তোকে। ঠাঁই নাড়া।


তারও অনেক অনেক পরে যখন সেই ছেলেটি কলম নিয়ে বসবে সে লিখবে একটা শ্মশানের কথা। ডাঁই হয়ে মড়ার লেপ তোষকের ওপর বসে থাকা একটা সন্যাসীর কথা। যে তার উপন্যাসের কথক। যার চোখ দিয়ে দেখছেন লেখক। উদ্ধারণপুরের ঘাট বাংলা সাহিত্যে বিরল নির্দশন হয়ে থেকে যাবে আজীবন। আর লেখক অবধূত মরুতীর্থ হিংলাজে ধরিয়ে দেবেন আসলে যাকে তোমরা সন্ন্যাসী বলে জপ করছো সে একটা রক্ত মাংসের মানুষ।

কেন মনে পড়লো আজ অবধূতের কথা? কোনো এক গভীর রাতে যখন তিনি হিমালয়ের পথে পথে হেঁটে বেড়াচ্ছেন নিজেকে প্রশ্ন করছেন - কি খুঁজছি আমি? কাকে? নীলকণ্ঠের কাছে কি আছে তার হিসেব নিকেষ? রাত্রির যে এই ভীষণ মূর্তি সেটাই কি তাঁর মায়ের? যিনি অজ্ঞেয়? যিনি সম্পূর্ণা? যিনি স্থিতি লয় এবং ধ্বংসের প্রতীক? কার কাছে কার দিকে ছুটছেন তিনি। সেই সময় ডিনামিট দিয়ে উড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে একের পর এক পাথরের চাঁই। জগৎ সংসারের বুকে রাস্তা তৈরী হচ্ছে। ক্ষত বিক্ষত হচ্ছে প্রকৃতি। তিনি পঞ্ছি ব্রত নিচ্ছেন। একবেলা আহার। কখনও অজগর ব্রত। কখনো দিনের পর দিন নির্জলা উপবাস। পায়ে ঘা। গায়ে ক্ষত। ঘুরে বেড়াচ্ছেন যে মানুষটি দুবছর তিনি কারও সাথে কথা বলেন না। কারণ মহাকাল তাঁর জিভে বসিয়ে দিয়েছেন স্বয়ং সৃষ্টি, স্থিতি এবং বিনাশকে।

আরও অনেক পরে যখন পরিচয় হবে আমার তাঁর সঙ্গে। অনেক আলোকবর্ষ দূর থেকে তাঁর বইগুলো হাতে আসবে সেখানে দেখবো কোথায় ঈশ্বর? কোথায় ভোগ ত্যাগ? এতো শুধু মানুষের কথা লিখে গেছেন তিনি। যে মানুষ ঈশ্বর বানায়। গড়ে। যে মানুষ রূপী ঈশ্বরের মধ্যে আদি শক্তি সাধনার কথা বলে গেছেন তাঁর পূর্বজরা। বলে গেছেন তন্ত্র মন্ত্র কিছুই জানিনে মা। সে মাতৃরূপিনী প্রকৃতির আরাধনা আজ থেকে তো শুধু নয় বহুদিনের আমাদের জীবনের সাথে সঞ্জিবীত। আর সেই ভুত গুলো যারা ভুত চতুর্দশীর রাতে ঘুরে বেড়ায়, মায়া ছড়ায়, ফিরে আসার বার্তা দেয় বাঙালীর মায়া ভরা সংসারে। তারাও তো কোথাও কোথাও আমাদের মন কেমন করায়। ফিরে যেতে হয় কত কত না বলা গল্প কথায়। ঠিক তখনই আমরা চোদ্দ প্রদীপ জ্বালাই। চোদ্দ শাক খাই। একটা জাতি দ্বীপান্বিতায় ঘর আলো করে শক্তির উৎসকে পুজো করে। আর মনে পড়ে যায় একটা ছেলে ঘুরে বেড়ায় সেই আদি শক্তির উৎস সন্ধানে। যে একদিন অবধূত নামে আত্মপ্রকাশ করে বিস্মিত করে দেবে সবাইকে।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি