বাড়ির নাম কণিকা

এক

আমি তখনও সেইরকম ভাবে চিনি না তাঁকে। আমি তখনও জানি না গোটা একমাস ধরে আমার ওপর দিয়ে এক ঝোড়ো হাওয়া বইবে অবিরত। রাজাকারদের ফাঁসির দাবীতে গোটা শহরকে উত্তাল হতে দেখবো নিজের চোখের সামনে সেটাও তখন অজানা। একজন কবি আমাকে নিয়ে রাতের আঁধারে মশালের আলোয় শাহবাগে নিয়ে হাঁটাবেন সেটাও তো যেন অনেকটা স্বপ্নের মতো। গিয়েছি কার্যসূত্রে। গিয়েছি চিত্রনাট্যের কর্মশালায়। কিন্তু জ্বলন্ত এক সময়ের ছবিতে যেন হাত শেঁকে নিচ্ছি বারবার। তখনও আমার মোবাইলে ছবি ওঠে না। কিন্তু যে ছবি গুলো চারিদিকে টাঙানো, রাস্তা জোড়া যে ফ্রেস্কো চোখের সামনে উজাড় করে রাখা আছে তাকে অস্বীকার করবো কী করে? লাঠি হাতে মশাল নিয়ে ছেলেরা পাহাড়া দিচ্ছে তাদের ধর্নার জায়গা। রাস্তার কোন একটা দিকে শাহবাগের মোড়ে দেখানো হচ্ছে ‘মুক্তির গান’। সমবেত ভাবে দূরে জটলা পাকিয়ে গান গাইছে কেউ কেউ। বনবন করে ঘুরছে সেই গান আকাশে, বাতাসে। একটা স্বাধীনতা যেন আবার নতুন করে ফিরে এসেছে। এবারের ঢাকায় আসাটা আমাকে যেমন বড় ঝক্কির মধ্যে ফেলেছে। তেমনই চারপাশটাকে দেখতে পাচ্ছি দুচোখ ভরে। খবরের কাগজেই পড়ছিলাম আন্দোলন চলছে। দু একটা বিচ্ছিন্ন ঘটনা ঘটছে। এদিককার ইমিগ্রেশান অফিসার সেটা মনে করিয়ে আমার দিকে কয়েক মুহূর্ত তাকিয়ে থাকলেন। “ভেবে দেখুন”। তাঁর হাতে স্ট্যাম্প। সেটা পাসপোর্টের ভিসার ওপরে পড়ার অপেক্ষা। লাগেজ চেকিং হয়ে গেছে। হাতে জানলার ধারের টিকিট। বিমান এক ঘন্টা লেট। একটা বিরাট পরীক্ষার সামনে আমি।

“যেতে হবে। কাজ আছে। অনেকে অপেক্ষা করবেন। অনেক দিন আগে থেকে সব ঠিক হয়ে আছে।” বিড়বিড় করে বলি।

“সেটা এখন হবে তো? কাজ?” অফিসার আমার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে। এঁদের চোখ দেখে বোঝা যায় না ঠিক কি ভাবছেন।

“না হলে টিকিট পাঠাবেন কেন? আমার পক্ষে নিজে যাওয়া সম্ভব নয়। আর ওদের নিমন্ত্রণ চিঠিও তো এই তো...”। এগিয়ে দিই চিঠিটা। অফিসার দেখেন।

“বেস্ট অব লাক”। স্ট্যাম্প পড়ে পাসপোর্টে। ইমিগ্রেশান পার করলে ঝেঁপে বৃষ্টি নামে। কাচের জানলা দিয়ে দেখতে পাই এয়ার ইন্ডিয়ার বিমান ভিজছে একা দাঁড়িয়ে রানওয়েতে।

হজরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে নেমে বুঝতে পারি চারপাশের পরিস্থিতি ঠিক আগের মাসের মতো নয়। বিমানের যারা যাত্রী ছিলেন ঢাকার অধিবাসী তাদের কাছে ফোন আসতে থাকে শহরে কার্ফু জারী হবে। কোন একজন রাজাকারের ফাঁসি কার্যকর হবে হয়তো আজই। চোখে মুখে উৎকন্ঠা নিয়ে সবাই গাড়িকে ফোন করার চেষ্টা করে। নিজের ব্যাগ নিয়ে আমার বেরোতে সময় যায় আরও এক ঘন্টা। বেশ রাত। ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে চিন্তিত মুখে অপেক্ষা করছেন। একটু বেশি রাতেই পৌঁছে যাই নির্দিষ্ট গন্তব্যে। কিছুক্ষণের মধ্যেই চলে আসেন কবি পারভেজ। খুশিতে ঝলমল করছে আজ তার মুখ। “যাবেন না কি কল্লোল আজ একবার শাহবাগে? রিক্সা দাঁড় করিয়ে এসেছি।” বড় বড় মশাল। তার মাঝে হাসিমুখের মাথায় ঘোমটা দেওয়া এক বয়স্ক নারী। শহীদ জননী জাহানারা ইমাম যেন জ্বলজ্বল করছেন ওই মধ্যরাতে। কারা যেন দূরে কোথায় ছোট্ট জমায়েতের মধ্যে গান ধরেছে “আমার মরা গাঙে বান এসেছে জয় মা বলে ভাসা তরী...”। বুঝতে পারছিলাম আমি আগে যেমনটা ছিলাম তেমনটা আর থাকতে পারছি না। একই ভূখন্ডের ওপরে দাঁড়িয়ে আমার টালমাটাল হচ্ছে পা। কাঁপছে ধরনী। কোন একটা বই যেন সুদূরের হাতছানি দিয়ে অনেক দিন পরে আমাকে ডাকছে।

 

দুই

একটা বই এর আগে কখনো একটা গোটা মাস কেড়ে নিয়ে এমন ভাবে মুখের দিকে তাকিয়ে থাকেনি। একটা বই আগে কোনোদিন এমন ভাবে বলেনি, বাংলার হরফে যা পড়লে বাংলা সাহিত্যে শুধু তা প্রথম নয় একেবারেই বিরল। শুধু বাংলা সাহিত্যে কেন বিশ্বের সাহিত্যের ভান্ডারে এই বই খুঁজে বের করা দুঃসাধ্য। এক মা লিখছেন যুদ্ধের দিনলিপি। এক মা লিখছেন এমন এক নিদারুণ সময়ের কথা, ব্যাথার কথা, আনন্দের কথা যা পড়তে বসলে আজ এতোদিন পরেও স্থির থাকতে পারাটা দুষ্কর।

“আপনি ‘একাত্তরের দিন গুলি’র কথা বলছেন না দাদা?” আমার হাতে মেলা বইয়ের আধখোলা অংশ। আমার পাশে হীরক। স্ব-প্রশ্নে তাকিয়ে আমার দিকেই। তারপাশে ফাহমিদ। আর একদিকে নাসিমুল। উলটো দিকে সানি, একটু দূরে জুনায়েদ। রাজীব আরো অনেকটা দূরে চেয়ার নিয়ে ঘুরে বসেছে আমি কি বলছি শুনবে বলে। এনা এই মুহূর্তে লেখা থামালো। বাইরে শ্রাবণের বৃষ্টি। সকাল থেকে একটানা। অবসর ভবনের পাশেই আমাদের অফিসের ছোট্ট গলিটায় বেশ জল। চায়ের দোকানটা যেখানে আমরা চা খেতে খেতে কত কি যে আলোচনা করি সেটা আধখোলা। চোখ বন্ধ করলে সেদিনটা আমি আজও যেন স্পষ্ট দেখতে পাই। এসি মেশিনের টানা এক ঘিরঘিরে শব্দ। হাত পা ঠান্ডা হয়ে আসা জলীয় আস্তরণ। আর সেইসবের মধ্যে আমরা যেন উপলব্ধি করি, আমাদের অফিসে, চিত্রনাট্যের কর্মশালার কোথাও কোনো এক নিভৃত কোণে, লেখার সরঞ্জামের পাশে, ফাহমিদের ছড়িয়ে ছিটিয়ে রাখা টেবিলে কিম্বা, লীনার মহা ব্যাস্ততার মধ্যেও এক মা অনেকক্ষণ থেকেই শুধু না, বেশ কয়েকদিন ধরেই আমাদের সাথে আছেন। থাকছেন। কথা বলছেন। আমরা অবাক হয়ে শুনছি তার কথা।  কখোনো চোখ ভিজে আসছে নোনা জলে। একটা বই গড়িয়ে গিয়ে পড়ছে আরো একটা বইতে। বৃষ্টি মাথায় নিয়ে বই দিয়ে যাচ্ছে রকমারি থেকে আসা সেই ছোট্ট ছেলেটা। দুপুরের ফ্রাইড রাইস আর চিকেন জুড়িয়ে যাচ্ছে টিফিন কৌটোতে। পিউয়ের আনা পিঠে হাতে হাতে ফুরিয়ে যাচ্ছে। হঠাৎ ডাক্তার সাজিয়া তাঁর মেডিকেল ডিউটি শেষ করে চলে এলে আড্ডা, কথায় থাকছেন সেই মা। দুপুরের মতো বিকেল গড়িয়ে শেষ হচ্ছে বর্ষার ক্ষীণ আলো। আমরা ঠিক করছি তাহলে কি আজই বেরিয়ে যাই? গুনগুন করে উঠছে ঘরটা। এলিফ্যান্ট রোড তো কাছেই। তবু বৃষ্টি। জ্যামজট। অনিশ্চয়তা। চায়ের কাপে ধোঁওয়া ওঠা বর্ষার স্যাঁতসেঁতে আবহাওয়া। যাওয়া  হয় না আমাদের। বৃষ্টি আরো বাড়ে। আমরা কোনো মতে যে যার মতো বাসায় ফেরার চেষ্টা করি। জুনায়েদ বলে দেয়, “আগামীকাল ঠিক যাবো দাদা। বৃহস্পতিবার তো। শুক্রবার অফিস ছুটি। কাজেই আর কোনো চিন্তা নেই। ঠিক যাবো কাল”। ছাতাহীন জুনায়েদ ঝিরঝিরে বৃষ্টিতে মিশে যায় ধানমন্ডির সন্ধ্যাকালীন জ্যামে।


“হঠাৎ ভয়ানক একাকী নিঃসঙ্গ মনে হল নিজেকে। মুহূর্তেই মন চলে গেল বিশ-ত্রিশ বছর আগেকার স্মৃতিতে। বাবা, মা, ভাই-বোন, স্বামী, সন্তান-সকলের মুখ যেন মনের পর্দার সামনে দিয়ে ভেসে ভেসে গেল। বাবা মারা গেছেন ১৯৬৬ সালে, হার্ট অ্যাটাকে। স্বামী ও জ্যেষ্ঠ সন্তান হারিয়েছি একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ চলাকালীন। মা গেলেন ক্যান্সারে ১৯৭২ সালের সেপ্টেম্বরে। মায়ের ক্যান্সার হবে, একথা কেউ অতিবড় দুঃস্বপ্নেও ভাবেতে পারিনি। গলব্লাডার অপারেশনের পর মায়ের স্বাস্থ্য ভালো হয়ে যায়। তাহলে মাত্র তিন বছরের ব্যবধানে মায়ের কোলোনে কেন ক্যান্সার বাসা বাঁধল ? ডাক্তাররা বলেন ক্যান্সার কেন হয়, কিসে হয়, এখোনো বের করা সম্ভব হয়নি। তবে তারা অনেক গুলো কারণকে সন্দেহ করেন। তার মধ্যে কয়েকটা হল নিঃসঙ্গতা, নিরাপত্তাহীনতা এবং অসহনীয় তীব্র শোক ও দুঃখ। তা মা জীবনে কম তীব্র শোক পাননি। ১৯৬৪ সালে আমার ভাই চাঁদ মাত্র ত্রিশ বছর বয়সে অ্যাক্সিডেন্টে মারা যায়। ...মা মানসিক ভাবে আমার স্বামী শরীফ এবং বড় ছেলে রুমীর ওপর খুব বেশী নির্ভরশীল হয়ে পড়েন। সেই শরীফ আর রুমী যখন হারিয়ে গেল যুদ্ধের ডামাডোলে- সেই আঘাত আর তিনি সহ্য করতে পারলেন না। আমিও কি মায়ের পথেই চলেছি?” (ক্যান্সারের সাথে বসবাস/জাহানারা ইমাম সমগ্র/পৃষ্ঠা-৪০৪-৪০৫) 

নিজের জীবনে সবচেয়ে বড় অপারেশানের সামনে দাঁড়িয়ে তিনি লিখেছিলেন এই কথাগুলো। ভয়ে? না সেটা কখোনোই নয়। এই মা যতটা ভয় পান তার থেকে বেশি এগিয়ে যান নির্ভয়ের সেই রাস্তায়। জীবনের তীব্র দহন, শোকে তিনি আরো মরিয়া হয়ে উঠেছিলেন অন্য কাজের সৃষ্টিশীল উল্লাসে। তাঁকে লিখতে হবে ‘একাত্তরের দিনলিপি’। ক্যান্সারের সাথে সহবাসের আর একটু পর থেকেই তার সব কিছু অসুস্থতা ছাড়িয়ে যে দিনগুলো এগোবে এক মহৎ কাজের দিকে। এক মা লিখে চলেছেন তাঁর ছেলেকে হারিয়ে ফেলার গল্প। যে মা বলছেন তাঁর বড় প্রিয় অন্দরের কথা। স্বাধীনতার কথা। মুক্তির যুদ্ধে তাঁর ছেলেদের বীরত্ত্বের কথা। যে বই প্রকাশিত হবার পর সাড়া পড়ে যাবে গোটা দেশে। শুধু তাঁর দেশ নয়। পাশের পশ্চিমবঙ্গেও। তারও অনেক দিন পর। অনেক টানা পোড়েনের মধ্যে দিয়ে, অনেক আলোকবর্তিকা পেরিয়ে আমি যখন বাংলাদেশের মাটিতে পা দেবো, হঠাৎই আমার হাতে এসে পৌঁছবে এই বই। ততদিনে বইয়ের কভারে উজ্জ্বল অক্ষরে প্রকাশিত একটা ফলক “ রজত জয়ন্তী সংস্করণ”। 


সারা রাত ঘুম হয় না আমার। আসলেই আমরা একটা বাড়ি খুঁজতে চলেছি। আমরা চলেছি সেই মায়ের বাড়ি যে মা একদিন বলেছিলেন সেইসব মানুষদের শাস্তি চাই যারা দেশের স্বাধীনতার যুদ্ধে শত্রুতা করেছে। যারা ছিনিয়ে নিয়েছে অসংখ্য দেশবাসীর প্রাণ। যে মা একাত্তরের যুদ্ধে হারিয়েছেন তাঁর বড় ছেলে আর স্বামীকে। যে মা তিলেতিলে জমিয়ে রেখেছেন এক বুক দুঃখ দুই মলাটের বইতে ঢেলে দেবেন বলে। “ ডিসেম্বরের তিন তারিখে গাজী আমার বাসায় এসে বললো, ‘আপনার একটা ডায়রী আছে না একাত্তর সালের? ১ থেকে ১৬ ডিসেম্বর পর্যন্ত দুটো লেখা লিখে দিন না দিনিলিপির আকারে। সন্ধানীতে দুই সংখ্যায় ছাপবো।’ হ্যাঁ, একাত্তর সালের লেখা ডায়রীটা এখনও আছে আমার কাছে। মাঝে মাঝে ভেবেছি রুমীর কথা লিখবো। কিন্তু লিখবার আগে পুরো ডায়রীটা পড়ে নিতে গিয়ে শোকে দুঃখে কান্নায় ভেঙে পড়েছি। লেখা আর হয়ে ওঠে নি। এখন এই বছরে হঠাৎ মনের মধ্যে লেখার জোয়ার এসেছে। তাই গাজীর প্রস্তাবটা লুফে নিলাম। সচিত্র সন্ধানীর একটা সংখ্যা বেরোবে ৯ ডিসেম্বর, পরবর্তী সংখ্যা ১৬ ডিসেম্বর। আজ ৩...। ৬ তারিখের মধ্যে কপি দিতে হবে। পারবো তো? পারলাম"(ক্যান্সারের সাথে বসবাস/ জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা-৪২২)

বৃষ্টি ধরে আসে না। কাঁচের জানলায় বৃষ্টির ছাঁট পাঁচতালায় আমার ছোট্ট কামরায় বিন্দু বিন্দু জলের আবরণ তৈরী করে। গভীর রাতে ঘুমোতে গিয়ে মনে মনে বলি “বাড়ির নাম কণিকা”। যে বাড়িতে খাটের পাশে রাখা এখোনো অনেক গুলো রবীন্দ্রসংগীতের ক্যাসেট। বিছনার চাদর পরিপাটি করে পাতা। মনে হয় এক্ষুনি কেউ গুছিয়ে রেখেছে। পরনের শাড়ি, লেখার খাতা, পড়ার বই সব যেমন ছিল তেমনটাই। এই বাড়িতে, এই পাড়ায়, এই দেশে দীর্ঘ প্রবাস জীবনের পর অসুস্থ অপটু শরীরে ফিরতে চাইছেন এক মা। আর এই বাড়ি তো শুধু বাড়ি নয়, স্বাধীনতার আর এক জ্বলন্ত ইতিহাস। “ওদের কী করে বোঝাবো এত সুন্দর, পরিষ্কার, ছবির মতো দেশে থাকতে থাকতে হাঁপিয়ে উঠেছি। এখানে কোলাহল নেই, বাচ্চাকাচ্চার চেঁচামেচি নেই, রাস্তায় ভিড় নেই, গলিতে ফেরিওয়ালার হাঁক নেই, দরজায় ফকিরের ঘ্যানর ঘ্যানর নেই। এখানকার পড়শিরা যখন তখন হুট করে বিনা টেলিফোনে এসে পড়ে না, পথ হাঁটতে গেলে প্রতি পদে রিক্সা এসে পথ অবরোধ করে না। ঢাকার বাড়ির চারপাশে পাড়ার বাচ্চাদের ছোটাছুটি চিল্লাচিল্লির জ্বালায় কোনোদিন দুপুরে ঘুমোতে পারিনি, অসময়ে মেহমান আসার জ্বালায় কতদিন কত কাজ বাকি থেকেছে, ফেরিওয়ালা আর ফকিরের হাঁকের জ্বালায় অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছি;এখন এই জ্বালাগুলোই আমাকে চুম্বকের মতো টানছে। ওইগুলির অভাবে এখানে এই শান্তিময়, সৌন্দর্যময়, সভ্যভদ্র জগতে আমার প্রাণ খাবি খাচ্ছে। ...আমারো দরকার খুব সুন্দর কোলাহল। মনোমুগ্ধকর হৈ চৈ।  তার অভাবে আমার এই দীর্ঘ দিবস, দীর্ঘ রজনী আর কাটে না।”(ক্যানসারের সাথে বসবাস/জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা-৪১৪-৪১৫) 


কেন আমি কণিকা যেতে চাইছি? আমি কি খুঁজে আনতে চাইছি সেই মাকে যে একদিন তার বড় ছেলের গেরিলা হবার প্রস্তুতি লিখেছিলেন? যে বাড়িতে, গলিতে অনেকটা সময়ের ইতিহাস ছায়া ফেলে আছে? নাকি সেই পূণ্য পরিবারের উঠোনে একবার দাঁড়াতে চাইছি যারা দেশের বড় দুর্যোগের দিনেও এগিয়ে দিয়েছেন নিজের খুব তরতাজা প্রাণের আহুতিকে? কিন্তু গোটা দেশ খুঁজলে এমন আদর্শ তো অনেক পাওয়া যাবে। হ্যাঁ তা গেছেও। শহীদ জননীর অন্যান্য লেখায় তার প্রতিচ্ছবি স্পষ্ট। ইতিহাসও তার সাক্ষী।  হয়তো আমি কোনো অন্দরের গল্প শুনতে চাইছি। আমি এক মায়ের কথা শুনতে চাইছি। যে মা লিখে যাচ্ছেন তাঁর নিছক আটপৌঢ়ে দিনলিপি ইতিহাসের পাতায়। তাঁর ঘরকন্নায় ধরা পড়ছে দেশের, সমকালের, বিচ্ছেদের এক অন্যরকম রঙ। যে রঙে আরো অনেকদিন পর আমি আরো এক মাকে খুঁজে পাবো। আনিসুল হকের দুই মলাটের লাল প্রচ্ছদের ‘মা’ জ্যান্ত মা হয়ে উঠবে। অনেক রাতে ঘুম থেকে ঠেলে তুলে দেবে। আমাকে ভাবাবে সত্যিই শহীদ আজাদের বাড়িটা কোথায়? গভীর রাতে হীরককে ফোন করলে হীরক বলবে খুঁজে দেবে আজাদের বাড়ি। কিন্তু সে তো অনেক পরের কথা। এখন এই মুহূর্তে একজন মা যখন লিখছেন তাঁর বড় ছেলের গেরিলা হবার প্রস্তুতি। একজন স্ত্রী যখন লিখছেন শিবপুর ইঞ্জিনিয়ারিং কলেজের সবচেয়ে মেধাবী ছাত্র, সরোদ বাজাতে পটু, দেশের জন্য নিবেদিত প্রাণ স্বল্পভাষী স্বামীর গুমড়ে গুমড়ে মরার কষ্ট। একজন পুত্রবধূ যখন জানতে দিতে চাইছেন না তাঁর বৃদ্ধ অন্ধ শ্বশুরকে শহরে যুদ্ধের অবরুদ্ধ অবস্থা। তখন সেই মা, সেই স্ত্রী, সেই পুত্রবধূ কোথাও যেন বইটার সাথে জীবন্ত হয়ে যাচ্ছেন। আমরা হাঁটছি ফাস্ট পার্সন ন্যারেশানে।

এক মহিলা এই বইটির কেন্দ্রবিন্দুতে কাহিনীর, আখ্যানের, হৃদয় বিদারক যে সত্য ঘটনার প্রাণ প্রদীপ জ্বালান তা চিরতরে বাংলা সাহিত্যের এক সেরা সম্মানের অংশীদার করে তোলে পাঠককে। এবং তার সাথে কোথাও প্রজ্জ্বলিত হয় তার নিজের বৌদ্ধিক এবং চিন্তন জগতের এক অন্য ছায়াছবি। ‘একাত্তরের দিনগুলি’ বাংলা সাহিত্যে শুধু অগ্রজ নয়, বিরলতম এক সংযোজন বলে আমি নিজে বিশ্বাস করি। বাংলার যুদ্ধ উপন্যাস খুবই কম। নেহাতই হাতে গোনা। বাঙালী যুদ্ধে যাবার সাহস দেখায়নি স্বাধীনতার সময়। এটা লেখার পরেই যাঁরা আমাকে তেড়ে মারতে আসতে চাইবেন তাঁদের বলি যে কতিপয় বাঙালী সাহস দেখিয়েছিল তাদের হয় নির্মম ভাবে মারা হয়েছে। চোর, স্বদেশী ডাকাত, টেররিস্ট বলে উৎখাত করা হয়েছে। সহিংস্রতার বদলে ইংরেজ প্রভুদের গালে চুমু খেতে বলা হয়েছে। কিম্বা দেশের বাইরে থেকে যুদ্ধ করতে করতে এগিয়ে আসা এমন এক বাঙালী বীর নায়ককে এমন এক উড়ো জাহাজে উঠিয়ে দেওয়া হয়েছে যে উড়ো জাহাজ আর কোনোদিন ভারতের দিকে একবারের জন্যও ফিরে আসতে পারেনি। কিম্বা তাদের পাঠানো হয়েছে দ্বীপান্তরে। গায়ের মাংস খুবলে এমন অত্যাচার করেছে প্রভু ইংরেজ সরকার তাঁরা আর মাথা তুলে দাঁড়াতে পারেননি। আর যাঁরা পেরেছিলেন তাঁরা এসে আবার অভ্যুত্থান ঘটিয়ে ছিলেন। অনেক আগেই বাঙালীকে কেরানী করে রাখা হয়েছিল। এবার স্বাধীনতার প্রাক্কালে দেশটা ভাগ করে তাদের মেরুদন্ডটা ভেঙে ফেলা হল। কিন্তু যুদ্ধটা একটা সময় বাঙালীকে করতেই হলো। তার মাতৃভাষার জন্য। তার মাথা উঁচু করে দাঁড়াবার জন্য। এবার সত্যি সারা বিশ্ব দেখলো একটা ভাষার জন্য একটা গোটা জাত কীরকম মরিয়া হয়ে ওঠে। এবার বিশ্ব শুনলো ভাষার জন্য একটা রাষ্ট্রের দাবী। এবার বিশ্ব জানলো বাঙালীরাও লড়তে পারে।

সবে সন্ধ্যে নামছে আমরা কয়েকজন ধানমন্ডি থেকে রিক্সা নিয়ে এলিফেন্ট রোডের পেট্রোল পাম্পের সামনে গিয়ে দাঁড়িয়েছি। সানি আর ফাহমিদ বয়সে সবার ছোট। তারা  সামনের গলিটা দিয়ে ঘুরে এসে জানালো, “দাদা এখানে তো বলছে কেউ নাম শোনেনি। চেনে না।” আমি একটু এগিয়ে গেলাম গলিটা দিয়ে। হ্যাঁ এটা তো একটা কানা গলি। বাড়িটা ছিল ঠিক কানা গলির শেষ সীমানায়। গাড়ি শেষ পর্যন্ত ঢুকতো না। গাড়ি ঘুরিয়ে আনা হতো। ফাহমিদ বললো “কী পরীক্ষায় ফেললেন বলুন তো?” আমি ধমকাই দাঁড়া। হীরক আর জুনায়েদ এক্ষুনি এসে পড়বে। আমরা ঠিক খুঁজে পাবো রুমীর বাড়ি। একদম ছটফট করিস না। পাশ থেকে এনা বললো “ চলুন দাদা, চা খাই”। আমাদের চা খাওয়া শেষ হতে না হতেই চলে এলো হীরক আর জুনায়েদ। শহরের এমন এক কেন্দ্রে নিজেদের বাড়ির অবস্থান, এমন এক সমাজের পরিসরে তাঁদের বসবাস সেখানে সেই সময়ের এমন কোনো গুণীজন ছিলেন না যাদের আসা যাওয়া হয়নি। একটা ভাষার জন্য একটা দেশকে নতুন জন্ম দিতে যে মা হারালেন চিরকালের জন্য তার ছেলেকে, স্বামীকে, সেই মা যখন অনেক দিন পর ফিরে দেখেন তাঁর ছেঁড়া পাতার ডায়রী তখন কান্না চেপে রাখতে পারেন না। কারণ ততদিনে তাঁর দেহে বাসা বেঁধেছে মারণ ক্যানসার। কিন্তু তিনি তো মা। যাকে সবাই পরবর্তীকালে শহীদ জননী বলে এক ডাকে চিনবে। শ্রদ্ধা জানাবে। শাহবাগে লক্ষ জনস্রোতের মাঝে উড়বে তার হাসি মুখের নিশান। তিনি কি তাঁর রুমীর জন্য লিখবেন না? যে রুমীকে উনি মত দিতে পারছিলেন না যুদ্ধে যাবার জন্য? যে রুমী একদিন মায়ের দিকে তাকিয়ে বলেছিল, “আম্মা দেশের এই অবস্থায় তুমি যদি আমাকে জোর করে আমেরিকায় পাঠিয়ে দাও আমি হয়তো যাবো শেষ পর্যন্ত। কিন্তু তাহলে আমার বিবেক চিরকালের মতো অপরাধী করে রাখবে আমাকে। আমেরিকা থেকে হয়তো বড় ডিগ্রি নিয়ে এসে বড় ইঞ্জিনিয়ার হবো; কিন্তু বিবেকের ভ্রুকুটির সামনে কোনোদিনও মাথা উঁচু করে দাঁড়াতে পারবো না। তুমি কি তাই চাও আম্মা?” (একাত্তররে দিনলিপি/ জাহানারা ইমাম/ পৃষ্ঠা-৬৬)।

“না এই গলিটা না। ভুল আইছেন। এখানে কণিকা নামের কোনো বাড়ি নাই। আর থাকলেও তা ভাঙা হয়ে গেছে শহরের অনেক পুরোনো বাড়ির মতো”। এক দর্জির দোকানের কর্মী জানায় আমাদের। জুনায়েদ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে। একটু পরে অনেক আশা নিয়ে বলে “হতেই পারে না দাদা।আমরা ভুল গলিতে এসেছি। এমনটা কী করে হবে? নামে চিনতে পারছে না? শাহবাগের ঘা এখোনো শুকোয়নি...। অন্য আর একটা পেট্রোল পাম্প আছে। ফিরতি পথে। ওই দিকে যাই”। আমরা সবাই অনুসরণ করলাম জুনায়েদকে। সানি আর ফাহমিদ অস্থির। নাসিমূল বরাবরের মতো চুপ। রাজীব মাথা নীচু করে হাঁটছে। এনা আমার পাশে ঠিক কয়েক কদম পেছনে। হীরক এসে পাশে হাঁটতে থাকলো। বারবার বললো, “এতোদিন ঢাকা থাকা হয়ে গেল দাদা। কেন একবারও রুমীর বাড়ি দেখতে আসিনি এর আগে?” বর্ষার ভ্যাপসা সন্ধ্যে জনা কয়েকের মিছিল অগ্রাহ্য করলো। যারা সত্যি খুঁজছে কণিকা নামের বাড়িটা। যারা খুঁজছে সেই মাকে, যে মা একদিন অনেক মায়ের মতো তার ছেলে রুমীকে বলেছিলেন, “ ঠিক আছে তোর কথাই মেনে নিলাম। দিলাম তোকে দেশের জন্য কোরবানি করে। যা তুই যুদ্ধে যা।” 


যুদ্ধ এখন নেই। চারিদিকে শান্তি। আর সেই শান্তির সন্ধ্যে বলছে এই পথ দিয়ে কত দিন আগে রুমী হাঁটতো।এই পথ দিয়ে শেষবারের মতো শত্রুপক্ষ তাকে তার মায়ের সামনে থেকে নিয়ে গিয়েছিল।মায়ের ছেলে আর ঘরে ফিরে আসেনি। সন্ধ্যার গাঢ় হওয়ার, জমাট বাঁধার সব আয়োজনের মাঝেও আমাদের চলা থামে না। একটা গলির কাছে থমকে দাঁড়ায় জুনায়েদ। গলির দেওয়ালে একটা ছেঁড়া ফ্লেক্সে লেখা ‘শহীদ জননীর বাড়ি’। তীর চিহ্নটি ম্রিয়মান হলেও আমাদের মনে এক অন্য ধরনের উথালপাতাল। আর কয়েক মুহূর্তের মধ্যে আমরা কী সত্যিই কণিকার সামনে?


একটা সরু গলির আদ্যপান্ত কিছু ঠাহর করা যাচ্ছে না। একটুও বোঝা যাচ্ছে না আসলেই ঠিক কতগুলো বাড়ির পরে কণিকা? ঢোকার মুখে ডানহাত বরাবর যে কয়েকটা বাড়ি সেগুলো তো সব নতুন। আর বাঁ পাশের দিকে তো উঠে গেছে বড় বড় সব এ্যাপার্টমেন্ট! তাহলে কী লোকটা ভুল বললো আমাদের? আচ্ছা হীরক সামনের বাড়িটা কি? ওই তো একটা পুরোনো বাড়ি! জুনায়েদ এগিয়ে যায়। কিন্তু কী করে হবে? এটা তো কানাগলির সেই প্রান্তিক বাড়ি নয়। হীরক বলে “আমরা এগিয়ে যাই দাদা। নিশ্চই পাবো”। সানি বলে ওঠে। “হ...পাবে...ক্যামনে পাবে তুমি? দেখছো না চারিদিকে শুধু ফ্ল্যাট আর ফ্ল্যাট...। ইঁটের জঙ্গলে ভর্তি?” আমরা আশা ছাড়ি না। ক্ষীণতম আলোয়, সবে নামা এক বর্ষার সন্ধ্যায় এগিয়ে যাই গলির পথ ধরে। থমকে দাঁড়াই একটা বাড়ির সামনে। বলি, মাধবীলতায় মোড়া এই...এই বাড়িটা কী? কিন্তু সামনের বারান্দা কোথায়? কোথায় সেই গেট জোড়া বাগান? ফাহমিদ এগিয়ে এসে বলে “কলিংবেল দিই দাদা? যাই না... একবার বাজিয়েই দেখি?”


“আমার একাত্তরের দিনগুলি বইটি ইতিমধ্যে বিপুল জনপ্রিয়তা পেয়েছে এবং বইটি পড়ার পর অনেক পাঠকই বাড়ি খুঁজে বের করে খবর নিয়ে গেছে। তারা আমাকে দেখতে চায়। আমি দেশে নেই শুনে অপেক্ষা করেছে। আমি আসার পর তাদের অনেকেই একে-একে এসে দেখা করতে লাগলো। আমাকে তো চেনে না, আগে দেখেনি কখোনো, আমার ভাস্তের মেয়ে রিমা যখন দরজা খুলে তাদেরকে দোতলায় সোবার ঘরে নিয়ে আসে তারা প্রথমে আমাকে দেখে চিনতে পারে না। রিমা যখন বলে ইনিই। তখন তারা একটা ধাক্কা খায় মনের মধ্যে। সেটা তাদের চোখে মুখে ফুটে ওঠে। চমকে রুদ্ধশ্বাসে বলে ই-নি-ই। তখন মনে হয় ধরণী দ্বিধা হও। এরা এই বই পড়ে এক সনাতন বাঙালী মাকে দেখবে বলে আশা করে এসেছে। তার বদলে এই খাটো চুলের জিভ বের করা মহিলা! তারা মেলাতে পারে না। অবশ্য মিনিট খানেকের মধ্যে সামলে নেয়। তারপরে বসে সহজ কন্ঠে কথা বলতে শুরু করে। বলে কীভাবে, কত কষ্ট করে বাড়ি খুঁজে বের করেছে। বইতে লেখা আছে বাড়ি থেকে বেরিয়েই ডানদিকে দু-তিনটে গলি পেরিয়েই পলিক্লিনিক। তারা পলিক্লিনিক ধরে উলটো পথে হাঁটতে হাঁটতে এসে বহুজনকে জিজ্ঞেস করে করে বাড়ি খুঁজে বের করেছে। এসে শোনে আমি নেই। হতাশ হয়ে চলে গেছে, মাঝে মাঝে এসে বা ফোন করে জিজ্ঞেস করেছে কবে ফিরব? বেশিরভাগ বিশ্ববিদ্যালয়ের ছেলে মেয়েরা আসে। কারো কারো বিবাহিত বড় বোন আসে। বাড়ি থেকে মাছ বা পায়েস বা পুডিং বানিয়ে নিয়ে আসে। মন খুব ভালো হয়।” (ক্যান্সারের সাথে বসবাস/ জাহানারা ইমাম সমগ্র/ পৃষ্ঠা- ৪৫২-৪৫৩)

কলিংবেল বাজে। কেউ দরজা খোলে না। অন্ধকারে দাঁড়িয়ে আমরা জনাকয়েক। মাঝে মাঝে বর্ষার আকাশে বিদ্যুতের ঝিলিক। গুমোট গরম আর অস্বস্তি ঘিরে ধরছে আমাদের। আমার চারপাশে ঘিরে থাকা বয়সে ছোট অনেক লেখকবন্ধু। ওরা সবাই খুঁজে বেড়াচ্ছে কণিকা নামের বাড়িটাকে। যে বাড়িতে থাকতেন শহীদ জননী। যে বাড়িতে থাকতো রুমী। যে বাড়ি থেকে একদিন বেরিয়ে যাওয়ার পর আর ফিরে আসেনি সে। তাকে ফিরতে দেওয়া হয়নি। অথচ দেশ স্বাধীন হয়েছে। অনেক বছর কেটে গেছে। একাত্তরের দিনলিপি রজত জয়ন্তী সংস্করণ পেরিয়ে গেছে। একটা বাচ্চা মেয়ে দরজা খুলে দেয়। আমাদের, অতগুলো মানুষকে দেখে সে একটু থতমত। কাকে চাই প্রশ্নের জবাবে যখন সে জানতে পারলো আমরা কণিকা নামের একটা বাড়িকে চাই, তখন সে ঠোঁট উলটে জবাব দিল এমন নামের বাড়ি সে চেনে না। আচ্ছা তাহলে কি সে শহীদ জননীকে চেনে? মাথা নাড়লো ছোট্ট মেয়েটি, চেনেনা সে। আমাদের মাথার ওপর বর্ষার কালো মেঘ। পায়ের নীচে মাটি দুর্বিসহ হতাশায় কাঁপছে। ঠিক তখনি, মনে হয় অনেক অপেক্ষার চূড়ান্ত সীমা কাটিয়ে সেই প্রায় অন্ধকার গলির মধ্যে এক জন বয়স্ক দ্বাররক্ষী এগিয়ে এলেন আমাদের দিকে। “কারে খুঁজছেন আপনারা?” এগিয়ে যায় জুনায়েদ, “চাচা, সালাম, আমরা আসলে একটা বাড়ি খুঁজছি...তার নাম কণিকা...শহীদ জননী...”। কথা শেষ করতে পারে না জুনায়েদ। বয়স্ক ভদ্রলোক আঙুল তুলে আমাদের যে বাড়িটার দিকে দেখান, কোথাও যেন তার সাথে, বইয়ের বর্নণা, রুমীর গেরিলা যোদ্ধার প্রস্তুতি,  রজনী গন্ধার ফুলের টব, শেষ বিদায়বেলায় সেই রাতের ঘন কালো আঁধার তমশায় পাকিস্তানি মিলিটারী বুটের হাড়হিম করা শব্দ। রুমীর একবারও পেছন ফিরে না তাকানো। বারবার...বারবার...ফিরে আসে। আর সেই দোতলা ঘর...? যেখানে জমায়েত হত রুমী আর তার বন্ধুরা? যে ঘরের মাটি পুরু করে কার্পেটে মোড়া ছিল। যে ঘরে দিনের পর দিন হতো দেশকে স্বাধীন করার স্বপ্ন? যে ঘরে বসেই ছকা হয়েছিল ২৫ অগাস্ট রাতের একশান প্ল্যান। আমরা তাকালাম সবাই সমবেত ভাবে। আমরা তাকালাম ইতিহাসের দিকে। আমরা তাকালাম একটা বাড়ির দিকে। যার নাম কণিকা। কিন্তু সেখানে আমাদের যাবতীয় কৌতূহল, আমাদের যাবতীয় আকাঙ্খা, আমাদের যাবতীয় স্বপ্নকে ভেঙেচুরমার করে দাঁড়িয়ে আছে আকাশ ছোঁওয়া এক অট্টালিকা। নেই সেখানে কণিকা।


জানা গেল বেশ কয়েকবছর হল বাড়িটা ভাঙা পড়েছে।বিশ্বাস হলো না আমাদের। সামনে এগিয়ে নিয়ে গেলেন বয়স্ক সেই দ্বাররক্ষী। আমরা দেখলাম ফ্ল্যাটের নীচে শহীদ জননীর মুখ ফ্রেস্কোতে উজ্জ্বল। লেখা আছে কণিকা। কিন্তু এই কণিকা দেখার জন্যই কি আমি ছুটে গিয়েছিলাম? নাকি আমার লেখকবন্ধুরা আমাকে পথ চিনিয়ে নিয়ে গিয়েছিলেন? সবাই যখন চুপ। বাতাসে ভারী জলীয় শব্দ ছাড়া ওই অন্ধকার গলি থেকে কিছু উঠে আসছে না। ঠিক তখনই সেই রক্ষী শোনালেন এক আশার কথা। “আপনারা শনিবার আসেন। বেলা একটা নাগাদ। তখন দোতলার মিউজিয়ামে যেতে পারবেন। আম্মার কিছু কিছু জিনিস রাখা আছে”। আমরা ঠিক করলাম আমরা আবার ফিরে আসবো। “রুমীর পায়ের চিহ্ন ধরে”। খুব সুন্দর কথাটা আস্তে আস্তে বললো নাসিমুল। এখনি কি আবার বৃষ্টি পড়বে? নাকি আমাদের চোখের পাতা ভারী?

তিন

“রুমী একটা দীর্ঘশ্বাস ফেলে চুপ করে রইলো। জিম রিভস বেজে বেজে এক সময় থামলো। রুমী উঠে আর একটা রেকর্ড লাগালো, বললো আম্মা, গানটা শোনো মন দিয়ে। টম জোনসের গ্রীন গ্রীন গ্রাস গানটা বেজে উঠলো। বহুবার শোনা এ গান। রুমী এটা প্রায়ই বাজায়। শুনতে শুনতে সুরটা আমারও প্রায় মুখস্থ হয়ে গেছে, যদিও ইংরেজি গানের কথা বিশেষ বুঝি না। তিন মিনিটের গানটা শেষ হলে রুমী আস্তে আস্তে বললো, গানটার কথা শুনবে? এক ফাঁসীর আসামী তার সেলের ভেতর ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখছিল সে তার গ্রামের বাড়িতে ফিরে গেছে। সে ট্রেন থেকে নেমেই দেখে তার বাবা-মা আর প্রেয়সী মেরী তাকে নিতে এসেছে। সে দেখলো তার আজন্মের পুরোনো বাড়ি সেই একই রকম রয়ে গেছে। তার চারপাশ দিয়ে ঢেউ খেলে যাচ্ছে সবুজ সবুজ ঘাস। তার এতো ভালো লাগলো বাবা মাকে দেখে, তার প্রেয়সী মেরীকে দেখে।তার ভালো লাগল সবুজ সবুজ ঘাসে হাত রাখতে। তারপর সে হঠাৎ চমকে দেখে সে ধূসর পাথরের তৈরী চার দেওয়ালের ভেতরে শুয়ে আছে।সে বুঝতে পারে সে এতোক্ষণ স্বপ্ন দেখছিল।আমি বলে উঠলাম চুপ কর রুমী চুপ কর।আমার চোখে পানি টলমল করে এলো।হাত বাড়িয়ে রুমীর মাথাটা বুকে টেনে নিলাম। রুমী...রুমী এতো কম বয়স তোর পৃথিবীর কিছুই তো দেখলি না। জীবনের কিছুই তো জানলি না। রুমী মুখ তুলে কি একরকম যেন হাসি হাসি হাসলো। মনে হল অনেক বেদনা সেই হাসিতে।”(একাত্তরের দিনগুলি/জাহানারা ইমাম/ পৃষ্ঠা- ১৭৫)

কয়েকদিন পরেই রুমী ধরা পড়ে যায়। আর ফিরে আসেনি সে। ফিরতে দেওয়া হয়নি তাকে। অনেকের মতোই। আজ এই প্রায়ন্ধকার গলির সামনে, কণিকা নামের এক বিরাট অট্টালিকার সামনে দাঁড়িয়ে মনে হল এই বাড়িটাকেই কি খুঁজতে এসেছিলাম আমরা? নাকি কারো বেদনার তাপ পুইয়ে নিতে এসেছিলাম দু-পাঁজর উজার করে? কি চেয়েছিলাম এক মায়ের কাছ থেকে আমরা? অসুস্থ শরীরে যখন তিনি যুদ্ধ শানাচ্ছিলেন সেই রাজাকারদের বিরুদ্ধে? আমরা কি তাকে কিছু দিতে পেরেছি? ঝিরঝির করে আবার বৃষ্টি নামলো। “আজ সত্যি সত্যি এতো বছর পরে যদি রুমী ফিরে আসে?”আমরা সবাই চমকে তাকালাম হীরকের দিকে। “আমাদের কিছু বলার থাকবে না দাদা...একরাশ হতাশা ছাড়া...।” চুপ করে মাথা নীচু করে হাঁটলাম আমরা। বৃষ্টি ভিজিয়ে দিল আপাদমস্তক সবাইকে।

বইটা পড়ার সময় যেমন সুস্থির থাকতে পারিনি। লেখাটার সময়েও না। তাই লেখাটা এখানেই শেষ করে দিচ্ছি। মানে দিতে বাধ্য হচ্ছি। অনেক লেখায় যেমন আমি সুস্থির থাকতে পারি। নিজেকে গুছিয়ে উঠতে চেষ্টা করি। ল্যাপটপের কি-প্যাডকে নিজের বশ্যতা মানতে বাধ্য করি এবার সেটা হয়ে উঠছে না। আবেগঘন উপসংহারে যেতে পারছি না। কিম্বা লিখতে পারছি না কিছুই। ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকছে সব কিছু। এমনটা তখনি হয়, যখন আমি কারো প্রেমে পড়ি। আমি লক্ষ্য করেছি আমি প্রেমে পড়ে গেছি একটা ছেলের। যার সামনের বড় দুটো দাঁতের একটার নীচের দিকটা একটু ভাঙা। সবসময় হাসে। আর হাসলে গালে টোল পড়ে। অসম্ভব পজেটিভ এনার্জি নিয়ে সারক্ষণ হাসি হাসি মুখ নিয়ে তাকিয়ে থাকে ফটো ফ্রেম থেকে। যার মা-বাবা একদিন তাকে এগিয়ে দিয়েছিল দেশের জন্য...স্বাধীনতার জন্য... শহীদের পথে। 

বর্ষার এক ঝলমলে বৃষ্টিভেজা শনিবারে মিউজিয়াম থেকে বেরিয়ে এসে আমার জীবনের একটাই প্রাপ্তি থাকে। সেটা অনেক বড় প্রাপ্তি। আমার লেখক বন্ধু হীরক এসে বলে সে রুমীকে নিয়ে একদিন না একদিন জীবনীমূলক উপন্যাসে হাত দেবে। আর তারও বেশ কয়েক দিন পরে বাড়ি ফেরার সময় ঢাকার আন্তর্জাতিক বিমান বন্দরে আমার দিকে অবাক হয়ে তাকান ইমিগ্রেশান অফিসার। আমি কেমন একটু আড়ষ্ট হয়ে যাই। ইমিগ্রেশান ক্রস করার ফোবিয়া হয়তো। “শহীদ জননী আছেন আপনার সাথে। আপনার যাত্রা শুভ হোক।” একটা দেশ থেকে বেরিয়ে যাওয়ার স্ট্যাম্প পড়ে পাসপোর্টে। তাকিয়ে দেখি আমার হাতে ধরা ‘একাত্তরের দিনলিপি’। কথা বলতে বলতে অফিসের কাজের তাড়ায় কখন হাতে নিয়ে বেড়িয়ে পড়েছি মনে নেই। ঢোকানো হয়নি আর ব্যাগে। সেই সব মন কেমনের অলি গলিতে ঘুরে ঘুরে সময়টাও তো অনেক দিন বয়ে চললো। কতদিন বাংলা দেশে যাওয়া হয় না। দেখা হয় না বন্ধুদের সাথে। তবুও আশা থাকে একদিন সত্যি রুমী ফিরে আসবে আবার বাংলার এই মাঠ...ঘাট...নদী...মাটির গন্ধ স্পর্শ মেখে...হীরকের হাত ধরে... দুই মলাটের মধ্যে আমাদের কাছে। কোথা থেকে যেন ভেসে আসে, কেউ আবৃত্তি করছে, কেউ কি কোনো সংকেত পাঠাচ্ছে আমাদের?  বাতাসে কান পাতি...

"দেখতে কেমন তুমি? কি রকম পোশাক আশাক

প'রে করো চলাফেরা? মাথায় আছে কি জটাজাল?

পেছনে দেখাতে পারো জ্যোতিশ্চক্র সন্তের মতন?

টুপিতে পালক গুঁজে অথবা জবর জং, ঢোলা

পাজামা কামিজ গায়ে মগডালে একা শিস দাও

পাখির মতোই কিংবা চা-খানায় বসো ছায়াচ্ছন্ন?

দেখতে কেমন তুমি? অনেকেই প্রশ্ন করে, খোঁজে

কুলুজি তোমার আতিপাতি! তোমার সন্ধানে ঘোরে

ঝানু গুপ্তচর, সৈন্য পাড়ায় পাড়ায়। তন্ন তন্ন 

করে খোঁজে প্রতি ঘর। পারলে নীলিমা চিরে বের 

করতো তোমাকে ওরা, দিতো ডুব গহন পাতালে।

তুমি আর ভবিষ্যৎ যাচ্ছো হাত ধরে পরস্পর।

সর্বত্র তোমার পদধ্বনি শুনি, দুঃখ তাড়ানিয়া

তুমি তো আমার ভাই, হে নতুন সন্তান আমার।"

(গেরিলা/ শামসুর রহমান)

ঋণ

একাত্তরের দিন গুলি। জাহানারা ইমাম।

ক্যান্সারের সাথে বসবাস। জাহানারা ইমাম সমগ্র। জাহানারা ইমাম।

ঋণ ছবি- ব্যক্তিগত সংগ্রহ এবং গুগুল ও ফেসবুক ইমেজ। গান ইউটিউব।

কৃতজ্ঞতা

হীরক, নাসিমূল, ফাহমিদ, জুনায়েদ, সানি, রাজীব, এনা, পিউ, লীনা, শারওয়ার, অমলদা, রাকিন। আমার বাংলাদেশের লেখক বন্ধুরা। 

 

 

 

 

 

 

 


মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি