এ তুমি কেমন তুমি?

 

একটা সময় ছিল গঙ্গায় ভরা কোটাল আসলে লোকজন ভিড় করতো তা দেখার জন্য। রাসবাড়ির বড় মাঠে জল ঢুকে পড়তো। পাশের লালবাবা আশ্রমে। ওদিকে কাকেশ্বরতলা থেকে শুরু করে গঙ্গার ধারের আসেপাশের সব জায়গায়। এটা আমাদের কাছে নতুন কিছু ছিল না। গঙ্গার পাড়ের মানুষরা এইগুলো নিয়েই বসবাস করতেন। ভরা কোটালের সেই বড় ঢেউয়ের মধ্যে ঝাঁপিয়ে পড়তো পাড়ার দুঃসাহসিক ছেলেরা। এটা তাদের এক ধরনের স্টান্ট ছিল। মজা পেতো। ভরা বর্ষায় ইলিশ আসার আগে গঙ্গা ভরে উঠতো মেঠো লাল রঙের ঘোলা জলে। আমরা বুঝতে পারতাম এবার জলে নামলেই পায়ের পাতায় কুট কুট করে কামড়াবে ছোট ছোট সাদা সাদা কাঁকড়ার বাচ্চা। ছেয়ে যাবে তারা গঙ্গায়। ছেলেরা সেই কাঁকড়া গামছায় তুলে পুকুরে ছাড়বে এই আশায় একদিন সেই কাঁকড়া গুলো বড় হবে। যদিও বছরের পর বছর সেই কাঁকড়ার আর হদিস পাওয়া যাবে না। ইলিশ আসলে নদীর বুকে দুলে উঠবে ছোট ছোট নৌকা গুলো। টিমটিম করবে হ্যারিকেন। ইলশে গুড়ি বৃষ্টির মধ্যে কারেন্ট অফের রাতে গঙ্গার পাড়ে দাঁড়ালেই দেখা যাবে সেই দৃশ্য। কাজেই অনেক পরে পদ্মানদীর মাঝি আমাদের অনেককে আর বিস্ময় জোগাতে পারবে না। ইলিশ ধরা নৌকা গুলো পাড়ে আনার সাথে সাথেই বিক্রি হয়ে যাবে সব মাছ। নৌকার খোলে ভুল করে জল ঢোড়া সাপ উঠে পড়লে বুড়ো তাকে বাচ্চাদের মতো আদর করতে করতে পৌঁছে দিয়ে আসবে পুকুরে। কয়েকদিন পরে দেখা যাবে সে তার বাচ্চা কাচ্চা নিয়ে শালুক গাছের পাতার ওপরে খেলে বেড়াচ্ছে। পুকুরে তাল পড়লে আর নামতে ভয় লাগছে না। কারণ ও তো বুড়োর সাপ। দশহারা মানে গঙ্গা পুজোর দিন মা তো উত্তাল। এপাড় ওপাড় দেখা যায় না প্রায়। দশ ফল দিয়ে একদিকে যেমন নদী পুজো হচ্ছে ওদিকে পল্টুর দল গায়ে সর্ষের তেল মেখে গঙ্গা এপার ওপার করছে। শ্রীকৃষ্ণতে যশ সিনেমা এলে এই প্রথম পাড়ার লোক গঙ্গাতে নামতে ভয় পাচ্ছে। কয়েকদিনের মধ্যে সেই ভয় কাটিয়ে দিচ্ছে ঠুলি। কতক্ষণ ডুবে থাকার কম্পিটিশানে সে হারিয়ে দিচ্ছে সবাইকে। জীবন বয়ে চলেছে নদীর পাড়ের মানুষদের এমনই। কিন্তু তারপর বাধ সেধেছে অনেক কিছু। আগে যে গোটা পাড়াটা গঙ্গায় নেমে ঝাঁপাতো সেই পাড়ায় গঙ্গার স্নান বন্ধ হলো। সমস্ত হাইড্রেনের জল গিয়ে পড়তে শুরু করলো গঙ্গায়। কাঁকড়ার ডিম পাড়তে আসা বন্ধ হয়ে গেল মিঠে জলে। তাদের বাচ্চারাও গেল হারিয়ে। ইলিশকে খুঁজতে হলো দূরবীন দিয়ে। ছোট ছোট নৌকা আর টিমটিমে হ্যারিকেন গুলো হারিয়ে গেল আমাদের উন্নয়নের জোয়ারে। যে ছেলে মেয়ে গুলো গঙ্গা ঝাঁপাতো তাদের বাচ্চা কাচ্চারা জল দেখে ভয় পেলো। সাপ দেখে ভয় পেলো। টিকটিকে দেখে বেগন স্প্রে করলো। মাকড়সা হলো তাদের কাছে ভয়ঙ্কর 'এ্যানিম্যাল'। পশ্চিমী দেশের কাছে প্রকৃতি ছিল যেন শত্রু। আমরা তাদের আদর্শ মাথা পেতে নিলাম। টিকটিকি, মাকড়সা থেকে শুরু করে গুবড়ে পোকা হয়ে ঝড় সব হয়ে গেল আমাদের কাছে প্রাকৃতিক শত্রু। গায়ের ওপরে ব্যাঙ উঠলে আমরা চিৎকার করলাম মাইক নিয়ে ক্যামেরার সামনে "দেখুন আমার গায়ে ব্যাঙ বসেছে। কি ভয়ঙ্কর বিপদের মধ্যে আছি আমরা"। টিভির সামনে যারা ছিলাম, বেগন স্প্রে নিয়ে যারা টিকটিকি মারলাম তারা ভাবলাম সত্যি কি বিপদ। মনে পড়ে গেল আমাদের মামার বাড়িতে সুখু দুখুর কথা। দুটো কোলা ব্যাঙ কিছুতেই ঘর ছাড়া হচ্ছে না। তা আমার এক মামা তাদের নাম দিল সুখু দুখু। কেন দিয়েছিল কে জানে? রাতের বেলা এতো বিচ্ছিরি করে ডাকতো দিদা বললে "দিয়ে আয় না বাপু ওদের মাঠে ঘাটে"। মামার মন খারাপ। তা যদি আবার চিনতে পারে তারজন্য সে দুটোকে সিঁদুর পরালো। পার করে দিয়ে আসলো সেই ধান ক্ষেতের মাঠ। ওমা পরের দিন রাতে আবার ডাক। টর্চ নিয়ে দেখা গেল সুখু দুখু ফিরে এসেছে সিঁড়ির তলায়। কপাল থেকে পিঠ বরাবর বড় সিঁদুরের দাগ। টর্চের আলোয় আনন্দে হোক বিরক্তিতে হোক ঘ্যাঙর ঘ্যাঙ বলে ডেকে উঠলো। অনেক দিন পরে বাজার করতে যাওয়ার সময় আমার বছর দশের ভাইঝি চিৎকার করে দাঁড়িয়ে পড়লো। আমি ভয় পেয়ে গেলাম। কী হয়েছে তোর? সে চিৎকার করে বললো "কাকা...ফ্রগ...জ্যান্ত ফ্রগ..."। আমরা গুটি গুটি পায়ে এগিয়ে গেলাম। রাস্তার ওপর দিয়ে একটা ছোট্ট সোনা ব্যাঙ তিড়িং বিড়িং করে লাফিয়ে পার হচ্ছে। এর আগে ভাইঝি কোনদিন জ্যান্ত ব্যাঙ দেখেনি। আমরা অনেকক্ষণ ধরে তার গতিবিধি দেখলাম। সুখু দুখুর কথা মনে পড়লো। বুড়োর সেই পোষা জলঢোড়াটার কথাও। প্রকৃতি আমাদের শত্রু ছিল না কোনদিন। আমরাই কি তাকে হিন্দি সিনেমার ভিলেন আর হলিউডি সিনেমার হরর বানিয়ে দিলাম? কিজানি ?

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি