হেমন্তের রঙ


 

হেমন্তের একটা আলাদা রঙ আছে। গন্ধ আছে। সেটা শহরে বোঝা যায় না। একটুও না। সত্যিই কি তাই? সকালের কাঁচা সোনা রোদটা ঘুম চোখে ভালো লাগে। অনেক সকালে উঠলে ফেরিঘাটের প্রথম ফেরিটা যখন ছাড়ে গঙ্গার জল সোনা্রাঙা হয়। সেসব কখনও সখনও দেখা যায়। কপাল ভালো থাকলে। একটু আলস্য ঝেড়ে ফেলে বাজারের দিকে গেলে উঁকি মারে এখনও হেমন্তের ফসলেরা। কারো কারো ঝুড়ি থেকে। ডেও থেকে ঢাকনা থেকে। তাদের পাশে বসলে সেই মাঠটাকে দেখা যায়। ঘাটটাকে দেখা যায়। কমতে থাকা পুকুরের জলের গেঁড়ি গুগলি উজিয়ে এসে উত্তরপাড়ার বাজারে গল্প করে। নতুন পাকা ধানের ছড়া। কচি পালং। পেঁয়াজকলির মাথা গুলো কেমন যেন শিরশিরে উত্তরে হাওয়ায় নড়ে ওঠে। কচি সীম ছড়িয়ে থাকে এদিকে ওদিকে। মুড়ির মোওয়া। চিঁড়ের মোওয়া। নতুন খই উঁকি মারে। ট্রেন ছুটছে বোঝা যায় এক শহুরে উপত্যকার বাজারে এসে। মাসিরা অনেক দিন পর কেউ কেউ আসেন। পানের খিলি মুখে পুরে কুশল সংবাদ নেন। অনেকের আসন এখনও খালি। তাদের জায়গায় নতুন মুখ। সকালের নরম রোদ সরতে থাকে। জলের মধ্যে নড়েচড়ে ওঠে বিলের ট্যাংরা। কই। মাগুর। ছোট ছোট পুঁটি নেতিয়ে পড়ে থাকে চাতালে। বেলা বাড়তে থাকে। সাহিত্যে হেমন্তের ঝুড়ি ঝুড়ি উদাহরণ আছে আমাদের। চিত্রকলায়? আমি জানি না। একটুও চর্চা নেই সেক্ষেত্রের। কিন্তু সিনেমায়? হেমন্তের মাঠ...ঘাট...উপত্যকা...নদী প্রান্তর? ছেঁড়া ছেঁড়া কুয়াশায় শত ছিন্ন কম্বল গায়ে ইন্দির ঠাকরুনের চলে যাওয়া দৃশ্য। হেমন্ত ছিল কি? জানি না। কুবের মাঝির গ্রামে কুয়াশা ঢাকা পথ। একটা জেলে পাড়া। নিরন্নের উৎসব। আর কেন কিছু মনে পড়ছে না। সত্যিই জানিনা। হয়তো অনেকে জমিয়ে বসে নতুন ওঠা কড়াইশুটি ছাড়িয়ে মুড়ি মেখে খেতে বসলে উঠে আসবে অনেক অনেক কথা। হেমন্তের সকাল সাঁঝ যা হারিয়ে যায়নি। কিন্তু চলে গেছে আমাদের থেকে অনেক দূরে তারা হয়তো ফিরবে কোথাও। গোধুলির শুহুরে পথের দুদিকে ভিড় জমাবে মোয়ার ব্যাপারিরা। ভাই ফোঁটা দেওয়ার পর দিদিরা সবাই চলে গেলে বাড়ি একদম ফাঁকা হয়ে যেত। হুহু করে উঠতো মন। নতুন সর্ষেতে কাসুন্দি দেওয়ার তাল ঠুকতো মনি। দিদা নতুন গুড়ের পাত্র গুলো খালি করতে থাকতো আসন্ন নবান্নের উৎসবের জন্য। রোদে পিঠ দিয়ে বারন্দায় বসে চলতো উলের কাঁটা বোনা। লাল, নীল বল গুলো নিয়ে খেলতো হরিমতির দুটো দুধ সাদা ছানা। মাঝে মাঝে মিউ মিউ করে কেসি নাগের অঙ্কের বইয়ের ওপর উঠে পড়তো। ঘুমিয়ে পড়তো। আমাদের চারপাশে ঘিরে ধরতো এক মাস উৎসবের শেষে পরীক্ষার ভূত। সেইসব ভূত ঘাড় থেকে নামিয়ে ছুট লাগাতাম সেই একটা বড় বাড়িতে। হেমন্তের শেষ রোদটায় বসে আছে দিদা। পাটি সাপটা, দুধ পিঠের এক একটা পদ সাজিয়ে। বাসি রুটিতে মৌঝোলা গুড় মাখিয়ে নেড়া ক্ষেতের ওপরে ছোটাছুটি করতে গিয়ে হেমন্তের শিশির লাগতো পায়ে। বাংলা মাষ্টার মশাইকে মনে পড়ে যেত। হাতে ধরা তাঁর জসীমউদ্দীন। রাখাল ছেলে হয়ে তখন কাটিয়ে দিতে পারলে বেঁচে যাই আমরা। তবুও কখনও কখনও অনেকে হারিয়ে যাওয়ার পরে। অনেক কিছু হারিয়ে। কোন এক সকালে আলো গুলো টুকরো টুকরো হয়ে ছড়িয়ে পড়ে মন কেমনে। বাজারের মাসি ভালোবেসে একটা কতবেল হাতে দিয়ে বলে খেয়ো কেমন? আমার নাতনি কুড়িয়ে এনেছে হেই ভোরবেলা। তখন সব কিছু স্বপ্ন স্বপ্ন মনে হয় যেন।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি