এক্সট্রা
সামনের কুলগাছটায় ফুল এসেছে। সারাদিন ভোঁ ভোঁ আওয়াজ করে ঘুরে বেড়াচ্ছে মৌমাছি গুলো। বিজু জানে ওরা শ্রমিক মৌমাছি। মধু সংগ্রহ করা ওদের কাজ। সারাদিন ওরা ঘুরে ঘুরে মধু সংগ্রহ করে সবার জন্য। তাই না সবাই মধু খেতে পায়। বিজুর বাবাও সারাদিন ঘুরে ঘুরে সবজী বেচে। প্রচন্ড পরিশ্রম করে। অনেক ভোরে গিয়ে সোনারপুরের কোন ভেতরের গ্রাম থেকে সবজী তুলে নিয়ে আসে। তারপর ভ্যানে করে বিক্রি। বাবা এতো পরিশ্রম করে বলে বিজু খেতে পায়। সেটা সে জানে। বাবা আগে যে এইকাজটা করতো তেমনটা নয়। একটা ছোট্ট অফিসে যেত। বাবার একটা চেয়ার ছিল। সবার টেবিলে চা, জল, খাবার দিতো। ফাইফরমাশ খাটতো। এগুলো বিজু দেখেছে। হালখাতার সময় বাবা নিয়ে যেতো অফিসে। বড় একটা মিষ্টির প্যাকেট। নতুন ক্যালেন্ডার। শীতের সময় একটা করে পিকনিক হতো। সেখানে তার বাবা মাকেও নিয়ে যেত। বিজু তো থাকতোই। সকালে কলা, ডিম, পাউরুটি। দুপুর বেলায় মটন, ভাত। বাড়ি ফেরার সময় হাতে একটা করে জয় নগরের মোয়া আর কমলালেবু। মনে আছে সব বিজুর। তখন তো সামেনের কুলগাছটায় টোপা টোপা কুল। কারেন্ট নুন মাখিয়ে দিব্যি খাওয়া। একটু পাকলে গুড় দিয়ে মা চাটনি করতো। কাঁচের বয়ামে তুলে রেখে দিতো সারা বছরের জন্য। এবারেরটাও আছে। রান্নাঘরের তাকে। আধখালি অবস্থায়। কিন্তু বিজু খায় না। ওই দিকে বড় একটা যায় না সে। বাবার কাজটাও আর নেই। অনেকটা মজা যেন খালি হয়ে গেছে চারপাশ থেকে।
উত্তরে হাওয়া দিতে শুরু করে দিয়েছে। মা দুগগা জলে গিয়েছেন অনেক দিন হল। সামনে কালী পুজো। কিন্তু এবার কোন বাজি কেনা নেই। প্রদীপ জ্বালানো নেই। পুজোয় নতুন জামাও পরেনি বিজু। কেউ বলেওনি। কিনেও দেয়নি। মামা বাড়িতে বাবা নিয়ে যাবে বলেছিল তাও যেতে পারেনি বিজুকে নিয়ে। কি করে যাবে? বাবা যে এবার পুজোয় চপ বেগুনির দোকান দিয়েছিল। সকালে সবজী বিক্রি করে দুপুরে চপের পুর বানাতো। বিকেলে মন্ডপের সামনের রাস্তায় উনুন ধরিয়ে বসে যেত সব কিছু সাজিয়ে। বিজুও বাবার সাথে বসতো। বই রাখার এ্যালুমনিয়ামের বাক্সটাতে তারা টাকা পয়সা রাখতো। বাবা বলেছিল এটা হল ক্যাশ বাক্স। এবারই তো সে ক্লাস টুয়ে উঠলে কলকাতা থেকে এনে দিয়েছিল বাবা। মা বলেছিল মন দিয়ে পড়লে সামনের বছরে একটা লাল টুকটুকে স্পাইডার ম্যানের ব্যাগ কিনে দেবে। সকালে উঠে বাবা আর মা সেই যে চলে যেত কাজে, ফিরে আসতো সন্ধ্যে পার করে। মা ট্রেনে ট্রেনে বিক্রি করতো লাল ফিতে, মোজা, চিরুনি, সূচ আরও কতকি। একবার সে মায়ের সাথে গিয়েও ছিল। মহিলা কামড়ায় ওঠার সাথে সাথে সবাই মাকে ডেকে কত কথা বললো। জিনিস কিনলো। বিজুর গাল টিপে দিয়ে আদর করলো। কেউ বিস্কুট খাওয়ালো। পয়সা দিল। কিন্তু ওই এক বারই। তারপর আর কোন দিন মা নিয়ে যায়নি তাকে। কতবার বিজু বায়না করেছে। তার ট্রেন চাপতে ভালো লাগে যে। সুর করে মায়ের গলা কতবার যে সে নকল করেছে। চুরুনী নেবে গো চিরুনী...। লাল ফিতে নেবে গো লাল ফিতে...। সূচ নেবে গো সূচ...। একবার মা দেখে ফেলেছিল। খুব বকেছে। পড়া শুনো করে মানুষের মতো মানুষ হও। তারপর ট্রেনে চাপবে। নিজের পয়সায়।
বাবা মা কাজে চলে গেলে বাড়িটা কেমন যেন ঝুপ করে ফাঁকা হয়ে যায়। স্কুল থেকে ফিরে এলে বেলা মনে হয় কত বড়। এই একা একা থাকতে থাকতে এত্তোটা বড় হয়েছে সে। নিজে নিজে চান করতে শিখেছে। খেতে শিখেছে। জামা কাপড় পড়তে শিখেছে। এমনকি গলায় মাছের কাঁটা আটকালে সেই কাঁটা ভাত গিলে নামিয়েও দিতে শিখেছে। মা বলেছে বিজু আমার স্বাবলম্বি হয়েছে। আর চিন্তা নেই। সেই বিজু পুজোর সময় চপের দোকানেও কাজ করেছে অনেক। বালতি করে জল এনে দেওয়া। ঠোঙা তৈরী করা। ক্যাশ বাক্স সামলানো। বাড়ি ফিরে এসে সেই টাকা বাবার সাথে বসে গোনা। অনেক রাতে রুটি আর ডাল সেদ্ধ খেয়ে ঘুমিয়ে পড়া। কিন্তু ঘুম কোথায় তার বাবার? আকাশ পাতাল ভাবনা। বাড়ি ওয়ালা তিন মাসের টাকা পায়। মুদির দোকানে ধার। সবজী কেনা মহাজনের কাছে ধার। বাবা এপাশ ওপাশ করে। বিজু সব বুঝতে পারে। সে তো সাবলম্বি। বড় হয়ে গেছে না। কিন্তু কিছু বলে না। চুপ করে চেয়ে থাকে কুল গাছের ফাঁক দিয়ে দেখতে পাওয়া আকাশটার দিকে। আগে ওখানে কালপুরুষটাকে দেখা যেত। মা চিনিয়েছিল কোমরের বেল্টটা। হাতের তির ধনুক। মাথার মাঝখানের গোল চোখটা। এখন আর কিছু দেখা যায় না। স্কুল যখন খোলা থাকতো তখন কত তাড়াতড়ি ঘুমিয়ে পড়তো বিজু। কিন্তু এখন ন মাস স্কুল বন্ধ। বাবার সাথে এদিক ওদিক ঘুরে এতো কাজ করেও বিজুর রাতে ঘুম পায় না। কী করে পাবে? পিঠে হাত বুলিয়ে দেয় না তো কেউ মায়ের মতো। সুরসুড়ি দেয় না। গল্প বলে না। তারাদের গল্প। তবুও অনেক রাতে ঘুমিয়ে পড়লে বিজু স্বপ্ন দেখে। স্কুল খুলে গেছে। তার মা আর বাবা আবার সকালে উঠে কাজে যাচ্ছে। স্কুলের রোয়াকে থালা নিয়ে তারা সবাই মিলে বসে খাচ্ছে সয়াবিনের ডাল দিয়ে ভাত। একটা করে আস্ত ডিম পেয়ে সবার মুখে হাসির ফোয়ারা। এমন টুকরো টুকরো ভাসা ভাসা স্বপ্ন দেখতে দেখতে সকাল হয়ে যায়। ঘুম ভেঙে যায় বিজুর। বাবা কার সাথে যেন কথা বলছে। বিজু বাইরে এসে দেখে কেউ একজন নিয়ে যাচ্ছে তাদের সবজী বেচার ভ্যান। বাবা চুপ করে দাঁড়িয়ে আছে। বিজুর একটুও বুঝতে অসুবিধে হয় না। টাকা দিতে পারেনি বলে মহাজন নিয়ে যাচ্ছে ভ্যান। বাবা কিছু বলে না। বিছানায় এসে শুয়ে পড়ে। চাও খায় না। বিস্কুটও না। বিজুকেও কিছু খেতে বলে না। কারণ বিজু জানে বাড়িতে আসলে কিছুই নেই আজ। তাড়াতাড়ি বিজু চান করে নেয়। থলি নিয়ে স্কুলের পথে হাঁটা দেয়। আজ মাসের সেই তারিখ যেদিন সারা মাসের চাল স্কুল থেকে দেবে। আলু দেবে। সয়াবিন দেবে। সেই চাল বাড়িতে আনলে বিজু ভাত চড়াবে। বাবাকে ঘুম থেকে তুলে খেতে দেবে। তারপর বলবে চলো না বাবা মায়ের মতো ট্রেনে ট্রেনে ফেরি করি জিনিস। বিজু জানে বাবা বলবে ট্রেন বন্ধ। বিজু জানে বাবা এই কাজ গুলো একটুও পারে না। বিজু জানে তার বাবার মন খারাপ। ভারী কষ্ট।
বিজু স্কুলে এসে জানতে পারলো হেডস্যার আসতে পারেনি। তার নাকি জ্বর। কাল কোন এক স্যার চাল বিলির ব্যবস্থা করবে। কিন্তু আজ তারা খাবে কী? রান্না হবে কি দিয়ে? এইসব সাত পাঁচ ভাবতে ভাবতে বিজু যখন বাড়ি ফিরলো বাবাকে দেখে সে অবাক হয়ে গেল। বাবা দাড়ি কামিয়ে, চান করে, আলমারী থেকে জামা কাপড় বের করে, পরে, রেডি হয়ে বসে আছে। বিজুকে দেখতেই বাবা বললো তাড়াতাড়ি চান করে নে বিজু। একটু পরেই আমরা বেরিয়ে যাবো। গনেশ কাকু গাড়ি নিয়ে আসবে। বিজু তো অবাক। কোথায় যাবো আমরা বাবা? বাবা বলে সেও জানে না। কোন একটা জায়গা। শ্যুটিং দেখবো। বিজুর চোখ বড় বড় হয়ে যায়। ফিল্মের শ্যুটিং বাবা? বাবা ঘাড় নাড়ে, হ্যাঁরে ফিল্মের শ্যুটিং। বলেছে নাকি শ্যুটিং দেখাবে। খেতে দেবে। চল চল দেরী করিস না।
শ্যুটিং জিনিসটা কি এর আগে বিজু জানতো না। তাদের বাড়িতে টিভি নেই। পাশের বাড়িতে মাঝে মাঝে সিনেমা দেখতে যেত সে। দেব, জিৎ সবার সিনেমা সে সেখানেই দেখেছে। এতো আলো। এতো লোক। চিৎকার চেঁচামেচি। এতো গাড়ি এর আগে দেখেনি বিজু। গণেশ কাকুকেও সে প্রথম দেখলো। লোকটা একটা টাটা সুমো ভর্তি করে লোক নিয়ে গেছে। কোন রকমে বাবার জায়গা হয়েছিল গাড়ির মধ্যে। নিতে চাইছিল না বিজুকে প্রথমে গণেশ। জায়গা কোথায় বলো তো বীরেশ? বাবাকে বিরক্ত হয়ে বলেছিল। তোমাদের একজনের খাবার ব্যবস্থা হলে চোদ্দটাকে জোটাও। বাবার মুখটা দেখে বিজুর একটুও যেতে ইচ্ছে করছিল না। লজ্জায় অপমানে যেন বাবা হারিয়ে যাচ্ছিল অতো গুলো লোকের মধ্যে। অস্ফুটে বলেছিল ও না গেলে আমার যাওয়া হবে না গণেশ। কোথায় রেখে যাবো ওকে? কোন রকমে বসেছিল বিজু বাবার কোলে ওই অতোগুলো লোকের মধ্যে। অনেকটা পথ গিয়ে একটা মাঠের ধারে গাড়িটা দাঁড়িয়ে পড়েছিল। মাঠে তৈরী হয়েছিল মিছি মিছি বাড়ি ঘর। মিছি মিছি উঠোন। বাবা বলেছিল এটাকে কি বলে জানিস তো? বিজু জানে না কি বলে। বাবা বলেছিল সেট। এর মধ্যে সবাইকে অভিনয় করতে হবে ঘুরে ঘুরে। বিজু অবাক হয়ে তাকিয়ে দেখছিল সব কিছু। আমরা কী করবো বাবা? এখানে? বাবা জানে না। তারা কী করবে। শুধু জানে ওরা বলেছে খেতে দেবে। একটু পরে একটা মেয়ে ছোট্ট একটা মাইকে চিৎকার করে ডাকতে শুরু করলো। গণেশ বাবু সব এক্সট্রাদের লাইন করে দাঁড় করান কস্টিউম দেওয়া হবে। গণেশ এসে লাইন করে দাঁড় করিয়ে দিল বিজুদের। আরও আসা অনেক লোকজনদের। সবাইকে দেখে দেখে নানা রকমের জামা কাপড় দিলো তারা। মাঠের মধ্যেই সেই জামা কাপড় পড়ে নিল বিজুরা। জামাটা একটু বড় হল বিজুর। কি বলে যেন ডাকছিল দিদিটা? বাবা বলে এক্সট্রা। এক্সট্রা শব্দের মানে কি বাবা? বাবা মাঠের দিকের লাইনটা দেখে বলেছিল উদ্বৃত্ত। বাড়তি। বিজু কি বুঝেছিল কে জানে। সন্ধ্যে হওয়া আকাশটার দিকে তাকিয়ে কালপুরুষ খুঁজছিল সে। ভুলেই গিয়েছিল সকাল থেকে খাওয়া হয়নি তার।
একটু পরে যে মেয়েটা মাইকে চিৎকার করছিল সে বলে গেল এই যে মাঠের মধ্যে বাড়ি ঘর গুলো দেখছেন সেখানে আপনারা থাকেন। মানে মিছিমিছি। ওগুলো সব আমরা জ্বালিয়ে দেবো। এটা কিন্তু সত্যি সত্যি। সেই আগুনের মধ্যে দিয়ে আপনাদের ছোটাছুটি করতে হবে। সাবধানে করবেন। আবার বিপদ ঘটাবেন না। এই যে গণেশদা বলেছিলাম না বেশি করে বাচ্চাও লাগবে। এই কটা দিয়ে কী হবে? বাচ্চাদের একবার লাইন করে দাঁড় করান দেখি। গণেশ বাচ্চা গুলোকে লাইন করে দাঁড়ালে তাদের মধ্যে থেকে বিজুকে পছন্দ করে মেয়েটা।
এ্যাই কি নাম তোর?
বিজু।
এ্যাক্টিং করতে পারিস? মানে অভিনয়?
বিজু মাথা নাড়ে। না ।
ঠিক আছে অসুবিধে নেই। দাঁড়িয়ে থাকবি। আর ফুঁপিয়ে ফুঁপিয়ে কাঁদবি। তাহলেই হবে। পারবি তো?
বিজু কোন উত্তর দেয় না।
সেই দিদিটা তার পকেট থেকে একটা কালো ফোনের মতো কি যন্ত্র বার করে বলেছিল স্নেহাশিষদা একটা বাচ্চা ছেলেকে পেয়েছি। চোখ গুলো বড্ড সুন্দর। নিয়ে নিলাম। ওভার। বিজুর দিকে তাকিয়ে বলেছিল-
খেয়েছিস?
বিজু মাথা নেড়ে বলেছিল না।
সেকি? এখনও খাবার দেয়নি?
দিদিটা চিৎকার করে ডেকেছিল একটা লোককে। কি ব্যাপার রমেশদা? এখনও খাবার পায়নি এক্সট্রারা?
লোকটা মাথা চুলকে বলেছিল খাবারের গাড়ির টায়ার পাঞ্চার হয়ে মাঝরাস্তায়। আনতে পাঠিয়েছি আরেকটা গাড়ি দিয়ে। দিদি চিৎকার করে বলেছিল ওসব কিচ্ছু জানি না। বাচ্চা গুলোকে খাবার দাও। শ্যুটিং শুরু করবো।
সন্ধ্যে গড়িয়ে গিয়েছিল। চা আর বিস্কুট ছাড়া কোন খাবার পায়নি বিজুরা। এদিকে শ্যুটিং শুরু হয়ে গেল। চারি দিকে কত কত আলো। একটা টিভির সামনে একটা পান খাওয়া সুন্দর দেখতে লোক শুধু এ্যাকশান আর কাট বলছিল। সবাই বললো ওই নাকি ডিরেক্টার। এ্যাকশান মানে দৌড়োতে হবে। কাট বললে থেমে যেতে হবে। দিদিটা বুঝিয়ে দিয়ে গেল। মাইকে শোনা গেল এ্যাকশান। ছুটতে শুরু করলো সবাই। বাবার সাথে বিজুও। কিন্তু চারিদিকে কি আগুন। জ্বলছে সব। দাউ দাউ করে। ডিরেক্টার যেই কাট বললো সবাই দাঁড়িয়ে পড়লো। এইভাবে চললো অনেক ক্ষণ। যতক্ষণ না আগুন নেভে। ওরা ছুটলো। ওরা জল দিয়ে নিভিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করলো আগুন। ওরা চিৎকার করলো বাঁচাও বাঁচাও। কত কি যে হল। তারপর এক সময় ডাক এলো বিজুর। দিদিটা নিয়ে গিয়ে দাঁড় করালো সেই সুন্দর মতো দেখতে পান খাওয়া ডিরেক্টারের সামনে। ডিরেক্টার একবার তাকে দেখলো। পারবে তো? দিদিটা বিজুর হয়ে বলে দিল হ্যাঁ পারবে স্যার। ডিরেক্টার বললো তাহলে শুরু করি? বিজুকে নিয়ে যাওয়া হল পোড়া বাড়িঘর গুলোর মাঝে। সেখানে তখনও ধিকি ধিকি আগুন জ্বলছে। একজন মহিলাকে শুইয়ে দেওয়া হল সেই নিভু নিভু আগুনের সামনের জায়গাটায়। বলা হল এই হচ্ছে তার মা। আগুন থেকে বেরোতে পারেনি বলে মরে গেছে। বিজু তার ছেলে। মাকে খুঁজতে এসে দেখছে মরে গেছে মা। দিদিটা বলে গেল কিচ্ছু করতে হবে না তোকে। শুধু ফুপিয়ে ফুপিয়ে কাঁদবি। বাবা একটু দূরে দাঁড়িয়ে চুপ করে। গণেশকাকুকে কি যেন বলছে। গণেশকাকু মাথা নেড়ে বাবাকেও কি যেন বলছে। চোখ সরিয়ে নিল বিজু। হাত পা সব ঠান্ডা হয়ে যাচ্ছে তার। সোয়েটার পরেনি যে। নাকি ভয়ে? ততক্ষণে তার চারপাশে কত কত লাইটের স্ট্যান্ড দাঁড়িয়ে করিয়ে দেওয়া হয়েছে। সেই যে বড় ক্যমেরাটা ছিল দূরে সেটা এখন তার সামনে। সবাই তাকিয়ে আছে বিজুর দিকে। বিজুর সামনে পড়ে আছে সেই মহিলা। এই মুহূর্তে যে বিজুর মা। তাদের সাথে গাড়ি করে এসেছে। সারাক্ষণ ফোনে কথা বলছিলস আসার সময়। এখন কেমন মড়ার মতো পড়ে আছে। সত্যিই কি তাহলে ইনি বিজুর মা। নানা সেটা হয় কী করে? এখানে সবটাই যে মিছিমিছি। তাহলে বিজুর আসল মা কোথায় গেল? যে সুর করে করে ট্রেনে ফেরি করতো জিনিস? চিরুনী নেবে গো চিরুনী...। লাল ফিতে নেবে গো লাল ফিতে...। সূচ নেবে গো সূচ? যে শীতকালে গুড় দিয়ে কুলের আচার করে রাখতো। ঘুমোনোর আগে পিঠে হাত বুলিয়ে সুরসুরি দিত। গল্প করতো তারাদের। সেই মা কোথায়? বিজুর সামনে কাঠের কি একটা স্লেটের ওপর লেখা দেখিয়ে একটা লোক কি সব বলে গেল । আর ঠিক তখনি ডিরেক্টার বলে উঠলো... হ্যাঁ বিজু স্পষ্ট শুনতে পেল এ্যাকশান। বিজু ওই অতো আলোর মধ্যে চোখ তুলে তাকালো। আর সত্যি সে দেখতে পেল তার মাকে। রান্না ঘরের মধ্যে চুপটি করে বসে আছে ভাতের থালা নিয়ে। তাকে ডাকছে। বিজু ছুট্টে গেল। কিন্তু কোথায় মা? কেউ নেই রান্না ঘরে। ফাঁকা রান্না ঘর। কী করে থাকবে তার মা এখানে? তার মাকে সেই যে জ্বর হয়েছে বলে কলকাতায় নিয়ে গিয়েছিল একটা সাদা এ্যাম্বুলেন্স তারপর আর মা ফিরে আসেনি। বাবা বলেছে মা তারা হয়ে গেছে। আর পাড়ার লোক বলেছে মরে গেছে তোর মা জ্বরে। ধাপার মাঠে বেওয়ারিশ লাশ হয়ে জ্বলেছে। বিজু বিশ্বাস করেনি। একটুও না। শুধু এই কয় মাস মায়ের কথা একটুও ভাবেনি। মনে হয়েছে এই তো মা গেছে কাজে। এক্ষুনি ফিরবে। কিম্বা কাল ফিরবে। কিম্বা অনেক দিন পর। কিন্তু মা আর ফেরেনি। সত্যি মারা গেছে বিজুর মা। তার মা আর কোনদিন আসবে না। বিজু চিৎকার করে কাঁদে। মা মা বলে ডাকে। হাউ হাউ করে একটা বাচ্চা ছেলেকে কাঁদতে দেখে ডিরেক্টার মনিটরে তন্ময় হয়ে পড়েন। একটা মায়ের ওপরে আছড়ে পড়ছে তার বাচ্চা। সবাই হাততালি দেওয়ার পর কাট বলেন তিনি। এগিয়ে এসে চুমু খান। উতরে দিলিরে সিনটা। যা টেনশানে ছিলাম।
অনেক রাতে বাড়ি ফেরার পথে গণেশ কাকু ফোন নাম্বার নেয় বিজুর বাবার। কাজ থাকলে জানাবো। হাতে গুঁজে দেয় পাঁচশোটা টাকা। যোগাযোগ রেখো কিন্তু। বিজুর হাতে তখন দুটো বিরিয়ানির প্যাকেট।
শোওয়ার সময় আকাশের দিকে তাকায় বিজু। জানলায় কুল গাছটার ফাঁক দিয়ে এক টুকরো রাতের আকাশ। সেখানে সে আজ স্পষ্ট দেখতে পায় কালপুরুষকে। এই প্রথম বাবা পিঠে হাত বুলিয়ে দেয়। অনেক দিন পর খুব তাড়তাড়ি ঘুমিয়ে পড়ে বিজু।
উৎসব সংখ্যা। গুরুচন্ডালি। ২০২০। প্রকাশিত।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন