মহালয়া
পিতামহ ভীষ্মের ইচ্ছা মৃত্যু ছিল। কুরুক্ষেত্রের প্রান্তরে তীরের শয্যায় তিনি অনন্ত কাল অপেক্ষা করেছিলেন যুদ্ধ শেষ হওয়ার। কার যুদ্ধ? নিজের রক্তের সাথে নিজের রক্তের। নিজের ছায়ার সাথে যুদ্ধ দেখতে দেখতে ক্লান্ত ভীষ্ম যখন মরতে চাইলেন তখন অর্জুন তাঁকে শেষ জলটা খাইয়ে ছিলেন। তবুও পিতামহের নিজের বলে কেউ ছিল না। বিয়ে করেননি। পরিবার নেই। যুদ্ধ প্রান্তরে মরে যাওয়া সেই অসুখী মানুষকে তাই যব আর গঙ্গাজলে প্রথমে স্মরণ করা হয় আজ। বলা হয় আপনি আমার তর্পণ গ্রহণ করুন। এরপর আসে আর এক ট্র্যাজিক নায়ক কৃষ্ণের পালা। যুদ্ধ শেষ। মাথায় রয়েছে গান্ধারীর অভিশাপ। যদু বংশ ধ্বংস হচ্ছে চোখের সামনে। বনের মধ্যে পায়ে ব্যাধের তীর বেঁধেছে কিংবদন্তী কূটনীতিজ্ঞের। পচন ধরছে শরীরে। যার কথায় চন্দ্র সূর্য অস্ত যেত। যার মুখের বানীতে লেখা হল ভাগবত গীতা। তিনি মারা যাচ্ছেন নির্জনে। একাকী। অসহ্য মানসিক যন্ত্রনায়। অন্তিম মুহূর্তে কেউ তাকে দিচ্ছে না খাওয়ার জলটুকু। তিনি আজ জল পেলেন অসংখ্য মানুষের কাছ থেকে। এইভাবে এক এক করে যম, ব্রহ্মা সবাই পেলেন। এমনকি যেসব আত্মাদের কেউ নেই তাঁরাও। যব, তিল, মধ্যমাতে কুশের আংটি, গঙ্গার ভোর এতো বাঙালীর মন কেমনের ছবি। এর পরেই তো ছিদাম বৈরাগী তার সুরেলা গলায় গেয়ে উঠবে “যাও গিরিরাজ আনিতে গৌরি উমা আমার কত কেঁদেছে”। ঠিক এখানেই বাংলার দেব-দেবীর সাথে গোটা ভারতের...আসমুদ্র হিমাচলের তফাত। এতো মায়া দিয়ে সব কিছুকে কেই বা জড়িয়ে রেখেছে? এখানেই তো সত্যনারায়ণের সিন্নিতে সত্যপীরের পাঁচালী পড়া হয়। বনবিবির মন্দিরে হত্যে দেন হিন্দু মুসলমান নির্বিশেষে। ক্ষীরের পুতুলে মা ষষ্টী যখন ষষ্ঠীতলায় ছটফট করে ওঠেন তখন চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন। মা লক্ষ্মী তিলের ফুল নিলে নারায়ণ নিদান দেন থেকে যেতে হবে কৃষকের ঘরে বারোমাস। করতে হবে দাসীর মতো কাজ। চাঁদ সদাগরের সাথে লড়াই একমাত্র এই বাংলার বেহুলারাই করতে পারে। যবন হরিদাস থাকেন চৈতন্যের পাশেই। তাই এই বাংলার মাটিতে শুধু মন্দির দিয়ে ঘিরে রাখা যায় না এঁদের। ধর্মের চোখ রাঙানিতেও না। ভেদাভেদেও না। যে বাংলায় লালনের গানে পলিমাটি জারিত হয়। সেই বাংলায় এখন যদি কেউ জাত নিয়ে ধর্ম নিয়ে কথা বলতে আসে তাদের একটু শুনিয়ে দেওয়া যাক না আমাদের পায়ের তলায় যে মাটি আছে সেটা খুব একটা নড়বড়ে নয়। আমাদের দুগগা আমাদের ঘরের মেয়ে। শিব তো কবেকার ভোলাভালা নেশাতুর জামাই। কৃষ্ণ একাধারে মহৎ প্রেমিক এবং ট্রাজিক নায়ক। আর সীতা। তাঁর কথা জানতে হলে চোখ ফেরাতে হবে বাংলা সাহিত্যে। মনের অন্ধকার তখন আপনা আপনি সরে যাবে দূরে। বাংলার নদীর চরে তখন কাশফুল দেখা দেবে। ঈশ্বরী পাটনী পার করে দেবেন জগৎ ঈশ্বরকে তার ছোট্ট নৌকাতে।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন