এ পরবাসে রবে কে
আশির দশকের গোড়ায় যারা আমরা শৈশব কাটিয়েছি বিশেষ করে মফস্বল শহর গুলোতে, তাদের অনেকেরই হয়তো মনে থাকবে পাড়ায় একটি বা দুটি বাড়িতে টিভি থাকার ঘটনা। সেই টিভিকে ঘিরে মানুষের বিস্ময়। উন্মাদনা। শনিবার আর রবিবারে বাঁধ ভাঙা ভিড়। জানলায়, দরজায়, বারান্দায়, রাস্তায় মানুষের ভিড় জমে যাওয়া। ছায়াছবি দেখার এক অদ্ভুত তাড়না। রাঙার হল ঘরে কে আগে জায়গা রেখে আসবে। টিভির কোথায় কে কোনদিকে বসবে। সব ঠিক। তার সাথে সেই সময়ে প্রচলিত ছিল ধরা বাঁধা কারেন্ট অফ। নিয়ম করে। কিম্বা বেনিয়ম। একবার গেলে ঘন্টা তিনেকের আগে আসার নাম নেই। কাজেই হ্যারিকেন, লম্ফ, মোমবাতি হাতের কাছে রাখা জরুরী। আমি যে ছোট্ট এবং প্রাচীন জনপদে বড় হচ্ছিলাম এবং যে সময়ে বেড়ে উঠছিলাম সেটা সেই শুধু সেই অঞ্চলের ভাঙা গড়ার সময় শুধু নয় পশ্চিমবঙ্গ নামক এক রাজ্যেরও অনেক কিছু ভেঙে চুড়ে নতুন কিছু করে গড়ে তোলার সময়। কাজেই টিভিতে যেমন এক দিকে উত্তম সূচিত্রা মোটরবাইকে করে ছুটছে। ঠিক উলটো দিকে গঙ্গার ধারে প্যান্ডেল করে চলচ্চিত্র উৎসব শুরু হয়েছে। একটা ফিল্মের ক্লাব হয়েছে। লাল, নীল হলুদ টিকিটে পর্দায় দেখানো হয়েছে যে ছবি গুলো আগে সেই ছবি এই জনপদের কেউ দেখেনি। এরও অনেক পরে যখন বাড়িতে টিভি এসেছে তখন সবে ঠোঁটের ওপর কালো একটা রেখা উঠতে শুরু করেছে। আমিও দাদার মতো বারবার সেই রেখা দেখার জন্য আয়নার সামনে দাঁড়াচ্ছি। মা বলছে বড় হয়ে যাচ্ছি আমি। সেই বড় হয়ে যাওয়া আমি যখন জানতে পারছি প্রতি শুক্রবার ন্যাশানাল চ্যানেলে জাতীয় পুরষ্কার প্রাপ্ত ছবি দেখানো হচ্ছে। হাতে গুনতে বসছি। শনিবার একটা, রবিবার একটা, শুক্রবার একটা। মোট তিনটে। সপ্তাহে তিন তিনটে ছবি দেখার লালসায় ঘাপটি মেরে পড়ে থাকছি। ঘুমোচ্ছি না। আমাদের দশফুট বাই দশফুটের বাসায় বাবা ঠিক বুঝতে পারছে। ছেলে লুকিয়ে যাতে না দেখে তারজন্য নিজেই ডেকে পাশে বসে দেখছে। আমার দেখা হয়ে যাচ্ছে নীম ‘অন্নপূর্ণা’, ‘গৃহযুদ্ধ’, ‘পার’, ‘ঘটশ্রাদ্ধ’, ‘পার্টি’র মতো ছবি। পরের দিন স্কুলে গিয়ে বন্ধুদের বললে তারা চোখ গোল গোল করে শুনছে। অঙ্কের স্যার কান মলে দিচ্ছেন। বাবাকে আলাদা করে ডেকে বলছেন, “ছেলের সাথে বসে অনেক রাতের ছবি দেখা কি ধরনের কালচার মশাই?”
ঠিক তার উলটো দিকেই একটা ছেলে আর মেয়ে ভালোবাসার জন্য পালিয়ে গিয়ে মরে যাচ্ছে। “কেয়ামত মানে জানিস না?” মাথা নেড়ে না বলায় হেসে ফেলছে বন্ধু। তখন হাতে স্মার্ট ফোন ছিল না। কাজেই সার্চ ইঞ্জিন গুগুল হয়তো গুরাকুর নামে বিক্রি হতো। পাড়াতে হাতে গোনা দুটো বাড়িতে টেলিফোন ছিল। কারো বড়িতে বাথরুমে শাওয়ার বসলে লোকজন ভিড় করে দেখতে যেত। গরমকালে বরফ নেওয়ার জন্য বাটি নিয়ে ছুটতো। কারো বাড়িতে গাড়ি থাকলে বলতো “লোকটা নিশ্চই বাটপার”। আবার সেই গাড়িতেই পাড়ার পিকনিক হতো। ছেলের পা ভাঙলে দৌড়াতো হসপিটাল। ঠিক তারই মধ্যে অমন একটা ফুটফুটে মেয়ে আর একটি অমন মিষ্টি ছেলে শুধু ভালোবাসার জন্য মরে গেলে শ্রীকৃষ্ণ হল ফেরত বলাইয়ের মা কাঁদতো। বড় হতে থাকা দিদিদের খাতায়, আমাদের পেন্সিল বক্সে উঁকি মারতো আমির খান আর জুহি চাওলা। এর কয়েক বছরের মধ্যে ‘ম্যায়নে পেয়ার কিয়া’ যেই শ্রীকৃষ্ণতে এলো পাড়ায় পায়রা পোষার ধুম পড়ে গেল। সেই পায়রা ওড়াতে গিয়ে কত পাড়ায় কত কত যে নাগরিক কমিটির মিটিং বসলো। কত কত বাবা তাদের ছেলে আর মেয়েদের পিঠে পায়রার খাঁচা ভাঙলো তার হিসেব কোন ফিল্মের ইতিহাস বই দেবে না। দিতে পারে না।
এদিকে সময় বয়ে যাচ্ছে। হাফ প্যান্ট থেকে আমরা ফুল প্যান্ট পড়ছি। বাংলায় তখন অনেকদিন সুখেন দাস আর নেই, অঞ্জন চৌধুরীর রাজত্বের পর স্বপন সাহা আস্তে আস্তে প্রবেশ করছেন। রাশিয়া ভাঙছে। বার্লিনের প্রাচীর ভাঙছে। কলকাতায় কোকাকোলা প্রবেশ করছে। মৃণাল সেন ছবি করছেন টুকটাক। তপন সিনহা কাজ করছেন। অনেক দিন পর ঘোষণা করছেন সত্যজিৎ রায় ছবি করবেন। টিভিটা ন্যাশানাল চ্যানেল আর কলকাতা দূরদর্শনে আটকে নেই। তার সাথে এসে গেছে ডিডি মেট্রো। হঠাৎই দূরদর্শন ‘মাষ্টার মশাইয়ে’র ভূমিকা ছেড়ে চলে যাচ্ছে সোজা বিনোদনের টুপিতে মাথা গলাতে। বাবরি মসজিদ ভাঙা হচ্ছে। প্রথম কার্ফু দেখছি আমরা। রাস্তায় মিলিটারি গাড়ি। মার্চ পাস্ট। তার আগে দেখে নিয়েছি দেশের দুই প্রধান মন্ত্রীকে হত্যা। ভিসির আর চালিয়ে দেখে নিয়েছি ‘রাম তেরি গঙ্গা ময়লী’, ‘রাম লখন’, ‘ধক ধক করনে লাগা’, বড় বউ, মেজো বউ, চূড়ান্ত সব সিরিজ। সিনেমা একশো বছরে পড়বো পড়বো করছে। আর কিছুদিন পরে আরও মুক্ত অর্থনীতি আমাদের বুঝিয়ে দিচ্ছে শুধু আর একটি চ্যানেল নয়। আরও অসংখ্য চ্যানেলে আমরা হারিয়ে যাচ্ছি। বোকা হনুমানটা এসে আর আমাদের এ্যান্টেনা খারাপ করে দিতে পারছে না। তখন ঘরে বসে আমরা গলফ ওয়ার দেখছি। তারও অনেকদিন পর দেখবো গুজরাত দাঙ্গা। দৃশ্য-শব্দ-কল্প-দ্রুম হয়ে বসে থাকবো আমরা। যেমনটা আজ আছি।
কেন এই এতো শব্দ খরচ করলাম এবার বলি। আপনাদেরও অনেক সময় নষ্ট হল। সিনেমার পোষ্টার দিয়ে কয়েকজন আমাকে রিকোয়েস্ট পাঠিয়েছিলেন। যে খেলা চলছে তাতে অংশ গ্রহণ করায়। তাতে দেখলাম কাকে ছেড়ে যে কাকে রাখবো চোখের সামনে ‘ঘুটঘুটি আন্ধার রাতে দেখছি’। তার চেয়ে ভাই নিজেকে নিজেই প্রশ্ন করা ভালো। “রাত কত হলো?” দেখলাম উত্তর আসছে শতাধিক দিক থেকে।
চুল পাক ধরেছে। কবীরের ভাষায় “কাকার টাক পড়েছে”। শ্রীয়ের ভাষায় “তুমি বুড়ো হয়ে যাচ্ছো।” বন্ধুরা মাঝে মাঝেই বলছে “অসহ্য হয়ে উঠছিস”। আর আমার সামনে দিনের পর দিন বেড়ে চলেছে এক একটি ওটিটি প্ল্যাটফর্ম। কোনটা ছেড়ে কোনটা দেখি মনে রাখতে পারি না। গুচ্ছ গুচ্ছ সিনেমা হাত বাড়ায়। অর্ধেক দেখে। না দেখে। ঝুলে থেকে ঝিমোতে থাকি। তারই মধ্যে শুধু শ্রীকৃষ্ণ হলটা কেমন যেন ঝুল মেখে ভ্যানিস হয়ে থাকে বাস স্টপেজের নামে। গৌরীতে চামচিকি উড়ে বেড়ায়। মাঝে মাঝে তার সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় মনে হয় স্পিলবার্গের ইটি হয়তো ওখানেই ওত পেতে বসে আছে আবার সাইকেলে ওড়ার বাসনায়। এই বুঝি কবেকার মর্চে ধরা প্রজেক্টার গুলো আবার চলতে শুরু করে। ঠুলি গঙ্গার ঘাটে পয়সা কুড়িয়ে হাঙরের ছবি দেখবে বলে টিকিট কাটে ব্যালকনির।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন