কলাপাতায় গরম ভাত, একটু ঘি আর ইন্দুবালা

ভেবেছিলাম তোমার সঙ্গে হয়তো আর কখনও দেখা হবে না। সেই যে বারান্দায় এক চিলতে পড়ন্ত রোদে কাসুন্দি, আচার, আমসত্ত্ব, বড়ির পাশে বিশ্রাম নেওয়ার জন্য একটু চোখ বুঁজলে, ওখানেই তো ছেড়ে দিয়ে এসেছি তোমাকে। পেছন ফিরে তাকাইনি একবারও। হাতে মালশা, নদীর মাটি তার মধ্যে এক টুকরো পোড়া স্মৃতির অস্থি নিয়ে ফিরে তাকাতে নেই যে পেছন পথে। আমি তোমাকে ভাসিয়ে দিয়েছিলাম ইন্দুবালা গঙ্গা, ইচ্ছামতী, কপোতাক্ষ আরও কত শত নদীর পলিতে জারিত এই উপ মহাদেশের টুকরো টুকরো ভূখন্ডে। 

বিশ্বাস করো সত্যি ভেবেছিলাম ফিরে দেখবো না তোমাকে আর কোনদিন। অভিমানে? কষ্টে? সময়ের বয়ে চলার হিসাব না মেলাতে পেরে? কি জানি! বই ছাপতে চলে গেল প্রেসে। মেখলা তোমাকে আঁকলো সুন্দর করে। পাতায় পাতায় ছড়িয়ে থাকলো তোমার খুলনা। কলাপোতা। ছেনু মিত্তির লেন। বোসদের পুকুর। ঘুটঘুটে অন্ধকারে পুকুরপাড়ে জোনাকিদের ওড়া। মনিরুলের ভাসা ভাসা চোখ। কুমড়ো ফুলের বড়া। সবুজ রঙের ধূসর ট্রেন। 

তখন তো পৃথিবী রুদ্ধ। কেউ বেরোতে পারছে না বাড়ি থেকে। হাসপাতাল ভরে থাকছে রোগীতে। শ্মশানে জমছে মৃতের স্তুপ। পাশে বসে স্বজন হারানো মানুষটাকে স্পর্শও করতে পারছে না কেউ। চোখের জল শুকিয়ে জমাট বাঁধছে বরফের মতো। বাড়িটাকে মনে হচ্ছে কারাগার। মানুষের কাজ নেই। পাতে ভাত নেই। কোন ভিন দেশ থেকে বাড়ি ফেরার পথে হাঁটতে হাঁটতে মরে যাচ্ছে কত কত মানুষ। ঠিক এমন এক অবরুদ্ধ অবস্থায় কলেজস্ট্রিট পাড়ায় পা রাখলে তুমি। না, দুয়ারে দেওয়া ছিল না আলপনা। মঙ্গলঘট বসানো হয়নি। শাঁখ বাজিয়ে উলু দিয়ে বরণ করে নেয়নি তোমাকে কেউ ইন্দুবালা। নেওয়ার মতো ছিল না কেউ। হ্যাঁ এক্কেবারে ঠিক তোমার জীবনের মতোই।

সুপ্রকাশের অসীম প্রেস থেকে নিয়ে এসেছিল বইগুলো। তালিকা দেখে ঠিক করেছিল কারা কারা তোমায় প্রথম দেখায় নেমনতন্ন করেছে। আসন পেতে রেখেছে। এগিয়ে দিয়েছে খাবার জল, পান, সুপারি। সেই ভয়ঙ্কর অতিমারির সময়েও অপেক্ষা করে থেকেছে তোমার জন্য। টিং করে বেজে উঠেছে শব্দ করে আমার স্মার্ট ফোন। শুনশান কলেজস্ট্রিট পাড়ায় একটা বেঞ্চের ওপর আলগোছে তুমি বসে আছো। ছবি পাঠিয়েছে শ্রেয়ান। তোমাকে বাড়ি নিয়ে আসার জন্য তার যে দিন রাত এক হয়ে গেছে।

তখন আমার ধুম জ্বর। চোখ বন্ধ করলে দেখছি বিস্তৃর্ণ ধানের ক্ষেত। নতুন চালের ভাতের গন্ধ নাকে এসে লাগছে। ঝিম ধরা এক রাতে উত্তরপাড়া জেনারেল হসপিটালের বেডে স্যালাইনের নল ঢুকিয়ে অক্সিজেনের মাস্ক পরে শুয়ে আছি। ভারী হয়ে আসছে চোখের পাতা। মনে হচ্ছে একটা ভিন গ্রহের বাসিন্দা যেন। চারপাশের মানুষজন ঘুরে বেড়াচ্ছেন স্পেসশিপের মতো পিপিটি কিট পরে। দূর থেকে দিচ্ছেন ওষুধ, ইনজেকশান। ভারী শ্বাস প্রশ্বাসে গুমোট হয়ে উঠছে ওই অতোবড় হল ঘর।

আর কি অদ্ভুত জানো ইন্দুবালা ঠিক তখনি মনে পড়ে যাচ্ছে আমাদের বালীর বাড়ির সেই ঝুল কালি মাখা রান্নাঘরটার কথা। মাটির তোলা একটা উনুন। গনগনে আঁচে প্রথম রান্না বসানোর আগে মনি ছড়িয়ে দিচ্ছে চিনি। ধক করে জ্বলে উঠছে আঁচের মুখটা। প্রনাম করে বিড়বিড় করে বলছে, “সবার পাতে ভাত জুগিও ঠাকুর”। ভাত। খানিকটা গরম ভাত। গাঢ় সবুজ কলাপাতার ওপর। সাথে একটুস খানি ঘি। আলু মাখা। হাপুস হুপুস করে খাচ্ছি। ঘুম ভেঙে যায়। হসপিটালের বড় জানলার বাইরে তখন অঝোরে বৃষ্টি। ঘাড় ঘোরালে দেখেছিলাম পাশের বেডের অসুস্থ মানুষটি উবু হয়ে বসে একটা স্টিলের থালায় ভাত খাচ্ছেন। পরম মমতায়। এক একটা গ্রাস মুখে দিচ্ছেন আর তাঁর চোখ থেকে টপ টপ করে পড়ছে জলের ধারা। আমার দিকে তাকালে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছিলাম। ভাত খেতে গিয়ে কাঁদছে কেন লোকটা? ওকি বুঝতে পারছে আমরা কেউ আর এই ঘর থেকে বেরোতে পারবো না? এখানেই কি তবে সব শেষ?

কান্না পাচ্ছিল তখন আমারও। খেতে পাচ্ছি না বেশ কয়েকদিন। মুখের ভেতর ঘা। পেটে ক্ষিদে। ভাতের গন্ধ আকুল করে তুলছে আমাকে। তোমাকেও কি করেনি ইন্দুবালা? নিজের স্বামী মাষ্টার রতনলাল মল্লিককে পুড়িয়ে এসে দেখেছিলে ভাঁড়ার খালি। উনুনের ওপরে বসিয়েছিলে শুধু জলের হাঁড়ি। টগবগ শব্দ করে ফুটছিল চালহীন জল। ক্ষিদের পেটে ছেলে মেয়েগুলো তাকিয়ে ছিল তোমার দিকেই। লছমী তখন যদি ওই রাস্তা দিয়ে না যেত? যদি খেতে না চাইতো তোমার কাছে ভাত? যদি না তার পরের দিনও হাটুরে গুলোকে জড়ো করতো খাবার জন্য? ভাতের হোটেল খুলতে তুমি? ছড়িয়ে পড়তো তোমার নাম এমন চারিদিকে? পুব বাংলার কোন এক অজ গ্রাম থেকে আসা মেয়ের কাছে একটু ভাত খাওয়ার জন্য চারপাশের এতো লোক আঁকড়ে বাঁচতো তোমাকে? হাসছো? জানি শুধু ভাত নয়। ওটা মায়ার বাঁধন। যে বাঁধনে আষ্টে পৃষ্ঠে জড়িয়ে নিয়েছিলে নিজেকে। যে বাঁধনে ঈশ্বরী পাটনী বর চেয়েছিল জগন্মাতার কাছে। “আমার সন্তান যেন থাকে দুধে ভাতে”। কত শান্তির সেই চাওয়া তাই না ইন্দুবালা? আমরা তো এইটুকুই চেয়ে এসেছিলাম সারা জীবন। তাহলে এতো ছারখার হওয়ার উপাখ্যান জুটলো কেন কপালে? কোন নিয়তির অঙ্গুলি হেলনে?  

“এই যে শুনছেন?” পাশ ফিরে তাকাই। একটা বছর পনেরোর ছেলে। ঠোঁটের ওপরে সবে কালচে গোঁফের রেখা। ভাসা ভাসা চোখ নিয়ে আমার দিকে তাকিয়ে। “বাবা জানতে চাইছে আপনি কি ভাত খাবেন? আমরা বাড়ি থেকে আরও ভাত এনেছি। মা, বোন আমি খাবো তো।” আমি কোনরকমে মাথা নাড়ি। “না।” ছেলেটা আর কোন কথা না বাড়িয়ে চলে যায়। এই ওয়ার্ডে ওর আসা উচিত নয়। তবুও আসে। বাবাকে যত্ন করে খাওয়ায়। নার্সরা বকাবকি করে। শোনে না। “একটু খায়ে নিলে পারতেন। ভোলা মাছের ঝাল। জ্বরের মুখে রুচতো ভালো”। পাশের বেডের লোকটা কেমন হাওয়ায় ফিসফিসিয়ে বলে। হাত দিয়ে ইশারায় দেখাই আমার বাড়ি থেকে আনা খাবার পড়ে আছে এখনও।

রাতে আবার ঝড় ওঠে। বৃষ্টি পড়ে। শীত করে আমার। বাতাস থেকে হাওয়া টেনে নিতে পারি না। ভারী হয়ে ওঠে বুক। নার্স এসে অক্সিজেন দেয়। স্যালাইনের বোতল পালটে চলে যায়। সকালে ঘুম ভাঙলে দেখতে পাই মাথা পর্যন্ত সাদা কাপড়ে ঢাকা আমার পাশের বেডের লোকটাকে। কাল উবু হয়ে ভাত খাচ্ছিল যে। “তাকাবেন না ওদিকে। ব্রেকফাস্ট করে নিন। ওষুধ খেতে হবে”। কড়া সুরে নার্স বলে যায়। আমি এক মৃত মানুষের পাশে বসে খাবার খাই। কানে ভাসে, “একটু খায়ে নিলে পারতেন”। গলার মধ্যে দলা পাকিয়ে আসে সব কিছু। তুমি কি কোনদিন গঙ্গায় ভেসে যাওয়া অপরিচিত নকশাল ছেলে অলোকের দেহটা দেখতে পেয়েছিলে ইন্দুবালা? সেও তো ভাত খেতে এসেছিল তোমার কাছে। রোজ রাতে ভাত বেড়ে বসে থাকতে তুমি। কারা হারিয়ে গেল আর কারা ফিরে এলো তার হিসেব কি তোমার ওই নোনা ধরা হোটেলের কালো বোর্ড রাখতে পারলো? উত্তর আছে তোমার কাছে? আমার কাছে নেই যে ইন্দুবালা। কয়েকদিন পরে অনেক সকালে হসপিটাল থেকে ছাড়া পেয়ে মাথার ওপর খোলা আকাশটার দিকে তাকিয়ে মনে হয়েছিল বেঁচে থাকার সুখ অনেক। যুঝে চলার নাম জীবন।

আমি জানি তোমার জীবন থেকে, তোমার চারপাশ থেকে, তোমাকে একা করে চলে গিয়েছিল কাছের মানুষগুলো। তাই কি ইন্দুবালা ভাতের হোটেলের এক নির্জন দ্বীপে তুমি বেঁচে রইলে সব কিছু আগলে? এই বাঁচা তো শুধু তোমার একার বাঁচা নয় ইন্দুবালা। এই বাঁচার মধ্যে তুমি উজাড় করে রাখলে দুটো দেশকে। আমার ঠাম্মা, মনি, দিদা, রাঙা, বড়মা, মা বাংলার সেইসব মানুষকে যাঁরা চিরটাকাল কাটিয়ে গেল ঝুলপড়া, স্যাঁতসেঁতে আলো না ঢোকা এক রান্নাঘরে। আমাদের মুখে তুলে দিলো অন্নের গ্রাস। আমরা বাড়ি নামক এক হোটেলে চির চেনা চিত্রনাট্যের ছক আর মুখস্থ সংলাপ দিয়ে বছরের পর বছর অভিনয় করে গেলাম একে অপরের সঙ্গে। আহ্নিক আর বার্ষিক গতির একই আবর্তনে বিরক্ত হলো না পৃথিবী নিজেও একটুও। এক দিন দুনিয়া জোড়া ভাতের হোটেলে পংক্তি সাজিয়ে কলাপাতা, লেবু, নুন, লঙ্কা দিয়ে আমরা কাদের আপ্যায়ণ করলাম? কোন চিরচেনা গল্প শোনার জন্য?

এবার আমাকে চিনতে পারছো ইন্দুবালা? আমি তোমাকে দূর থেকে দেখেছি। ভয়ে ভয়ে এড়িয়ে গেছি। পাছে আমার অভিনয় তুমি ধরে ফেলো। পাছে কাছে বসিয়ে মায়ার বাঁধনে আটকে দাও। তাই তোমায় আমি কণকাঞ্জলি দিলাম। হারিয়ে ফেললাম বিপুল জনস্রোতে। তারপর ঘটে গেল সেই বিশাল বিস্ফোরণ। কত কত মানুষ যে তোমার সাথে দেখা করতে চাইলো। খেতে চাইলো তোমার ভাতের হোটেলে। তার কোন ঠিক ঠিকানা রইলো না। সুদূর চট্টগ্রাম থেকে আসামের কোন এক প্রত্যন্ত গ্রাম। নিউইয়র্কের বিলাসবহুল এ্যাপার্টমেন্ট থেকে উত্তর চব্বিশ পরগণার ইচ্ছামতীর ধার সব জায়গায় কেমন তুমি ঘুরে বেড়ালে। কত কত মানুষ যে তোমার কথা শুনে তাদের মনের কথা শুনিয়ে গেল আমাকে জানলে অবাক হবে তুমি। এই সমষ্টিগত স্মৃতিই তো তোমার হোটেলের নোনা ধরা দেওয়ালে মালপোয়া, কচুর বাটা, চিংড়ির হলুদ গালা ঝোল আর ছ্যাঁচড়ার মতো কত কত পদে সাজানো থাকতো। তুমি তো তাদের মধ্যেই বাঁচতে চেয়েছিলে ইন্দুবালা। জীবে প্রেম করে। বাঙালীর চিরন্তন এক ভাতের হোটেল হয়ে।

 

 এই সময়ের রবি বারোয়ারিতে প্রকাশিত। ২১ নভেম্বর, ২০২১


 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি