ঘুরে দাঁড়ানো


 ১৯৯৬ সালে আমাদের বাড়িতে প্রথম টেলিফোন আসে। ঠিক সেই সময় সরকার খুব কম খরচে নিন্মমধ্যবিত্তদের ফোন দেওয়া শুরু করেছিল। আমার বাবা প্রাথমিক স্কুলের শিক্ষক ছিলেন। সেই বছরই তাঁর অবসর নেওয়ার সময়। তাঁর পক্ষে সেই দায়ভার বহন করা সম্ভব ছিল না। আমার দাদা ততদিন সাবলম্বি হয়েছে। সে নিজের খরচে বাড়িতে নিয়ে এলো ফোন। তার সাথে ইয়া মোটা দুটো গাবদা ডিরেক্টারি। আমি সেগুলো খুব সুন্দর করে সাজিয়ে রেখেছিলাম ফোনের পাশে। অন্যান্য বন্ধুদের দেখাদেখি। সেই ফোনে বাবা বহুদিন পরে তার প্রবাসী বন্ধুদের সাথে কথা বলেছিল। অনেক আত্মীয় যারা প্রায়ই অসুস্থ বাবার খোঁজ নিত। অনেক দিনের পুরনো ছাত্র ছাত্রীরা যাঁরা তাঁর আত্মার কাছাকাছি ছিল তারাও সংযোগ স্থাপন করতে পারলো। কাজেই মারা যাওয়ার দু বছর আগে বাবা ঠিক যাদের দেখতে চাইতেন কিম্বা দেখতে পেতেন না তাদের সবার সাথে অন্তত সংযোগ স্থাপন করতে পেরেছিলেন। দাদার সেটা ছিল চাকরী পাওয়ার পর একটা বড় এ্যাচিভমেন্ট। তারপর অনেক দিন কেটে গেছে। আমরা বহু জায়গায় ঠাঁই নাড়া হয়েছি। তার সাথে ভাসতে ভাসতে আমাদের টেলিফোনটিও এসেছে নাম্বার পাল্টাতে পাল্টাতে। সে এখনও আছে। কারণ বাবার স্মৃতি বিজড়িত হয়ে। এবং আমার মা অত্যাধুনিক ফোনটি ব্যবহার করতে পারে না তারজন্যেও। বি এস এন এল আমাদের নিরলস ভালো সার্ভিস দিয়ে এসেছে দীর্ঘদিন। যতদিন না জিও তার জাদুর ঝুলি খুলে বসেছে। যতদিন না অর্ধেক সরকারী টাওয়ার ভাড়া দেওয়া হয়েছে কর্পোরেটকে। এখন লাইনটির এমন অবস্থা কেঁদে ককিয়ে চালাতে হচ্ছে। ছেড়ে দিতে পারলে বাঁচি। কিন্তু ওই। স্বদেশি জিনিস। স্মৃতি। পিছুটান। (এই পাড়াতে এই বাড়িতেই একমাত্র নাকি ল্যান্ড ফোন আর কেউ রাখেনি। সত্যি মিথ্যা জানি না। যিনি সারাতে এসেছিলেন বললেন) তা এতো কিছুর অবতারণা কেন? একটাই কারণ। সব কিছু বেচে দিয়ে ভাড়ে ভবানী হয়ে যাওয়া এক চিলতে প্রকোষ্টে কৃষিও হাতছাড়া হয়ে কর্পোরেটে যাচ্ছে। আমাদের সামনে নাকের বদলে নরুন ধরা হচ্ছে। আমাদের সামনে বড় বড় পুকুর অনেক দিন আগেই চুরী হয়ে গেছে এখন জামা প্যান্ট খোলা বাঁকি। সেটুকু হলে দিগম্বর হয়ে যাবো। সেও না হয় হলাম। বাঙালিদের আর বেঁচেছেই বা কি? আন্দোলনের পরিসর যত তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে ততই দেখছি এই রাজ্যে এক পক্ষ আর এক পক্ষকে তীব্র গালাগালি করছে। কোন দাদা ভালো তার হলোগ্রাম সমেত রাস্তায় পোষ্টার পড়ছে। কে ঘরে ফিরলেন দীর্ঘদিন পরে তার জয়ধ্বনি উঠছে। আর সবাই বলছেন "বিশ্বাস করো আমি রাজা হতে আসিনি"। সবাই নাকি দেশ সেবা করছেন। আর প্রজারা? তারাও দোলাচলতায়। তবুও তাদের মধ্যে কেউ কেউ নিজেদের উদ্যোগে নানা কিছু করছেন। স্বশরীরে কৃষকদের পাশে উপস্থিত না থেকেও বাড়িতে কেউ অনশন করছেন। সোশ্যাল মিডিয়াতে থাকছেন পাশে। অনেকে লিখছেন। প্রতিবাদ জানাচ্ছেন। এছাড়া হয়তো এই মুহূর্তে আর কিছু করার নেই। ভারতের তাবড় রাজনৈতিক দলগুলির প্রতি অনেক দিন আগেই মানুষ বীতশ্রদ্ধ হয়ে পড়েছে। এবার চাইছে অন্তত এতোদিনের পঞ্জীভূত রাগ তারা তাদের অন্য কারোর গলায় শুনছে যাদের এতোদিন রাস্তায় দেখা যায়নি। সবাই বলছেন এটা একটা স্বাধীনতার যুদ্ধ। সেই যুদ্ধে সবাই কাল থাকছেন। বনধের যারা ভালো চান তাঁরাও থাকছেন। বনধের যারা বিপক্ষে তাঁরাও থাকছেন। কারণ অনেক দিন পর আগামীকাল ভারত একটা বনধ দেখতে চলেছে। কৃষকের স্বার্থে। নিজেদের জন্য। আর সেই বনধের দাবী গুলোর মধ্যে কেউ কেউ যেন তাঁদের সব হারানোটাকে প্রতিফলিত হতে দেখছেন। ঠিক যাদের দেখা যায় না সংবাদে, টিভিতে, কাগজে তারা। দেওয়ালে পিঠ ঠেকে গেলে কোন না কোন সময়ে ঘুরে দাঁড়াতেই হয়। আর সেই সময়টাই হয়ে ওঠে কোন এক মানুষের...কোন এক সমষ্টির...কোন এক দেশের ঐতিহাসিক সময়। আমরা সেই সময়টার দিকে তাকিয়ে। সবার পাশে। কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে। এই ভার্চুয়ালেও। সময়টা ঠিক না ভুল সেটা সময় বিচার করবে। কিন্তু আপাতত ঘরে আগুন লেগেছে। সেটা না নিভিয়ে কী করে বড়াকাকা আর সেজ পিসির ঝগড়া সামলাই বলুন তো? পক্ষ বাছতেই হবে। আগুন নেভানোর? না ঝগড়া সামলানোর।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি