মিনি আর ভ্যাঁও
তোমরা কি মিনি আর ভ্যাঁও কে চেনো? চেনে না তো? আমিও চিনতাম না। দাদাও না। মাও না। বাবাও না। এমনকি পাঁচিলে বসা দুষ্টু কাকটা না। রান্নাঘরের ঘুলঘুলিতে থাকা চড়াইয়ের পরিবারও না। তাহলে প্রশ্ন করতেই পারো চিনলাম কী করে? সেটা নিয়েই তো গল্প।
তখন সবে গরমের ছুটি পড়েছে স্কুলে। সকালে ঘুম থেকে উঠে সবে একটু দাঁত মেজে লুচি, সাদা আলুর বাটি চচ্চরি আর ক্ষীরমোহন খাচ্ছি আয়েশ করে। ওমা শুনি কিনা কোথা থেকে মিউ মিউ করে বেড়ালের বাচ্চা ডাকছে। দাদা বললো “নিশ্চই পাশের সারদাদির বাড়ির পেত্নী আমাদের বাড়িতে এসে বাচ্চা পেড়েছে। মা জানলে আর রক্ষে থাকবে না। এক্ষুনি রাগারাগি করবে”। আমি বললাম ধুর। সারদাদির পেত্নী কুচকুচে কালো লোমশ খুব সুখী বেড়াল। বাড়ি থেকে বেরোতেই চায় না। আর ওর তো এই দুমাস আগে বাচ্চা হয়েছে চারটে। সারদাদি আমাদের ডাকলো। আমরা গেলাম। মনে নেই? খাটের তলায় বিছানার ওপর কেমন সবাই জড়িয়ে মড়িয়ে কুন্ডুলী পাকিয়ে শুয়েছিল বাচ্চাগুলো। যেন মনে হচ্ছিল নরম তুলতুলে বালিশ। কোলে নিতে খুব ইচ্ছে করছিল। কিন্তু সারদাদি বললো এখন যদি ওদের গায়ে হাত দিই তাহলে পেত্নী রেগে যাবে আর বাচ্চাদেরও চোখ ফুটবে না। তাই তখন আমরা ওদের দূর থেকে দেখে অনেক ফ্লাইং কিস দিয়ে চলে এসেছিলাম। দাদা ক্ষীরমোহনে কামড় বসাতে বসাতে বললো “ঠিক ঠিক”। তবে এখন পেত্নীর বাচ্চারা বড় হয়ে গেছে। জ্বালাতন করে মারছে সবাইকে। একদিন কি হয়েছে জানিস? দাদা চোখ গোল গোল করে “কী হয়েছে শুনি?” আরে বদমায়েশ বাচ্চাগুলো এখন ওদের বুড়ো হুলোটাকে দিয়ে ভাঙা ফ্রিজের দরজা ঠেলা দেওয়ায়। আর আলগা দরজা খুলে গেলে সবাই ফ্রিজের মধ্যে উঠে পড়ে মিষ্টি, মাখন, নকুলদানা, চিজ সব খেতে শুরু করে। শুধু তাই কি? বুড়ো হুলোটা নীচ থেকে ম্যাঁও ম্যাঁও করে ডাকে। আর বাচ্চাগুলো পা দিয়ে দিয়ে ঠেলে ফেলে দেয় খাবার বুড়ো হুলোটা সেসব নীচে বসে খায়। শুনেছি ওই নাকি যত নষ্টের গোড়া। সারদাদি সেদিন যা বকছিল না ওকে। আবার মিউ মিউ আওয়াজ ভেসে আসে। দাদা বলে “নাহ ব্যাপারটা তো দেখতে হচ্ছে এইভাবে সারাক্ষণ কানের কাছে কান্নাকাটি করবে সেটা চলতে পারে না”।
এদিকে মা এসেছে আবার এক থালা গরম ফুলকো লুচি নিয়ে। “কী কথা হচ্ছে শুনি? তোরা কি কোন বেড়ালের ডাক শুনেছিস?” সঙ্গে সঙ্গে আমার আর দাদার চোখাচুখি হয়। দুজনেই একসাথে মিথ্যে কথা বলে উঠি “কই না তো”। মা কেমন যেন একটু সন্দেহ নিয়ে রান্নাঘরে চলে যায়। আমরা কোন রকমে লুচিগুলো তাড়াতাড়ি খেয়ে নিয়ে বেড়াল খুঁজতে শুরু করি। প্রথমেই যেন মনে হয় শোওয়ার ঘরের খাটের তলা থেকে ডাকছে। এই খাটের তলাটা বেশ বড় আর অন্ধকার। দাদা বললো, “এই রকম ভাবে খোঁজাটা ডেঞ্জারাস হতে পারে ভাই। ওদের কাছে যদি ওদের মা বেড়াল থাকে তাহলে আমাদের এ্যাটাক করতে পারে।” আমি বললাম কেন? এ্যাটাক করবে কেন? আমরা কি ওদের মারবো? না ফেলে দেবো? আমরা তো ওদের হেল্প করতে চাই। ওদের ডাকে সাড়া দিয়েই তো খুঁজছি। দাদা বিজ্ঞের মতো ঘাড় নাড়ে। “সেটা না হয় আমরা জানি। কিন্তু ওরা তো জানে না”। বাবার আলমারী থেকে বড় টর্চ বার করা হল। আমরা যখন আমাদের গ্রামের বাড়িতে বেড়াতে যাই তখন এই টর্চটা নিয়ে যাই। অন্ধকারে রাস্তায় যেতে কত সুবিধে হয়। কত নানারকম পোকা মাকড় দেখা যায়। রঙীন ফড়িং। রাস্তার ধারে বসে থাকা ব্যাঙ। চালতা গাছে ঝুলতে থাকা বাদুড়। দাদা সেই টর্চ দিয়ে খাটের তলায় ভালো করে দেখলো। না কোথাও কিছু নেই। অথচ ডাকটা এই বাড়ি থেকেই আসছে। মিউ মিউ। আমরা সিঁড়ির তলায় দেখলাম। পাম্পের ঘর। পেছনের বাগান। চিলেকোঠার ঘর। সব জায়গায় তন্নতন্ন করে খুঁজলাম। এদিকে বেলা বাড়তে থাকলো। আরও জোরে মিউ মিউ আওয়াজ বাড়তে থাকলো। বাবা বাজার থেকে এসে বললো “এতো বেড়াল কাঁদছে। কে নিয়ে এসেছে ওদের?” আমি আর দাদা বললাম “সত্যি বলছি বাবা আমরা কেউ নিয়ে আসিনি”। বাবা বললো “তা অমন কাঁদো কাঁদো করে বলার কী আছে? নিয়ে আসোনি তো আসোনি। কিন্তু ওরা যখন একবার এই বাড়িতে এসে গেছে, ক্ষিদে পেয়ে কাঁদছে। তখন খুঁজে বার করতে হবে তো। কোথায় ওরা?” মা বললো “আমিও তো তাই জিজ্ঞেস করছি তোমার দুটো হনুমানকে তা ওরা নাকি শুনতেই পায়নি”। আমাদের তখন কাঁদো কাঁদো অবস্থা। কোত্থাও খুঁজে পাচ্ছি না তো তাদের। বাবা এবার নিজেই উদ্যোগ নিয়ে এগিয়ে এলো। আমাদের বাড়িতে বাথরুমের ওপরে ভাঙা জিনিসপত্র রাখার একটা ঘর ছিল। সেই ঘরটায় এমনিতে ওঠা যেত না। টুল নিয়ে উঠতে হতো। অনেকটা ভাঙা জিনিস জমা হয়ে গেলে লোক ডেকে সেগুলো বিক্রি করে দেওয়া হতো। বাবা এবার সেখানে টুল নিয়ে উঠলো। আর একটু খোঁজাখুঁজিতে পাওয়া গেল কালো পুঁথির মতো ছোট্ট ছোট্ট চোখের দুটো মিষ্টি বেড়াল ছানাদের। বাবা তো তাদের নামিয়ে আনলো। বললো, “এক্ষুনি খেতে দাও। এরা মনে হয় অনেকক্ষণ খায়নি। পেটগুলো এক্কেবারে পড়ে গেছে।”
মা সঙ্গে সঙ্গে বাটি করে দুধ নিয়ে এলো। কিন্তু ওইটুকুনি বাচ্চারা আর কি খেতে পারে দুধ? মা তখন বললো, “ছুট্টে যা তো হোমিওপ্যাথির কাঠের বাক্সে প্লাস্টিকের ড্রপার আছে নিয়ে আয় শিগগিরি”। আমি ছুটলাম। দাদুর সেই কবেকার হোমিওপ্যাথির বাক্স থেকে ড্রপার এনে মাকে দিলাম। মা সেটা ভালো করে ধুয়ে সেই ড্রপারে করে যেই না দুধ তুলে ছানাদের মুখে দিতে থাকলো ছানারা সেই দুধ অমনি চুকচুক করে খেতে শুরু করলো। তা দেখে আমার আর দাদার কি আনন্দ। পাঁচিলের ওপরে দুষ্টু কাকটা ঘাড় নেড়ে খানিকক্ষণ কা কা করে ডেকে বাচ্চাগুলোকে দেখলো। চুড়ুইয়ের পরবিবার তাদের ছানাপোনা নিয়ে রান্নাঘরের ঘুলঘুলি দিয়ে উঁকি ঝুঁকি মারলো। আর নিজেদের মধ্যে কিচিরমিচির করে কিসব কথা বললো। দুধ খেয়ে বেড়ালদুটোর পেট তখন পাশ বালিশের মতো ফুলে গেছে। ঘুমে তাদের চোখ ছোট হয়ে আসছে। মা ওদের ঝুড়ির মধ্যে সুন্দর করে বিছানা করে শুইয়ে দিল। ওরাও দুজনে জড়িয়ে মড়িয়ে শুয়ে পড়লো। আমি আর দাদা এতো কাছ থেকে আগে কখনো বেড়াল ছানা দেখিনি। সারা দুপুর আমরা বসে থাকলাম ওদের মাথার কাছে। কি যে ভালো লাগছিল। দাদা বললো “ওদের আমরা কী বলে ডাকবো ভাই?” কত নাম যে আমরা ভাবলাম। কিছুতেই কোনটাই পছন্দ হলো না আমাদের কারও।
বাড়িতে কাজ করতে আসা চাঁপাদি সব দেখে শুনে বললো “এতো ঠিক কথা না দুধের বাচ্চাদের মা কোথায় গেল? কেউ মেরে টেরে ফেললো কিনা।” মা রেগে গিয়ে বললো “অমন অলুক্ষুনে কথা বলবি না চাঁপা। কে আবার মেরে ফেলবে?” সেদিনই বিকেলে পাশের বাড়ির পাঁচুদের পাতকো থেকে পাওয়া গেল বেচারিদের মাকে। হয়েছিল কি পাতকো তলা পার হতে গিয়ে অসাবধানে পরে মরে গেছে সে। এবার কী হবে? কে দেখবে বাচ্চাগুলোকে? সারদাদি বিকেলে এক বাটি আইসক্রিম নিয়ে এসে বললো “কেন তোরা দেখবি। এখন থেকে ওরা তোদের বাড়ির মেম্বার। যা খাওয়াবি ওরা তাই খাবে। যা শেখাবি তাই শিখবে”। আমি আর দাদা আইসক্রিম খেতে খেতে বললাম আর মা যদি বকে? সারদাদি বললো “কিচ্ছু বকবে না মাসিমা। এই তো শুনলাম চাঁপাদিকে বলছে ওদের জন্য কাঁথা বানিয়ে দিতে।” ব্যাস আমাদের আর আনন্দ দেখে কে। পাড়া শুদ্ধু খবর হয়ে গেল আমাদের বাড়িতে দুটো বেড়াল ছানা এসেছে। ওপাড়া থেকে হরিশ এলো। লক্ষ্মী এলো। জয়ন্ত এলো। এমনকি ঘুঁটে দেওয়া তালবুড়ি এসে কত আদর করে গেল। অনেক রাতে আবার মিউ মিউ করে কান্নার শব্দ পেলাম আমি আর দাদা। “এই তো কিছুক্ষণ আগে খাইয়েছে মা”। আমার কি মনে হচ্ছে বলতো দাদা? ওরা আমাদের বিছানায় শুতে চাইছে। দাদা চোখ বড় বড় করে বললো “মা কিন্তু বিছানায় তুলতে বারণ করেছিল ভাই?” কিন্তু ওরা যে কাঁদছে। কী করবো? ওদের যে মন কেমন করছে। নিজেরাও ঘুমোবে না। আমাদেরও ঘুমোতে দেবে না।
চুপি চুপি আমরা ওদের দুজনকে নিয়ে এসে আমাদের বিছানার চাদরের তলায় এনে রাখলাম। কেমন কুতকুতে ছোট ছোট চোখ দিয়ে ওরা আমাদের দেখলো। আর একটুও ডাকলো না। দাদা বললো “এই যে হলুদ সাদাটে বেড়ালটা এর নাম হলো মিনি”। আমি বললাম আর এই কালো সাদা সিঁথে কাটা বেড়ালটা ভ্যাঁও। দুজনের খুব পছন্দ হলো নামটা। অনেকবার করে ওদের মিনি আর ভ্যাঁও বলে ডাকলাম। ওরাও সেই ডাক শুনতে শুনতে ঘুমিয়ে পড়লো।
এই মিনি আর ভ্যাঁও এর সূত্র ধরে তারপরে আমাদের বাড়িতে কত বেড়াল হয়েছিল তোমরা কী জানো? প্রায় একুশখানা। তাদের একুশ জনের আলাদা নাম ছিল। একুশজনের আলাদা থালা। সে যে কি বিশাল কান্ডমান্ড বেঁধেছিল তা না হয় আর একদিন বলবো।
তোমাদের কারও বাড়িতে কি এমন মিনি আর ভ্যাঁও আছে? তাহলে তাদের ছবি তুলে আমাকে পাঠাতে ভুলো না কেমন? পারলে তার সাথে তাদের গল্পও লিখো।
প্রকাশিত হয়েছে শিশুকাগজ ডট কমে জুলাই সংখ্যায়।
আরে, কী দারুণ বেড়ালমংগলের গল্প! আমার যে বেড়াল দেখলেই গা শিরশির করে, আমি পজ্জন্ত এই মিনি আর ভ্যাও কে দেখে একেবারে মুগ্ধ! তাপ্পর কী হল?
উত্তরমুছুন