ভালোবাসার ছবি


 

ভাঁড়ে বেশ কিছু খুচরো পয়সা জমিয়ে ছিলাম ক্লাস ইলেভেন আর টুয়েলভ পড়ার সময়। কলেজের ফাস্ট ইয়ারে টিউশানির টাকা রেখে দিতাম যত্ন করে বাবার কাছে। ইচ্ছেটা ছিল বিরাট। সিনে সেন্ট্রালের মেম্বার হওয়া। "জানো না ওরা শনিবার আর রবিবার সিনেমা দেখায়। গোটা মাস জুড়ে থাকে আলোচনা, তর্ক-বিতর্ক"। মেম্বারশিপের টাকাটাও অনেক। কিছুদিন আগেই গোটা বার্গম্যান দেখিয়েছে। কলেজ কেটে দেখে এসেছি। আর লাতিন আমেরিকার 'মেমারিজ অব আন্ডারডেভালপমেন্ট'। আলেয়ার ছবি। অঞ্জনদাকে কার্ড দিয়েছিল। সেই কার্ডে। প্রায় লুকিয়ে চুরিয়ে। কিন্তু নিয়মিত ছবি দেখতে গেলে মেম্বার হতে হবে। এখন যেখানে অবলুপ্ত প্রায় মেট্রো সিনেমা সেই বাড়িতেই সামনের দিকে অনেক পুরনো বন্দুক বিক্রির দোকানের পাশে একটা কাঠের অন্ধকার সিঁড়ি ছিল। সেই সিঁড়ির দেওয়া্লের গায়ে ছিল অসংখ্য ইলেকট্রিক মিটার। আর একধাপ এগোলে বেশ কয়েকটা ফিল্ম ডিস্ট্রিবিউটারের অফিস। ঘরের মধ্যে টিম টিম করা টিউব লাইটে সিনেমার পোষ্টার গুলো দেখা যেত। সিগারেটের ধোঁওয়ায় কুয়াশার মতো মনে হত চারিদিক। সিঁড়িটার শেষ প্রান্তে উঠলে কয়েকটা দোকান। লম্বা বারান্দার দু-পাশে। কবেকার পুরনো মার্বেলের ওপর পানের পিক, কাদার দাগ। পাশে খোলা ছাদের বাথরুমের বিকট গন্ধ পেরিয়ে এগিয়ে গেলে একটা দরজা। সেখানে আবার কাঠের সুইং গেট। সামনে রিল গোটানোর চরকার মতো একটা মেশিন রাখা। বোর্ডে লেখা সিনে সেন্ট্রাল, ক্যালকাটা। ১৯৯৩ সালে নিজের জমানো টাকা আর বাবার ভর্তুকিতে সদস্য হয়েছিলাম সিনে সেন্ট্রালের। সজলদা একপ্রস্থ ইন্টারভিউ নিয়ে ভেতরের খুপরি ঘরটায় নিয়ে গেলেন ধুতি পাঞ্জাবি পরা, পান খাওয়া সৌম্য দেখতে এক মানুষের কাছে। "অলোকদা, কল্লোলকে মেম্বার করা হল"। অলোক চন্দ চন্দ তখন সর্বে সর্বা সিনে সেন্ট্রালের। চশমার ফাঁক দিয়ে জানতে চেয়েছিলেন "ছবি দেখতে আসবে তো? নষ্ট করবে না কার্ড?" প্রবল জোরে মাথা নেড়েছিলাম। পরের রবিবার বিকেল চারটে আর সন্ধ্যা ছটায় পরপর দুটো ছবি দেখানো হয়েছিল নন্দন ওয়ানে। পরিচালকের নাম ক্রিস্তফ কিসলস্কি। একটা লম্বা লাইনে দাঁড়িয়ে ছিলাম আমরা। কিন্তু এইভাবেই তো তখন আমরা ছবি দেখি। তারজন্য বেশ ধৈর্য্য লাগে। হুটোপাটি ঝগড়া ঝাঁটি করলে হয় না। একটু কান সজাগ রাখতে পারলে পাশে দাঁড়ানো এক দঙ্গল মানুষের ছবি নিয়ে আলোচনা শোনা যায়। কোথায় কবে কি ছবি দেখানো হবে তার খবরও। চেনা হয়ে যেতে থাকে গোর্কি সদন, ম্যাক্সমুলার, সরলা রায় মেমোরিয়ালের হল গুলো। নতুন মেম্বারশিপের কার্ডে যে ছবি দুটো দেখে হল থেকে বেরিয়েছিলাম তার ধাক্কা লেগেছিল বেশ জোরেই। তার বছর দুয়েক পরে যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্রবিদ্যা বিভাগে পরিচালকের সাথে বেশ জমিয়ে আলাপ হলো। 'কিসলস্কি অন কিসলস্কি' তখন জেরস্ক করে বাড়ির টেবিলে। ভালোবাসা আর মৃত্যুকে এমন ভাবে ছড়িয়ে দেওয়া তাঁর ছবির বুননের এক বিশেষ দিক। ফিল্ম সোসাইটিগুলো এখনও কেউ কেউ টিম টিম করছে। প্রদর্শনী নিয়ে সেই উন্মাদনা নেই। লাইন নেই। কিন্তু কিসলস্কি আছেন। তীব্র ভাবেই। মন কেমনের দিন গুলোতে যেমন ছিলেন আগেও। হঠাৎ কেন মনে পড়লো তাঁর কথা? মুবিতে অনেক দিন পরে বেশ কয়েকটা ছবি এসেছে তাঁর। দেখলাম অনেকে আলোচনা করেছেন। লিখেছেন তাঁদের কথা। বাঙালীর কাছে তিনি নতুন ছিলেন না। এক্কেবারে পড়শি ছিলেন তিনি। হয়তো একা একা বসে ছবি দেখা যায়। কিন্তু একা একা ছবি নিয়ে চর্চা করা যায় না। তার জন্য এক দঙ্গল লোক লাগে। এখন হয়তো খুব সহজেই হাতের কাছে চলে আসছেন অবাক করে দেওয়া পরিচালকরা। তাঁদের ছবি। নতুন করে আবিষ্কার করা যাচ্ছে মিডি জি কে। আলেক্সি বালাবানোভকে। তাঁদের ছবি যখন চমকে দিচ্ছে। ভালো লাগাচ্ছে ঠিক তখনই একটা লম্বা লাইনকে মিস করছি। ছবি দেখে দঙ্গল বেঁধে আলোচনা। কিম্বা তারপর দিনই খুব কাছের বন্ধু হয়তো শোনাচ্ছে তাঁর সারা রাত জেগে লেখা চিত্রনাট্য। কেউ কেউ তাঁর তার্কিক পয়েন্টে মনে করিয়ে দিচ্ছেন আসলে নতুন কিছুই দেখছো না ভায়া। হাঁটছো সেই পুরনো রাস্তাতেই। মুড়িয়ে নিয়েছো শুধু নতুনের খোলস। আড্ডা চলছে...তর্ক চলছে...লেখালেখি...ছবি করা। এখন যখন সেই দিনগুলোকে ফিরে দেখি তখন সিনেমা হলের চারপাশে নেমে আসে যেন নিঃসঙ্গতার একশো বছর। কিন্তু এখানেই কি তাহলে শেষ? মোটেই না। প্রবাসী বন্ধু জানায় প্যারিসে নাকি আবার ছোট ছোট ভিডিও হল গুলো খুলে যাচ্ছে। যারা ইন্টারনেটের যুগে বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। ধূসর সেই হলগুলো আবার সেজে উঠছে। সেখানে দেখানো হচ্ছে তখন ষাটের দশকের কোন পুরনো আমেরিকান গ্যাংষ্টার ছবি। কিম্বা কোন এক পুরনো রোমান্টিক ফরাসী ছবি। মানুষ এসে কফির কাপ নিয়ে সিনেমা দেখতে বসছেন। শেষ হলে আড্ডা। অফিস ফেরতা পথে কেউ কেউ ঢুঁ মেরে যাচ্ছেন একবার। অবাক হয়ে দাঁড়িয়ে থাকছে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র কবেকার এক পুরনো সিনেমার পোষ্টারের সামনে। তার বান্ধবীকে ফোনে জানাচ্ছে দেখবে নাকি একবার হলে বসে? যে ছবি গুলো অনায়াসেই বাড়িতে বসে দেখা যেত শুধু মানুষের গায়ের গন্ধ মেখে দেখবে বলে ভিড় হচ্ছে। একটা বিচ্ছিন্ন দ্বীপের মতো বাঁচার কষ্টটা বুঝতে পারছে ওরা। সেই ঢেউ আছড়ে পড়তে হয়তো সময় লাগবে ভাগিরথীর পাড়ে। তবুও স্বপ্ন থাকবে একটা লম্বা লাইনের। ছবি দেখে হল থেকে বেরিয়ে চায়ের আড্ডায়। একটা নির্ভেজাল ছবি ছবি ঝিরঝিরে বৃষ্টির দিনের।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি