কর্পোরেট

 

নব্বইয়ের দশকের কোন এক বিজ্ঞাপনে হঠাৎই আমরা জানতে পারি আসলে আমাদের বগলের ঘামে এতো দুর্গন্ধ তার জন্য পাশে বসা প্রেম হুশ করে হাওয়া। একদঙ্গল বন্ধুদের মধ্যে একা হয়ে যাওয়া। ঠিকঠাক স্মার্ট গাইজেপরিণত না হওয়া। এক বহুজাগতিক সংস্থার ডিও ব্যবহার করলে এগুলো থেকে মুশকিল আসান। সেই ডিও একটু পুশ করলেই ফুস ফুস করে ধোঁওয়ার মতো স্প্রে। আমরা সমবেত ভাবে বগল তুললাম। এবং ঘামের গন্ধ শুকে বিশ্বাস করলাম হক কথা। এই গন্ধের জন্যেই যত সব ঝামেলা। আমরা সেই ডিও সমবেত ভাবে কিনলাম। ততদিনে প্রসারভারতী এ্যাক্ট নবকলেবরে এসে গেছে। ডিডি ন্যাশানাল, ডিডি মেট্রো, ডিডি সেভেন ছেড়ে আমরা ঝাঁপিয়ে পড়েছি কর্পোরেট টেলিভিশনের অন্যান্য চ্যানেলে। রীতিমতো জাঁক করে কোক ভারতেই শুধু আসেনি। কলকাতায় রীতিমতো তাদের র‍্যালি বার করে বামফ্রন্ট শাসিত পশ্চিমবঙ্গকে একটু ফ্রিও খাইয়েছে। এক বন্ধু চেখে বলেছে রক্তের মতো নাকি নোনতা স্বাদ। আর এক বন্ধু বলেছে বোতল গুলোর মোলায়েম দেহাবশেষে প্রেমে পড়ে যেতে হয়। তারমধ্যে আমরা গলফ ওয়ার দেখেছি। তখন সপ্তাহে একদিন ওয়ার্ল্ড দিজ উইক। যুদ্ধ দেখতে দেখতে আমরা রাতের খাবার খেয়েছি। তারও অনেক পরে সেই যুদ্ধের ফুটেজ যারা পাঠাতো সেইসব খোঁজ খবর নিয়ে পেল্লাই সাইজের সব বই বেরিয়েছে। কিভাবে সংবাদকে নির্মাণ করা হয়। সত্যি যেমন চাঁদে মানুষ না গিয়েও হলিউডের স্টুডিও বুক করে তার নির্মাণ করা হয় তেমন। আমরা কর্পোরেট খবর দেখতে শুরু করেছি। তা আমরা যারা বগলে পাওডার মাখতাম। কিউটি সেন্ট লাগাতাম জামায়। কিছু কিছু সেন্ট স্প্রে করলে গোলাপ জলের গন্ধ বা জুঁইয়ের সুবাস এনে দিত তারা সেগুলো সব বাদ দিয়ে ফুস ফুস করে বগলে হাওয়া দিলাম। কলকাতা শহরে পড়তে গিয়ে বিস্ময়ের পাল তুলে প্রচন্ড ধাক্কা খেয়ে জানলাম আসলে প্রেমেরও নির্দিষ্ট দিন আছে। সেখানে আর্চিজ এর গ্যালারিতে নামী দামী কার্ড কিনে মান রক্ষে করতে হয়। প্রেম কর্পোরেট না হলে জাতে ওঠা যায় না। তারপর তো জানলাম আরও অনেক কিছু। আসলে আমরা যে জলটা খাচ্ছি সেটা বিষ। বোতলের জল সুরক্ষিত। আমরা কর্পোরেটের জল খেলাম। জানতে চাইলাম না সেটা সত্যি বিষ কিনা। শপিং মল দিব্যি চলে এলো। আমরা কর্পোরেটের জামা পড়লাম। বাজারে গিয়ে খুব ভিড়। আমরা কর্পোরেটের মুদির দোকানে টুকটুক করে লিখে জিনিসপত্র কিনলাম। বাজার আনালাম। মাছ আনালাম। সবজীও। হলুদ ট্যাক্সি গুলো বড় আহাম্মক। বদমাশ। আমরা কর্পোরেট ট্যাক্সি চাপলাম। পাশের ফ্ল্যাটের লোককে সন্দেহ। বুড়ো দারোয়ানকে বিশ্বাস করা যায় না। আমরা কর্পোরেট সিসিটিভি বসালাম। সেই কর্পোরেট ছবি আমার কর্পোরেট মোবাইলে নিয়মিত লাইভ থাকলো। আমি বরকে দেখলাম। আমি বউকে নজরে রাখলাম। বাচ্চা। কাজের লোক। সব্বাই। আমি কর্পোরেট মেগা সিরিয়াল দেখলাম। আমি কর্পোরেট সিরিজ দেখলাম। আমি কর্পোরেট ফিল্ম, থিয়েটার, মিউজিক ফেস্টিভাল দেখলাম। রাত নটা বাজলেই আমাকে গুগুল তার সেলফ টাইমারে জানালো এবার তোমার বাড়ি ফেরা উচিত। আমি বাড়ি ফিরলাম। আমি গোটাটা ভাসিয়ে দিলাম সমস্ত নামি দামি ব্র্যান্ডে। তার যা শেখালো আমি শিখলাম। তারা যা বোঝালো আমি বুঝলাম। তারা যা খাওয়ালো আমি খেলাম। এরপর তারা যা চাষ করতে বললো সেই চাষ করলাম। তারা যখন যুদ্ধ করতে বললো আমরা যুদ্ধ করতে গেলাম। তারা যখন কাঁদতে বললো আমরা কাঁদলাম। হাসতে বললে হাসলাম। তারা যখন বললো মরো। আমরা মরলাম। চেনা লাগছে কী? তাহলে এখানে থামি। বনধ সফল হোক।

মন্তব্যসমূহ

  1. কল্লোল, তোমার লেখাতে এমন একটা মায়া আছে যে মনে হয় তোমার জীবন অনেক মানুষ এসেছেন যারা তোমাকে এই অন্তর্দৃষ্টি দিয়েছেন [ আমি অভিভূত ।

    উত্তরমুছুন

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

জনপ্রিয় লেখা গুলি