বাঘ দিবস
হঠাৎ গুগুল ফটো এই ঘোর বর্ষার দুপুরে মনে করালো আজ আন্তর্জাতিক বাঘ দিবস। আর বাঘের গল্প এই ঝমঝমে বৃষ্টিতে কার না ভালো লাগে। কিছুদিন আগেই শেরনি সুপার ডুপার হিট। সহজপাঠের ভক্তরামের নৌকা শক্ত কাঠের তক্তা দিয়ে তৈরী... কে না পড়েছি। তাদের বাঘ শিকারের অভিযান সেই কোন ছোট্ট বেলায় রীতিমতো ভয় পাইয়ে দিত। তারও পরে জানা গেছে সাহেবদের বাঘ শিকারের পরে জঙ্গল শূন্য। সাদা কালো ছবিতে বাঘের লাশের স্তুপের সামনে সাহেবদের হাসি হাসি মুখের ছবি ভালো লাগেনি। কষ্ট হয়েছে দেখে। পদ্মার পার থেকে আবদুল মাঝির এনে দেওয়া কচ্ছপের ডিমের স্বাদ নিতে চাইনি কোনদিন। যদিও চারপাশে কংক্রিটের জঙ্গলে ছায়া ছিল চিরকাল। জঙ্গলকে খুব কাছ থেকে দেখার সুযোগ এলো কার্যসূত্রে। জঙ্গলেরও যে নিজস্ব একটা ভাষা আছে চিনিয়ে দিচ্ছিলেন বনবস্তিতে থাকা মানুষেরা। জঙ্গলরক্ষীরা। নৌকায় যে জেলে কাঁকড়া ধরেন, জঙ্গলের মধু আনতে যান যে মানুষেরা, জ্বালানী কাঠ সংগ্রহ করেন যে মহিলারা, নদীতে ছোট্ট বেতের জাল নিয়ে মাছ ধরে যে মেয়েরা, কিম্বা সারা রাত হাতির হাত থেকে যে ফসল বাঁচায় পাহারা দেয় সেই ছোট্ট ছোট্ট বাচ্চারাও। খুব কাছ থেকে কুমীর দেখেছি। গন্ডার দেখা হয়েছে। হাতির সাথে বাস করেছি দেড় বছর। গরুমারা জঙ্গলে সপরিবারে চিতাও দেখেছি। কিন্তু অতোবার সুন্দরবনে নানা কাজে গিয়েও বসন্তরায়ের দেখা পাইনি। এমনকি রেডিও কলার পরা বাঘের পিছু নিয়েও না। তাই ভেবেছিলাম ইহজন্মে আর দেখা হবে না। ঠিক সাজানো গোছানো বাগানে দেখতেও চাইনি তাঁকে। কিন্তু সেদিন কি থেকে জানি কি একটা ঘটে গেল। আমি আর জয়াদি সারাদিন ধরে ঘুরেছি অনেক। এই গ্রাম সেই গ্রাম। অনেক রাত হয়ে যাওয়াতে আমাদের সঙ্গী বন্ধু বলেছেন বান্ধবগড়ের ফরেস্ট রেস্ট হাউজে রাতটা কাটিয়ে নিতে। আমরাও তো লাফিয়ে উঠেছি আনন্দে। পথে যেতে হবে অনেকটা পথ জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে হাইওয়েতে। এর আগেও বিক্রমের সাথে এই পথ ধরে বেরিয়েছি অনেকটা। কিন্তু সেটা দিনের বেলা। এখন অনেক রাত। যাওয়ার সময় ফিসফিস করে ড্রাইভার বললো টাইগার। ডানদিকে তাকালাম। ধুর ওটা তো স্ট্যাচু। বলা নেই কওয়া নেই টাইগার আসতে যাবে। লোকটা বিরক্ত হল। ইধার কোই স্ট্যাচু নেহি হ্যায়। সঙ্গী যিনি ছিলেন তিনি ফিসফিস করে বললেন পিছে লো। পিছিয়ে এলো গাড়ি প্রায় সন্তর্পনে। মূর্তিমান দাঁড়িয়ে তিনি। জীবনে কত সাধ্যি সাধনা করেছি তাঁকে দেখার। একজন মৌলে বলেছিলেন, বাবু তাঁর রূপ ভোলবার নয়। এদিকে আমি মোবাইল খুঁজে পাচ্ছি না। জয়াদি চুপ। তাঁরা একজন নয় দুজন। উলটো দিকে বাইকটা এসে থমকে দাঁড়িয়েছে। কোথায় গেল।মোবাইল। ছবি তুলবো যে। জয়াদি ফিসফিস করে বললো ওরা রাস্তা পার হবে। ততক্ষণে মোবাইল পেয়ে গেছি। দুলকি চালে রাস্তা পার হবার ছবি তুললাম। সত্যিই তাঁর রূপ ভোলার নয়। পরিসংখ্যান বলছে বাঘের বংশ দিন দিন কমছে। আমরা যত সভ্য আর উন্নত হচ্ছি বইয়ের ভাষায় তত এগিয়ে চলেছি জঙ্গলের দিকে তাকে সাফ করার জন্য। উন্নয়নের নামে গাছ কাটা হচ্ছে। খনিজ লুঠ হচ্ছে। জল শেষ হচ্ছে। চোখের সামনে পৃথিবীর জলবায়ুর পরিবর্তন হতে দেখেও চুপ করে থাকছি। হিমালয়কেও ছাড়ছি না। ব্লাস্ট করিয়ে, অরণ্য ধ্বংস করে উন্নয়ণ হচ্ছে। মনে পড়ে গেল সেই বৃদ্ধ ফরেস্ট গার্ডের কথা। ভোরবেলায় সুন্দরবনের এক মধু সংগ্রহের নৌকাতে বসে তিনি বলেছিলেন, দক্ষিণরায় কখন গ্রামে আসেন জানেন? যখন তাঁকে জঙ্গলে থ্রেট করা হয়। তাঁর কাছে বাঘ শিকারের আধুনিক পদ্ধতির যে গল্প শুনেছিলাম তাতে মানুষকেই পশু মনে হয়েছিল সব থেকে বেশি। কেন এই ঝিরিঝিরে বৃষ্টিতে পীরখালির বিট অফিসের বনবিবির মন্দিরের সেই ছোট্ট চাতালটায় বসতে ইচ্ছে হল কে জানে?
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন