রবি স্যার
জ্ঞান হবার পর থেকে যে লোকটা চারপাশে চরকি পাক খেয়ে বেড়াতো পাড়ার লোকে তাকে চিনতো ‘রবিস্যার’ বলে। আমার আর দাদার কাছে তিনি ছিলেন 'বাবা'। খুব কম কথা বলা হাসি খুশি মানুষটার ঝুলিতে ছিল অনেক অনেক গল্প। তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে লাফিয়ে তার হাত ধরে বাজারে গেলে, রেশনের দোকানে লাইন দিলে সেইসব গল্প কিছু কিছু শোনা যায়। কত লোক যে তার সঙ্গে দেখা করতে আসে। রাস্তায় বেরোলে কত কত লোক যে ডেকে কথা বলতে চায়, প্রনাম করে। সে আর হিসেব নিকেষ করা যায় না আজকের দিনে।
শত শত উনুনের ধোঁওয়া মাখা আর জুটমিলের ভোঁ শোনা আমাদের সেই মফস্বলে কিন্ডারগার্ডেন বলে কোনো বস্তু আশির দশকের গোড়ায় ছিল না। কাজেই দাদা ইস্কুলে যাচ্ছে অথচ আমি যাচ্ছি না কেন বায়না জুড়লেই বাবার হাত ধরে টিঙটিঙে একটা ব্যাগ নিয়ে স্কুলে যাওয়া যেত সহজেই। রাস্তার ওপারেই তো স্কুল। কিন্তু তারও কয়েক বছর পর হাতেখড়ি হলে, পড়াশুনোর গাম্ভীর্য আর জিভ ভ্যাঙচানো বুঝতে পেরে বেবাক বোকা বনে যাওয়া আমি যখন ঠিক করলাম এই পড়াশুনোর চেয়ে আর খারাপ কিছু ইহ জগতে থাকতে পারে না। কাজেই এখানেই ইতি গজ। ততদিনে ঢের দেরী হয়ে গেছে। সহজ পাঠ, কিশলয়, দশের ঘরের নামতা ঝাঁপিয়ে পড়েছে জীবনে। ততদিনে যেন নিজেও কানাই মাষ্টার হয়ে পড়েছি। পোড়ো মোর বেড়াল ছানাটির মতো। সামাজিক অনুশাসনও চলে এসেছে রীতিমতো। নিজের বাবা যদি পেশায় শিক্ষক হন তাহলে তার যে কি মারাত্মক চাপ জীবনে বইতে থাকে তা যাঁরা এর অংশীদার তাঁরা হাড়ে হাড়ে নিশ্চই টের পেয়েছেন। এবং এখনও পাচ্ছেন। মাষ্টারের ছেলেই যে আসলে মা সরস্বতীর ভাঁড়ারে অশ্বডিম্ব পেয়ে থাকেন তা যেন নিয়তির কানে বাঁধা সুরের মতোই বীনার ঝংকারে বাজতে থাকে নিয়মের একটু এদিক ওদিক হলেই। বাড়ির লোকের যত না বেশি চিন্তা থাকে তারচেয়ে থাকে পাড়া প্রতিবেশি আত্মীয় স্বজনের। আর দাদা যদি হয় ক্লাসের ফাস্টবয় তাহলে ভাইয়ের কপালে জোটে ডবল টিপ্পনী। যার ভাগীদার হয়ে সারা জীবন মা সরস্বতীকে গালমন্দ পাড়া ছাড়া আর কোন উপায় থাকে না।
মাষ্টারের ছেলে গালাগালি, মারামারি, লুকিয়ে টিভি দেখা নৈব নৈব চ। কান ঢাকা দেওয়া চুল? ছিঃ ছিঃ ছিঃ। ‘রাম তেরি গঙ্গা মইলি’? ‘শত্রু’? ‘হোপ এইট্টি সিক্স’? ‘ডিস্কো ডান্সার’? খবরদার! দুপুর বেলার স্কুল কেটে নুন শো? তৌবা তৌবা। চারপাশে ছড়ানো পাপের ফাঁদে পা দিলেই পাড়ায়, মহল্লায়, স্কুলে, টিউশানিতে আর রেহাই থাকবে না। বাড়িতে ঘুরে বেড়ানো সবার প্রিয় মাষ্টার মশাইয়ের মাথা কাটা যাবে। আর বাবার? কোনোদিন জিজ্ঞেস করিনি। ইচ্ছেও করেনি লোকটা কষ্ট পাক কোনো দিন।
কাজেই শিক্ষক দিবস বলতেই আমার যে মানুষটার কথা মনে আসে তিনি হলেন আমার বাবা। যিনি কোনোদিন শিক্ষকের অছিলায় আমাদের কোনো কিছু বোঝাতে আসেননি। চাপিয়ে দেননি। অথচ আমার আর দাদার কাছে বাবা রয়ে গেছেন এক্কেবারে না ভয় পাওয়া একটা মানুষ হিসেবে। যাকে সব কথা বলা যায়। এমনকি মাকে যেটা বলতে পারছি না সেটাও। বরং মাকে সমঝে চলতে হয়। ভয় পেতে হয়। পিটুনিটাও মাই বেশি দেয়। অথচ বাবা কোনোদিন একটা চড়ও মারে না আমাকে আর দাদাকে। না পড়লে বলে "কী করে সিনেমা নিয়ে পড়বি তুই? এতো রাশি রাশি পড়া?" ঘুম থেকে তুলে ন্যাশানাল নেটওয়ার্কে গভীর রাতে সম্প্রচারিত হওয়া 'নিম অন্নপূর্ণা' দেখায়। খোঁজ রাখে সিনে ক্লাবের। আকালের সন্ধানের চারটে হলুদ রঙের টিকিট আসে বাড়িতে। ফিল্ম নিয়ে পড়বো শুনে যখন পাড়ার লোকেরা আত্মীয় স্বজন হাসাহাসি করে বাবাই তখন পাশে দাঁড়ায়। “ওকে ওর মতো থাকতে দাও” বলে।
কোনো কালেই পড়াশুনোয় ভালো ছিলাম না। বলা যায় ইচ্ছে করেনি পড়াশুনো করতে। পড়তে বসলেই রাসবাড়ির গঙ্গার ঘাট হাতছানি দিতো। জি টি রোডের ধারে অমরদার দোকানে আলু খেতে আসা ভোলা ষাঁড় যেন জাবর কাটতে কাটতে বলতো "এতো পড়ে কি হবে টুকনু? তার চেয়ে চল গঙ্গায় গিয়ে পয়সা কুড়োই। লুকোচুরি খেলি"। পুজোর ছুটি পড়ার দিন লম্বা লাইন হতো স্যারেদের নমস্কার করতে। আমি কোনোদিন বাবাকে নমস্কার করার লাইনে দাঁড়ায়নি। "বাবাকে কেউ আবার প্রনাম করে নাকি?" এই ছিল মুখের লব্জ। প্রাথমিক স্কুল ছেড়ে হাইস্কুল, হাইস্কুল ছেড়ে কলেজ, কলেজ ছেড়ে বিশ্ববিদ্যালয়। কত ভালোলাগার, ভালোবাসার, জীবনকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার, নতুন পথ দেখানোর শিক্ষককে পেয়েছি। যাঁরা পালটে দিয়েছেন জীবনের মানে। কর্মক্ষেত্রে গিয়ে পেয়েছি কত ভালো বন্ধু সহকর্মী। যাঁরা শিখিয়ে পড়িয়ে ভাবতে সাহায্য করেছেন অনেক। বাজারের মাসি চিনতে শিখিয়েছেন নানান শাক, সবজি। সুন্দরবনের সেই বয়স্ক বনরক্ষী বলেছেন, “বাঘ, হাতি, কুমীরকে তুই তোকারি কিসের? ওদেরও কি সম্মান নেই? কালু খাঁ... বাবা বসন্ত রায়...মহাকাল...ইজ্জত দিয়ে কথা বলতে শেখো বাবা”। কিম্বা বাঁকুড়ার জঙ্গলবর্তী সেই কৃষক যিনি দেখেই বলে দিতেন কোন মেঘে বৃষ্টি আসবে। কোন মেঘে না। এইসব অসংখ্য শিক্ষকের মধ্যে কোথাও আমার বাবা টিমটিম করে মাটির প্রদীপের মতো জ্বলে। কবে এক অগ্রাহায়ণের ভোরে চলে যাওয়ার পরেও গনগনে ইলেকট্রিক চুল্লির সামনে দাঁড়িয়েও যাকে আমি প্রনাম করিনি। "নিজের বাবাকে কেউ প্রনাম করে নাকি? ভালোবাসতে হয়" বলে। সেই রবি স্যার ফ্রি বছর ফিরে আসেন শিক্ষক দিবসে। আর বাবা স্যার রোজ থাকেন সঙ্গে। যিনি ছাড়া আমি দাদা মা কেউই এক বিরাট আখ্যানের অংশীদার হতে পারতাম না।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন