শিউলি ফুল
আড়বেলিয়ায় মামার বাড়িতে চন্ডীমন্ডপের গায়ে একটা অনেক পুরনো শিউলিফুলের গাছ ছিল। শরতের সকালে গোটা উঠোন জুড়ে কেউ যেন সাদা ফুলের আঁচল মেলে রাখতো। অনেক ভোরে অধিবাসের ঢাকের আওয়াজে যখন ঘুম ভাঙতো, বাতাসে ঘুরে বেড়াতো শিউলিফুলের গন্ধ। দিদা হাতে ধরিয়ে দিতো মস্ত বড় একটা ফুলের সাজি। আমি আর দাদা ঘুম চোখে সবে সূর্যি মামার আলো এসে পড়া উঠোনে সেই সাদা আঁচল কুড়োতাম মন দিয়ে। ছোট ছোট হাত দিয়ে গাছটা একটু নাড়া দিতেই আরও অনেক অনেক ফুল মাথা গা ভর্তি করে টুপটুপ করে পড়তো। তার সাথে গায়ে লাগতো শিশিরের ছোঁওয়া। স্থলপদ্ম কেমন যেন মুখের দিকে তাকিয়ে থাকতো আমাদের। সারা গ্রাম জুড়ে ফুল তুলে বেড়িয়ে এলেই গরম চা, কুচো নিমকি আর গজা আসতো আমাদের সামনে। যেগুলো ভাজা হয়েছে সারা রাত ধরে। সেসব তো অনেক দিন আগের কথা। মনে হয় কবেকার যুগ যেন। শিউলি ফুলের গাছটা সমেত দিদাও অনেক কাল আর নেই। কিন্তু শরত রয়ে গেছে, পুজোও। মামার বাড়ি যাওয়ার পাট যখন চুকলো। ধানের আগায় শিশিরের রূপ যখন ভুলতে বসলাম সমবেত ভাবে। শিউলি ফুল তখনও থাকলো কোথাও কোথাও পাড়ার এদিক সেদিক। গ্র্যান্ড ট্রাঙ্ক রোডের আসেপাশে। পাপ্পুদের বাড়ির পেছনের মস্তবড় বাগানে সার সার দোপাটি গাছের মধ্যে এক বুড়ো বেল গাছের পাশে ছিল শিউলি গাছ। পাপ্পুর ঠাম্মা আমাকে আর দাদাকে খুব ভালোবাসতেন। আমাদের স্বাধীনতা ছিল সেই বাগানের ফুল তাঁদের বাড়ির লোকের সাথে তোলার। শরত এলেই বাগানটা ভরে যেত ফুলে ফুলে আলো করে। একটা ভোর, পুজোর ঢাক, আর মন কেমনের সাজি ভরে উঠতো নানা রঙের ফুলের মেলায়। ঠাম্মা চলে যাওয়ার সাথে সাথে সেই বাগানও কেমন যেন চুপ করে গেল। কেউ আর গাছগুলোর সাথে কথা বললো না। তাদের আদর করলো না। আমরাও না। রাসবাড়ির গঙ্গার ধারে রাধারমনের লোহার গেটের পাশে বিষ্টুদার বাগান ছিল। একটা বিশাল গাব গাছের নীচে আমাদের ছিল জমাটি আড্ডা। কবেকার এক অশ্বত্থ গাছের ঝুড়ি ধরে দোল খাওয়া। একটু বেশি গরম লাগলেই টুপটুপ করে ঝাঁপ দেওয়া মা গঙ্গায়। উলটো ভল্ট, সোজা ডিগবাজি সে যে কত রকমের নানা কসরত। বিষ্টুদা তেড়ে আসলে ছুটে পালানো। গাছ গাছ ছায়া ছায়া নিবিড় অঞ্চলে তখনও শিউলিফুল টুপটাপ ঝড়ে পড়তো। এদিকে ওদিকে তাকেলেই খুঁজে পাওয়া যেত। তখনও তারা বালীর মতো অঞ্চলে বিরল হয়ে যায়নি। হারানো প্রাপ্তি নিরুদ্দেশে নাম লেখাতে হয়নি। অনেক দিন পরে ঢাকার ধানমন্ডির রাস্তায় নভেম্বরের এক শীতের সকাল। একটা ছোট্ট মেয়েকে হাতে অনেকগুলো শিউলি ফুলের মালা নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে থমকে দাঁড়িয়ে ছিলাম। ইচ্ছে করছিল সব গুলো যদি নিয়ে নিই। সেই ছোট্ট বিষণ্ণ মেয়েটি বিড়বিড় করে বলেছিল তার আরও অনেক অনেক লোক আছে যারা এগুলো নেবে। সে আমাকে একটা ফুলের মালা দিয়েছিল। গেস্ট হাউজে এসে ছোট্ট থালায় ভিজিয়ে রেখে ছিলাম তাকে। সারাদিন ঘরটায় আলপনা আঁকলো ছায়া ছায়া জলছবি। কিছু কিছু ফুল শুধু ফুটে থাকে না। তারা ভিড় করায় একটা সময়কে। জীবনকে। সমষ্টির স্মৃতিকে। কিছু কিছু গাছ অবাক করিয়ে দিয়ে আমাদের সেইসব মনে করায়। কান ধরে টেনে নিয়ে যায় সামনে হাঁটতে থাকা নিজেকে ভুলতে বসা আমাদের অনেক পেছনে। সেই পথে কেউ ফিসফিস করে গল্প শোনালে মন আলোকিত হয়ে ওঠে। তখন ইঁট কাঠ জঙ্গলের ভিড়ে দেবালয় মেখলার বাঁশদ্রোণীর ফ্ল্যাটের বাগানে লিকলিকে শিউলি ফুলের গাছটা সারা বছর ফুল ফোটালে অবাক লাগে না। অনেক রাতে শ্যুটিং ফেরত ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে যখন আমরা বাড়ি ফিরি পায়ের কাছে টুপটাপ ছড়িয়ে থাকা একটা দুটো ফুল যেন বলে ওঠে এই তো এতো কিছুর পরেও বেঁচে আছি সবাই কেমন। ঘুমতো যাওয়ার আগে বালিশের পাশে রাখলে তারা কেমন যেন কথা বলে ওঠে। জীবনের প্রবাহমানতার গল্প শোনায়। এখনও তাই কোথাও তাদের দেখা পেলেই থমকে দাঁড়াতে ভালো লাগে। দুদন্ড তাদের কাছে বসতে প্রান চায়। উত্তরপাড়ার বাজারে যে মাসি হেলেঞ্চে, কলমীশাক, কুলেখাগড়া নিয়ে বসতো সেই মাসি গত বছরের লক ডাউনের পর থেকে আর আসে না। শরীর চলে না আর তার। কিন্তু এখনো তার ছেলের হাতে ঝুড়ি ভরে তুলে দেয় শিউলি ফুল। বাজারের একটা ছোট্ট কোনে বেতের ঝুড়িতে সেই ফুল যখন সেজে ওঠে কেউ কেউ দাঁড়িয়ে পড়ে অতো ভিড়ের মাঝেও। ঠিক তখনি একটা আখ্যানের শুরু হয়। মনে মনে কথা বলাও। এক মুঠো শিউলি ফুল নিয়ে আমরা পা বাড়াই। আগামীর আবার কোন এক মন কেমনের রাস্তায়। বাড়ি ফিরে সেই মুঠো ফুল যখন মায়ের হাতে দিই সেই হাসি যেন শরতের অনন্ত আকাশে মেঘের ভেলায় ভেসে বেড়ায়।
ভালো থাকবেন সবাই। একমুঠো শিউলির ভালোবাসা সব্বাইকে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন