ফার্নান্দো সোলানাস (১৯৩৬-২০২০)


 

তাঁর সাথে আমার আলাপ ১৯৯৬ সালের কোন এক শীতের সকালে। যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের চলচ্চিত্র বিদ্যাবিভাগের সামনে যে রোদ আসা বারান্দাটা ছিল সেখানে। আমার হাতে একটা ভি এইচ এস ক্যাসেট ধরিয়ে দিয়ে লাতিন আমেরিকার ইন্দ্রনীলদা (আমরা সেই নামেই ডাকতাম) বলেছিল প্রজেকশান এ্যারেঞ্জ করতে। এক্ষুনি দেখানো হবে ছবিটা। তার কয়েকদিন আগে থেকেই অবশ্য আমাদের ওপর ঢেউয়ের মতো আছড়ে পড়ছিল একের পর এক লাতিন আমেরিকার ছবি।কারণ তখন সারা সপ্তাহ জুড়ে পড়ানো হচ্ছিল লাতিন আমেরিকার সিনেমা। জাদুবাস্তবতা কিভাবে সাহিত্য থেকে সিনেমায় এলো। কিম্বা ক্যামেরা কী করে বন্দুকের নল হয়ে উঠলো সেইসব নানান জটিল তত্ত্ব আর তার আনুষাঙ্গিক গল্প। সেই বছরেই তো কলকাতা ঘুরে গেছেন মিগুয়েল লিতিন। নাকি তার আগের বছর? স্মৃতি ঝাপসা। যাইহোক আমার কাঁধের নীল রঙের ব্যাগে ঘুরেছে বেশ কয়েকদিন 'চিলিতে গোপনে'। আলেয়ার ছবি নিয়ে ফিল্ম স্টাডিজের নীচের স্যাঁতসেতে ঘরে কম আলোচনা হয়নি। আর ওই যে ফায়ারিং স্কোয়াডের সামনে দাঁড়িয়ে কর্নেল আরেলিয়ানো বুয়েন্দিয়ার হঠাৎ মনে পড়ে যাওয়া বাবার সাথে তার বরফ আবিষ্কার! আমাদের চারপাশে ঝুরঝুরে মন কেমনের আস্তরণ তৈরী করছিল ইন্দ্রনীলদা। সকাল থেকে রাত পর্যন্ত আমরা ডুবে যাচ্ছিলাম এক হারানো কুহক মায়া বাস্তবতার মধ্যে। একটা বড় ট্রলির ওপর মনিটর সেট করে তাকে এক ঘর থেকে অন্য ঘরে টেনে টেনে নিয়ে যেতাম আমরা। ভি এইচ এস প্লেয়ারটা থাকতো নীচের প্রকোষ্ঠে। না তখনও ভিডিও প্রজেকশান আসেনি আমাদের বিভাগে। তবে গর্বের সাথে যেকোন সিনে ক্লাবের দাদাকে আমরা বলতে পারতাম আমাদের ভিডিও লাইব্রেরীটা ঈর্ষা করার মতো। এমন কালেকশান সারা ভারতে আর কোথায়? যাই হোক প্রজেকশান ঠিক করে যে ছবিটা শুরু হল তার নাম 'সুর' ইংরাজিতে বললে 'সাউথ'। এক দ্বিপান্তরিত বিপ্লবী...বিতাড়িত মানুষ ফিরে আসছেন জেল খেটে বহুদিন পর তাঁর শহরে। মিলিটারি ক্যু মুক্ত হয়েছে সবে সেই প্রান্তর। বিপ্লবী ফিরছেন নানা টানেলের মধ্যে দিয়ে। আর কিভাবে শহর মুক্ত হল এই অরাজকতা থেকে তার গল্প বলে চলেছে তাকে চেনা পরিচিত মানুষজন যাঁরা আজ আর কেউ বেঁচে নেই। মারা গেছেন এই শহর মুক্ত করতে। কিন্তু কিছুতেই নিজের বাড়ির কাছে আর পৌঁছোনো হচ্ছে না তার। দীর্ঘ...বড় দীর্ঘ হয়ে দাঁড়াচ্ছে সে পথ। মনে আছে ছবি শেষ হলে আমরা রোদে গিয়ে দাঁড়িয়েছিলাম। কেমন যেন শীত করছিল আমাদের সবার। তারপর টানা যখন একের পর এক কাজ দেখছিলাম মন কেমনের মধ্যে বসিয়ে রেখেছিলাম ফার্নান্দো সোলানাসকে। কলকাতায় যখন এসেছিলেন তিনি তখন দেখা হয়নি তাঁর ছবি। এখন যে কটা ছবি হাতের কাছে এদিকে ওদিকে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে তাদের প্রিন্ট খুব খারাপ। কিন্তু যখনই তাঁর কাজ দেখেছি। মনে পড়ে গেছে একটা শীতের ঝিম ধরা সকাল।লম্বা বারান্দা। আর কিছুতেই নিজের দেশে...নিজের বাড়িতে... ফিরতে না পারা একটা লোকের কথা। কতকগুলো কফিন যারা শহর ভেসে গেছে বলে ফিরে যাচ্ছে তাদের নিজের বাড়ি(জার্নি)। এই ফেরা আর না ফেরা। চেনা আর না চেনার চিহ্ন গুলো যখন খুব করে আঁকড়ে ধরছে আমাদের ঠিক সেই সময় চলে গেলেন সোলানাস। ভালো থাকুন কমরেড। স্বপ্নে থাকুন। দিন বদলের।

মন্তব্যসমূহ

জনপ্রিয় লেখা গুলি