ঠিকানা লেখা নেই_২
তাঁর সাথে ঠিক কবে কোথায় প্রথম আলাপ হয়েছিল আজ আর মনে করতে পারিনা। আমার জন্মের এক বছরের ব্যবধানে তিনি চলে গেছেন অনেক দূরে। তবে রাঙার বাড়িতে কাঠের যে দরজা লাগানো টেলিভিশন ছিল সেখানে একটা ছবি দেখে পাড়ার লোকজন কেঁদে ভাসিয়ে দিয়েছিল। মনে আছে বেশ। মেয়েটা খুক খুক করে কাশে আর মুখ দিয়ে রক্ত ওঠে। ওই গোটা সংসারটা কি একটা মেয়ের পক্ষে টানা সম্ভব? টিভি দেখতে দেখতে পাশ থেকে বলে উঠেছিলেন ঘনির ঠাকুমা। কচুপাতায় করে আমাদের বাসার সামনে গঙ্গার চুনো মাছ বিক্রি করতেন। তো সেই খুকি ওরফে নীতা তো মরলো। তার দুঃখে কাঁদলো আকাশ, বাতাস, পাতাল, পাহাড় এমনকি লাহিড়ী বাড়ির সবাই। যারা উদ্বাস্তু তারা তো কাঁদবেই। আর কে উদ্বাস্তু নয় মশাই এই পৃথিবীতে? তারপর থেকে যতবার ছবিটা দেখেছি। পড়াশুনো করেছি। পড়িয়েছি। চোখ ভিজে উঠলে পালাতে হয়েছে। বিরক্ত করে ছেড়েছেন মানুষটি। তাই হয়তো যত আলোচনা হয়েছে তাঁকে নিয়ে বাঙালী তার কাজের অনুপ্রেরণার ধারে কাছে পৌঁছতে চায়নি।
আর করেছেনটাও বা কি সেই সময়, যা কেউ ভাবতে পারেনি। বড় বড় পিয়ানোতে কোথায় নায়িকারা গান গাইবে আর উনি কিনা দেখাবেন একটা গাড়ির প্রাণ আছে? সেই গাড়ি তার ড্রাইভারের ডাকে সাড়া দেবে? নাম হবে তার জগদ্দল? সেই ছবির নাম আবার অযান্ত্রিক? পাগোল ছাড়া আর কিছু হতে পারে? নিজের হাত আগুনে পোড়ানো ছাড়া আর কী?
অনেক পরে বেঙ্গল ল্যাম্পের স্টপেজে নেমে যখন যাদবপুরের ফিল্ম স্টাডিজে ঢুকবো জানতে পারবো সেই জগদ্দলকে নিয়ে কি সুন্দরই না একটা ছোট্ট লেখা লিখে গেছেন পরিচালক। খালি হলের সিটের দিকে তাকিয়ে কোনো এক বিকেলে কোনো এক সিনেমা হল থেকে মন খারাপ করে বেরিয়ে আসছেন পরিচালক। গাড়িটাকে সাজানো হয়েছে সিনেমা হলের সামনে। সেখানে বাসা বাঁধছে দুটো চড়াই। পরিচালক এগিয়ে যাচ্ছেন আরও একটা নতুন ছবির দিকে। যদি দর্শক দেখে।
এক মামা তার আঙুলের বয়সী এক ভাগ্নেকে নিয়ে যেন মহাপ্রস্থানের পথে বেরিয়েছেন। ছবি শেষ হচ্ছে ইতিহাসের এক ক্রান্তিলগ্নে। সেই ছোট্ট ছেলেটা ক্লান্ত বৃদ্ধ মামাকে প্রশ্ন করছে তারা কি নতুন বাড়ি যাচ্ছে? তার মামা এতো বুড়ো হয়ে গেল কেন? অনেক পরে যখন দিদির বাড়ির কাছে গিয়ে সুবর্ণরেখা নদীটা দেখেছিলাম আমার শুধু একটা পরিতক্ত্য রানওয়ের কথা মনে পড়ছিল। এক বহুরুপী কালী যেন দাঁড়িয়ে ছিলেন বাংলার সিনেমার ভাগ্য নির্ধারণে। সীতাকে হারিয়ে যেতে হয়েছিল। হারিয়ে দিয়েছিলেন ঋত্বিক নিজেকেও। সত্যিই কি তাই? ভাবি আজ বেঁচে থাকলে কী করতেন? আমাদের দিকে তাকিয়ে কী বলতেন তিনি?
আকাশ গঙ্গার স্রোত ধরে যিনি পথ চলতে চেয়েছিলেন আজ তাঁর জন্মদিন। আমরা তাঁকে না, সত্যিই কিছু ফিরিয়ে দিতে পারিনি। তিনি চানওনি। তোয়াক্কাও করেননি। তাই আজও শুধু বাংলা নয় ভারতীয় চলচ্চিত্রে তিনি নীলকণ্ঠ।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন