ব্রেকিং নিউজের সন্ধানে

শাদা পর্দার ভেতর থেকে ছুটে আসছে একটা বিশাল ট্রেন। ছুটে আসছে সামনে বসা বেশ কিছু মানুষের দিকে। ভয় পেয়ে হুড়মুড় করে উঠে পড়েছিল মানুষগুলো। কারণ তারা আগে এইভাবে একটা ঘরের মধ্যে বসে এমন ট্রেনকে দেখেনি। দিনটা ছিল ১৮৯৫ সালের ২৮ ডিসেম্বর। স্থান প্যারিসের গ্র্যাণ্ড কাফে। লুমিয়ের ভাইয়েরা ইতিহাস সৃষ্টি করছিলেন। চলচ্চিত্র নামক শিল্পের জন্ম হচ্ছিল সেদিন। মানব জীবনে যান্ত্রিক উপায়ে চলমান ছবিতে গল্প বলার সূত্রপাত বোধহয় সেটাই। ঠিক তার এক বছর পরে ভারতে এই ছবিগুলো দেখানো হয়। স্টেশনে ট্রেন এসে দাঁড়াচ্ছে। বাগানে মালী জল দিচ্ছে। রাস্তা দিয়ে হেঁটে যাচ্ছে মানুষজন। কারখানা ছুটির পর শ্রমিকরা বেরিয়ে আসছেন। বাস্তবে হবহু যেমনটা দেখি তেমনটাই। চলচ্চিত্র পরিভাষায় যাকে বলা হল ‘বাস্তবের প্রতিরূপায়ণ’। কেন বাস্তবের ‘প্রতিরূপায়ণ’? কেন আসল বাস্তবটাই নয়? তাত্ত্বিকরা বললেন চোখে দেখা রুঢ় বাস্তব আর ক্যামেরায় বন্দী করা বাস্তবের মধ্যে আকাশ পাতাল তফাত আছে যে। কেমন তফাত সেটা? যেমন ধরুন কোন একটা স্টেশনে একটা ট্রেন ঢুকছে। সেটা আপনি যদি খালি চোখে দেখেন এক ব্যাপার। যেখানে খুশি দাঁড়িয়েই তা দেখতে পারেন। কিন্তু ক্যামেরায় দেখতে হলে আপনাকে একটা নির্দিষ্ট দৃষ্টি কোন (এ্যাঙ্গেল) বেছে নিতে হবে। যেখান থেকে ছবিটা সবচেয়ে ভালো উঠবে। শুধু তাই নয় তারমধ্যে আপনি কোন কোন জিনিস রাখবেন, কোন জিনিস রাখবেন না, কতটা রাখবেন সেটাও ঠিক করে নিচ্ছেন। কাজেই ছবি তোলার সময় আপনি নিজের দেখার ওপরেই অনেকটা কাট-ছাঁট করে সম্পাদনা করছেন। খালি চোখে যেমনটা দেখছিলেন তেমনটা আর থাকছে না। ছবির জন্মের সূত্রপাতে লুমিয়ের ভাইদের ‘রিয়েলিটি অব রিপ্রেজেন্টেশান’ থেকে শুরু করে মেলিয়ে, পোর্টার, গ্রিফিথ হয়ে ছবিতে গল্প বলার ঘটনাটা খুব আকস্মিক নয়। সেটা দীর্ঘদিনের এক পারম্পর্য। আর সেই পথে হাঁটতে গিয়ে এই শিল্পের নানা শাখা উপশাখা বিস্তৃত হয়েছে। সময়ের সাথে সাথে হয়েছে পরিণত। আমাদের দেখার ‘ভাষাও’ পাল্টেছে। দৃশ্য মাধ্যমের যে ভাষায় আমরা আগে সিনেমা হলে গিয়ে ছবি দেখতাম সেই ভাষায় এখন আর বাড়িতে বসে মোবাইলে বিভিন্ন ভিডিও ক্লিপিং দেখি না। পাল্টেছে অনেক কিছু সেটা চোখ কান খোলা রাখলেই বোঝা যায়।

কাজেই ছায়ায় মায়ায় যে বিচিত্র রহস্য একটা সময় পর্দা উৎপাদন করতো তা এখন আমাদের বাড়িতে বসার ঘরে টিভি, ল্যাপটপ, ডেস্কটপ, ট্যাব, এমনকি হাতের স্মার্ট ফোন উৎপাদন করছে। আমি কখনও দর্শক হিসেবে তা গ্রহীতার ভূমিকায়। আবার কখনও নিজেই উৎপাদক। কেমন সেটা? ইচ্ছে করলেই আমি এখন আমার জীবনের স্মরনীয় মুহূর্ত, আমার সামনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়, আমার হাসির উৎস, আমার নিজের বিজ্ঞাপন সবই নির্মাণ করতে পারছি নিজের হাতের কাছের চলমান দূরভাষ যন্ত্রটি থেকে। তারপর সেটিকে আমি সোস্যাল মিডিয়াতে পোষ্ট করতে পারছি। সেটা একদিকে যেমন আমাকে অনেকের মধ্যে একক হতে সাহায্য করছে তেমনি আমি উদ্রেক এবং উৎপাদন করছি এমন সব দৃশ্য মুহূর্ত যা একে অন্যের সাথে প্রতিযপোগিতা করছে। কোনটা সবচেয়ে বাস্তব আর কোনটা আরও বাস্তব সেই দিকে যেন ধাবিত করছে আমাদের। তার সাথে পাল্লায় বাড়ছে ভিউয়ের সংখ্যা। লাইকের কম্পিটিশান। কোনটা তথ্য, কোনটা সংবাদ, কোনটা অতি মাত্রায় নির্মিত সবটাই যেন গুলিয়ে যাচ্ছে। এই চেনা বৃত্তটা আরও বড় অংশে গিয়ে রিপ্রেজেন্ট করছে এখনকার মূল ধারার অডিও ভিজুয়াল মিডিয়াকে।

চলচ্চিত্রের জন্ম লগ্ন থেকে তথ্যচিত্র আর কাহিনীচিত্র দুটো ধারাই পাশাপাশি বয়েছিল গঙ্গা পদ্মার মতোই। তথ্যচিত্র আর কাহিনীচিত্রের প্রভেদ নির্ধারণ করতে গিয়ে মূল যে কয়েকটি পয়েন্ট বলা হয় তারমধ্যে বেশ গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে : তথ্যচিত্র সর্বদাই এক গল্পের দিকে হাঁটে। আর কাহিনীচিত্র হাঁটে তথ্যচিত্রের দিকে। ব্যাপারটা হলো ডকুমেন্টারি ফিল্মে গল্প না বললে লোকে দেখবে না। আর কাহিনীচিত্রে বাস্তবের মতো সবকিছু না হলে লোকে হল ছেড়ে বেরিয়ে যাবে। মিডিয়া স্টাডিজের ছাত্রদের কাছে এটা খুবই পুরনো প্রসঙ্গ। তাহলে দেখা যাচ্ছে সব কিছুতেই আমাদের সিংহভাগ জুড়ে থাকছে গল্প। সেই গল্প যেমন তথ্যচিত্রে, কাহিনীচিত্রে, সিরিয়ালে, সিরিজে, এমনকি নন ফিকশানের প্রতিযোগিতামূলক ইভেন্টগুলোতেও দেখা যাচ্ছে। আসলে সবটাকেই নির্মাণ করা হচ্ছে। এই ধ্রুব সত্যটাকে বিশ্বাস করে নিলে হোঁচট খেতে হবে কম। বানানো হচ্ছে এক বিশেষ শ্রেনীর দর্শকদের জন্য যে দর্শক আসলেই এইসব কিছুর ক্রেতা। তাহলে কি খবরও নির্মাণ হচ্ছে না? তাদের গল্প গুলো? আচ্ছা ধরা যাক জনপ্রিয় যেকোন দুটি নিউজ চ্যানেল। তাদের প্রাইম স্লট। সেখানে কি খবর পরিবেশন হচ্ছে? কেমন ভাবে? উপস্থাপিকারা কি বলছেন? এমনকি সেই সংবাদের মাঝে কি ধরনের বিজ্ঞাপন পরিবেশিত হচ্ছে? একটু লক্ষ্য করলেই আপনার কাছে দুটো সংবাদের আলাদা ধরণ চোখে পড়বে। আপনি বলতেই পারেন সেটাই তো স্বাভাবিক। রাজনৈতিক দৃষ্টি ভঙ্গীতে দুজনে আলাদা। যদিও তারা ক্লেইম করে দুজনেই নিরপেক্ষ। টেলিকাস্ট রেটিং পয়েন্ট যা আমরা টি আর পি নামে জানি তা নিয়েও দুজনের রেষারেষি তুঙ্গে। একে অপরের ঘাড়ে নিশ্বাস ফেলে। দুজনেরই বাজারকে ধরার চেষ্টা প্রবল। আর সেখানেই আসে আরও মারাত্মক ভাবে খবরকে ছাপিয়ে খবর হয়ে ওঠানোর হিড়িক। সেটা দেশের যুদ্ধকালীন সময়েই হোক, কোভিড পরিস্থিতিতেই হোক কিম্বা প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সময়। আমরা যেমন সাত পাঁচ না ভেবে যা কিছু তুলে বা লিখে শেয়ার করতে পারি সামাজিক মাধ্যমে; টেলিভিশন চ্যানেল তা করে অনেক ভেবে চিনতে, লাভ ক্ষতির হিসেব দেখে অত্যন্ত প্রফেশনাল দক্ষতায়। যদিও তা মাঝে মাঝেই ধরা পড়ে গিয়ে কেঁচে যায়। মুখ পুড়লেও মেক আপ করার লোকের অভাব হয় না।

এইসব নিয়ে অনেক গাবদা গাবদা বই আছে। তত্ত্বের কচকচি আছে। একটু খোঁজ খবর করলেই পাওয়া যায়। কিন্তু ভুলে গেলে চলবে না ঘরে ঘরে টিভি আসার আগেও প্রোপাগান্ডা ধর্মী চলচ্চিত্র কিভাবে গোটা বিশ্ব দাপিয়ে বেড়াতো তা হিটলারের প্রিয় চলচ্চিত্র নির্মাতা লেনি রাইফেনস্তাল থেকে শুরু করে সোভিয়েতের অনেকেই দেখিয়েছেন। বর্তমানে মুবি নামের একটি ওটিটি চ্যানেলে সেগুলো দেখা যাচ্ছে আবার নতুন করে। এখনও রাষ্ট্রকে মহান আর মহিমান্বিত করে প্রজেক্ট করার জন্য যে পরিমান অর্থ বরাদ্দ হয় তাতে মনে হয় দেশে বেশ কয়েকটি প্রথম সারির হসপিটাল নির্মাণ করে বিনা পয়সায় অনেককে চিকিৎসা দেওয়া যায়। কিম্বা নাগরিকদের জীবন ধারনের জন্য প্রাথমিক সুযোগ সুবিধে দেওয়া যায় অনেকটাই। সেদিকে অবশ্য দৃষ্টি থাকে না কারও। সেটা উন্নত দেশ হোক কিম্বা উন্নয়নশীল।  

গল্ফ ওয়ারের সময় তখনও অডিও ভিজুয়াল মিডিয়া এখনকার মতো পল্লবিত হয়নি। তাও সেই যুদ্ধ নিয়ে যে গল্প মিডিয়া শুনিয়েছিল তা নিয়ে সমসময়ে এবং পরবর্তীতে অনেকে প্রশ্ন করেছেন। তারও আগেও চন্দ্র অভিযান নিয়ে আমেরিকা কম জলঘোলা করেনি। কারা প্রথম মাটিতে পা রাখলো? তারা না সোভিয়েত ইউনিয়ন? চুলোচুলি কম হয়নি। তা নিয়ে একটা বড় তথ্যচিত্র আছে। এমনকি চাঁদে নামার স্টুডিও সেট, তার সিক্রেট প্রজেক্ট নিয়ে হইচই হয়েছে বিস্তর। কিভাবে সংবাদ খাওয়ানো হবে সেটা বহু আগে থেকে সবলভাবে পরীক্ষা নিরীক্ষা করা হয়েছে। তাই রাতের খাবার টেবিলে একটা বিধ্বংসী ঝড়, কোন একটা দেশের ওপর কোন এক দেশের বোমারু বিমানের হামলা বা রাষ্ট্র ঘটানো দাঙ্গা আমাদের কাছে এখন অনেকটা স্যালাড খাওয়ার মতো। একটা বিরাট আখ্যানের অংশীদার হয়ে জীবন নির্বাহের পাশাপাশি আমি যেন দেখছি প্যালেস্তাইনের রাস্তায় নেমে পড়েছে সেনা। শয়ে শয়ে মৃতদেহ। কিম্বা উত্তাল সমুদ্রে ছোট্ট একটা বোটে বাবা মার সাথে প্রানের ভয়ে পালিয়ে আসতে গিয়ে বালুকাবেলায় মুখ থুবড়ে পড়ে আছে ছোট্ট একটি নিষ্প্রান দেহ। রাতের আঁধারে বিশ্ববিদ্যালয়ের মধ্যে ঢুকিয়ে দেওয়া হচ্ছে পুলিশ, আধাসেনা। নির্মম অত্যাচার করা হচ্ছে ছাত্রদের ওপর। রাস্তায় ফেস্টুন টানিয়ে আমাদের দেশের কোন এক রাজ্যের সরকার মানুষকে দাগিয়ে দিচ্ছে দেশদ্রোহী বলে। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধে হিটলারের নাৎসি বাহিনীর কনসেনট্রেশান ক্যাম্পের মতো তৈরী হচ্ছে আইসোলেশান ক্যাম্প। নজর রাখা হচ্ছে প্রতিটা নাগরিকের ওপর, তাদের আসা-যাওয়া, খাওয়া-পরা সব কিছু। আর সেই সবের ফাঁক ফোঁকর দিয়ে জন্ম নিচ্ছে ‘খবর’। যে ‘খবর’ হাঁটু সমান জলের মধ্যে হামাগুড়ি দিয়ে মিথ্যে সাঁতার কাটার ভান করছে। ঢেউয়ের সামনে পিটিসি দিয়ে আছড়ে পড়ছে অসহায়তার ভড়ং করে। “আমরাই প্রথম দেখাচ্ছির” অছিলায় ‘কি’ দেখাচ্ছে, ‘কেমন’ করে দেখাচ্ছে সেটাই যেন ভুলে যাচ্ছে। চাকরী বাঁচানোর কৌশলটা হয়ে যাচ্ছে দেশকে সেবা করা। সঠিক তথ্যকে সরিয়ে রাষ্ট্রের মহার্ঘের ফাঁদে পা দিয়ে তৈরী হচ্ছে সেই রূপকথা যা আসলে সংবাদকে সরিয়ে দিচ্ছে সাধারণ মানুষ থেকে অনেক দূরে। যা ছিল এক সময়ের সমাজ দর্পণ তাই যেন চূর্ণবিচূর্ন হচ্ছে অবিশ্বাসে। তাহলে এই স্বতোপ্রনোদিত জল্লাদের উল্লাসের দায়ভার আসলে কার? যাঁরা আসলেই চাকরী বাঁচাতে চাইছেন তাঁর? নাকি একটা গোটা সিস্টেমের। যে সিস্টেমের অংশীদার হয়ে যিনি সংবাদকে ক্যামেরায় ধারণ করছেন, সম্পাদনা করছেন, প্রচার করছেন এবং ঘরে বসে দেখছেন তাঁদের সবার? এই প্রশ্নগুলো নিয়ে আমরা খুব একটা নাড়াচাড়া করিনা। ভাবি না। বরং একটা ব্রেকিং নিউজ থেকে চোখ সরিয়ে আর একটা ব্রেকিং নিউজ খুঁজি।

বার্তালিপি পত্রিকায় প্রকাশিত। ২৮ মে, ২০২১ 

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি